#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা পর্ব ৩৭
-Farhina Jannat
৩৭.
বাইরে বেরোতেই মনটা ভালো হয়ে গেল সিদ্রার। কিছুক্ষণের জন্য এলোমেলো চিন্তাগুলো উড়াল দিল মাথা থেকে। আকাশটা একদম ঝকঝকে পরিষ্কার, মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। ঘুরতে যাওয়ার জন্য একদম পার্ফেক্ট ওয়েদার। ড্রাইভিং সিটের পাশের দরজাটা খুলে ধরল রাইয়্যান।
গাড়িতে উঠে বসতেই আবার ভাবনাগুলো ভীড় করল সিদ্রার মনে। জীবনের প্রথম আব্বু আম্মু অথবা বোনকে ছাড়া কোথাও ঘুরতে যাচ্ছি। যদিও জানিনা কোথায় যাচ্ছি কিংবা আদৌ ঘুরতে যাচ্ছি কিনা। কারণ এর পেছনে লোকটার যদি অন্য কোন উদ্দেশ্য থেকে তাহলে তো হয়েই গেল। ভয়ংকর কিছু হবেনা তো আজকে?
“সিটবেল্টটা বেঁধে নাও” রাইয়্যানের কথায় যখন সিদ্রা ভাবনার জগত থেকে ফিরে এল, ততক্ষণে গাড়ি টি এস্টেট ছেড়ে বড় রাস্তায় পড়েছে।
নাও! হঠাৎ করে তুমি বলছে কেন? মানুষের সামনে নাহয় বলে, কিন্তু এখন তো কেউ নেই, তাহলে?
“তুই করেই বলেন, গাড়ির ভেতর কেউ তো আর শুনতে আসছেনা, আপনার মান সম্মান যাবেনা” সিটবেল্ট লাগাতে লাগাতে বলল সিদ্রা।
“না, আজকের জন্য তুইতোকারি অফ” গাড়ি স্টার্ট দিল রাইয়্যান।
“কেন?” বিস্মিত কণ্ঠে বলল সিদ্রা।
“ঘুরতে গিয়ে বসগিরি দেখালে, ঘুরার কোন মজা থাকবেনা তাই। ধরে নে, আজকের জন্য আমরা…….বন্ধু?” ‘সত্যিকারের হাজবেন্ড ওয়াইফ’ বলতে ইচ্ছে করছিল রাইয়্যানের, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর সাহসে কুলোলনা, পাশাপাশিই বসে আছে, থাপ্পড় খেতে দেরী হবেনা।
অবাক হওয়ার সাথে হাসি পেল সিদ্রার, যদিও সেটা রাইয়্যান দেখতে পেলনা।
“ছেলে আর মেয়ের মধ্যে কখনও বন্ধুত্ব হয়না। আধুনিক সমাজ হয়তো বানিয়েছে, কিন্তু ইসলাম সেটা এলাউ করেনা”
“তাহলে রক্তের সম্পর্ক ছাড়া কি এক মানুষের সাথে অন্য মানুষের কোন সম্পর্ক থাকবেনা?”
