#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা পর্ব ৩৪

0
451

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা পর্ব ৩৪
-Farhina Jannat

৩৪.
মুনিরা ওপাশ থেকে কল কেটে দিলেও রাইয়্যান পুরো তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল, কয়েক মুহূর্ত যেন নড়তে চড়তে ভুলে গেল ও। কি মেয়েরে বাবা, এতো পুরা সিদ্রার অপজিট। হুম, চ্যাটের কথার ধরণের সাথে এই মেয়ের কথার হুবহু মিল পাওয়া যাচ্ছে, যার এক কণাও সিদ্রার সাথে পাওয়া যায়নি।

সিদ্রার জ্বর ভাল হওয়া আর খালাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে রাইয়্যান। তারপরেই আর দেরী করেনি, ফ্লাইট ধরে সোজা ঢাকায় চলে এসেছে। এবার সব রহস্যের জবাব নিয়ে তবেই ফিরবে ও। আর সবকিছুর চাবি রয়েছে ওই মুনিরার কাছে।

সেক্রেটারিকে দিয়ে মুনিরার ব্যাপারে সকল খবর নিয়েছে ও, কিভাবে চলাফেরা করে, কাদের সাথে মিশে সবকিছু, সাথে যোগাড় করেছে ওর ফোন নাম্বার। তাতেই ডায়াল করছে ও সকাল থেকে আর এইমাত্র কথা শেষ করল।

“মে আই কাম ইন স্যার?” সেক্রেটারির গলার আওয়াজ ভাবনার জগত থেকে ফিরিয়ে আনল রাইয়্যানকে।

“ইয়েস, কাম ইন” মুনিরার জুতার বাড়ির কথা শুনে শকড হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল রাইয়্যান, এখন বসল আবার।

সেক্রেটারি কাছে এসে বলল, “স্যার, একটা ইনফরমেশন দিতে ভুলে গিয়েছিলাম, আমার কাছে তেমন জরুরী মনে হয়নি, কিন্তু আপনার কাছে হতেও পারে”

“কি?”

“ওই মেয়ের একটা জমজ বোন আছে, প্রায় আড়াই মাস ধরে নিখোঁজ, নাম সিদ্রাতুল মুনতাহা”

“হুম জানি আমি, এক সেকেন্ড! কি বললা তুমি!?” উত্তেজনায় আবার চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেল রাইয়্যান, “জমজ বোন!? তুমি শিওর?”

“জ্বী স্যার, ওর ফ্যামিলি সম্পর্কেও খোঁজ নিয়েছি যদি আপনি জিজ্ঞেস করেন তাই। ওর বাবা……”

“আচ্ছা, ফাযিল কাকে বলে?”

“স্যরি স্যার!?” হতভম্ব দেখাল সেক্রেটারিকে।

“আরে, ওই যে মাদ্রাসার পড়ার লেভেল আছে না, ফাযিল টাযিল কি কি যেন। সেখানে ফাযিল কোনটা?”

“ও আচ্ছা, ওইটা অনার্স স্যার। দাখিল এসএসসি, আলিম এইচএসসি, ফাযিল অনার্স আর কামিল মাস্টার্স” গড়গড় করে বলে গেল সেক্রেটারি।

“শিট শিট শিট! অন্তত এটাও যদি জানা থাকতো আমার!” দুম করে টেবিলে একটা কিল বসাল রাইয়্যান। “মুনিরা অনার্স ফাস্ট ইয়ারে পড়ছে তাইনা?”

“জ্বী স্যার, ঢাকা ইউনিভারসিটিতে, ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট”

“শিট! আগে কেন আমি ওর ফ্যামিলি সম্পর্কে খোঁজ নিইনি, তাহলে তো অনেক আগেই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যেত”

“এনি প্রবলেম স্যার?”

