#দুজনা
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-৯ম/সমাপ্তি পর্ব
আজকে আমি,আদন এবং আদিল গ্রামে যাচ্ছি আদিলের বাবার এবং আমার বাবার কবর যিয়ারত করতে।আগে থেকেই আদিল তার গ্রামের দূরসম্পর্কীয় এক বন্ধুর সাথে কথা বলে হুজুর ঠিক করে রেখেছে।যারা কবর যিয়ারত করবেন।আদিল অফিস থেকে সপ্তাহ খানেকের মতন হলো ছুটি পেয়েছে।তাই এই ছুটিতেই যাচ্ছি।আমরা গ্রামের বাড়িতে আসতে দেখি বাড়ির আশপাশ অনেক পরিবর্তন হয়েছে।রাস্তার পাশে কয়েকটা টিনের বাড়ি ছিল,সেগুলো পাকা দালান হয়ে গেছে।রাস্তাঘাটের শান বাঁধা হচ্ছে।পাঁকা করবে মনে হয়।আমি আদনকে নিয়ে কার গাড়ি থেকে নামি।আদিল গাড়ি লক করে নামে।আমরা সামনে হাঁটা ধরলে পেছন থেকে আদিয়া নানি ডাক দিয়ে উঠেন,
“আরেহ প্রিয়া যে?”
আমরা থেমে গেলাম।বললাম,
“হ্যা,আসসালামু আলাইকুম।ভালো আছেন নানি?”
“হ্যাঁ,ভালো আছি রে।তোদের দয়ায় খুব ভালো আছি।তা হঠাৎ কি মনে করে গ্রামে?এ তোমার ছেলে?”
“জ্বী,নানি।”
“মাশাআল্লাহ মাশাআল্লাহ অনেক সুন্দর। তা বাড়িতে যাইতেছো?”
“জ্বী,নানি।বাবার কবর যিয়ারত করতে আসছি।”
“আচ্ছা।”
“তাহলে যাই নানি।পরে আবার দেখা হবে।”
“যাও বু।”
আমরা বাড়িতে আসলাম।বাড়িটার অবস্থা ভালো না।বড় কোনো ঝড় এলে যেকোনো সময় উড়ে যেতে পারে।আমি বাড়ির ভেতর ঢুকলাম।ধূলা-বালি ভরা।তারপরও নিজের অতীত,নিজের স্মৃতি,নিজের আপন নীড় এক মায়া ছুঁয়ে গেলো!বাড়ির চারপাশ ঘুরলাম কিছুক্ষণ। আদিল আমাদের জন্যে দোকান থেকে কিছু পানীয় খাবার,কেক এবং কলা নিয়ে আসে।হাতে তুলে দিয়ে,
“আপাতত এগুলো খাও,প্রিয়া।বাবার যিয়ারত শেষ হলে আমরা বাইরে যেয়ে খাবো।”
তখন বললাম,
“আচ্ছা?আমার না খুব মন চাচ্ছে বাড়িতে ক’দিন বেড়াতে।আজকে এলাম।আর আজকে রাতেই যদি রওনা করি..!”
আদিল বললো,
“থাকা যায়।কিন্তু বাড়ির অবস্থা! ”
“সমস্যা নেই।আমি সব ঠিক করে নিব।”
এরমাঝে কয়েকজন হুজুর আমাদের উঠানে এসে দাঁড়ায়।আদিলকে ডেকে উঠে,
“কই আদিল, বাবা?আছো?”
হুজুররা চলে এসেছে।আদিল আমাকে বলে,
“থাকো তাহলে। ”
বলে আদনকে তুলে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়।আদিলের কবর যিয়ারতের এইটুকু ঘরটা পরিষ্কার করার প্রস্ততি নিই।বিকেলে আদিল আদনকে নিয়ে ফিরে।বলে,
“প্রিয়া?আমার বাবারটা কাল করবো।আমরা যেহেতু আজ এখানে থাকবো তাই কাল করতে সমস্যা নেই।”
“তোমার ইচ্ছে।”
“তাহলে তুমি আদনকে নিয়ে থাকো আমি বাইরে থেকে খাবার নিয়ে আসছি।”
আমি বাঁধা প্রদান করি।বলি,
“আজ মাটির চুলাতে রান্না করবো।আপনি বাজার নিয়ে আসেন।”
আদিল কুট করে হেসে দেয়।বলে,
“আজকে মাটির চুলাতে রান্না করার খুব ইচ্ছ হয়েছে, না?”
