#Journey episode 3

0
282

#Journey episode 3

#৩

জাফার ঠিক বুঝতে পারে না জেসমিন কি বুঝাতে চাচ্ছে।সে আবার জিজ্ঞাসা করল,
“আপনি এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চাচ্ছেন মানে বুঝিনি”
জেসমিন একটু কেশে নিয়ে শুরু করে,
“আসলে আমি জানি না আমি কাউকে সেভাবে পছন্দ করি কিনা,মানে…আমি কনফিউজড।যেখানে যাচ্ছি সেখানেই ঐ উত্তর লুকিয়ে আছে”
“মানে ঐ ছেলে কি সিসিলিতে থাকে?”

জেসমিন মাথা নিচু করে মুচকি হাসে।জাফার বলে,
“ও মাই গড!কে সে?আমাকে বলা যাবে?সত্যি খুব শুনতে ইচ্ছা করছে!”
জাফারের অমন উৎসুক ভাব দেখে জেসমিন যেই মুখ খুলতে যাবে,ওম্নি সেলিম কি যেন বলে উঠে।জেসমিন বুঝতে পারে না ওর ভাষা,এই প্রথম ওর সামনে ছেলেটা কোন কথা বলল।জাফারের জ্যাকেটের হাতা টেনে আবার কি যেন বলে,মনে হয় ইতালীয়ান ভাষা,তবে আধো আধো বুলি,তাই হয়ত! জাফার হেসে জেসমিনের দিকে তাকায়,
“সেলিমকে ওয়াশরুমে নিয়ে যাই,ওর কাজ শেষ করে এসে সব শুনব কিন্তু!”

জাফার ছেলেকে নিয়ে উঠে চলে যায় ট্রেনের ওয়াশরুমের দিকে।জেসমিন বাইরে তাকায়।এখন ওরা আছে ফ্লোরেন্সে,এক ঘন্টা পর পৌঁছাবে রোমে।সেখানের স্টেশনে ট্রেন থামবে।বাইরের দিকে তাকিয়ে উদাস হয়ে যায় ও,ছবির মত শহর,গাছপালা,গাড়ি,মানুষ,বসতবাড়ি ফেলে ট্রেনটা এক মনে ছুটে চলছে।ট্রেন যে গতিতে ছুটে চলছে,সে গতিতে মনে এসে ভীড় করছে ঐ মানুষটার কথা যার টানে সিসিলিতে,ইতালীর প্রায় শেষ মাথায় ও ছুটে যাচ্ছে!

ওর নাম রাইফ,রাইফ সোবহান।কলেজে থাকতেই ছেলেটার সাথে পরিচয়,তবে জেসমিন ছিল বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী, আর রাইফ মানবিক।তখন থেকে জানাশোনা হলেও তেমন ঘনিষ্ঠতা হয়নি।ভার্সিটিতে যখন জেসমিন আর রাইফ এক বিভাগে চান্স পেয়ে যায়,তখন তাদের মাঝে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পূর্ণ গড়ে ওঠে।রাইফ খুব এক্টিভ একটা ছেলে ছিল।গান গাওয়া,কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিত,ডিপার্টমেন্টের ক্লাবের সদস্য ছিল একেবারে শুরু থেকে,সব স্যার ম্যাডামরা ওকে চিনত।রাইফের প্রেমে যে কেউ পড়বে,তবে জেসমিন পড়ে নি।প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে অনেক কথাই হত,তবে সেটা সার্কেলের মাঝে থেকেই।একা একা ওরা না কখনও কথা বলত,কিংবা দেখা করত।অনেক আড্ডাবাজী অনেক স্মৃতি তৈরির পর জেসমিন ব্যাপারটা ধরতে পারে যে,রাইফের প্রতি ওর দুর্বলতা কাজ করে।তবে সেটাকে নিছক বন্ধুত্বের খোলসে মুড়ে একপাশে সে সরিয়ে রাখে।

জেসমিনের ভুল ভাঙে যখন থেকে রাইফ বদলে যায়,ওর অনেকটা ছন্নছাড়া হয়ে যায় গ্রুপ থেকে,এমনকি ডিপার্টমেন্ট থেকে।ওর বাবা মারা যাওয়ার মাস দুয়েক পর থেকে হুট করেই রাইফের মাঝে এই পরিবর্তন আসে।তখন ওরা শেষ বর্ষে। ক্যান্টিনে,আড্ডায়,ক্লাবে এবং ক্লাসে রাইফের অনুপস্থিতি মোটামুটি সবাইকে নাড়া দেয়,তবে অবচেতন মনে সবচেয়ে বেশি নাড়া দেয় জেসমিনকে।অজান্তেই পাশের সিটে রাইফকে খুঁজত,কিংবা চায়ের কাপে যখন মহসিন হলের সামনের টঙে ঝড় উঠত,জেসমিন অজান্তেই আশা করত,এখন রাইফ এসে ওদের মাঝে লাফিয়ে পড়বে! কিন্তু এসব কিছুই হত না।ওকে ফোন করলে ও বলত ব্যস্ত আছে,সময় করে আসবে।হলের বন্ধুদের কাছ থেকে পড়া যোগাড় করে চলে যেত ক্লাসে তেমন একটা আসত না। রাইফের এমন পরিবর্তনে একদিন সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয়,ওকে ছাই দিয়ে ধরবে।যেই কথা সেই কাজ।

