#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা পর্ব২০
-Farhina Jannat
২০.
ধুর! আমাকে কাপড় আনতে বলে উনি আবার কোথায় গেলেন। তখনি কবরটার কথা মনে পড়ল সিদ্রার। নিঃশব্দে এগিয়ে টিলার পাশ দিয়ে উঁকি দিল ও। যা ভেবেছিল তাই, লোকটা বসে আছে কবরের পাশে। চোখে শূন্য দৃষ্টি, মুখটা বিষণ্ণতায় ভরা। কান্নার চিহ্ন ফুটে আছে চোখেমুখে।
প্রথমবারের মত লোকটাকে ভালমতো খেয়াল করার সুযোগ পেল সিদ্রা। মাথায় ঈষৎ কোঁকড়ানো অবিন্যস্ত চুল, মায়াবী দুটো চোখ, খাড়া নাক, ঠোঁট দুটো না পাতলা না পুরু। কয়েকদিনের শেভ না করা খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি-গোঁফ মুখটাকে আরো বিষণ্ণ করে তুলেছে। এত মায়াকাড়া একটা চেহারা, এখন দেখলে কে বলবে, এই লোকই ওর সাথে এত খারাপ আচরণ করে? চুল-টুল কিছুই তো ভিজে নেই, তার মানে গোসল করেনি লোকটা। ইশ! এতক্ষণ ধরে এখানে বসে আছে, নিশ্চয় ভাইকে অনেক মিস করছে।
লোকটার কষ্ট যেন সিদ্রাকেও স্পর্শ করল। নিজের অজান্তেই বসে গেল ওখানেই, চেয়ে রইল লোকটার দিকে। ভাবতে লাগল সিদ্রা, লোকটা ওকে যতই কষ্ট দেক, তার পেছনে তো একটা কারণ আছে। নিজের ভাইয়ের এমন অবাঞ্ছিত মৃত্যু, আসলেই কি মেনে নেয়া যায়, না সহ্য করা যায়! আর সেটা যদি কোন মেয়ের জন্য হয় তাহলে তার প্রতি যে এরকম রাগ হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। আমারওতো বোন আছে, আল্লাহ না করুক ওর যদি এমন কিছু হত, আমি কি পাগল হয়ে যেতামনা? যে এর জন্য দায়ী, আমার কি তাকে খুন করতে ইচ্ছে করতোনা?
ব্যাপারটা অনুভব করে লোকটার জন্য অসম্ভব মায়ায় ভরে গেল সিদ্রার মন। সারাদিনের সব রাগ যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। মনে মনে বলল ও, শুধু যদি জানতে পারতাম, সেই মেয়ের জায়গায় আমি কিভাবে ঢুকে গেলাম!
“তুই এখানে বসে বসে কি করছিস?” চমকে তাকাল সিদ্রা, ঢোক গিলল। লোকটা কখন ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতেও পারেনি।
“আ-আমি…. আমি আপনার জামাকাপড় নিয়ে এসেছিলাম” হাত দিয়ে পোষাকগুলো তুলে ধরল উপরে।
“তো, সেগুলো নিয়ে এখানে বসে আছিস কেন?” কাপড়গুলো নিয়ে ভ্রু নাচাল লোকটা।
“আপনি চুপ করে বসে ছিলেন, ডাকব কিনা বুঝতে পারছিলাম না” একটু থেমে আবার বলল, “আর মনে হচ্ছে আপনি গোসলও করেননি, তাই…….”