“কেন থাকবেনা? ভাইবোনের সম্পর্ক থাকবে। হাদীসেই তো আছে এক মুসলমান আরেক মুসলমানের ভাই, মেয়ে হলে সেটা বোন হবে”
ভাইবোন! রাইয়্যানের মনে হল নাক বরাবর কেউ একটা বিশাল একটা ঘুষি মেরেছে, আরেকটু হলে বেখেয়াল হয়ে এক্সিডেন্ট করতে যাচ্ছিল, শেষ মুহূর্তে হার্ড ব্রেক কষে ফেলল।
“ইন্না-লিল্লাহ! থাক, ড্রাইভিং এর সময় আর কথা বইলেননা” হঠাৎ ব্রেক কষায় সামনে ঝুঁকে গিয়েছিল সিদ্রা, সিটবেল্ট না থাকলে মাথা ঠুকে এতক্ষণ ভয়াবহ কান্ড ঘটত, সোজা হয়ে বসে বলল কথাটা।
“সে তুমি যাই বলো, যাকে আমি মানুষের সামনে ওয়াইফ পরিচয় দিচ্ছি, তাকে আর যাই হোক বোন ভাবতে পারছিনা। আমি তোমাকে বন্ধু মনে করছি, তুমি কি ভাববে সেটা তোমার ব্যাপার”
সিদ্রাও কথাটা সরল মনে বলেছিল ঠিকই, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই লোককে ওও ঠিক ভাই ভাবতে পারছেনা, তাই আর কথা না বাড়িয়ে রাস্তার দিকে মন দিল।
অবশ্য রাস্তার যে অপরূপ দৃশ্য, মন না দিয়ে উপায় আছে? দুইপাশে চা বাগান, তার মাঝে আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলছে, দার্জিলিং এর স্মৃতি মনে পড়ে গেল সিদ্রার। তবে দার্জিলিং এর সাথে একটা বড় পার্থক্য আছে সিলেটের। ওইখানে ছিল সুবিশাল আর বিস্তৃত পাহাড়ের সারি, আর এখানে ঠিক পাহাড় না, বড় বড় টিলার সারি। কোন কোন টিলা শুধুই চা গাছে ভরা, আবার কোনটাতে মাঝে মাঝে বড় বড় গাছ দেখা যাচ্ছে। ওখানে রাস্তা ছিল পাহাড়ের গায়ে, কখনো ঘুরে ঘুরে আবার কখনো এঁকেবেঁকে উপরে উঠেছিলো ওরা। আর এখানে সমতল, হালকা উঁচুনিচু আছে, কিন্তু এতটা নোটিসেবল মনে হচ্ছেনা। রাস্তার পাশের সাইনগুলোতে শ্রীমঙ্গল লেখা দেখতে পেল সিদ্রা, বুঝতে পারল লোকটার চা বাগান শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত।
পাহাড়ি রাস্তাগুলো তো এমনিতেই অপূর্ব হয়। প্রতিটা বাঁক ঘুরতেই আল্লাহর সৃষ্টিজগতের বিশালতা আর মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্যে দম আটকে আসতে চায়, মুখ দিয়ে স্বগতই বেরিয়ে আসে সুবহানআল্লাহ! আর তার সাথে যদি যুক্ত হয় নিবিড় পরিপাটী চা গাছের সারি, তাহলে তো আর কোন কথাই থাকেনা। শুধু একটা কথাই মনে হয়, “এ পথ যদি না শেষ হয়!”
কিছুদূর যাওয়ার পর রাস্তার পাশে একটা হোটেলের সামনে নাস্তা করার জন্য গাড়ি দাঁড় করাল রাইয়্যান। পাঁচতলা একটা থ্রি স্টার হোটেলের নিচতলায় খাবার হোটেল বা রেস্টুরেন্ট। লোকজনে মোটামুটি ভরাই ছিল, তবু রাইয়্যান কোণার দিকের একটা টেবিল ম্যানেজ করে ফেলল। সিদ্রাকে একপাশের চেয়ার দেখিয়ে বলল,
“এপাশে বসো, তাহলে কম মানুষ তোমাকে দেখবে, কমফোর্টেবলি খেতে পারবা”
