#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা পর্ব ৩৮

0
421

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা পর্ব ৩৮
-Farhina Jannat

৩৮.
বনের ভেতর ঢোকার পর মুগ্ধ দৃষ্টিতে ডানে বাঁয়ে তাকাতে লাগল সিদ্রা। বড় বড় গাছ পানির মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, আর সেই গাছগুলোর মাঝ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে নৌকা। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো পড়ছে নিচের পানিতে, আলোছায়ার খেলা চলছে যেন। সেই সাথে বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ পরিবেশে যোগ করছে এক নতুন মাত্রা। মনে মনে ক্ষণে ক্ষণে সিদ্রা উচ্চারণ করতে থাকল মহান প্রভুর প্রশংসাবাণী।

পরিবেশটাকে আরও একটু বেশি উপভোগ্য করতেই যেন হালকা গলায় গান ধরল রাইয়্যান, আর সেই সুরের মূর্ছনা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে।

“জিসে জিন্দেগী ধুঁড় রাহি হ্যায়, কেয়া ইয়ে য়ো মাক্বাম মেরা হ্যায়
ইয়াহা চ্যায়ান সে বাস রুক যাউঁ, কিউঁ দিল ইয়ে মুঝে কেহতা হ্যায়
যাজবাত নায়ে সে মিলে হ্যায়, যানে কেয়া আসার ইয়ে হুয়া হ্যায়
এক আস মিলি ফির মুঝকো, জো কুবুল কিসি নে কিয়া হ্যায়
হাঁ………
কিসি শায়ের কি গাজাল, যো দে রুহ কো সুকুঁ কে পাল
কোয়ি মুঝকো য়্যুঁ মিলা হ্যায়, য্যায়সে বানজারে কো ঘার
হুম…….
য্যায়সে কোই কিনারা, দেতা হো সাহারা, মুঝে য়ো মিলা কিসি মোড় পার
কোয়ি রাত কা তারা, কারতা হো উজালা, ওয়্যাসে হি রশন কারে য়ো শেহের

দারদ মেরা য়ো ভুলা হি গায়া, কুছ এ্যাসা আসার হুয়া
জীনা মুঝে ফিরসে য়ো সিখা রাহা
হুম……
য্যায়সে বারিশ কার দে তার, ইয়া মারহাম দারদ পার
কোই মুঝকো য়্যুঁ মিলা হ্যায়, য্যায়সে বানজারে কো ঘার

মুসকাতা ইয়ে চেহরা, দেতা হে যো পেহরা, যানে ছুপাতা কেয়া দিল কা সামান্দার
অউরো কো তো হার দাম সায়া দেতা হ্যায়, য়ো ধুপ মে হ্যায় খাড়া খুদ মাগার

চোট লাগি হ্যায় উসে ফির কিয়্যুঁ মেহসুস মুঝে হো রাহা
দিল তু বাতা দে কেয়া হ্যায় ইরাদা তেরা

মে পারিন্দা বেসাবার, থা উড়া জো দারবাদার
কোয়ি মুঝকো য়্যুঁ মিলা হ্যায়, য্যায়সে বানজারে কো ঘার…..”

প্রথমে আস্তে আস্তে শুরু করলেও পরে গলা ছেড়ে দিয়েছিল রাইয়্যান। মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছিল সিদ্রা। এত সুন্দর গলা উনার, মা শা আল্লাহ্‌! একদম অন্তরে গিয়ে ধাক্কা মারছে যেন। লোকটা যে বেশ বড়সড় মাপের বিজনেসম্যান সেতো বোঝাই যায়, সেই উনি কিনা নৌকা বাইছে, গান গাইছে, আরো না জানি কত কি পারে! একটা মানুষের মধ্যে এত প্রতিভা থাকে! গান শুনতে শুনতে এসবই ভাবছিল সিদ্রা। তাই গান শেষ হয়ে গেলেও তন্ময়তা ভাঙলনা ওর। নিশ্চুপ বসে রইল, যেন নড়লেই রেশটা কেটে যাবে।