“অনেক।নিয়ে আসেন।”
“আচ্ছা,তাহলে আদন তোমার কাছেই থাকুক।”
গ্রামের অনেক মানুষই ইতোমধ্যে শুনেছে আমি গ্রামে এসেছে তাই অনেকেই আমাকে দেখতে এসেছে।আদনকে কোলে নিয়েছে।আবার আদর করে দিয়েছে।সবার সাথেই অনেকক্ষণ ধরে কথা বলি।আসলে এই মাটি,মানুষ,পরিবেশ সবটার প্রতি কেনজানি একটা টান অনুভব হচ্ছে।খুব বেশি অনুভব হচ্ছে!
———————————————————পরদিন আমিও আদিলের সাথে যাই।আদিলের বাবার কবর যিয়ারত করবে।যিয়ারত শেষ হলে আদিলের বড় ভাইয়ের সাথে আদিলের দেখা হয়ে যায়।উনার চোখমুখ কেমনজানি উদাসীন উদাসীন।হাবভাবে বুঝা গেলো উনি খুব একটা ভালো নেই।আদিল ভাবলো পাশ কেঁটে চলে যাবে।উনি থামিয়ে দেন।বলে উঠেন,
“বড়লোক হয়ে ভুলে গেলি আমাদের?”
আদিল একদন্ড চুপ থেকে তারপর বললো,
“কেনো ভুলবো।সবই মনে আছে।”
“তাহলে আমাদের সাথে যোগাযোগ করিস নি যে?মায়ের,আমাদের একবারও খবর নিয়েছিস?”
আদিল এবার চুপ করে থাকে।উনি বলেন,
“জানিস আমার সব যে শেষ!সাজানো এতবড় কোম্পানি সআ তছনছ হয়ে গেলো!পথের ভিক্ষুক বানিয়ে দিয়েছে!খেতেও পারি না।কত মানুষ ঋণগ্রস্ত হয়ে আছি মানুষের কাছে!জমি আমার ভাগের থেকে একবিঘা বিক্রি করে কিছু মানুষের দেনা শোধ করেছি।আরো এখনো লাখ লাখ টাকা পাওনা।কিভাবে দিব,কি করবো কিছুই বুঝতেছি না।কাউকেই পাচ্ছি না সাহায্য করার মতন আমাকে!সব ব্যাটা স্বার্থপর!”
বলতে বলতে ভাসুরের চোখে পানি এসে এলো।আদিল চুপ করে রইলো।এবার তিনি চোখের কোণা থেকে পানি মুছে নেন।তারপর হাক ছেড়ে বলেন,
“ঘরে যাবি না?চল?”
আদিল বললো,
“আমি ঘরে যাবো না।মায়ের সাথে একটু দেখা করবো।আর দেখা করেই চলে যাবো।”
বলে আদিল বাড়ির দিকে এগোয়।বাড়ির ছোট উঠান টায় পা দিতে শাশুড়ী মা বেরিয়ে আসেন।আমি সালাম করি উঠি।উনি আদিলকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেন।আর কাঁদতে কাঁদতে বলেন,
“এই ছেলে তোর মনে কষ্ট দিয়েছে বাপ!তাই আজ কারখানার এই হাল হলো!মানুষকে ঠকিয়ে নিজে যে কোনোদিন সুখে থাকা যায় না আজ তার প্রমাণ হলো!এখন তো বাপ বুঝে।বুঝে আর কী লাভ হলো,সব তো তছনছ হয়ে গেলো!”
শাশুড়ী মা আদিলের সাথে কথা বলার মাঝপ আমার ঝা,এবং চাচী শাশুড়ী আমার দিকপ এগিয়ে আসেন।আমি সালাম করি চাচীমাকে।তিনি সালামের জবাব নিয়ে বলেন,
“আরেহ আমাদের প্রিয়া যে!এ কি তোমার ছেলে?”
বলেই আদনকে তুলে নেন।জা আমার কাছে আসে।খুব শান্ত কন্ঠে বলে,
“কেমন আছো,প্রিয়া?”