সিদ্রা অবাক হয়ে গেল, এই লোক তার পর্দার খেয়াল রাখবে অন্তত এটা ও স্বপ্নেও ভাবেনি। কেন ভাবোনি সিদ্রা? ভেতর থেকে কেউ একজন বলে উঠল, তুমি না বলতেই কি উনি তোমার পছন্দানুযায়ী পোষাক আর বোরকা কিনে আনেননি? আসলেই তো! ভাবল সিদ্রা, চেয়ারটা টেনে বসে পড়ল ও।
“কি খাবে?” জিজ্ঞেস করল রাইয়্যান।
“কিছু একটা খেলেই হল” জবাব দিল সিদ্রা। আমাকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে কি খাব, আমাকে? মনে মনে বিস্মিত না হয়ে পারলনা সিদ্রা।
“রুটি পরোটা খিঁচুড়ি, সব পাওয়া যায় এখানে”
“আপনার যেটা ইচ্ছা, আমার কোনটাতেই আপত্তি নেই”
“ওকে” পরোটার সাথে সবজি, ডাল, চিকেন কারি অর্ডার করল রাইয়্যান।
খাবার আসার আগেই সিদ্রা খেয়াল করে দেখছিল, পরোটা তো আর চামচ দিয়ে খাওয়া যাবেনা, হাতমোজা খুলে পরোটা খেলে কেউ দেখতে পাবে নাকি। নাহ! ডানদিকের লোকটা তাকালেই দেখতে পাবে। ইশ! বাইরে রুটি বা পরোটা খাওয়ার প্রয়োজন হলে আব্বু সবসময় কি সুন্দর করে মাঝে সবজি দিয়ে রোল করে দিত, টিস্যু দিয়ে ধরে আরামসে খেয়ে ফেলতাম। এখন কি করব? হুম্ম, কাঁটাচামচ দিয়ে চেষ্টা করে দেখতে হবে কি করা যায়।
কিন্তু ওকে আরেকদফা অবাক শুধু না, পুরো হতভম্ব করে দিল রাইয়্যান। খাবার দিয়ে গেলে সিদ্রার প্লেটটা টেনে নিল নিজের দিকে। দুইটা পরোটা উঠিয়ে ছুরি আর কাঁটাচামচ দিয়ে সুন্দর করে ছোট ছোট টুকরা করল। তারপর কাঁটাচামচ সহ প্লেটটা সিদ্রার দিকে এগিয়ে দিয়ে সবজির বাটিতে একটা বড় চামচ দিয়ে দিল।
“সবজি আর ডাল দিয়ে শুরু করো, আমি চিকেনটা রেডি করে দিচ্ছি” বলল রাইয়্যান।
এরপর চিকেন কারির বাটিটা নিয়েও হাড্ডিওয়ালা গোস্তগুলো থেকে হাড্ডি আলাদা করে ফেলে দিল, এবার সিদ্রা অনায়াসে শুধু চামচ দিয়ে খেতে পারবে। তারপর বাটিটা স্বস্থানে রেখে দিয়ে বলল,
“পরোটা কি আরেকটা কেটে দিব?”
সিদ্রা জাস্ট স্পিচলেস হয়ে রাইয়্যানের কাজগুলো দেখছিল। প্রশ্নটা শুনে সজোরে মাথা নাড়ল ও, কাঁটাচামচ টা হাতে নিল, শুধু চোখটা তুললনা। অপরিসীম আনন্দ আর কৃতজ্ঞতায় চোখে বেরিয়ে আসা অবাধ্য জলটুকু লোকটা দেখে ফেললে লজ্জার সীমা থাকবেনা।
“আচ্ছা, এ দুটো আগে খাও, পরে আরো লাগলে আমি আবার কেটে দিব, ঠিক আছে?”
“হুঁ” ছোট করে উত্তর দিল সিদ্রা।
কাঁটাচামচ দিয়ে পরোটা আর তার সাথে বড় চামচ দিয়ে সবজি, ডাল আর চিকেন মুখে দিচ্ছিল সিদ্রা, নির্ঝঞ্ঝাটে খেয়ে যাচ্ছিল ও। হঠাৎ এক লোক এসে রাইয়্যানের পিঠে জোরে একটা থাবা বসাল। প্রায় লাফিয়ে উঠল রাইয়্যান, তারপর দেখেই সাথে সাথে জড়িয়ে ধরল লোকটাকে।
“হোয়াট এ প্লেজান্ট সারপ্রাইজ! তুই এখানে? কিভাবে?” জিজ্ঞেস করল রাইয়্যান।
“ঘুরতে এসেছি দোস্ত, আমি তো ভেবেছি তুই ঢাকায়, এজন্য আর কল করিনি তোকে” উত্তর দিল নতুন লোকটা।
“কাম অন ইয়ার! ভাবাভাবি না করে কলটা করেই দেখতি!”