লোকটা ওর থেকে চোখ ফিরিয়ে ঝর্ণার দিকে তাকাল, বিষণ্ণ কন্ঠে বলল, “পারলামনা রে…. ওর এত পছন্দ ছিল জায়গাটা…….ওকে ছাড়া কোনদিন একা নামিনি আমি…….. কত সাঁতার কেটেছি দুজনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা…… অথচ আজ…….” গলা কেঁপে গেল লোকটার।
“তুই চলে যা এখান থেকে” স্বর বদলে গেল লোকটার, “আজকের এই দিনটা আমাকে তোর জন্য দেখতে হচ্ছে, এটা মনে হলেই মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে আমার। কিন্তু তোকে টর্চার করার মুড নাই আমার এখন। সো, নিজের উপর কন্ট্রোল হারানোর আগেই দূর হয়ে যা আমার চোখের সামনে থেকে” ওর দিকে না তাকিয়েই শক্ত কন্ঠে বলল লোকটা।
“কিন্তু আমি তো…….” থামিয়ে দিল ওকে লোকটা।
“কিছু করিনি, তাইতো!” বাঁকা একটা হাসি ফুটে উঠলো লোকটার ঠোঁটের কোণে, কিন্তু হাসির থেকে বেশি কান্নার মত দেখাল চেহারাটা, “অন্তত এই মুহূর্তে তোর মিথ্যে কথাগুলো শোনার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা বা ধৈর্য কোনটাই নাই আমার, নিজের ভালো চাইলে প্লিজ চলে যা”
নীরবে সরে এল সিদ্রা, ধীরপদে ঝর্ণা থেকে বালতি ভরে রাস্তার দিকে এগোল। জানেনা কেন, বুকটা বড্ড ভারী লাগছে ওর। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া দুফোটা পানি মুছে ফেলল হাতের চেটো দিয়ে।
*****
পরের দিনগুলো কাটতে লাগল দ্রুত, প্রায় একই নিয়মে।
ঝর্ণা থেকে পানি আনতেই অর্ধেক দিন চলে যায় সিদ্রার। কিন্তু ওই জায়গাটা সিদ্রার এত পছন্দের যে এই একটা কাজ করতে ওর খারাপ লাগেনা। সাধারণ কাজের পানি জলাশয় থেকে, আর খাওয়ার আর রান্নার পানি সরাসরি ঝর্ণা থেকে নিতে হয়। পিছল পাথরের উপর দিয়ে পা টিপে টিপে হেঁটে গিয়ে ঝর্ণার ধারা থেকে পানি ধরে আনা যে এত মজার একটা কাজ, যে না করেছে সে বুঝবেনা।
একদিন তো পিছলে পড়েই গিয়েছিল সিদ্রা। খালা সেদিন বাঁচিয়েছিল ওকে। সাঁতার জানেনা শুনে খালা ওকে প্রতিদিন সাঁতার কাটা শেখাচ্ছে, এখন মোটামুটি পারে। ঝর্ণার পানিতে পা ডুবিয়ে চুপচাপ বসে থাকা, আর মাঝেমাঝে টিলার উপর দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় উপভোগ করাও সিদ্রার কাছে হয়ে দাঁড়িয়েছে নেশার মত। ও মাঝে মাঝে ভাবে, এ ঝর্ণাটা ওর কাছে সঞ্জীবনী ধারার মত, এটা এখানে না থাকলে কিভাবে বাঁচত ও!
তারপর আবার রান্না করা, বাসন মাজা, গোসল-নামাজ, দম ফেলার ফুরসৎ পায়না সিদ্রা। এর সাথে আবার প্রতিদিন কোথেকে এক গাট্টি করে কাপড় নিয়ে আসে খালা, সেগুলো ধুতে হয় ওকে, লোকটার হুকুম।
তবে খালা ওকে সাহায্য করে সব কাজে, পারলে সবটাই করে দেয়, হয়তো তাকে সেবা করে সুস্থ করার কৃতজ্ঞতা! কিন্তু বুড়ো মানুষটার জন্য মায়া লাগে সিদ্রার, তাই উনাকে সবটা করতে দিতে খারাপ লাগে ওর। হাজার হোক, উনিও তো ওর জ্বরের সময় ওর মায়ের মত সেবা করেছেন। আর তার সাথে খালার জায়গায় হাসান নামক উপদ্রব চলে আসার ভয় তো আছেই। আর আছে স্বপ্নে শোনা সেই আশ্বাসবাণী, যার কারণেই এত কিছু সহ্য করার মনোবল পাচ্ছে সিদ্রা।