“নো থ্যাংকস, তুমি এখন যেতে পারো”

“ওকে স্যার”

লেট মি বি ক্লিয়ারড ওয়ান বাই ওয়ান। বোরকা নেকাব পরলেও মুনিরা তুলনামূলক আধুনিক, ছেলে ফ্রেন্ড আছে, নিয়মিত ফেসবুক ব্যাবহার করে, এক্সট্রোভার্ট। তাহলে তো ফারহানের গার্লফ্রেন্ড হিসেবে এই মেয়েই যায়, সিদ্রা কোনভাবেই না। আর বোনকে বোনের থেকে বেশি আর কেউই চিনবেনা। মুনিরা যখন বলেছে সিদ্রা ফেসবুক ব্যবহারই করেনা, সেখানে ছয়মাস ধরে ফেসবুকে প্রেম করে গেল আর ওর চোখেই পড়লনা, এটা ইম্পসিবল! আর জেনে থাকলে বোনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা এমন অবস্থায় সেটা লুকানোর প্রশ্নই উঠেনা। তার মানে চ্যাটে সিদ্রার নাম দিয়ে নিজের ব্যাপারে যা কিছু বলেছে, সেগুলো সব আসলে মুনিরার ক্যারেক্টার, আর বোনের নামে যেটুকু বলেছে, সেগুলো আসলে সিদ্রার সম্পর্কে ছিল, আর আমি গাধা সেটা ধরতেও পারিনি! তার প্রমাণ তো পেয়েছিও আমি। “আমার ফেভারিট বিরিয়ানি আর আমার বোনের ফ্রাইড রাইস” এমনটাই লেখা ছিল চ্যাটে। কিন্তু ফ্রাইড রাইস দেখে সিদ্রার চোখ আনন্দে নেচে ওঠা আর জ্বরের মুখেও অতটা খেয়ে নেয়াই প্রমাণ করে ফ্রাইড রাইস ওর কতটা পছন্দের!

টেবিলে সজোরে একটা ঘুষি মারল রাইয়্যান। এত কেয়ারলেস আমি কিভাবে হলাম! মেয়েটার ফ্যামিলি সম্পর্কে খোঁজ না নিয়ে শুধু চ্যাটিং এর ইনফোর উপর ভিত্তি করে আমি ওকে কিডন্যাপ করে ফেললাম! হাউ কুড আই? অবশ্য তখন জানলেও বা কি হতো, তখন তো আর এসব মাথায় আসতোনা। কিন্তু পরে সিদ্রাকে দেখার এবং চেনার পর তো কনফিউশন ক্লিয়ার হয়ে যেতো, অন্তত এত দেরী তো হতোনা। যাক, যা হবার হয়ে গেছে, দেরীতে হলেও প্রকৃত সত্যটা জানা গেছে। আসল দোষী যে সিদ্রা নয় মুনিরা, এতে আর সন্দেহ নেই। এবার তোমাকে সিদ্রাকে মুক্তি দিতে হবে রাইয়্যান!

মুক্তি দিতে হবে!? বুকের বাঁ পাশটা যেন মুহূর্তের মধ্যে ফাঁকা হয়ে গেল ওর। মুক্তি দেয়া মানে তো সারাজীবনের মত হারিয়ে ফেলা! ওকে হারিয়ে ফেললে আমি কি নিয়ে বেঁচে থাকব?

ফারহানের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেয়াই তো ছিল এখন আমার জীবনের একমাত্র বেঁচে থাকার কারণ। তাহলে কি এখন সিদ্রাকে ছেড়ে দিয়ে মুনিরাকে তুলে নিয়ে যাব? নাহ! যে মেয়ে তার নিজের মায়ের পেটের বোনকে এভাবে ফাঁসাতে পারে, তাকে দেখতেও আমার রুচি হচ্ছেনা।

আর তাছাড়া এতে সিদ্রা অনেক কষ্ট পাবে, ও সবকিছু জেনেও চুপ করে ছিল নিশ্চয় ওর বোনকে সেফ রাখার জন্য। আমি ওকে এমনিতেই অনেক কষ্ট দিয়েছি, এটুক নাহয় আর না দিলাম। রইল বাকি আমার প্রতিশোধ, এই আড়াই মাসেই ক্লান্ত হয়ে গেছি আমি। সিদ্রাকে যত কষ্ট দিয়েছি, সব এখন আমার কাছেই বুমেরাং হয়ে ফিরে আসছে। ফারহান, ভাইরে, ক্ষমা করে দে ভাই, আমি পারলামনা তোর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে। কিন্তু, সিদ্রাকে ছেড়ে দিলে আমার কি থাকবে, আমার তো কেউ থাকবেনা।

আচ্ছা, আমি যে সত্যটা জেনে ফেলেছি, সেটা তো আর সিদ্রা জানেনা। ওকে যদি না বলি তাহলে? আমি যদি ওকে সত্যি সত্যি বিয়ে করে নিই? তাহলেই তো ও আর আমাকে ছেড়ে কোনদিন যেতে পারবেনা।