“আসলে……. সত্যি কথাটাই বলি। এসেছি শশুড়বাড়ির ফ্যামিলি নিয়ে, বিশাল ঝামেলা। তাই ইচ্ছে করেই আর তোকে ডিস্টার্ব করতে চাইনি”
“কিসের ডিস্টার্ব! কয়দিন আছিস বল?”
“আজকেই ব্যাক করছি রে”
“ও নো! এটা কিন্তু ঠিক করলিনা তুই”
“স্যরি দোস্ত, ইন শা আল্লাহ্ নেক্সট টাইম। বাট….. হু ইজ শি?”
“উপস! স্যরি, পরিচয় করিয়ে দিতে একদম মনে নাই, বকবক করে যাচ্ছি। ও হচ্ছে সিদ্রা, আমার ওয়াইফ, আর সিদ্রা, এ হচ্ছে আমার বন্ধু তমাল”
সিদ্রা কিছু না বলে শুধু মাথাটা একটু ঝুঁকাল, আর তমাল একটা ঘুষি মারল রাইয়্যানের পেটে।
“শালা, আমাদের না জানিয়ে কাম সেরে ফেললি! কেমনে করলি এটা?”
“আরে দোস্ত, হুট করে হয়ে গেছে। প্রোগ্রাম করিনি, সত্যি বলছি। কেউ ভালভাবে এখনও জানেইনা”
“সত্যি তো?…..” আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল তমাল, কিন্ত ফোনের রিংটোনে কথা আটকে গেল ওর।
“মরেছি! ইন্টারকমটা কাজ করছেনা দেখে আমি শশুর আব্বার জন্য চায়ের কথা বলতে এসে এখানে আটকে গেছি। ভাবী, নাইস টু মিট ইউ! দোস্ত, ভাবীকে নিয়ে বেড়াতে আসিস, তখন আলাপ করব। এখন আমি যাই, বুঝলি?”
“আচ্ছা, দৌড়া। নাইলে তোর কপালে দুঃখ আছে আজকে”
“তা যা বলেছিস, ওকে দোস্ত, টা টা”
তমাল চলে যেতেই চেয়ার বসে হাসল রাইয়্যান, “বউকে এত ভয় পাওয়ার কি আছে কে জানে!” আবার খাওয়া শুরু করল রাইয়্যান। লক্ষ্য করল সিদ্রা কোন রেসপন্স করছেনা।
এদিকে সিদ্রা মনে মনে ভাবছে, আলহামদুলিল্লাহ্! লোকটা চলে যাওয়ায় বড় বাঁচা বেঁচেছি! ওই লোকের ওয়াইফের সাথে পরিচয় করতে গেলে আবার একশো একটা মিথ্যে বলতে হতো।
“স্যরি, আমি নিজেই নিজের রুলস ভেঙেছি। বন্ধুর কথা বলে আবার ওয়াইফ পরিচয় দিয়েছি” সিদ্রার নিরবতা খেয়াল করে বলল রাইয়্যান।
“আপনি স্যরি কেন বলছেন। আপনি তো যা ইচ্ছা বলতে পারেন, আফটার অল আপনার রেপুটেশনের ব্যাপার!” চোখ নিচু করেই উত্তর দিল সিদ্রা।
“আজকেরটা কিন্তু আমার জন্য ছিলনা, ছিল তোমার জন্য”
“মানে?” অবাক হয়ে চোখ তুলল সিদ্রা।
“তুমিই না একটু আগে বললা, ইসলামে ছেলে আর মেয়ে বন্ধু হতে পারেনা। সেখানে আমি তোমাকে আমার বন্ধু বলে পরিচয় দিলে কি তোমার সম্মান থাকতো? তোমার মত মেয়ের কি ছেলে বন্ধুর সাথে সকাল সকাল রেস্টুরেন্ট এ বসে নাস্তা করা মানায়?”
