#JourneyThe last chapter

0
344

#JourneyThe last chapter

#৪৭

সেলিম ওর মামার সামনে বসে আছে ২৮মিনিট ধরে।ওর মামা বসে বসে বিড়ি ফুঁকছেন।যতটা কথা বলবে ভেবে সেলিম এসেছিল,তার কিছুই এখনো বলা হয়নি,বিষয়টা অস্বস্তিকর।সেলিম হাত মটকাচ্ছে,আর ওদিকে আলআমিন আয়াজ বিড়ি ফুঁকছেন নিশ্চিন্তে।উনার বিশেষত্ব আছে,বিড়ি ফুঁকার সময় কারো সাথে কথা বলেন না,আয়েশ করে খুব মনোযোগ দিয়ে বিড়ি ফুঁকেন।তাই তো সেলিম ১৩মিনিট ধরে ধৈর্য্য ধরে তার কান্ড দেখে যাচ্ছে। ধীরে সুস্থে বিড়ি শেষ করে এর শেষ ছাইটুকু ছাইদানিতে ফেলে হাল্কা কেশে সেলিমের দিকে তাকান।

“তোমার মামী আর ভাই বোন হলুদের অনুষ্ঠানে গেছে,আসতে আসতে রাত হবে।তাই তো এখানে বসে বিড়ি ফুঁকছি।ওরা থাকলে এতক্ষণে আমার মাথা পাগল করে ফেলত”
“জানি,মামী বলে গিয়েছেন”
“হুম।তা কি যেন বলছিলে?”
“বলছিলাম হীরে গুলোর ব্যাপারে”
“কেন?হীরে এখনও খুঁজে পাওনি?!”
“আমার কি আপনার সাহায্য ছাড়াই এগুলো পাওয়ার কথা ছিল?”
“কতদূর গেছ?”
“যতটুকু গেলে আমি বুঝতে পারি যে এসবের চাবিকাঠি সবটাই আপনার হাতে!”

আলআমিন হাসেন।সেলিমের দিকে ইশারা করেন,সেলিম সূত্র সবগুলো তার হাতে তুলে দেয়।আলআমিন সবগুলো উলটে পালটে দেখেন।

“একা একাই সবগুলো খুঁজে বের করেছ?”
সেলিম এক মুহূর্ত ভাবে প্রান্তের কথা বলবে কিনা ভাবে,পরমুহুর্তে বলে,
“হুম,প্রান্ত আমাকে কিছুটা বুঝতে সাহায্য করেছে”
“কিন্তু এটা তোমার একার করার কথা ছিল!”
“কথা তো অনেক কিছুই থাকে মামা! আমার পাপাও তো আজ বেঁচে থাকার কথা ছিল,আমার জীবন অন্যরকম হওয়ার কথা ছিল,আমার এই দেশে এসে ঘুরতে ইচ্ছে করেনি,না বাংলা ভাষা নিয়ে এত ঝামেলা পোহানোর কোন কথা ছিল!তবুও তো এসব হয়েছে,তাই না??”

আলআমিন ওপাশে চুপ থাকেন। উত্তর না দিয়ে পালটা প্রশ্ন ছুড়ে দেন,
“তোমার কি মনে হয়?তোমার মায়ের এমন উদ্দেশ্যের কারণ কি?তোমাকে এখানে এনে তার লাভ কি?”
“লাভ আবার কি হবে!মা তো ডায়েরিতেই লিখেছে,আমি যেন এসব খুঁজে নেই,আর তাতে আমার মনে হবে আমি আমার প্রাপ্য অর্জন করেছি।কিন্তু বিশ্বাস করেন,আমার এখন পর্যন্ত এরকম কিছুই মনে হচ্ছে না।বরং বিরক্তি হচ্ছে।আমি যে বাংলা খুব ভাল পারি না,তা মা জানত না??”
“হলো না সেলিম,জেস শুধু তোমাকে এই কারণে এখানে পাঠায়নি।একটু ভেবে বল সে কেন এরকম কাজ করল?”

সেলিম কিছুক্ষণ ভাবে,তারপর বলে,
“আমি জানি না ঠিক”
“জেসের ইচ্ছা ছিল তোমাকে নিজের দেশ দেখাবে,দেশের সবাই কত কষ্ট করে থাকে,তাদের জীবন বিদেশের জীবনের চাইতে কতটা শোচনীয় তা দেখানোর জন্যে এনেছে।যদি ও এভাবে তোমাকে না আনত,তবে যতই অনুরোধ করত,লাভ হত না।আমার মনে হয় আগামী দুই সপ্তাহে তুমি এই দেশকে অনেকটাই চিনেছ,এর মানুষগুলো,তাদের জীবন ধারা,খাদ্যাভ্যাস সব কিছু দেখেছ,জেনেছ।জেস এটাই চেয়েছে।তুমি কি জানো তোমার পাপা যে একজন পাকিস্তানি বাঙালী?তোমার মা বাঙালি আর বাবা পাকিস্তানি”

