#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা পর্ব ২২

0
472

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা পর্ব ২২
-Farhina Jannat

২২.
খাবার টেবিলে বসে রাইয়্যান অবাক হয়ে গেল। মনে যা এসেছিলো তখন বলে দিয়েছে, কিন্তু মেয়েটা যে সত্যি সত্যি এসব রান্না করতে পারবে, এতটা আশা করেনি। এদিকওদিক তাকিয়ে সিদ্রাকে না দেখে ওর কথা খালাকে জিজ্ঞেস করল রাইয়্যান। খালা জানাল, ও গোসল করতে গেছে। মুখে লোকমা তুলতেই চমৎকৃত হয়ে গেল রাইয়্যান। এত ভাল রান্না বহুদিন খায়নি ও। খালার হাতের রান্না ভাল, কিন্তু আজকের রান্নাটা অনেকটা ওর মায়ের মত হয়েছে, যদিও পুরোপুরি নয়। ওদের মা রান্না করে খাওয়ানোর সুযোগ খুব বেশী পেতোনা, তাও মাঝেমাঝে যেটুকু করতো সেগুলোর স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে ওর।

ঢং এর কথা, রান্না পারিনা। মিথ্যুক একটা, মনে মনে বলল রাইয়্যান। এখন পর্যন্ত মেয়েটাকে কিছু না পারতে দেখিনি। পারিনা বললেও শেষমেশ ঠিকঠাক মতই করেছে সব কাজ। কাজ না করার জন্য মিথ্যে বলে, নাকি যা করে সেটা সিন্সিয়ারলি করে বলে ভাল হয়ে যায়, কোনটা?

“খালা, রান্না কি ওই মেয়ে করেছে?”

মাথা ঝাঁকাল খালা। জানাল, আপনি তো আমাকে সাহায্য করতে নিষেধ করেছিলেন, আমি তেমন কিছু করিনি। শুধু রান্নার যোগাড়গুলো করে দিয়েছি, নাহলে তো এত জলদি খাবার রেডি হতনা। কেন, বেশী খারাপ হয়েছে কি, জানতে চাইল খালা।

“আরে না, দারুণ হয়েছে। খেয়ে দেখ তুমি। দেখেছো, মেয়েটা কি পরিমাণ মিথ্যুক! বলে কিনা রান্না করতে পারিনা! তুমি তো ওর কথা খুব বিশ্বাস কর দেখি!”

সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে মাথা নিচের দিকে ঝুঁকিয়ে কান পেতে ছিল সিদ্রা। লোকটার কথা শুনে বিশেষ কায়দায় ডান হাত উপর নিচ করে ইয়েস! বলে উঠলো। জীবনের প্রথম এত কিছু রান্না করেছে, তাও আবার কোন রেসিপি ছাড়া। রান্নায় সময় তো আম্মুকে হেল্প করতো, দেখতো সবকিছুই, সেগুলোই মনে করে করে রেঁধেছে, এখন খেতে কেমন হয়েছে জানতে তো ইচ্ছে হবেই। প্রতিটা জিনিস কতবার করে যে চেখে দেখতে হয়েছে হিসাব নেই। কিন্তু ও সামনে থাকলে লোকটা সত্যি কথা জীবনেও বলবেনা বুঝেই গোসলের কথা বলে উপরে চলে এসেছে। উনি যখন বলেছে দারুণ হয়েছে, তার মানে আসলেই ভাল হয়েছে। খুশিমনে গোসল করতে ঢুকল সিদ্রা।

খেতে বসে নিজেও মুগ্ধ হয়ে গেল সিদ্রা, এত ভাল রান্না ও করেছে! দীর্ঘ একমাস পর এতগুলো আইটেম দিয়ে পেটপুরে ভাত খেল সিদ্রা। কৃতজ্ঞতা জানাল আল্লাহর দরবারে আর প্রার্থনা করল, ইয়া আল্লাহ, সমস্ত প্রশংসা তোমার জন্য। যেভাবে আমার পেটপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা তুমি করেছো, সেভাবে লোকটার ভুল ভাঙার আর আমাকে সসম্মানে মুক্তি পাবার ব্যবস্থাও করে দাও। তুমি তো সর্বশক্তিমান, অসীম দয়ালু আর উত্তম পরিকল্পনাকারী।

***
রাতে খাওয়ার পর টেবিল আর রান্নাঘর গুছিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে যাবে, পেছন থেকে লোকটা ডাকল সিদ্রাকে। ধুর! আবার কি, বিরক্ত হল সিদ্রা, অনিচ্ছাসত্ত্বেও ঘুরলো ও। লোকটা জিজ্ঞেস করল, “কফি বানাতে পারিস?”

মাথা ঝাঁকাল সিদ্রা। মনটা ভারী হয়ে গেল ওর। কফি! আমি নাই, মুনিরাকে কফি বানিয়ে দেওয়ারও কেউ নাই, ও কি নিজে নিজে কফি বানিয়ে খায়?

