#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী পর্বঃ বারো

0
302

#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী পর্বঃ বারো
#মম_সাহা

ধূসর রাঙা বিকেল পরিবেশে। গগনে থেমে থেমে মেঘ গর্জন করে উঠছে। কিঞ্চিৎ বিদ্যুৎও চমকাচ্ছে। ধুলোবালি উড়ছে বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে।

দর্শিনী শুয়ে আছে তার বিছানায়। দিন পেরুচ্ছে স্রোতের বেগে। আজ সাতাশটা দিন হতে চললো সে পিছুটান ফেলে চলে এসেছে তার বাবার ভিটায়। আজকাল তাকে শূণ্যতা তত বেশি পুড়াতে পারে না। কিন্তু বিষাদ রোজ নিয়ম করে বক্ষস্থলে নীল ব্যাথা লেপ্টে দিয়ে যায়। বিষন্নতা রোজ হিসেব করে সকাল বিকেল কড়া নাড়ে তার হৃদয় কোণে। সে পাত্তা দেয় না। নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চায় নানান অজুহাতে। কিন্তু মন কী সেসব বুঝে! সে তো ভালোবেসে ছিল। বড্ড ভুল কিছু কী করেছিলো? মানুষ কেনো চলে যায়? কেউ একজন থেকে যেতে পারে না? কেউ একজন থেকে যাক। কেউ থাকুক,যে ব্যাথা বুঝবে,আবেগ বুঝবে। বিপ্রতীপকে সে ভালোবেসে ছিলো। কিন্তু দিনশেষে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সে মানুষ। কী ভীষণ যন্ত্রণায় তাকে ডুবিয়ে দিয়ে মানুষটা সুখের বাসর পেতেছে। মানুষ গুলো কেমন বদলে যায় তাই না? মানুষ গুলো কেনো চিরদিন এক থাকে না? কেনো ভীষণ ভালোবাসা বদলে যায় অবহেলার কার্তুজে! মানুষ গুলো কেনো কথা দিয়ে কথা রাখে না? মানুষ গুলো কেনো দিনশেষে থেকে যায় না?

ভাবনার মাঝেই দর্শিনীর ফোনটা বেজে উঠে তুমুল শব্দে। তার ধ্যানে ব্যাঘাত ঘটে। ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই জ্বলজ্বল করে উঠে একটা অপরিচিত নাম্বার। বোঝা-ই যাচ্ছে,ফোনের সংরক্ষণ তালিকায় নাম্বার খানা নেই। দর্শিনী তবুও নাম্বার খানা চিনলো। ফোনটা রিসিভ করে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো,
“মায়া?”

ফোনের বিপরীতে থাকা নারীটি অবাক হলো। বিষ্মিত কণ্ঠে বললো,
“চিনলে কীভাবে আমাকে,সই?”

দর্শিনী একটু হাসলো। নিবিড়ভাবে বললো,
“তোমায় চিনবো না? কি বলছো! আমার জীবনের চরম সর্বনাশ বলো আর উপকার বলো,সেটা তো তুমিই করেছিলে তাই না? আর তোমায় চিনবো না আমি!”

মায়া খিলখিল করে হেসে উঠলো। দর্শিনীর কথাটা প্রশ্রয় দিয়ে বললো,
“কোনো একদিন বুঝবে, এটা চরম উপকার ছিলো। চরিত্রহীন পুরুষের সাথে ত্যাগ স্বীকার করে পরে থাকা,ভীষণ ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই না।”

“তাই বুঝি? তা আমি নাহয় না জেনে চরিত্রহীন পুরুষের কাছে গিয়েছিলাম,তুমি জেনেশুনে এলে যে! নিজের এত বড় ক্ষতিটা করে আমার উপকার না করলেই পারতে।”