“কিন্তু খাঁচায় বন্দী পাখি নিয়েই বা তুমি কি করবে রাইয়্যান? সারাজীবনের জন্য ওর মুখের হাসি কেড়ে নিতে চাও তুমি?” ওর ভেতর থেকে কেউ একজন বলে উঠল।

“কেড়ে নিব কেন? আমার কি টাকার অভাব আছে নাকি? পৃথিবীর সমস্ত সুখ ওর পায়ের নিচে এনে দিব আমি, হাসি এমনিই ফুটবে” জবাব দিল রাইয়্যান।

“স্বাধীনতার থেকে বড় সুখ আর কিছু হয়না রাইয়্যান, সেটা বাদ দিয়ে যাই এনে দাও ওর মুখের হাসি তুমি ফেরাতে পারবেনা” সেই কন্ঠটা আবার বলে উঠল।

“কিন্তু ওকে ছাড়া আমি যে বেঁচে থাকতে পারব না” চেয়ার ছেড়ে নিচে অসহায়ের মত বসে পড়ল রাইয়্যান। ওর মনে হচ্ছে ও অথৈ সাগরে তলিয়ে যাচ্ছে, একটামাত্র কাঠের টুকরা বেঁচে থাকার অবলম্বন, সেটাও ভেসে যাচ্ছে দূরে, বহুদূরে।

***
বাগানের দোলনাটায় দোল খাচ্ছে সিদ্রা, কিন্তু মন ওর দোল খাওয়ায় নেই। সেদিনের কথা মন থেকে কিছুতেই ঝেড়ে ফেলতে পারছেনা ও। জ্বরের সময় প্রলাপ বকলেও পুরোপুরি বেহুঁশ তো আর ছিলনা। লোকটার চোখেমুখে ওর জন্য উদ্বেগ, জ্বর কমানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করা, সবই আবছা আবছা মনে পড়ছে, কিন্তু এসব তো বিশ্বাস করার মত নয়। এই লোক আমার জন্য এতকিছু করেছে, আমি স্বপ্ন দেখিনি তো? এমনটাই ভেবেছিল ও প্রথমে। কিন্তু স্বপ্ন যে দেখেনি তার সবথেকে বড় প্রমাণ হল ঘুম ভেঙে নিজের ঘরে নিজেকে আবিষ্কার করা।

মনের মধ্যে চলছে চরম দোটানা। লোকটা ওকে অত জ্বরের সময় সেবা করে বাঁচিয়ে তুলেছে বলে কৃতজ্ঞ হবে নাকি অচেতন অবস্থায় লোকটা ওকে কতটা বেপর্দা অবস্থায় দেখেছে সেটা নিয়ে রাগ হবে যেন ঠিক করতে পারছেনা।

অবশ্য রাতের বেলা গিয়ে খালার ঘরে শোয়ার জন্য লোকটাকে এত ঝামেলা পোহাতে হয়েছে, ওকে দরজা ভেঙে বের করতে হয়েছে, সেজন্য লোকটার ভয়ংকর একটা রিএকশন এর জন্য অপেক্ষা করছিল সিদ্রা, কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে কিছুই করেনি লোকটা। জাস্ট একবার জিজ্ঞেস করেছিল, ও কেন রাতের বেলা উঠে খালার ঘরে গিয়ে দরজা আটকেছিল। কোন উত্তর দেয়নি ও। কিভাবে বলতো, আপনার ভয়ে গিয়েছি! লোকটা অবশ্য আর জোরাজুরি করেনি, হয়ত অসুস্থ বলে ছেড়ে দিয়েছে, পরে কখনো আবার ধরবে।

কিন্তু কি করতো ও? সেদিন রাতে এত প্ল্যান পরিকল্পনার পরেও প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছিল ওর, কিন্তু এ ঘরের দরজা ভেতর থেকে আটকানো যায়না দেখে ঘুমাতে ভরসা পাচ্ছিলোনা। তাই খালার ঘরে গিয়ে শুয়েছিল। ভেবেছিল, ফজরের পর আবার চলে আসবে উপরে, লোকটা জানতেও পারবেনা। কিন্তু জ্বর এসে অজ্ঞান হয়ে গিয়ে যে সবকিছু ভজঘট হয়ে যাবে, ও স্বপ্নেও ভাবেনি।