“জ্বী,ভালো।আপনি ভাবী কেমন আছেন।”
“জানোই তো কেমন আসি।”
বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।আমার শাশুড়ী মা আদিলকে ছেড়ে এবার বলেন,
“আমার নাতি কই?আমার নাতিকে আমাট কোলে দে।”
চাচীমা আদনকে শাশুড়ী মায়ের কোলে তুলে দেয়।শাশুড়ী কোলে নিয়েই বলেন,
“আদিলের মতন একদম আমার দাদুটা।মাশাআল্লাহ। ”
আদনকে নিয়ে খুনসুটি করেন।তারপর আমি বলি,
“মা ভালো আছেন?”
শাশুড়ী মা আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। বলেন,
“আমার উপর তোমার খুব রাগ,না?”
“নাহ,মা কি বলেন!”
“হ্যাঁ,আমি জানি।তুমি মুখে না বললেও আমি বুঝি।আমাকে মাফ করে দে মা।আমি তোর উপর অনেক অন্যায়-অবিচার করেছি।”
আমি কথাগুলো এড়ানোর চেষ্টা করলাম।বললাম,
“মা আপা কোথায়?আপাকে দেখতেছি না যে?”
“ও তোমার ভাসুরের এই হাল দেখে আর আসেনি।ওর স্বামীর আবার যদি সাহায্য করা লাগে।পৃথিবীর সবাই ই নিজের স্বার্থ বুঝে রে মা।”
আমি তপ্তশ্বাস ছাড়লাম।আমি আর কি বলবো।সত্যিই,পৃথিবীর সবাই নিজের স্বার্থটা আগে বুঝে!আর যখন তারা কোনো বিপদে পড়ে তখন নিজেদের অন্যায়গুলো ধরতে পারে।অথচ এরআগে এরা অন্ধ থাকে।
আমার ভাবনার মাঝেই ভাসুর আদিলের সামনে এসে দাঁড়ায়।দুইহাত বাড়িয়ে বলে,
“ভাইরে তুই আমাকে একটু সাহায্য কর!আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি,ভাই!তুই ই পারবি আমাকে একমাত্র সাহায্য করতে!ভাই।আমার রক্তের ভাই!”
———————————————————
আমরা ঢাকায় আসার পর আদিল ওর ব্যাংক একাউন্টের সঞ্চিত যত যা টাকা আছে, সব উনার ভাইকে পাঠিয়ে দেয়।কারণ,উনার ভাইয়ের খোটা ছিল উনি আদিলের ভরণপোষণ চালিয়েছেন,বিয়ের পর আমাদের সংসারটাও চালিয়েছেন সেই খরচ, উনি আদিলের ভাই তাই এখানে একটা দায়িত্ব আছে।তারউপর উনি হাতজোড় করে আদিলের কাছে সাহায্য চেয়েছে
এসব ভেবেচিন্তে আদিল নিজের সব দিয়ে মুক্ত করেছে।কারণ আদিল উনাদের মতন বেইমান এবং পাষাণ না।আল্লাহ চাইলে উনাকে এরথেকেও বেশি দিতে পারে!তবে,হ্যাঁ,আদিল গতকাল রাত তার মাকে ফোনে বলে দিয়েছে,
“এই ভাইয়ের সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক থাকবে ঠিকাছে,কিন্তু কখনো মুখের সম্পর্ক হবে না।মিল হবে বা।আমার যতটুকু সামর্থ্য ছিল আমি সবটাই করেছি উনার জন্যে।আর হ্যাঁ,তোমার যখন ঢাকায় আসতে ইচ্ছে হবে আসবে।যদি থাকতে ইচ্ছে হয় থাকবে।যতদিন ইছে হয়।আর হ্যাঁ, তোমার ওষুধ খরচ,অন্যান্য যত যা খরচ,সবকিছুর জন্যে আমি প্রতি মাসে তোমাকে বিকাশে টাকা পাঠিয়ে দিব।
আদিল তাই ই করে।মাস না আসতে ওর মাকে সাতহাজার হাত খরচ দিয়ে দেয়।কারণ এটা আদিলের দায়িত্ব এবং কর্তব্য।
(অতঃপর শেষ হলো গল্পটি। জানি না আপনাদের কেমন লেগেছে। অবশ্যই আপনাদের মন্তব্য জানাবেন।ইনশাআল্লাহ নতুন গল্প নিয়ে হয়তো আবার হাজির হবো।তবে এখন না।সামনে পরিক্ষা। পরিক্ষাটা যাক।নাহলে আবার ইররেগুলার।ভালোবাসা সবাইকে)