দর্শিনীর কণ্ঠে বিদ্রুপ স্পষ্ট। মায়া হাসলো,মিষ্টি করে বললো,
“দর্শিনীরা ভীষণ নরম। তারা প্রতিবাদ করতে জানে না। তারা সহ্য করেই কাটিয়ে দিতে চায় জীবন। কিন্তু মায়া তেমন না। বিপ্রতীপদের সোজা করার জন্য মায়ারা আসে। তুমি হয়তো আমায় খারাপ ভাবছো। জেনেশুনে বিপ্রতীপকে বিয়ে করেছি বলে,তুমি আমাকে সই ডেকেও শত্রু ভাবো। কিন্তু এটা সত্যিই আমি প্রাপ্য না। তোমার স্বামীর তোমাকে রেখেও আমার দিকে নজর গিয়েছিলো। যদি আমি প্রত্যাখ্যান করতাম, তবে আরেকদিকে যেতো। তোমার সংসার একদিন ঠিকই ভাঙতো। দু’দিন আগে আর পরে। কিন্তু এই বেইমান গুলো উচিৎ শিক্ষা পেতো না। দর্শিনীদের ভেঙে দিয়েও এরা নির্দ্বিধায় সুখে থাকতো।”

দর্শিনী অবাক হলো। এতটুকু একটা মেয়ে,কিন্তু তার কথায় কি তেজ! কি প্রতিবাদ! সত্যিই তো দর্শিনীরা বোকা,নরম। তারা প্রতিবাদ করতে জানেনা। মায়ার কথা আর যুক্তি তো ফেলনা না। সত্যিই বিপ্রতীপের মন বাহিরে চলে গিয়েছিলো। মায়া না হলেও কেউ না কেউ তার সতীন হতো। মেয়েটার তো দোষ নেই।

দর্শিনীকে চুপ থাকতে দেখে মায়া তপ্ত শ্বাস ফেললো। কী মনে করে যেন বললো,
“জানো,তোমার জন্য আমার আক্ষেপ হয় ভীষণ। মন খারাপের উড়োচিঠি আসে হৃদয় মাঝে। ভালোবেসে কি ভুলটাই না করেছিলে!”

“আমারও নিজের উপর ভীষণ মায়া হয় গো। কী আর করার? ভুল গুলো মোর ফুল হয়ে যাক। তুমি নাহয় আগলো রেখো ঐ পরিবারকে।”

মায়া আবার হাসলো। মেয়েটা কারণে অকারণে হাসে। হাসি থামিয়ে তার রিনরিনে কণ্ঠে ঝংকার তুলে বললো,
“এত ভালোবেসার পরও এই ইট পাথরের বাড়ি তোমায় আপন করলো না। আর আমায় বলছো আগলে রাখতে? এরা কারো আপন হতে পারে না।”

দর্শিনী মায়ার কথার অর্থ খুঁজে পায় না। মেয়েটার মনে, কথার ধরণে কেমন একটা আক্রোশ খুঁজে পায়। এত আক্রোশ নিয়ে ও আদৌও বিপ্রতীপকে ভালোবেসে ছিল তো!

দর্শিনী নিজের মনে দ্বিধা মনে রাখলো, বিষণ্ণ কণ্ঠে বললো,
“ওরা যা করার আমার সাথে করেছে। তোমায় ওরা কিছু করবে না। তুমি ওদের একটু ভালোবাসা দিও।”

“ওদের হয়ে তুমি এত কথা বলছো, সই? অথচ সেদিন তোমার পক্ষ থেকে উকিল সাহেবের ডিভোর্স পেপার দেখে কি খুশি শাশুড়ির! বিপ্রতীপ অবশ্য একটু খারাপ লাগা প্রকাশ করছে কিন্তু পরক্ষণেই সাইন করে দিয়েছে পেপারটাতে। হ্যাঁ, ননদ আর শ্বশুরমশাই ভালো কিন্তু ওরা ভালো না। তোমায় একটু ভালোবাসলে কী বড্ড বেশি ক্ষতি হয়ে যেতো?”