রাইয়্যান সারাটাক্ষণ সিদ্রার দিকে তাকিয়ে ছিল। অন্তরে তো ধাক্কা মারবেই, কারণ গানের প্রতিটা শব্দ, প্রতিটা বাক্য যে ওরই মনের কথা ব্যক্ত করছে! সিদ্রা ওর দিকে তাকায়নি বলে লক্ষ্য করেনি ব্যাপারটা। কিন্তু রাইয়্যান ওর চোখের অভিব্যক্তি দেখে বুঝতে পারছিল যে ওর ভাল লাগছে। হঠাৎ নৌকাটা জোরে দুলে উঠতেই সিদ্রা এমনভাবে নড়ে উঠল যেন কেউ ওর ঘুম ভাঙাল।

একটা গাছের সাথে নৌকা লাগিয়েছে রাইয়্যান। সেই গাছে উঠতে বলল ও সিদ্রাকে। প্রথমে না না করলেও পরে মজা পেয়ে গেল সিদ্রা। বাচ্চা মেয়ের মত খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠল, “কি মজা, আমি গাছে উঠেছি”। গাছটা বেশ বড়, মোটা মোটা শাখা প্রশাখা ছড়ানো। উঠার পরে ও নিজেই ওগুলো ধরে ধরে এগুতে লাগল উপরের দিকে।

রাইয়্যান ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করল। খেতে খেতে দেখল, সিদ্রা তৃষ্ণার্ত নয়নে ওর পানি খাওয়া দেখছে। নিজের খাওয়া শেষে বোতলটা সিদ্রার দিকে এগিয়ে দিল ও।

খানিক পরে আবার চলতে শুরু করল ওরা। মাঝেমাঝেই অন্যান্য নৌকা পাশ কাটাচ্ছে ওদের। কেউ ছবি তুলতে ব্যস্ত, কেউ আবার গান গাইছে। একটা কাপলকে দেখা গেল গাছের ওপর উঠে নানারকম অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি করে সেলফি তুলছে, দেখে হাসি পেল সিদ্রার। কিন্তু ওদের চোখেমুখে যে সুখ আর পরিতৃপ্তির হাসি লেগে আছে, তা দেখে বুকের ভেতরটা চিনিচিন করে উঠল ওর। কত স্বপ্ন ছিল বিয়ে নিয়ে, বিয়ের পর ঘুরতে যাওয়া নিয়ে, সেসব হয়তো আর পূরণ হবে না। আজ এই লোকের যায়গায় যদি ওর সত্যিকারের হাজবেন্ড থাকতো, ভ্রমণটা কত আনন্দেরই না হতো! দীর্ঘশ্বাস ফেলল সিদ্রা।

কিছুদূর যাওয়ার পর যেন হঠাৎ করে বন থেকে একটা ফাঁকা যায়গায় বেরিয়ে এলো নৌকা। সেই ফাঁকা যায়গার মাঝে একটা ওয়াচ টাওয়ার। ওয়াচ টাওয়ারের আশেপাশে অনেকগুলো নৌকা আর প্রচুর মানুষ ওয়াচ টাওয়ারে উঠেছে। এত মানুষ দেখে সিদ্রার আগেই বিরক্তি লেগে গেল, “আমি কিন্তু ওইটার উপরে উঠবনা”

“কেন? বনের সবথেকে সুন্দর ভিউ তো ওপর থেকেই পাওয়া যায়” অবাক হল রাইয়্যান।

“কিন্তু এত মানুষ…..”

“নো টেনশন। ভীড় বেশিক্ষণ থাকবেনা, কেউ তো আর এখানে থাকতে আসেনি, আমরা বরং অপেক্ষা করি” এই বলে রাইয়্যান আস্তে আস্তে ওয়াচ টাওয়ারের চারিধার দিয়ে কয়েকবার চক্কর লাগাল। আসলেই, দশ মিনিটের মধ্যেই দুইটা বাদে বাকি সবগুলো নৌকা চলে গেল। সিদ্রা বলল, “এখন যাওয়া যেতে পারে”

উপরে উঠে মনে মনে স্বীকার করল ও, না আসলে বিশাল মিস করত। পুরো বনটাই উপর থেকে দেখা যাচ্ছে, অসম্ভব সুন্দর লাগছে দেখতে। নিচে একরকম সুন্দর লাগছিল আর এখন আরেক রকম, অনেকটা পাহাড় চূড়ায় উঠে নিচে তাকানোর মত ব্যাপার, বিশ্বাস হচ্ছেনা একটু আগে ওই সুন্দর জায়গার ভেতর দিয়েই এসেছে, একেবারে অন্যরকম একটা অনুভূতি।