সারাদিন এসব করে এত ক্লান্ত হয়ে থাকে, বিছানায় পিঠ লাগানো মাত্র ঘুমের জগতে হারিয়ে যায় সিদ্রা। সবকিছুই ঠিক থাকে, শুধু মাঝে মাঝে লোকটা এসে অশান্তি বাধায়। কোনদিন হয়তো ধোয়া কাপড় মাটিতে ফেলে দিয়ে আবার ধোয়ানো, কিংবা ভরে আনা পানি ফেলে দিয়ে আবার আনানো। কখনো ওর রান্না করা খাবার কুকুরেও খায়না বলে ফেলে দেয়া, কখনো আবার ওর রান্না করা ভাত তরকারি বেলার পর বেলা ওকেই খাওয়ানো, বাসি গন্ধ হয়ে গেলেও। মোটকথা লোকটা যেন ওকে কষ্ট দেওয়ার নিত্যনতুন উপায় খুঁজে।
এর মধ্যেই সিদ্রা মনে মনে পালানোর নতুন প্ল্যান কষছিল। লোকটা কোনদিক দিয়ে আসে আর যায় এটা খেয়াল করে ও। যদিও এক জায়গা দিয়ে কখনওই ঢুকতে বা বেরোতে দেখেনি, তবুও একটা আন্দাজ ও পেয়েছে। আর এতবার যখন আসা যাওয়া করে, হালকা হলেও রাস্তা একটা থাকবেই। আমাকে শুধু সেটা খুঁজে পেতে হবে, তাহলেই কেল্লাফতে, ভেবেছে সিদ্রা। এখন শুধু সুযোগের অপেক্ষা।
কিন্তু সুযোগ পাওয়াই হয়ে দাঁড়িয়েছে দুষ্কর। খালা ওকে এক মুহূর্ত চোখের আড়াল হতে দেয়না। ঘরে থাকলে তালা দেয়া, আর বাইরে থাকলে তো কথাই নেই। কখনো কখনো খালা অন্য কাজে ব্যস্ত থাকলে আর সিদ্রা ঘরের বাইরে থাকলে শিকল পরিয়ে রাখে ওকে। এতে একটু মন খারাপ হলেও একবার পালাতে গিয়ে খালার বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে, তাই আর কিছু বলার মুখ নেই ওর।
একদিন বিকেলে ঘরের বাইরে গাছের ছায়ায় খালা ওর মাথায় তেল দিতে বসেছে। খালা ওকে এখন এতই ভালবাসে, চুলে তেল দিয়ে দেয়, শ্যাম্পুর প্যাকেট এনে দেয় সপ্তাহে একবার। প্রথমদিন যখন তেল দিতে বসেছিল, চুল তো ময়লায় পুরা আঠা হয়ে ছিল, তার মধ্যে যে উনি কিভাবে তেল দিয়েছে, সেটা উনিই জানে।
তেল দিতে দিতেই সিদ্রার মনে হল, যথেষ্ট হয়েছে, এবার খালাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করব আমি। ঘুরে খালার মুখোমুখি বসে বলল, “খালা, অনেকদিন তো হল। আমি আপনাকে আজ একটা কথা জিজ্ঞেস করব। প্লিজ, আপনি আমাকে সত্যি সত্যি উত্তর দিবেন, কিন্তু তার আগে আপনাকে কিছু কথা বলা দরকার। মনযোগ দিয়ে শুনবেন প্লিজ” একটু থামল সিদ্রা।
“আমি আর আমার বোন সম্পূর্ণ ইসলামিক গন্ডির মাঝে বড় হয়েছি। আম্মু আমাদেরকে ক খ শেখানোর আগে আলিফ বা শিখিয়েছে। আমরা এত ছোটতে কায়দা পড়েছি, যে সেটা পড়ার কথা আমার মনে নেই। সাড়ে তিন বছর বয়সেই মাদ্রাসায় সারাদিন রেখে আসত আম্মু আমাদের। আমরা হাফেযা হয়েছি, মাদ্রাসায় পড়েছি এতগুলো বছর ধরে। ছেলেদের সাথে যে বিনা প্রয়োজনে কথাও বলতে নেই, সেটা আমরা ছোটবেলা থেকেই জানি এবং মানি। আমরা এত ছোট থেকে পর্দা করি যে, এমনকি আমাদের কাজিনরাও আমাদের দেখতে কেমন সেটা বলতে পারবেনা। সেখানে কোন ছেলের সাথে প্রেম করা তো অনেক দূরের কথা। এমনকি আমার আব্বু-আম্মুর এত ইচ্ছে ছিল আমি ডাক্তারি পড়ি, কিন্তু সহশিক্ষার গুনাহর ভয়ে আমি মাদ্রাসায়ই ভর্তি হয়েছি” একটানে এতগুলো কথা বলে দম নিল সিদ্রা।
“এখন আপনিই বলুন খালা, আমার পক্ষে কি এসব করা সম্ভব? আর আমি যদি শয়তানের ফাঁদে পড়ে এমন কিছু করেও থাকতাম, আমি সেটা কেন অস্বীকার করতে যাবো বলেন। আমার কারণে একটা ছেলের প্রাণ চলে গেছে জেনেও আমি অনুতপ্ত না হয়ে অস্বীকার করে যাবো, আমাকে কি আপনার এতটা অমানুষ বলে মনে হয় খালা? দয়া করে কি বলবেন, কিসের ভিত্তিতে আমাকে একিউজ করে আপনারা বন্দি করে রেখেছেন?”