সিদ্রা রাইয়্যানের কথায় এতই অবাক হল যে কি বলবে বুঝতে পারলনা। এমনকি, কোনটা বেশি অসম্মানের, বন্ধু বলা নাকি মিথ্যে ওয়াইফ পরিচয় দেয়া, সেটাও মাথায় ঢুকলনা ওর।
খাওয়া শেষ হতে হতে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো সিদ্রা, যা হবে হোক। আপাতত আল্লাহর উপর ভরসা করে আজেবাজে চিন্তাগুলো বাদ দিই। লোকটা আজ এ পর্যন্ত যে কাজগুলো করলো তার বিপরীতে এতোটুকু ট্রাস্ট সে ডিজার্ভ করে।
এরপর জার্নিটা হল সম্পূর্ণ নিরবে। সিদ্রা পুরোটা সময় রাস্তার অপরূপ শোভা দেখতে ব্যস্ত রইল, আর রাইয়্যান গাড়ি চালানোর ফাঁকে ফাঁকে সিদ্রাকে দেখতে।
প্রায় দেড় ঘন্টা পর ওরা পৌঁছল গন্তব্যে। সিদ্রা গাড়ি থেকে নেমে এদিক ওদিক তাকাতেই পেয়ে গেল কাঙ্ক্ষিত সাইনবোর্ডটা। “রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট”, খুশিতে সিদ্রার বুকটা লাফিয়ে উঠল। ওর এক ক্লাসমেট সিলেট বেড়িয়ে যাবার পর এত গল্প করেছিল আর এত অসাধারণ সব ছবি দেখিয়েছিল, তখন থেকেই সিলেট ঘুরার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল ও। আর সেখানে রাতারগুল জায়গাটা ওর সবথেকে ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছিল। লোকটাকে ওর বিশাল একটা থ্যাংকস দিতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু খুশিটা নিজের মাঝেই চেপে রাখল সিদ্রা।
রাইয়্যান গাড়ি পার্ক করে পাশে এসে বলল, “চলো”
বেশ খানিকটা হেঁটে ওরা ঘাটে এসে পৌঁছল। বুড়া মত একটা লোক রাইয়্যানকে দেখে প্রায় দৌড়ে এল, মুখটা খুশিতে জ্বলজ্বল করছে। লোকটা এসে হড়বড় করে সিলেটী ভাষায় কি যে বলতে লাগল, বুঝতে পারলনা সিদ্রা। ওমা, ইনিও দেখি সিলেটী ভাষায় দিব্যি কথা বলছে। সিদ্রা একটু দূরে দাঁড়িয়ে আশেপাশের মানুষজনকে লক্ষ্য করছিলো, অনেকেই নৌকা ঠিক করছে ভ্রমণের জন্য। কয়েকটা মেয়েকে দেখল সিদ্রা, রাইয়্যানের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছে আর একে অন্যকে গুঁতোগুঁতি করছে। এবার রাইয়্যানের দিকে ভাল করে তাকাল ও। জিন্সের প্যান্ট, নেভি ব্লু রঙের টিশার্ট আর চোখে সানগ্লাস, পেছনে আবার একটা ব্যাকপ্যাকও নিয়েছে, সব মিলিয়ে রাইয়্যানকে দারুণ হ্যান্ডসাম লাগছিল। বুঝেছি, মহাশয়ারা ক্রাশ খেয়েছেন! দিনেরাতে নির্ঘাত কয়েকশো মেয়ে উনাকে দেখে ক্রাশ খায়, ভাবল সিদ্রা। খেলেই বা, তাতে আমার কি!