ওয়াচ টাওয়ার দেখা শেষে আবার বনের মধ্যে ঢুকল ওরা। সিদ্রার খুব মায়া লাগছিল রাইয়্যানের জন্য, লোকটা এতক্ষণ ধরে নৌকা বাইছে, হাত টাত তো ব্যাথা হয়ে যাওয়ার কথা। হঠাৎ রাইয়্যান ব্যাগ খুলে একটা চিপস এর প্যাকেট ছুড়ে দিল সিদ্রার দিকে।

“চলবে তো?” ভ্রু নাচাল রাইয়্যান।

“হুঁ, আপনি খাবেননা?” চিপস এর প্যাকেট খুলতে খুলতে জানতে চাইল সিদ্রা।

“না, আমার এত পছন্দ না, তোমাদের বয়সের ছেলেমেয়েরা বেশি পছন্দ করে এসব। ফারহান তো চিপস বলতে ক্রেজি ছিল। ঘুরতে গেলে ওর পুরো ব্যাগ ভর্তি শুধু চিপসই থাকত”

আবার! আবার উনি ফারহানের নাম এতো ক্যাজুয়ালি নিচ্ছেন! আমার তো আবার একটু একটু ভয় করছে, সত্যি উনি আমাকে এখানে ডুবিয়ে মারতে আনেননি তো!?

কিন্তু একটু পরেই রাইয়্যান আবার গুনগুনিয়ে উঠলে সিদ্রার সব দুশ্চিন্তা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। সব চিন্তা বাদ দিয়ে চিপস খেতে খেতে গান আর প্রকৃতির দিকে মনোনিবেশ করল ও। এবার রাইয়্যান গাইল,

“তুম মেরে হো, ইস পাল মেরে হো
কাল শায়েদ ইয়ে আলাম না রাহে
কুছ এ্যয়সা হো তুম তুম না রাহো
কুছ এ্যয়সা হো হাম হাম না রাহে
ইয়ে রাস্তে আলাগ হো যায়ে
চালতে চালতে হাম খো যায়ে……
মে ফির ভি তুমকো চাহুঙ্গা
ইস চাহাত মে মার যাউঙ্গা…….” হঠাৎ থেমে গিয়ে আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল রাইয়্যান, আবার গাইলো,
“মে ফির ভি তুমকো চাহুঙ্গা
ইস চাহাত মে হি জিলুঙ্গা…..”
বেদনাময় একটা হাসি ফুটে উঠল রাইয়্যানের ঠোঁটের কোণে, লক্ষ্য করল সিদ্রা। উনি মনে হয় গানটা ভুল গেয়েছিলেন, কিন্তু এতে কষ্ট পাওয়ার কি হল? এরপর বাকি গানটা গেয়ে গেল রাইয়্যান আর সিদ্রা আগের মতই তন্ময় হয়ে শুনতে লাগল।

“এ্যায়সে জারুরী হো মুঝকো তুম, য্যায়সে হাওয়ায়ে সাঁসোকো
এ্যায়সে তালাশুঁ মে তুমকো, য্যায়সে কি প্যায়র জামিনোকো…..
হাসনা…. ইয়া রোনা হো মুঝে, পাগাল সা ধুঁড়ুঁ মে তুমহে
কাল মুঝসে মুহাব্বাত হো না হো, কাল মুঝকো ইজাজাত হো না হো
টুটে দিল কে টুকরে লেকার তেরে দার পার হি রেহ জাউঙ্গা……”

এ পর্যায়ে লোকটার গলা সামান্য কেঁপে গেল মনে হল সিদ্রার, সাথে সাথে তাকাল ও রাইয়্যানের দিকে। আরে, লোকটার চোখের কোণে পানি মনে হচ্ছেনা, চোখদুটোও লাল হয়ে গেছে। উনি হঠাৎ এত ইমোশনাল হয়ে গেলেন কেন?

রাইয়্যান তখনো গেয়ে যাচ্ছে,
“মে ফির ভি তুমকো চাহুঙ্গা, ইস চাহাত মে হি জিলুঙ্গা…….”