হাততালি দেয়ার শব্দে চমকে উঠলো সিদ্রা, মাথায় ওড়না তুলল তাড়াতাড়ি করে।
“এক্সিলেন্ট! মাইন্ড ব্লোয়িং! খালার ব্রেইনওয়াশ করার প্রচেষ্টাটা দারুণ ছিল” জংগলের ভেতর থেকে কথাগুলো বলতে বলতে বেরিয়ে আসল লোকটা। “কিন্তু স্যরি মিস নটঙ্কি বেগম, আপনার সেন্টিমেন্টাল লেকচার কোন কাজেই আসবেনা”
“আমি কাউকে ব্রেইনওয়াশ করিনি আর লেকচারও দেইনি, যেটা সত্যি সেটাই বলেছি। যেখানে অপরাধীরাও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পায় সেখানে আমি তো নিরাপরাধ” শক্ত কন্ঠে বলল সিদ্রা। খালার দিকে তাকাল ও, “আপনাকে আমি যেটা জিজ্ঞেস করেছি, সেটার উত্তর দেন খালা, প্লিজ। আর কেউ কি ভাবল আমার কিচ্ছু যায় আসেনা, আপনি শুধু আপনার কথা বলেন। চুপ করে থাকবেননা, প্লিজ খালা”
খালাকে দেখে মনে হল সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে, কি বলবে বুঝতে পারছেনা। একবার সিদ্রার দিকে আবার একবার লোকটার দিকে তাকাচ্ছে।
হা হা করে হেসে উঠল লোকটা। “পেয়েছিস উত্তর? তুই কি ভেবেছিলি, একমাসের মধ্যে বিশ বছরের ভালবাসাকে মিথ্যে করে দিবি? নিজের সন্তানের মত ভালবাসে খালা আমাদের। সেই সন্তানের খুনিকে খালা বিশ্বাস করবে, তুই ভাবলি কি করে?” কয়েক কদম হেঁটে সিদ্রার কাছে আসল লোকটা। পেছাল সিদ্রা, গাছের সাথে ধাক্কা খেল।
হঠাৎ কি যেন মনে পড়ল লোকটার, “আর কি যেন বলছিলি, হাফেজা, মাদ্রাসায় পড়া, ব্লা ব্লা ব্লা! তোর ওপর আমার এত রাগের এটাও একটা কারণ। বাবা মার পয়সাগুলো জাস্ট নষ্ট করেছিস। একটা গিরগিটি তৈরি হয়েছিস তুই। সবাই তোকে জানে দুধে ধোয়া তুলসী পাতা বলে আসলে তুই একটা মাকাল ফল। খারাপ মেয়েদের তো চেনা যায় রে, রাস্তায় দাঁড়ায় বলে কিন্তু তোর মত মুখোশধারীদের মানুষ কি করে চিনবে, তোরা তো ওদের থেকেও খারাপ”
সিদ্রা আর কন্ট্রোল করতে পারলো না নিজেকে, ঠাস করে একটা চড় মারল লোকটার গালে। রাগে চোখ দিয়ে যেন আগুন বেরোচ্ছে ওর।
“শয়তান্নি!” বলে চিৎকার দিয়ে সিদ্রার ঘাড় ধরে মাথাটা গাছের সাথে ঠুকে দিল লোকটা। দুচোখে অন্ধকার দেখল সিদ্রা, জ্ঞান হারাল ও। কিন্তু চোখ মেলল সম্পূর্ণ নতুন জায়গায়।