মায়ার প্রশ্নে উত্তর খুঁজে পায় না দর্শিনী। আনমনেই কেটে দেয় ফোনটা। সত্যিই তো,তাকে ভালোবাসলে বড্ড ক্ষতি কী হয়ে যেতো? সে তো একটু ভালোবাসার জন্য ও বাড়ির মাটি আঁকড়ে পড়ে ছিলো। কিন্তু শেষমেশ অবহেলা নিয়ে ফিরে আসতে হলো কেন তাকে!

দর্শিনীর চোখের কার্নিশ ঘেষে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়লো। তার ভাবনার মাঝেই গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে রুমে প্রবেশ করলো তৃণা। দর্শিনী দ্রুত চোখের কোণা মুছে চুপ করে শুয়ে রইলো। ভাব এমন যেন,সে ঘুমিয়ে আছে।

তৃণা কতক্ষণ গুনগুনিয়ে গান গাইলো। চুল গুলো যত্নে বাঁধলো। সব নিরবে পর্যবেক্ষণ করলো দর্শিনী। মেয়েটার মধ্যে অগাধ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় আজকাল। আগে ও চঞ্চল থাকলেও এত সাজগোজ করতো না কিন্তু এখন সাজগোজ করে, গুনগুনিয়ে গান গায়- আরও নানান রকমের পরিবর্তন। জীবনে যখন প্রেমময় বসন্ত আসে তখনই বিশেষ পরিবর্তন ঘটে মানব দেহে। আর তৃণার শরীরের পরিবর্তন সেই দিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

তৃণা চুল আঁচড়ানোর মাঝেই ধৃষ্ট ঘরে ছুটে এলো। হাঁপাতে থাকা শ্বাস প্রশ্বাস নিয়ে মুখের ঘামটা মুছে দর্শিনীকে ধাক্কানো আরম্ভ করলো। ধাক্কানোর সাথে হাঁপিয়ে উঠা কণ্ঠে বললো,
“পিসি,তাড়াতাড়ি উঠো। ওরা দাদুকে মারছে।”

ধৃষ্টের কথায় লাফিয়ে উঠলো দর্শিনী। তৃণাও ততক্ষণে আরশির সামনে থেকে সরে ধৃষ্টের কাছে এলো।

দর্শিনী ধৃষ্টের ঘর্মাক্ত মুখ খানা আঁচল দিয়ে মুছে ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
“কী হয়েছে বাবার? কোথায় বাবা? কে মারছে বাবাকে?”
“পিসি,দাদু মাঠে। তাড়াতাড়ি চলো। দাদুকে কারা যেন মারছে।”

দর্শিনী দ্রুত উঠে দাঁড়ালো। তৃণার দিকে এক পলক তাকাতেই চোখে চোখে কথা হলো তাদের। সাথে সাথেই ছুট লাগালো দু’জন।

_

ঢাকা শহরেও অনবরত দু’দিন যাবত বৃষ্টি হচ্ছে। আজ সকাল থেকে আবার বর্ষন বন্ধ হয়েছে। আকাশ স্বচ্ছ। গত দুদিনের বর্ষনে শহরের কিছু কিছু আবাসিক এলাকা তো প্রায় ডুবে যাচ্ছে যেন। মায়া দর্শিনীর সাথে কথা বলার সময়ই আকাশ ভেঙে ঝরঝর করে আবার বৃষ্টি নামলো।

মায়া ফোনটা খাটে রেখে ছুট লাগালো ছাদের দিকে। সকালে জামা-কাপড় শুকাতে দিয়েছিলো ছাদে। সিঁড়ির দিকে আসতেই তার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেলো। সে আবার ধীর পায়ে নিজের ঘরের দিকে গেলো। ঘরের ভিতর দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে হাঁক পারলো,
“শাশুড়ি, শাশুড়ি। কোথায় আপনি?”

মায়ার ডাকের বিপরীতে কোনো শব্দ এলো না৷ মায়া কণ্ঠ আরেকটু উঁচু করে ডাকলো,
“শাশুড়ি, কোথায় আপনি?”