“যা, আমার জন্য কফি বানিয়ে আন, চিনি…….”

“১ চামচ, জানি আমি“ কথাটা শেষ করে রান্নাঘরের দিকে এগোল সিদ্রা, শুনতে পেল লোকটা বলছে, “খবরদার! প্রথমদিনের চায়ের দশা করলে কিন্তু কপালে দুঃখ আছে তোর”

ওইদিনের চা করার কথা মনে পড়তেই মুখে হাসি ফুটে উঠল সিদ্রার, কিন্তু পরের ঘটনা মনে পড়তেই হাসি মিলিয়ে গেল, রাগে শক্ত হয়ে উঠলো চেহারা। রাগের চোটে চা বানানোর ছোট হাতলওয়ালা সসপ্যানটা শব্দ করে ইন্ডাকশনের উপর রাখতে গিয়ে নিচেই পড়ে গেল।

শব্দতো হলই, রাতের নিরবতায় সেটা আরো প্রকটভাবে শোনা গেল। দৌড়ে এল রাইয়্যান রান্নাঘরে। দেখল সিদ্রা মগ থেকে পানি ঢালছে সসপ্যানের ভেতর।

“কি করছিস তুই?”

“আশ্চর্য, আপনিই না কফি বানাতে বললেন, এখন আবার জিজ্ঞেস করছেন কি করছি!” চোখ ঘুরিয়ে উত্তর দিল সিদ্রা।

“হ্যাঁ বলেছি, কিন্তু তার জন্য সসপ্যান আর ইন্ডাকশন কেন?”

“কেন? আপনি কি নরমাল পানিতে কফি চিনি গুলিয়ে খান?”

“ভেরি ফানি! তোরও যেমন বুদ্ধি!! কফি মেকার আছে কি জন্য?”

আড়চোখে কফি মেকারটার দিকে তাকাল সিদ্রা। “ও, আমি ওইটার ব্যবহার জানিনা। আমি যেভাবে জানি, সেভাবেই বানাচ্ছি” মগে কফি আর চিনি নিল সিদ্রা।

“আমি কফি মেকারের কফি ছাড়া খাইনা, খালা কই? তোকে শিখিয়ে দিবে কিভাবে কি করতে হয়”

“খালার মাথা ব্যথা, শুয়ে পড়েছে। আমি কালকে শিখে নিব। আপনি এভাবে খেলে খান, নাহলে আমি গেলাম” পানি দিয়ে কফি চিনি ফেটাচ্ছিল, সেটা থামিয়ে দিল সিদ্রা।

“আচ্ছা ঠিক আছে, আমিই দেখিয়ে দিচ্ছি। এত কঠিন কিছু না”

তারপর রাইয়্যান ওকে কফি মেকার দিয়ে এক মগ কফি বানিয়ে দেখিয়ে দিল। ধোঁয়া ওঠা মগটা হাতে নিয়ে বলল, “দেখলি, কত সহজ?”

এর মধ্যে সিদ্রাও শেষ করে ফেলেছিল ওরটা। কফির মগটা রাইয়্যানের দিকে ঠেলে দিয়ে বলল, “আমারটাই বেশি সহজ আর টেস্টিও। শুধু শুধু জিনিস মাখানো। পরিষ্কার তো আপনাকে করতে হয়না, হুহ!”

“বেশ! তোর বানানো কফি আমি খাবো, আর আমারটা তুই। অনেস্টলি বলতে হবে, কোনটা খেতে বেশি ভাল” টাশকি খেল সিদ্রা, রাতবিরাতে লোকটাকে ভুতে টুতে ধরলোনাতো!

“বুদ্ধি ভাল, কিন্তু আপনি অনেস্টলি বলবেন কিনা তাতে সন্দেহ আছে আমার। আর রাতে কফি খেলে আমার ঘুম হয়না। সো, দুইটাই আপনি খান আর নিজে বিচার করেন। এরপর যেভাবে বলবেন, সেভাবেই নাহয় বানিয়ে দিব, ওকে?” বলে হাতের সসপ্যানটা জায়গামত ঝুলিয়ে দিয়ে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে গেল সিদ্রা।

হা হয়ে গেল রাইয়্যান, এমন জবাব একেবারেই আশা করেনি। রেগেও গেল, আমার অনেস্টি নিয়ে প্রশ্ন তোলা, এতবড় সাহস! দ্রুতবেগে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল ও, “ওই, তোর সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি! আর এক পা এগোলে একদম ঠ্যাঙ ভেঙে দিব। তোর রাতে ঘুম হল কি হলনা তাতে আমার কি? চুপচাপ নিচে এসে কফি খাবি, উত্তর দিবি, তারপর তুই যেতে পারবি”

