এটা গল্প হলেও পারতো পর্ব-১৬

0
159

#এটা গল্প হলেও পারতো
#পর্ব ১৬
অরিন্দম কে নিয়ে অর্ক যখন বাড়ি ঢুকলো, তখন দুজনেরই মুখ থমথমে, অদিতি, সমরেশ আর রুমা তিনজনেই অধীর আগ্রহে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েছিলেন, ওদের বাড়িতে ঢুকতে দেখে বেল দেওয়ার আগেই দরজা খুলে দাঁড়ালেন।

একটা চূড়ান্ত মিথ্যেবাদী মেয়ে মেসোমশাই, বাড়িতে না গেলে জানতেই পারতাম না!

দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতেই হতাশ গলায় কথাগুলো বলেই সোফায় ধপ করে বসে পড়লো অরিন্দম, পাশে অর্কও।

হ্যাঁরে, বাড়িতে কে কে আছে? দেখা হলো মেয়েটার সঙ্গে?

রুমার একের পর এক ধেয়ে আসা প্রশ্নে বিরক্ত হলেন সমরেশ,

আহ! সব কিছুতেই তাড়াহুড়ো! দাঁড়াও আগে, শান্তি মতো বসতে দাও একটু!

দিতি ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা জল বার করে নিয়ে এসে দুজনের সামনে গ্লাসে রাখলো, এক চুমুকে গ্লাস খালি করে টেবিলে রেখে শ্বাস ফেললো অরিন্দম,

আহ! অদিতি এটাই এই সময় দরকার ছিলো, মাথা গরম হয়ে আছে একদম!

অর্ক কে কোনো কথা না বলে চুপ করে বসে থাকতে দেখে রুমা অবাক হলেন, অধৈর্য্য হয়ে বললেন,

তোর আবার কি হলো? কথাগুলো বল না একটু! আর কতো ধৈর্য্য ধরে থাকবো!

ও আর কি বলবে মাসীমা, ও তো বমকে গেছে একদম! কোথায় সিসিটিভি লাগানো তিনতলা বাড়ির মালিকের সাথে কথা বলতে গেলাম, আর ফিরলাম দেড় কামরার ভাড়াটের সাথে কথা বলে!

মানে! ও কি তিনতলা বাড়িতে থাকে বলেছিলো?

রুমার কণ্ঠে বিস্ময়, দিতি একটাও কথা বলছিলো না, অর্কর মুখ দেখে মনে মনে খুশি হচ্ছিলো ও, বুঝুক ও এবার!

এতক্ষনে অর্ক মুখ খুললো,

হ্যাঁ, ওর বন্ধুরা অন্তত তাই জানে! ওদের কথামতই সিসিটিভি লাগানো তিনতলা বাড়ি খুঁজতে জগু বাজারে গিয়েছিলাম আমরা, কিন্তু গিয়ে দেখলাম ওরা ওই বাড়ির একতলায় দুটো ঘর নিয়ে ভাড়া থাকে। অবশ্য দুটোও ঠিক বলা যায় না, কারণ যেখানে আমরা বসেছিলাম সেটা ঠিক ঘর নয়, বারান্দাটা কেই ঘিরে নেওয়া বলতে পারো।

বন্ধুদের মধ্যে কেও কি আজ পর্যন্ত ওর বাড়িতে যায় নি?

জানতে চাইলেন সমরেশ, অর্ক ঘাড় নাড়লো,

না, বাবা যদ্দূর মনে হচ্ছে কেউই যায় নি!! যদিও সবার সঙ্গে তো কথা বলিনি আমরা, তবু ওদের গ্রুপের যে কজন ছিলো আজ কলেজে তারা কেউ যায় নি। তারা অবশ্য সবাই ছেলে, মেয়েরা আজ কেউ আসে নি, ওদের মধ্যে কেউ গিয়েছে কিনা সেটা বোঝা যাচ্ছে না!

এতক্ষন চুপ করে থাকার পরে অদিতি মুখ খুললো,

তিয়াসা কে জিজ্ঞেস করো না একবার, ও তো ওই গ্রুপেরই,

আজ অদিতির কথায় আপত্তি জানালো না অর্ক, সঙ্গে সঙ্গেই ফোন তুলে তিয়াসা কে ডায়াল করলো,

সরি তিয়াসা, পরীক্ষার সময় বিরক্ত করছি একটু!