এসময় রাইয়্যান ইশারায় ওকে কাছে ডাকল। যথারীতি লোকটার সাথে ওকে নিজের ওয়াইফ বলে পরিচয় করিয়ে দিল রাইয়্যান। লোকটা ওকে সালাম দিল আর সাথে আরও কি কি যেন বলতে লাগল। কিন্তু সিদ্রা সেদিকে খেয়াল না করে ওই মেয়েগুলোর ফুটো বেলুনের মত চুপসে যাওয়া মুখগুলো দেখে মুচকি হাসল। আর মনে মনে বলল, উনি কি ঘুরতে এসেছেন নাকি আমার মিথ্যে পরিচয় এর মাইকিং করতে এসেছেন!
স্যরি সিদ্রা, আরও একটা দিন তোমাকে এই মিথ্যে পরিচয় বহন করানোর জন্য। কথা দিচ্ছি, কালকে থেকে তোমাকে আর মিথ্যে পরিচয় বহন করতে হবেনা, মনে মনে বলল রাইয়্যান।
মুখে বলল, “চলো, নৌকায় ওঠা যাক”
আরেকটু হেঁটে নৌকার কাছে পৌঁছল ওরা। নৌকায় ওঠার সময় রাইয়্যান হাত বাড়িয়ে হেল্প করতে চাইল, কিন্তু সিদ্রা হাত না ধরে একাই উঠতে গেল। নৌকায় উঠার অভ্যেস কি আর ওর আছে, হাত দিয়ে বোরকা ধরে দোদুল্যমান নৌকায় পা রাখতেই ভারসাম্য হারাল, সাথে সাথে ধরে ফেলল রাইয়্যান। ধমক খাওয়ার জন্য কান পেতে ছিল সিদ্রা, কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে কিছুই বললনা রাইয়্যান।
উলটো হাসিমুখে সিদ্রাকে নৌকার এক মাথায় বসতে বলল আর ব্যাকপ্যাকটা মাঝখানে রেখে আরেক মাথায় বৈঠা হাতে নিজে বসে পড়ল। চোখ কপালে তুলল সিদ্রা, “আপনি নৌকা বাইবেন নাকি?”
“হুম, কেন? মনে হয়না যে আমি নৌকা বাইতে পারবো?”
“না, মানে…….” চুপ করে গেল সিদ্রা। শুধু ওরা দুইজন একাকী এই বনের ভেতর ঢুকবে ভেবে আবার অস্বস্তি হচ্ছে ওর, কিন্তু সেটা তো আর বলতে পারছেনা।
“চিন্তা করোনা, অনেক বছরের অভিজ্ঞতা, তোমাকে ডুবিয়ে মারবনা। ফারহান আর আমি বছরে অন্তত দুতিনবার মামার নৌকা ভাড়া নিয়ে ঘুরতাম, মাঝেমধ্যে বুবুও আসতো। সেজন্যই এত চেনা, অনেক ভালবাসে আমাদের। ফারহান গুহামানব, মানে ঘরবন্দী হয়ে থাকতে পছন্দ করতো ঠিকই কিন্তু আমার সাথে ঘুরতেও অনেক ভালবাসত। সময় পেলেই ঘুরতে বের হতাম আমরা”
উনি ফারহানের কথা আমার সাথে এত স্বাভাবিক ভাবে বলছেন! আমাকে দেখলেই না উনার মনে পড়ে আমি উনার ভাইকে খুন করেছি, তাহলে আজ কোন রিএকশন ছাড়া স্মৃতিচারণ করছেন! হাউ ইজ দিস পসিবল? ভেবে পেলনা সিদ্রা।
“আরে, আমার দিকে না তাকিয়ে যে জায়গা দেখাতে এনেছি, সেদিকে তাকাও”
আরে তাইতো, কি গাধা আমি! এত সুন্দর দৃশ্য, আর আমি না দেখে কিসব ভেবে চলেছি। ওইতো সামনে জলাবন দেখা যাচ্ছে, আস্তে আস্তে সেদিকে এগোচ্ছে নৌকা।