সেলিম বেশ অবাক হয়,এই কথা ও জানত না।জানালা দিয়ে দেখা যাওয়া এক চিলতে অন্ধকার কালো আকাশটা দেখে নেয়,বুক ভরে বাতাস যতটুকু পারে টেনে নেয়।হ্যাঁ,এখন সবটাই আপন মনে হচ্ছে।আলআমিন আবারও বলতে থাকেন,
“তবে আমাকে স্বীকার করতেই হবে,তোমার ইন্টালিজেন্স আছে,তানাহলে এত দূর যেতে পারতে না।তোমার মা তো আর এতকিছু করতে পারে নি,আমিই সব ম্যানেজ করে দিয়েছি।তবে হ্যাঁ,শেষ সূত্রটুকু আমার কাছে থাকলেও এর সমাধান আমিও জানি না।এর সমাধান শুধুই তুমি করতে পারবে”

আলআমিন উঠে যান শোবার ঘরের দিকে,কয়েক মিনিট পরে সেলিমের কাছে ফিরে আসেন,হাতে আগের তিনটা বাক্সের মত হুবহু আরেকটা বাক্স।বাক্সটা ওর হাতে তুলে দেন।সেলিম বাক্সটা খুলে,সেখানে আরো একটা সূত্র আছে।তবে সেটা দেখার আগেই ওর মামা প্রশ্ন করেন,
“একটা ব্যাপারে খুব কৌতুহল ছিল।তুমি কি করে বুঝলে যে আগের সূত্রটা আমাএ নিয়েই ছিল?”

সেলিম মুচকি হাসি দেয়।কপালের চুল গুলো হাতে দিয়ে সোজা করতে করতে বলে,
“যাকে সবচেয়ে আপন ভাব,একদিন সেই চলে যায়,
যেমন আলোতে পিছু করা ছায়া অন্ধকারে মুছে যায়।
তবুও বুঝে নিও,ছায়া পালায় না,শুধু লুকোয়! সে আছে,সে থাকবে,সেই তোমার অস্তিত্বের আরেক রক্ষক!
-আমি এই কথার আগামাথা কিছু না বুঝলেও রক্ষক পড়েই আপনার কথা মনে পড়ল,তারপর শুধু পাজলের টুকরোর মত সবটা মিলিয়েছি!”

আলআমিন আয়াজ গলা ছেড়ে হাসেন।রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও সেলিমই জেসের যোগ্য সন্তান তা আজ প্রমাণিত!উঠে সেলিমকে বুকের সাথে চেপে ধরে পিঠ চাপড়ে দেন।
“সাব্বাস!আশা করি শেষটা সমাধান করে আমাকে আরও চমকে দিবে! আমার বোন আজ বেঁচে থাকলে অনেক বেশি খুশি হত!”
ওদের দুজনের ভেতরে জেসমিনের অভাবের দুঃখ মুচড়ে উঠেছে,কিন্তু ওরা পুরুষ,ওরা কাঁদতে পারে না।ওদের কান্না গুলো বুকের ভেতরে গুমরে মরে।

মামার সাথে সারারাত আড্ডা দিয়ে চতুর্থ বাক্স নিয়ে ঘরে এসে বসে।চতুর্থ সূত্রে বলা আছে,
“চার চতুষ্কোণের সমষ্টি এক মহাচতুষ্কোন।মহাচতুষ্কোণের চার কোণায় লুকিয়ে আছে চারশ কোটি কোণ!”

সেলিম কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে এর দিকে তাকিয়ে থাকে।চুল টেনে বেশ অনেকটা সময় চিন্তা করে করে বাক্সগুলো পাশাপাশি রাখে, ২ ৩ ৪ ৫।এর মাঝে কি রহস্য আছে?চতুষ্কোণ দিয়ে এই বাক্স ছাড়া আর কিছু বুঝাবে না। কারণ কাঠের ফলকগুলোর কোন নির্দিষ্ট আকার নেই।টেবিল লেম্পের আলোয় হুট করে খেয়াল হয়,বাক্স গুলোর উপরে আলাদা একটা নকশা আছে যা একে অপরের থেকে আলাদা,কিন্তু খেয়াল না করলে বোঝাই যায় না! নাহ,এভাবে পাশাপাশি মিলছে না।তারপর আবার সাজায়,
২ ৩
৪ ৫

হুম,এবার নকশাগুলো মিলেছে।এবার সেগুলো খুলে।চতুর্ভুজের চার কোণায় ভালোভাবে খেয়াল করে,কোথায়,কিছুই তো নেই।কাঠের বাক্সগুলোর এদিক ওদিক চাপতে থাকে,একসময় বাক্সগুলোর অপর কোণায়,অর্থাৎ মধ্যকার কোণায় চাপ লেগে একে একে চার কোণার চারটা টুকরো উঠে যায়।মনে হয় এর ভেতর কোন একটা লিভার জাতীয় সরে গেছে।সেলিম তার অবাক বিস্ময় ভরা চোখে খেয়াল করে,খুলে আসা গোপন কুঠুরি ভরা হীরে আর হীরে!!!