লোকটা যে ফাঁকাআওয়াজ দিচ্ছেনা, পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে ভালই জানা আছে ওর। ধীরপদে নিচে নেমে এল সিদ্রা। অনেকদিন পর কফির ঘ্রাণে বড্ড লোভ হচ্ছিল। কিন্তু এত রাতে একা একা লোকটার সাথে কফি খেতে ভরসা পাচ্ছিলনা বলেই ঘুম না হওয়ার অজুহাত দিয়েছিল ও।

কফিতে চুমুক দিয়ে তাজ্জব হয়ে গেল দুজনেই। সিদ্রা এর আগে কখনো কফি মেকার দিয়ে বানানো কফি খায়নি। কফিটাও বিদেশী ভাল ব্র‍্যান্ডের। তার ওপর এতদিন পরে খাচ্ছে, টেস্ট তো বেশি লাগবেই। আর রাইয়্যানও সবসময় এক টাইপের কফি খেয়ে অভ্যস্ত, চামচ দিয়ে ফেটিয়ে ফোম তোলা এই কফিও ওর কাছে কফি মেকারের কফির থেকে বেশি স্বাদের লাগল। দুজনেই চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে, অনেস্টলি বলতে গেলে তো নিজেই ফেঁসে যাবে।

হঠাৎ রাইয়্যান টেবিলের ওপরে রাখা ল্যাপটপটা সিদ্রার দিকে ঘুরিয়ে দিল। ওদিকে তাকাতেই খুশিতে চোখে পানি চলে এল সিদ্রার। মুনিরা! কতদিন পর বোনকে দেখছে ও, হোকনা নেকাব পরা ছবি! আগের পরের ছবিগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল সিদ্রা। বিভিন্ন সাইড এঙ্গেল থেকে তোলা ছবিগুলো, ওর অজান্তে তোলা হয়েছে। বেশভুষা দেখে বুঝতে পারল সিদ্রা, এগুলো ওর ভার্সিটি যাওয়ার বা আসার পথে তোলা হয়েছে, ছবির নিচে ডেটও দেখা যাচ্ছে, আজকের তোলা!

কিন্তু লোকটা হঠাৎ আমাকে মুনিরার ছবি দেখাচ্ছে কেন, অজানা আশঙ্কায় দুলে উঠলো সিদ্রার মন। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে রাইয়্যানের দিকে তাকাল সিদ্রা।

“তুই তো তোর বোনকে অনেক মিস করিস, তাই ছবিগুলো পাঠাতে বললাম আমার সেক্রেটারিকে” একটু যেন বাঁকা স্বরে বলল লোকটা।

“জাযাকাল্লাহ! জাযাকাল্লাহু খইরন!!” দুচোখভরা পানি নিয়ে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করল সিদ্রা।

“কি বললি ওটা?” বুঝতে পারেনি রাইয়্যান সিদ্রার কথা।

“আমি বললাম, আল্লাহ্‌ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন”

“কেন?” অবাক হল রাইয়্যান।

“আপনি আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন। কিন্তু আজকে এতদিন পর নিজের বোনকে দেখে অনেক খুশি হয়েছি। আর সেটা আপনার জন্য, তাই”

“থ্যাংকইউ বা ধন্যবাদ বললেই তো হয়ে যেতো”

“শুধু মুখে থ্যাংকইউ বা ধন্যবাদ বললে কি হয়? যাকে বলা হয় তার কি কোন উপকার হয়? বরং জাযাকাল্লাহু খইরন বলে আল্লাহর কাছে তার জন্য দোয়া করা হয়, সেটা কি বেশি ভাল না?”

এত অবাক হল রাইয়্যান, কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলনা ও। এখনো সিদ্রা চোখে পানি নিয়ে স্ক্রিনের উপর হাত বুলাচ্ছে, যেন আদর করছে বোনকে। মেয়েটার মুখের এই খুশিটা মুহূর্তের মধ্যেই কেড়ে নিতে মন সায় দিলনা রাইয়্যানের। যে কথা বলার জন্য এই ছবি তোলানো, সেটা কিছুতেই অনেক চেষ্টা করেও মুখে আনতে পারলোনা।

রাতে বিছানায় শুয়ে ভাবল সিদ্রা, বন্দীজীবনের সবথেকে অদ্ভুত দিন ছিল আজ। সারাদিন একের পর এক যা ঘটল, আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছিনা। এসব কি হচ্ছে আমার সাথে? এই লোকের ভাল ব্যবহারে তো আরো ভয় করছে আমার। বড় ঝড়ের পূর্বে সবকিছু শান্ত হয়ে যায়, এটাও তেমন কিছু নয়তো? হে আল্লাহ্‌, তুমি রক্ষা কর আমাকে। আনফরচুনেটলি, সিদ্রার ভয়টা অমূলক ছিলনা।

***
পরদিন দুপুরে আবার কলিংবেল বাজলো দরজায়। আগেরবারের মতই ছুটে গেল সিদ্রা, তবে নিশ্চিন্তে, ওকে আটকাবার কেউ নেই এখন, লোকটা বাইরে গেছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here