#Journey episode15

0
212

#Journey episode15

#১৫

জেসমিন তৈরি হয়ে হোটেলের লবিতে এসেছে।সেখানে এসে রুমের চাবি সহ বিল মেটাচ্ছে।পিছনে সোফায় যে রাইফ বসে আছে,সেটা ও দেখেনি।হাতের ট্রলি নিয়ে ঘুরতেই রাইফকে দেখে অবা হয়।
“কিরে,তুই এখানে চলে আসলি যে!”

রাইফ উঠে দাঁড়ায়। জেসমিন একটা মেরুন রঙের লং স্কার্ট আর গোল্ডেন টপ্স পড়েছে,সাথে মাথায় আছে মেরুন রঙের হিজাব।মেয়েটা বরাবরের মতই হাল্কা সাধারণ সাজ সেজেছে,কিন্তু ওর সম্পূর্ণ সাজ মিলিয়ে অসাধারণ লাগছে।রাইফ কিছুক্ষণ পুরোনো বান্ধবীকে দেখে।ওর ড্রেসের রঙটা মনে হয় ওর সৌন্দর্য্য আরো ফুটিয়ে তুলেছে।নাহ,ওর চয়েজ আছে বলতে হবে।এত সাধারণ হওয়ার পরও অসাধারণ!রাইফকে একদৃষ্টিতে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে জেসমিন কাছে এসে চোখের সামনে হাত নাড়ে।
“কিরে,এভাবে তাকিয়ে আছিস যে!”
রাইফের ধ্যান ভাঙে।হেসে বলে,
“তোকে এগিয়ে দিতে এসেছি।”
“আরে,সেটার দরকার কি ছিল!আমি যেতে পারব তো”
“আমার কোন বন্ধু তো আমাকে দেখতে ইটালী আসে নি,আমাকে এত খোঁজে নি,আমার জন্যে এতটা কষ্টও করেনি!সেখানে যে এসেছে,তাকে অন্ততঃ এগিয়ে দেয়াটা কি আমার উচিত না?”
জেসমিন হাসে।
“তার মানে তুই শুধু দায়িত্বের তাড়নায়ই এসেছিস?”
“তুই জানিস আমার সাথে তোর কোন দায়িত্বের সম্পর্ক নেই,যা আছে সম্পূর্ণটা আত্মার আর মনের।তাই তো আজ আমরা এখানে… যাই হোক।চল,ট্রেন মিস হয়ে যাবে নাহয়।

রাইফ গাড়ি নিয়ে এসেছে।ওর লাগেজটা পেছনে রেখে ড্রাইভারের পাশের দরজা খুলে পেছনে এক হাত ভাঁজ করে দাঁড়ায়,জেসমিনকে বসতে আহবান করছে।জেসমিন হেসে সেই সিটে বসে।দরজা লাগিয়ে রাইফ ড্রাইভিং সিটে বসে।মনে মনে ভাবে,ছেলেটা ভালই ভদ্রতা দেখাচ্ছে,ঘটনা কি?
“কিরে,আমার সাথে হঠাৎ এত ভদ্রতা?জানিস তো, অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ যে?”
“হা হা!কেন, আমি কি অভদ্রতা করেছি কোন তোর সাথে?
” তা করিস নি!তবে এখন এভাবে বসতে দিলি…দরজা খুলে দিলি…তাই বললাম আর কি!”
“আরে,তেমন কিছু না।আসলে তুই চলে যাচ্ছিস তো, তাই আর কি।ভদ্রতা দেখানোর আর কোন সুযোগ তো আসবে না!”
“বুঝলাম! একটা প্রশ্ন করি?”
“শিওর”
“আমাকে মিস করবি?”

ড্রাইভ করতে করতে রাইফ ওর দিকে একবার তাকায়,আবার রাস্তার দিকে মনোযোগ দেয়।তারপর এক হাতে ওর হাতে হাত রাখে,
“খুব মিস করব রে,খুব।সময় পেলেই চলে আসিস,আমার ভাল লাগবে।বড় একা হয়ে গেছি।আর ভাল লাগে না এই একা জীবন।তুই এই দেশে আছিস জানার পর থেকে কত ভাল লাগছে তোকে বুঝাতে পারব না।মনে হচ্ছে,কেউ তো আছে যাকে দেখতে আমার সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দিতে হবে না।আজ আবার এসে চলেও যাচ্ছিস,ঠিক ভাবে ঘোরাও হল না আমাদের,সময়ও কাটাতে পারলাম না এতদিম পর।এটা ভেবেই আরো খারাপ লাগছে।যেদিন তোকে দেখলাম,বিশ্বাস করবি কিনা জানি না,আমার নিজের বিশ্বাস হচ্ছিল না।তুই যখন বলছিলি যে আমাকে এত কষ্ট করে খুঁজেছিস,মনে হচ্ছিল তুই মিথ্যা বলছিস।সত্যিই আমাকে খুঁজতে কেউ এত কষ্ট করবে,সেটা বিশ্বাসের মত না।এতটা অবহেলিত হয়েছি কাছের মানুষ গুলোর কাছে,সেখানে তুই এসেছিস…আমার জন্য এটা ভীষণ রকম অবিশ্বাস্য। এই দেখ,কত কি বলে ফেলছি তোকে! আমার যায়গায় অন্য কোন ছেলে থাকলে তোকে এত কিছু বলত না,কিন্তু তুই জানিস আমি কতটা স্পষ্টভাষী।আমি কার্পণ্য করব না আমার মনে তোকে নিয়ে কি হচ্ছে বলতে।হাহ! জীবন কতটা বদলে যায়! দোস্ত,থেকে যা না আর কয়টা দিন,প্লিজ?”