উল্টো দিকে তিয়াসার গলা শোনা গেলো,

না, না, স্যার, বলুন না, বিরক্ত করার কিছু নেই,

রিয়ার বাড়িতে গিয়েছ কখনো?

না, স্যার! আমি যাই নি কখনো, আমার সঙ্গে ওর খুব বেশি বন্ধুত্ব নেই! তবে কৌশিক গেছে স্যার, ও ওর বাড়ি চেনে, একসঙ্গেই মেট্রো থেকে নামে ওরা।

কৌশিকের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে আগে, ও বাড়ি পর্যন্ত যায় নি কখনো,

এবার একটু অবাক হলো তিয়াসা, কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললো,

কৌশিক যায় নি! ও বললো আপনাকে একথা! আমার মনে হয় ও বলছে না সবটা, ও গেছে স্যার, আমরা সবাই জানি!

অর্ক একটু চমকে উঠলো, কৌশিক মিথ্যে কথা বলেছে! কিন্তু ওখানে তো সবাই ছিলো, কেউ তো কিছু বললো না! ওর চুপ করে থাকায় তিয়াসা কিছু ভাবলো, তারপর বললো,

স্যার আপনি এখন বাড়িতে থাকবেন তো? আমি অনির্বাণ কে নিয়ে আসছি তাহলে,

দুদিন পরে পরীক্ষা, এখন এলে তোমার অসুবিধা হবে না তো?

একটু কুণ্ঠিত গলায় বললো অর্ক, তিয়াসা তাড়াতাড়ি উত্তর দিলো,

না স্যার, আমি পড়ছিলাম না, অনির্বাণের বাড়িতেই আছি, ওকে নিয়ে আসছি ঘন্টাখানেকের মধ্যে।

অরিন্দম এর দেরি হয়ে যাচ্ছিলো, কলেজ থেকে সোজা এখানেই এসেছে ও, তাই অর্ক ওকে বেরিয়ে যেতে বললো,

তুই চলে যা, সোমা একা আছে। আমি তোকে আপডেট দিয়ে দেবো রাতে,

অরিন্দম বেরিয়ে যাওয়ার পরে ঘন্টাখানেকও লাগলো না, অনির্বাণ কে নিয়ে তিয়াসা পৌঁছে গেলো, দুজনেরই চোখে মুখে বিস্ময়ের ছায়া।

স্যার, কিছু হয়েছে কি? আজ সকাল থেকেই আপনি রিয়ার বাড়ি খুঁজছেন,

সোফায় বসতে বসতে বললো অনির্বাণ, তিয়াসা চুপ করে আছে দেখে অর্ক বুঝলো ও অনির্বাণ কে কিছু জানায় নি। মনে মনে খুশি হলো অর্ক, যাক মেয়েটার কথার দাম আছে। অর্ক কে ওর দিকে তাকাতে দেখে তিয়াসা নিচু গলায় বললো,

স্যার, আমি কিছু বলিনি ওকে, শুধু বলেছি আপনি রিয়ার বাড়ি খুঁজে পাচ্ছেন না তাই ডেকেছেন আমাদের। তবে আপনি ওর সামনে নিশ্চিন্তে কথা বলতে পারেন, ও জানলেও কাউকে বলবে না স্যার।

অর্ক মাথা নাড়লো, অনির্বাণের দিকে তাকিয়ে বললো,

রিয়ার বাড়ি আমি খুঁজে পেয়েছি অনির্বাণ, কিন্তু আমি জানতে চাই তোমাদের মধ্যে কে কে ওখানে গিয়েছ?

অনির্বাণ মাথা নাড়লো,

কেউ না স্যার! সকালে আপনারা চলে যাওয়ার পরে আমরাও এটা নিয়েই আলোচনা করছিলাম আজ! আমাদের সবার ধারণা ছিলো কৌশিক গিয়েছে কিন্তু ও ও আজ বললো যে ও যায় নি কখনো!