সেদিন ক্লাস থেকে বেরুবার সময় ওরা সবাই মিলে ওকে আটকে ফেলে,এরপর নিয়ে যায় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে। সেখানে গিয়ে সবুজ বলে,
“কিরে,তুই আজকাল একেবারেই আমাদের ভুলে গেছিস!কেন রে?আমরা কি কোম দোষ করেছি?”
অনম বলে,
“আমরা দোষ করলে বলবি,কে দোষ করল সেটাও বলবি বিচার হবে।কিন্তু এভাবে লাপাত্তা হয়ে আছিস কেন বল তো?”
জাভেদ পাশ থেকে যোগ করে,
“পারিবারিক কোন সমস্যায় আছিস নাকি?আমাদের বলবি তো! না বললে আমরা কিভাবে তোকে বুঝব?”
সবাই ওর সাথে সায় দেয়,জেসমিন শুধু চুপচাপ দেখে রাইফের কাজ।ও হাসছে।সবার কথা শেষ হতেই বলে,
“আরে ভাই কিছুই হয়নি!আমি অন্য একটা কাজে ব্যস্ত আছি!”
জাভেদ জিজ্ঞাসা করে,
“কি কাজ?”
একটা নিঃশ্বাস নিয়ে রাইফ বলে,
“তোরা তো জানিস আব্বা চলে গেছেন।ওদিকে ওশানার বিয়ে হয়ে গেছে,আমার অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে,এখন বাসার অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে।আমার মামা ইটালি থাকে,আমাকেও সেখানে নেয়ার চেষ্টা করছে।কাগজ প্রায় হয়ে গেছে,দু মাস পর ফাইনাল দিয়েই চলে যাব!”

রাইফের ফাটানো বোম্বে মোটামুটি সবাই আহত হয়,কারণ কেউ ভাবতে পারে নি ওর মত ক্যাম্পাস কাঁপান ছেলের সাথে জীবনের এত অল্প সময় পাওয়া যাবে!এই ছেলেটা আর কদিন পর সবাইকে ছেড়ে বিদেশের মাটিতে চলে যাবে।রাইফের ব্যাক্তিগত খবরের বোম্বে সবচেয়ে বেশি আহত হয় জেসমিন।ও জানত না রাইফের গার্লফ্রেন্ড আছে,তাত সাথে ব্রেকাপও হয়েছে!ব্যাপারটা যথেষ্ট শকিং ছিল ওর জন্য। কিন্তু সবার সামনে ও কিছুই বলতে পারেনি,শুধু নোটখাতা বুকে চেপে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল।যখন সবাই ওদের রাগ অভিমান আনন্দের মিশ্রণে এক অদ্ভুত অনুভূতি প্রকাশে ব্যস্ত,জেসমিন তখন একপাশে সরে পড়ে।কলাভবনের সামনের মামার কাছ থেকে একেবারে টক বরই দিয়ে একটা ভর্তা বানিয়ে এনে ওদের থেকে খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে খেতে থাকে।যখন অনেকেই চলে যায়,রাইফ নিজেই ওর কাছে আসে।
“কিরে,এখানে একা একা বসে আছিস?”
“এমনি।তোর কি?তুই তো চলে যাবি ইটালি,আমি কোথায় সেটা খেয়াল করে কি হবে?”
জেসমিনের কন্ঠে অভিমান স্পষ্ট ছিল।সেটা রাইফ পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে।
“আরে ধুর,যেকদিন আছি,সে কদিন ভাল ভাবে কাটাই!ক্যায়া পাতা,কাল হো না হো?”

জেসমিনও সেটাই চিন্তা করল।কি দরকার এসব ভেবে সময় নষ্ট করে? তাই তখন থেকে এরপরের দুমাস সবাই খুব মজা করল।জেসমিন রাইফকে সবসময়ই নিজের কাছের বন্ধু হিসেবে ভেবে এসেছে,শুধু মাত্র সেদিন… ঠিক সেদিন,যেদিন রাইফের শেষ দিন ছিল,সেদিনের বুকের বাঁ পাশে চিনচনে একটা ব্যথা জেসমিনের কানে ফিসফিসিয়ে বারবার বলেছে, “এই ব্যথা বন্ধুত্বের না,এই ব্যথা অন্য কিছুর!” তবুও জেসমিন তাকে ধামাচাপা দিয়েছে,যতবার খারাপ লাগা তৈরি হয়েছে,ওর বিদায়ের ঘন্টা শুনে চোখ ভিজেছে,ঠিক ততবার চোখের পানি মুছে বুঝিয়েছে,কাছের বন্ধুর বিরহে এই অশ্রু,অন্যকিছু নয়।