রাইফের এভাবে হাত ধরে কাকুতি করাটা জেসমিনের হজম হচ্ছে না,বিশ্বাসও হচ্ছেনা।রাইফ ওর হাত ধরল আবার? কোন মতে ঢোক গিলে উত্তর দেয় জেসমিন,
“দেখ,ছুটি নিয়ে আসি নি রে।আর ছুটির সময়টাও শেষ।ভেবেছিলাম খুব দ্রুতই তোকে পাব,কিন্তু তা আর হল না।অলরেডি আমার প্রফেসর দামেস্কা দুবার কল করে ফেলেছেন,অনেক কাজ জমে গেছে।এত কাজ ফেলে এখানে কিভাবে পড়ে থাকব বল?হাজার হোক,রুটি রুজির ব্যাপার”

রাইফ হাত সরিয়ে নেয়।স্মিত হাসে।
“সরি দোস্ত,হুট করে বেশি আবেগী চিন্তা করতে শুরু করেছিলাম।সমস্যা নেই,তুই যা।তুই যে এসেছিস,এটাই তো ভাগ্য রে! সাবধানে যাস।গিয়ে অবশ্যই যোগাযোগ করবি।”
জেসমিন মাথা নাড়ায়।দুজনেই চুপ করে আছে,একজন ড্রাইভিং করছে,আরেকজন জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে।রাতের সিসিলি শহর শোঁ শোঁ করে ওদের পেছনে চলে যাচ্ছে,স্মৃতিগুলো বার বার মনে পড়ে যাচ্ছে।এই মুহুর্তে জাফার আর সেলিমের কথা বেশ মনে পড়ছে,ওরা কি করছে এখন?একবারও কল দেয়া হল না,ট্রেনে উঠে প্রথম কাজ হবে জাফারকে কল দেয়া।এই শহরে আসার জার্নিটা খুব সুন্দর ছিল,আর ফিরে যাবার সময়টা যে ভাল যাবে না তা বলে দেয়াই যায়,কারণ সে ট্রেনে জাফার আর সেলিম থাকবে না।সেলিম!সেলিমের কথা মনে হতেই জেসমিনের ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে। কি মিষ্টি বাচ্চা!এই বাচ্চাকে আদর করবে না,এমন মানুষ বোধহয় পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

ওদিকে রাইফের খারাপ লাগছে বান্ধবী চলে যাচ্ছে বলে।ও আসার পর থেকে সবটা স্বপ্ন মনে হচ্ছিল,কিন্তু সেই স্বপ্ন থেকে বেরুবার আগেই যেন জোর করে তা ভেঙে দেয়া হচ্ছে।দিন শেষে রাইফ আবার একা হয়ে যাচ্ছে,যেমনটা আগেও ছিল। খারাপ লাগা গুলো বলার মানুষ দরকার খুব।সারাদিন একটা মানুষ যতই ব্যস্ত থাকুক,রাতে বিছানায় শোয়ার সাথে সাথে খুব কাছের একটা প্রাণের প্রয়োজন হয়।এই বিদেশের মাটিতে মানুষ অনেক ব্যস্ত,তাদের অন্যের জন্য সময় হয় না।হ্যাঁ রাত কাটাবার জন্য অনেক মেয়েকেই হয়ত পাওয়া যাবে, এরা সবাই পুরো দেহ ছুঁয়ে দিতে পারবে,কিন্তু এদের কারো আত্মা ছোঁয়ার সাধ্য নেই। রাইফের জীবনে একজন আত্মা ছোঁয়া প্রাণের অস্তিত্ব প্রয়োজন।কিন্তু কোথায় পাবে ও?