ও বললো, আর তোরা বিশ্বাস করে নিলি? আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর ও গিয়েছে অনেকবার! স্যার, আপনার সামনে একটা কথা বলতে একটু অস্বস্তি হচ্ছে কিন্তু এটা না বললে আপনি সবটা ঠিক বুঝতে পারবেন না, তাই আপনাকে বলতে বাধ্য হচ্ছি। কৌশিকের সঙ্গে রিয়ার একটা রিলেশন আছে স্যার, তাই ও যদি বলে ও কখনো যায় নি, এটা মিথ্যে বলছে ও!

এবার একটু চমকেই গেলো অদিতি, কৌশিকের সঙ্গে রিলেশন আছে! তাহলে অর্কর সম্বন্ধে এইসব কথা বলছিলো কেনো! অদিতির ভাবনার মধ্যেই অনির্বাণ বলে উঠলো,

না, না, এটা বোধহয় আমাদের ভুল ধারণা ছিলো, ওই যে তুই বলিস না মাঝে মাঝে, যে এটা একতরফা, রিয়া ওকে পাত্তাই দেয় না, ওটাই ঠিক আসলে!

তোকে কে বললো? কৌশিক?

একটু অবাক হয়ে বলল তিয়াসা, অনির্বাণ ঘাড় হেলাল,

হ্যাঁ। ও নিজেই বললো আজ এগুলো, ওকে রিয়া বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যায় নি কখনো!

ওকেও ডাকি স্যার? ওর কাছে অনেক বেশি খবর আছে, রিয়ার ব্যাপারে। যদি সত্যি কোনো রিলেশন নাই থাকে, তাহলে সবটা খুলেই বলবে নিশ্চয়ই!

তিয়াসার কথার উত্তরে অর্ক সম্মতি দেবার আগেই অনির্বাণ অবাক হলো,

কি খবর দেবে? কি হয়েছে বলতো আসলে? স্যার বলেছিলেন ও একটা খাতা নিয়ে গিয়েছে, কিন্তু তার জন্যে তো এতো কিছু হবার নয়!

তিয়াসা অর্কর দিকে তাকালো, তারপর আস্তে করে বললো,

শেষ যেদিন আমরা পড়তে এলাম, সেদিন আমার সামনে ও ম্যাম কে অনেক মিথ্যে কথা বানিয়ে বানিয়ে বলছিলো! আমি শুনেছিলাম সেগুলো, স্যার কেও জানিয়েছিলাম, তাই স্যার ওর সম্পর্কে একটু খোঁজ খবর নিচ্ছেন।

অদিতির সঙ্গে চোখাচোখি হলো অর্কর, ওর আর দিতির অশান্তির কথাটা যে তিয়াসা অনির্বাণ কে বললো না, সেটা দেখে খুশি হলো দুজনেই।

কি বলেছিলো ম্যাম কে?

কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলো অনির্বাণ, তিয়াসা মাথা নাড়লো,

ওই! সেরকম কিছু না! বলছিলো ও অনেকবার এখানে এসে কফি করেছে আগে! ও তো মিথ্যে বলেই, সেতো তুইও জানিস, মনে নেই, বোলপুর স্টেশনে ম্যাম কে কিরকম মিথ্যে বলেছিলো গয়না পছন্দ করা নিয়ে?

অদিতি অবাক হলো একটু, এরাও তাহলে গয়নার কথাটা নিয়ে আলোচনা করেছে আগে! অর্ক একটু লজ্জিত দৃষ্টিতে অদিতির দিকে তাকালো, নিজের ভুলের জন্যে নিজেরই লজ্জা লাগছে এখন! অনির্বাণ হেসে ফেললো হটাৎ,

স্যার, তিয়াসা ওটা ভুলতে পারছে না কিছুতেই! আসলে ওর ক্রেডিট টা রিয়া নিয়ে নিয়েছে তো! সেদিন ট্রেনেই রিয়ার সঙ্গে মোকাবিলা করতে চাইছিলো, নেহাত আমি ঠেকিয়ে দিলাম!