এরপরে পেরিয়ে গেছে কয়েকটা দিন।

সেলিম আজ ইটালীতে এসেছে,তবে সে সিসিলিতে না নেমে সরাসরি নেমেছে ভেনিসে।সেখানকার সান মিশেল কবরাস্থানে এসে একটা নামবিহীন কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।রেবেকা ওকে এটার কথাই বলেছে।সেলিম চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে মাটির পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে,আর হাত তুলে দোয়া করে কিছুক্ষণ। দোয়া শেষে চোখ খুলে আবিষ্কার করে দুচোখেই পানির অস্তিত্ব। সেটাকে পাত্তা না দিয়ে মাটিটা ভাল করে খেয়াল করে।তারপর মাথা নিচু করে বলতে শুরু করে,

“জানি অনেক অভিমান করে আছ কেন এতদিন পরে আসলাম।তবে যদি অভিমান করে থাক,তবে এটাও জেনে রেখো,তোমাকে ভাবিনি,তোমার জন্য দোয়া করিনি,তা কখনো হয়নি।জানো আমি এক দাদীর দেশে গিয়েছিলাম।সেই দেশটা অন্য রকম সুন্দর। আমি সেখান থেকে আসতে চাইনি জানো,কিন্তু সেখানে থাকার উপায়ও নেই…”

এক এক করে ওর সব কথা বলতে থাকে।এক সময় বলে,
“ভাবছ,আমি কি করলাম ওগুলো?পরদিনই মামা জিজ্ঞাসা করেছিল আমি রহস্যের কোন কূলকিনারা করতে পেরেছি কিনা।মামাকে বলেছি পারিনি,কারণ আমি চাইনি মামাকে এর কোন ভাগ দিতে।খুব লোভী আমি,তাই না?মামাকে দিতে চাইলাম না!!

তবে শোনো,যা ভাবছ তা ভুল।আমার মনে এক ফোঁটা লোভও নেই।তবে ভাবছ কেন ওখানে ছুটে গেলাম? আমি অভিশাপমুক্ত করতে চেয়েছি আমার পরিবারকে।হ্যাঁ,আমার পরিবার।এই হীরে গুলো অভিশপ্ত। কারণ এর অভিশাপে মায়ের মা মারা গেছে,তার জীবন তছনছ হয়েছে,তুমি মারা গেছ,বাবাও গেছে,মাও শেষে চলে গেছে।আমি চাই নি আর কেউ এই পরিবার থেকে অকালে ঝরে পড়ুক,কিংবা এর লোভে পড়ে অপরকে হত্যা করুক! তাই একদিন পরেই সমুদ্রে গিয়ে এগুলো ছুড়ে ফেলে এসেছি! এক এক করে সবগুলো! আমার কোন লোভ নেই এসবের প্রতি,না পৃথিবীর কারো লোভ থাকা উচিৎ! কি হয় কতগুলো খনিজ টুকরো দিয়ে?? লোভ তো থাকা উচিৎ ভালোবাসার প্রতি,একে অপরকে ভালোবাসার প্রতি! লোভ থাকা উচিৎ সকালের সূর্যোদয় দেখার,দিন শেষে ঘরে এতগুলো সুখী প্রিয় মানুষের মুখ দেখার! পাপা,আমি এগুলো নিতাম এক শর্তে,যদি এগুলোর বিনিময়ে তোমাকে পেতাম,তবে! মানুষ কেন ভালোবাসা পাবার লোভ করে না,বরং অর্থহীন প্রাণহীন কতগুলো খনিজ টুকরোর লোভ করে?প্রাণহীন হীরে,স্বর্ণ,টাকা,এরা কি আমাদের পালটা ভালোবাসে??”

সেলিমের প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্যে তখন কেউ নেই ওখানে, না জাফার,না রাইফ কিংবা জেসমিন।মৃত হীরে গুলোর ন্যায় ওরা তিনজন আর কবরে শুয়ে থাকা হাজার হাজার মানুষগুলোও আজ নিশ্চুপ।

সেলিম উঠে দাঁড়ায়। আরেকটা জার্নি করতে হবে ওকে।তারপরই নিজের বাড়ি,দুটো ভাই বোন,আর শান্তির ঘুম…এইত,আর একটু বাকি গন্তব্য,ভালোবাসায় মোড়ানো গন্তব্য!

সমাপ্ত

লেখনীতে #AbiarMaria

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here