ডাকের পর মিনিট দুই পেরুতেই মোহনা ছুটে এলো। চুল গুলো তার এলোমেলো, চোখ গুলো ফুলে আছে। বোধহয় এতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলো।

মোহনা হন্তদন্ত হয়ে রুমে প্রবেশ করেই বিরতিহীন কণ্ঠে বললো,
“কী হয়েছে, বউ? কী হয়েছে?”

মায়া নিজের মাঝে হাসি চেপে ন্যাকা স্বরে বললো,
“আসলে আমার আজ সারাদিন শরীরে জ্বর জ্বর ভাব। এদিকে দেখুন বৃষ্টি এসেছে। ছাদে কত গুলো কাপড় দিয়ে ছিলেন না সকালে? সে গুলো বোধহয় ভিজে চুপসে গেছে। আপনি গিয়ে নিয়ে আসবেন একটু?”

মোহনার ঘুমন্ত মস্তিষ্কে কথাটা পৌঁছাতেই হায় হায় করে ছুটলো ছাদে। মায়া মিটমিটিয়ে হাসছে। প্রায় মিনিট তিন পর ঠাস করে আওয়াজ এলো,সাথে মোহনার আর্ত চিৎকার। মায়া জানতো এমন কিছুই হবে। বৃষ্টির সময় ছাদ পিছলে থাকে । আর মোহনা কাপড় বাঁচাতে ছুট লাগালেই পিছলে পড়বে। অবশেষে তার বুদ্ধি সফল হলো।

মায়া আরেকটু সময় অপেক্ষা করে ‘কী হলো’ ‘কী হলো’ বলে ছুটে গেলো। তন্মধ্যেই বিপ্রতীপ অফিস থেকে ফিরেছে। মায়ের চিৎকার শুনে সেও দৌড়ে গেলো ছাদে।

_

মোহনা সোফায় বসে কাতরাচ্ছে। তার ডান পা’টার ভীষণ বাজে অবস্থা। পড়ে হয়তো ভেঙে গিয়েছে। বিপ্রতীপ বরফ ঘষছে, তার বাবা বসে আছে পাশেই। মায়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।

বিপ্রতীপ বরফ ঘষতে ঘষতে বিহঙ্গিনীর উদ্দেশ্য হাঁক ছাড়লো,
“বিহু,বিহু কোথায় তুই? বিহু?”

বিহঙ্গিনীর রুম থেকে কোনো শব্দ এলো না। বিপ্রতীপ বিরক্তিতে নাক মুখ কুঁচকে আবার ডাক দিলো,
“বিহু,কোথায় গেলি?”

তবুও কোনো শব্দ বা প্রতিত্তোর এলো না। বিপ্রতীপের ভ্রু কুঁচকে এলো। মায়ার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত কণ্ঠে বললো,
“বিহু কী বাড়িতে নেই?”

বিপ্রতীপের প্রশ্নে মায়া ঠোঁট উল্টালো। ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে বললো,
“জানিনা। ছোটদি তো আজ বাড়ি থেকে বের হয় নি।”

বিপ্রতীপের কুঁচকানো ভ্রু আরও কুঁচকালো। তড়িঘড়ি করে সে উঠে বিহঙ্গিনীর রুমের সামনে গেলো। দরজা সামান্য ঠেলতেই খুলে গেলো হা করে। ঘর পুরো ফাঁকা,কোথাও কেউ নেই। বিছানার উপর কেবল একটা সাদা কাগজ উড়ছে যা কলমদানি দিয়ে আটকে রাখা।

বিপ্রতীপ ছুটে গেলো। কাগজটা হাতে নিয়ে পড়তেই চক্ষু চড়কগাছ। ছুটে গেলো আবার বসার রুমে। তার শরীর কাঁপছে। ঘাম ছুটছে শরীরের শিরদাঁড়া বেয়ে।

মোহনা ছেলেকে ঘামতে দেখে ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
“বাবু,কী হলো? বিহু কই?”

বিপ্রতীপ মায়ের দিকে চিঠিটা এগিয়ে দিয়ে কাঁপা গলায় বললো,
“মা,বিহু চলে গিয়েছে। পালিয়ে গিয়েছে, বিহু।”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here