তিয়াসা লজ্জায় পড়লো, অর্কর দিকে তাকিয়ে বললো,

না, না, স্যার, অনির্বানটা ওই রকমই! শুধু আমাকে ফলস পজিশনে ফেলে! স্যার, বলুন তো, আমি হাটে আপনাকে চয়েস করতে হেল্প করেছিলাম না? রিয়া তো ওই দোকানে ছিলোই না!

অর্ক অদিতির দিকে তাকালো একবার, তারপর অনির্বাণের দিকে তাকিয়ে হাসলো,

হ্যাঁ, তিয়াসা সত্যি হেল্প করেছিলো, আমি দিতি কে বলেছিলাম সেকথা। ইনফ্যাক্ট, ও আমাকে রিয়ার নাম বলছিলো, কিন্তু আমি ভেবেছিলাম ও তিয়াসার নামটা ভুলে গিয়ে রিয়া বলে ফেলেছে!

ওদের কথাবার্তা চলাকালীন রুমা ঢুকলেন,

তোমরা খেয়ে যেও কিন্তু, আমি রান্না বসিয়েছি,

দুজনের কেউই খুব বেশি আপত্তি করলো না, তিয়াসা মা কে ফোন করে জানিয়ে দিলো, অনির্বাণ ওকে বাড়ি পৌঁছে দেবে জানালো। রাতে খেয়ে যাওয়ার কথা হয়ে যাওয়ায়, হাতে অনেকটাই সময় ছিলো, অনির্বাণ কৌশিক কে এখানে আসার জন্যে ফোন করে ফেললো। প্রায় আধ ঘন্টার মধ্যেই কৌশিক এলো, ঢুকেই সবার মুখের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো,

কি হয়েছে স্যার? খাতা খুঁজে পান নি?

অর্ক মাথা নাড়লো,

না, না, সেসব কিছু নয়, তোমার একটু হেল্প চাই কৌশিক! সবাই বললো রিয়ার সঙ্গে তোমার বেশ ভালো বন্ধুত্ব আছে, তাই তোমাকে ডাকলাম।

রিয়ার সঙ্গে ভালো বন্ধুত্বের কথাটা কৌশিক অস্বীকার করলো না, একটু নিচু গলায় বললো,

ওই একটু স্যার, ও আসলে খুব লোনলি, আর সবার সঙ্গে সব কথা শেয়ার করতে পারে না। তাই আমার কাছে কিছু কিছু শেয়ার করে, ওর বাড়িতে খুব অশান্তির মধ্যে থাকে ও!

অশান্তির মধ্যে থাকে! কি রকম?

ওর মায়ের সঙ্গে বাবার কিছু সমস্যা আছে স্যার! তাছাড়া ওর মায়ের ওপরেও রিয়ার রাগ আছে, উনি বোধহয় ওর ঠাকুমা, পিসীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা ঠিক পছন্দ করেন না! তাই কলেজের পর ও অন্য কোথাও চাকরি নিয়ে চলে যেতে চায়!

অর্কর প্রশ্নে একটু নিচু গলায় বললো কৌশিক, তিয়াসা অবাক হলো,

বাবা! তুই এতো কিছু জানিস! অথচ ওর বাড়িতে যাসনি বলছিস!

বিশ্বাস কর! কোনোদিনও যাই নি! আসলে ওর বাবা খুব কড়া, ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা পছন্দ করেন না। ওদের বাড়ির গেটে সি সি টি ভি লাগানো আছে, তাই ওর বাবা সব জেনে যাবে বলে ও আজ পর্যন্ত ওদের বাড়ির কাছাকাছিও যেতে দেয়নি আমাকে! আমি ওকে জগু বাজারের সামনে ছেড়ে এসেছি সব সময়।

অর্ক হাসলো, কৌশিকের জন্যে ওর খারাপ লাগছিলো, কৌশিকের দিকে সরাসরি তাকালো ও,

কৌশিক, ওদের বাড়ির গেটে কোনো সি সি টি ভি নেই, ওটা ওদের বাড়িও নয়! ওখানে ভাড়া থাকে ওরা, আর তোমার জানলে খারাপ লাগবে, ওর বাবা ওদের সঙ্গে থাকেন না! তাই তাঁর দেখে ফেলার বা জেনে যাবার কোনো প্রশ্নই নেই!
ক্রমশ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here