শুধু কি এটুকুই? দুপুরে বুবুর বাসা থেকে আনা ভাত তরকারি খেতে পারছিলনা দেখে লোকটা স্যুপ বানিয়ে খাইয়েছে ওকে। আবার রাতের বেলা খালাকে দেখে আসার পথে বাইরে থেকে ফ্রাইড রাইস নিয়ে এসেছিল, যদিও মুখে স্বাদ ছিলনা, তবু প্রিয় খাবার বলে অনেকটা খেতে পেরেছে। কিন্তু লোকটা কিভাবে জানলো ফ্রাইড রাইস আমার প্রিয়? মুনিরা কি প্রিয় খাবারের কথাও নিজেরটা না বলে আমারটা বলে রেখেছে নাকি!

কিন্তু উনার মত মানুষ, যিনি কিনা আমাকে এত ঘৃণা করেন, তিনি আমার জন্য এতকিছু কেন করলেন? উনার ভেতরে একটা নরম মন আছে, যাতে আছে তার কাছের মানুষগুলোর জন্য অকৃত্রিম ভালবাসা, বুঝতে পারে সিদ্রা। শুধু কি কাছের মানুষ, চা বাগানের প্রত্যেকটা শ্রমিককে উনি কি পরিমাণ ভালবাসেন নিজের চোখে দেখেছে ও। এইতো সেদিন, এক শ্রমিকের ছেলে পাহাড় থেকে পড়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলল, উনি এমনভাবে ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছিলেন যেন উনার নিজের ছেলে। তারপর বুবুর কাছে শুনেছে, ছেলেটাকে নাকি উনি রক্তও দিয়েছেন। একই মানুষ, একদিকে একজনের জীবন বরবাদ করছে, অন্যদিকে আবার প্রাণপণে আরেকজনের জীবন বাঁচাচ্ছে। এমন দ্বৈতসত্ত্বা এর আগে কখনও দেখেনি সিদ্রা। অবশ্য এ ক্ষুদ্র জীবনে কয়টা মানুষকেই বা দেখেছি আমি! অসুস্থ অবস্থায় আমাকেও নিশ্চয় একটা মানুষ হিসেবেই দেখেছে, নিজের ভাইয়ের হত্যাকারী হিসেবে নয়, সেজন্যই করেছে অতকিছু, এর বেশি কিছু নয়।

খালা এসে জোরে একটা দোল দিতেই চিন্তার জাল ছিন্ন হল সিদ্রার। হাসিমুখে খালার দিকে তাকাল ও। খালা ইশারায় জিজ্ঞেস করল, বুবুর ওখানে যাবে কিনা। সম্মতি জানাল সিদ্রা, উঠে দাঁড়াল রেডি হওয়ার জন্য।

বুবুর বাংলোয় গিয়ে বিস্মিত হল সিদ্রা। কোন রোগী নেই, বুবু বাগানে বসে বসে বই পড়ছে।

“কি ব্যাপার বুবু? আজ তোমার ছুটি নাকি?” বুবুর পাশে বসতে বসতে বলল সিদ্রা।

“হ্যাঁ রে, আজ ওদের বাৎসরিক উৎসবের দিন, আজ কেউ ইমার্জেন্সি ছাড়া আসবেনা”

“তাহলে তো আজকে বুবুর গল্প শোনার পার্ফেক্ট সময়, কি বলো?”

“কিসের গল্প?”

“ভুলে গেলে তো? তুমি না বলেছিলা সময় করে বলবা”

“ও আচ্ছা, ওই কথা, অত বিশেষ কিছুনা। শুধু শুধু তোর মনটা খারাপ হয়ে যাবে”

“হলে হবে, তুমি বলো”

“আচ্ছা ঠিক আছে, আমি যে ভাইটুর আপন বোন না, এটা তো জানিস?” বই বন্ধ করে বলল বুবু।

“কি? আপন বোন না মানে?” টাশকি খেল সিদ্রা।

“এটাও বলেনি, অবশ্য বলবে কেন, ওরা তো আমাকে আপন ছাড়া পর ভাবেইনি কোনদিন” খুশির অশ্রু চিকচিক করে উঠলো বুবুর চোখের কোণে, “মানে তুই গল্প থেকেই বুঝে যাবি, শোন তাহলে” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গল্প শুরু করল বুবু।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here