ভাবনার সমুদ্রে ভেসে ভেসে ওরা পৌঁছে যায় স্টেশনে। রাইফ বের হয়ে মালপত্র নামায়,জেসমিন ততক্ষণে বেরিয়ে আসে।রাইফ লাগেজ হাতে ওকে এগিয়ে দিতে যায়।স্টেশনে গিয়ে ওরা বসে।আরো ১৫মিনিট বাকি ট্রেন আসার।দুজনে বসে বসে চারপাশে দেখে।একটা সময় রাইফ জেসমিনের চেয়ে থাকে।মেয়েটাকে এই দেশে দেখার পর থেকে কেন যেন আগের মত লাগছে না,অন্য রকম লাগছে,অন্য রকম অনুভূতি হচ্ছে।আগে তো এমন লাগে নি! জেসমিনের প্রতিটি নড়াচড়া, ওর কেঁপে ওঠা ঠোঁট,নিটোল গাল,চাহনী,সব কিছুতে রাইফের এখন কড়া নজর।কেন এমন হচ্ছে?রাইফ বুঝে না,বুঝতে পারেও না।

এদিকে জেসমিন খেয়াল করে রাইফের ওর দিকে তাকিয়ে থাকা,কিন্তু চোখে চোখ মিলায় না।এই শেষ বেলায় এসে খারাপ লাগছে,ওকে কিছুই বলা হল না।আসার সময় কত কী ভেবেছে,কত কি চিন্তা করেছে,কিছুই বলা হল না।অথচ রাইফ কী অকপটে তখন জেসমিনকে বলে দিল যে ও জেসমিনকে খুব মিস করবে!আচ্ছা,ও রাইফকে বলতে পারল না কেন? তাছাড়া রাইফের উপর এখন আর আগেরমত অভিমানও নেই,সেখানে যায়গা করে নিয়েছে অনেক গুলো ভালো লাগা।যাক,ওর এতদূরে চলে যাওয়াটা এমনি এমনি ছিল না,এর পিছে ভাল একটা কারণ আছে। আচ্ছা,রাইফকে কী ওর ভাল লাগে? জেসমিন জানে না।তবে রাইফের জন্যে ওর মনে যে আলাদা একটা যায়গা আছে,সেটা নিশ্চিত।আর সময়ই বলে দিবে সেটা কি।

ট্রেন চলে এসেছে।জেসমিন এগিয়ে যায় ধীরে ধীরে থেমে যাওয়া ট্রেনের দিকে।রাইফ লাগেজ নিয়ে ওর হাতে দেয়।জেসমিন ট্রেনে উঠে রাইফের দিকে ঘুরে তাকায়,মুখে হাসি টেনে হাত নাড়ে।রাইফও হাতে নাড়ে,তবে ওর মুখে হাসি নেই,সেখানে আষাঢ়ের মেঘের ছায়া।পকেটে দুহাত ঢুকিয়ে ভ্রু কুঁচকে জেসমিনের দিকে চেয়ে রয়েছে,যেন খুব বিরক্ত ও।জেসমিনেরও দেখাদেখি ভ্রু কুঁচকে যায়,রাইফ এরকম করে আছে কেন? জেসমিন তবুও দাঁড়িয়ে আছে ট্রেনের দরজার কাছে।অনেকেই উঠছে ট্রেনে,তারা পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে জেসমিনের।আবার অনেকেই রাইফের চারপাশে ঘুরছে,হয়ত ট্রেনে উঠছে,কিংবা পরিচিত জনকে বিদায় জানাচ্ছে।ভীড়ের মাঝেও রাইফ আর জেসমিন তাকিয়ে আছে, একদৃষ্টিতে।

ট্রেনের দরজা লাগানোর সময় যখন এল,হুশ করে একটা আওয়াজ হল। আর তখনই রাইফ চিৎকার করে জেসমিনকে বলল,
“দোস্ত,ফিরে যাস না!”
জেসমিন চমকে উঠে,হাত নেড়ে বলে,
“কেন??!!”
আর তখনই দরজা লেগে যায়।জেসমিন দরজার কাঁচের কাছে এসে দুহাত দিয়ে চেপে ধরে, দরজার খোলা যায় কিনা দেখছে।রাইফও নড়ে উঠে হাত নাড়িয়ে কি যেন বলে,সেটা জেসমিনের কর্নপট পর্যন্ত পৌঁছায় না।রাইফের দিকে চিন্তা মাখা জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে,রাইফ আবার হাত নেড়ে চিৎকার করে বলে,

“I Love You!!!”

রাইফের চিৎকার হয়ত পুরো সিসিলি শহর,অন্ততঃ স্টেশনের সব মানুষ শুনেছে,শুধুমাত্র জেসমিন ছাড়া।

ট্রেন চলে যাচ্ছে,সামনে এগিয়ে যাচ্ছে জেসমিন অস্থিরতা নিয়ে,পিছে পড়ে যাচ্ছে রাইফ,একা।

এখন???

চলবে…

লেখনীতে, #AbiarMaria

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here