রাইফ ইটালি চলে আসার পর সেভাবে আর যোগাযোগ হয়নি,কারণ বিদেশে এসে খুব স্বাভাবিকভাবেই রাইফ জীবন গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।বন্ধু বান্ধব সবাই যে যে যার যার মত ব্যস্ত হয়ে পড়ে,এমনকি জেসমিনও।মাস্টার্স, চাকরি, ঘোরাঘুরি, শপিং,আর এখন এই বিদেশের পড়াশোনা। মাঝে মাঝে রাইফের কথা মনে উঁকি দিত,তখন ফেসবুকে ঢুকে ওর প্রোফাইলে উঁকি দিত,রিসেন্ট ছবি,ভিডিও, পোস্ট গুলো দেখত।খুব মিস করত তখন সবাইকে,বিশেষ করে রাইফকে,যেটা নিজেও জানে না।কেন জানে না,রাইফের গালে পড়া টোল আর চাপ দাড়ি দেখে ওর বুকের ভেতর ছটফটানি বেড়ে যায়।ওর মুখ ভর্তি হাসি দিয়ে চাপ দাড়িতে তোলা ছবিগুলো ঘুরে ঘুরে বারবার দেখা হয়।তবে অবাক করা কান্ড এই যে,জেসমিন ওর ইতালিতে পৌঁছিয়েছে কিনা,এই প্রশ্নের পর আর একটা টেক্সটও দেয়নি আজ অব্দি,আর রাইফ তো দেয়ই নি! কি অদ্ভুত দুজনের সম্পর্কটা।এজন্যে আজও জেসমিন বুঝে না,রাইফের প্রতি কি ও আসলেই দুর্বল?

নিজের অজান্তেই ফোনটা বের করে হাতে নেয় জেসমিন,রাইফের ছবিগুলো বের করে।শ্যামলা ছেলেরাও যে এত আকর্ষণীয় হতে পারে,রাইফ তার বড় প্রমাণ।শ্যামলা মাঝারি গড়নের ৫.৮’ উচ্চতার ছেলে ও,মাথায় পাতলা তবে স্ট্রেইট চুল,ঘন ভ্রু,টোল পড়া গাল আর চাঞ্চল্যে ভরপুর একটা ছেলে,এক দেখায় কারো ভাল লাগা দখল করার মত একটা মানুষ।ওর অনেক কথায় আজও জেসমিন ইন্সপায়ার হয়,মোটিভেশন পায়। রাইফের ছবি একমনে দেখতে দেখতে ঘাড়ের কাছে কে যেন কেশে উঠে।জেসমিন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখে জাফার ওর মাথার কাছে দাঁড়িয়ে ঝুকে ওর ফোনের ভেতর দেখছে।জেসমিন তাকাতেই মুখ সরিয়ে হেসে ফেলে।
“আপনি এত মমনোযোগ দিয়ে কি দেখছিলেন,আমি তাই দেখছিলাম!”

জেসমিন হেসে ফেলে,ওকে হাসতে দেখে জাফারও হেসে সামনের সিটে বসতে বসতে বলে,
“তা,এই কি সেই ভাগ্যবান?”
জেসমিন শ্রাগ করে,
“ঠিক জানি না ভাগ্যবান নাকি দুর্ভাগা!সে আসলে আমার বন্ধু”
“বন্ধুত্ব থেকেই প্রেম?”
“না না,আপনি যা ভাবছেন সেরকম কিছুই নেই আমাদের মাঝে, আমরা নিছক বন্ধু।আমাদের মাঝে গত চার বছর ধরে কোন যোগাযোগ নেই”
“তার মানে আপনি যে সেখানে যাচ্ছেন তার সাথে দেখা করতে,সে জানে না?!”
“উহু,বললাম না,কোন যোগাযোগ নেই”
“হুম!”
“বাদ দিন।তা আপনি পেছন থেকে আসলেন কখন?ওয়াশরুমে তো গেলেন সামনে দিয়ে”
“হা হা হা,আমি সামনে দিয়েই এসেছি,কিন্তু আপনি এতটাই ছবিতে মগ্ন ছিলেন যে আমাকে দেখেনই নি!”
“ওহ,সরি!”
এ সময় সেলিম আসে,ওকে টেনে জেসমিন নিজের কোলে বসায়,আর টুকটুক করে গল্প জুড়ে দেয়।সেলিমকে দেখতে দেখতে ভাবে, এসময় তার নিজেরও একটা ছেলে থাকার কথা ছিল,কিন্তু…

চলবে…

লেখনীতে, #AbiarMaria

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here