এরপর আর পুরোপুরি দৃশ্যের দিকে মনযোগ দিতে পারলনা সিদ্রা, একটু পর পর রাইয়্যানের দিকে তাকিয়ে ওর অভিব্যক্তি খেয়াল করতে লাগল। এবারের গানটার সুর কেমন যেন বিষন্নতার, বুকের কোথায় একটা যেন কাঁটার মত বিঁধছে। ফাইনালি,
“লেকিন যাব ইয়াদ কারোগে তুম, মে বানকে হাওয়া আজাউঙ্গা……” বলার সময় রাইয়্যানের ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটে উঠতে দেখল সিদ্রা, খুশি হল ও। আনমনা হয়ে পানিতে হাত দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু রাইয়্যান গান থামিয়ে চেঁচিয়ে উঠল,
“সাবধান! জোঁক আছে কিন্তু!”

“জোঁক!” সিদ্রা ভয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল, আর সাথে সাথে নৌকা ভয়ানকভাবে দুলে উঠল। তড়িৎ গতিতে রাইয়্যান দুহাত দুপাশে দিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করে কোনমতে নৌকাটা উলটে যাওয়া থেকে বাঁচাল। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বসে গেল সিদ্রা, রাইয়্যানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“স্যরি, আমি সাপ-জোঁক এসব অনেক ভয় পাই, তাই খুব চমকে গিয়েছিলাম”

“এতে স্যরি বলার কি আছে। প্রত্যেক মানুষই কিছু না কিছু ভয় পায়”

“নৌকা উলটে গেলে তো বিপদ হয়ে যেত!” ভীত কন্ঠে বলল সিদ্রা।

“কি আর হতো, আমি কি সাঁতার জানিনা? দুজনে ঠিক একটা গাছে উঠে পড়তাম, কত নৌকা যাচ্ছে দেখছোনা, কোন একটা আমাদের উঠিয়ে নিতো, সিম্পল!” হাসল রাইয়্যান।

লোকটা আগে আমার কাজকর্মে এত বিরক্ত হত, কিন্তু ইদানীং প্রায় কিছুই বলছেনা। আরেকটু হলে কতবড় ঝামেলা বাঁধিয়ে ফেলতাম, অথচ না বকে উল্টে আমাকেই সান্ত্বনা দিচ্ছে! না ভেবে পারলনা সিদ্রা।

এদিকে বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়েছে অনেকক্ষণ। রাইয়্যান তো এতক্ষণ নৌকা বেয়েছে, তার আগে আবার এতটা পথ ড্রাইভ করে এসেছে, ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করে উঠল ওর। সিদ্রার দিকে তাকিয়ে বলল, “ইঁদুর কি শুধু আমার পেটেই ডাকছে নাকি আর কারও পেটেও ডাকছে?”

সিদ্রা তখনও ভয় কাটিয়ে উঠতে পারেনি, কোন উত্তর দিল না।

“যদি ডেকে থাকে, তাহলে মাঝখানে আসো, সাবধানে” বলে নৌকা আবার একটা গাছের নিচে ভেড়াল রাইয়্যান। তারপর ব্যাগ খুলে একটা টিফিন ক্যারিয়ার বের করে খাবার সাজাতে লাগল ও।

সিদ্রাও ততক্ষণে মাঝে চলে এসেছে, টিফিন ক্যারিয়ারের ঢাকনা খুলতেই খিচুড়ির সুস্বাদু গন্ধে পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল ওর। ঠিকঠাক হয়ে বসার পর রাইয়্যান ওর হাতে টিফিন ক্যারিয়ারের একটা বাটি আর একটা চামচ ধরিয়ে দিল। বাটির দিকে তাকিয়ে চোখ কপালে উঠল সিদ্রার।

“ওয়াও! খিঁচুড়ি, গোস্ত ভুনা, ডিম ভাজি! এতকিছু কিভাবে?”

“খালাকে কালকে রাতে বলে দিয়েছিলাম”

“ইশ! খালা রাতেরবেলা একা একা কত কষ্ট করেছে, আমাকে বলেননি কেন?” মন খারাপ হল সিদ্রার।

“বললে তো আর সারপ্রাইজ হতনা! আর খালা একটু খেটেছে ঠিকই, কিন্তু সেটা না করলে এই যে গাছের ছায়ায় নৌকার ওপর বসে এত সুন্দর একটা লাঞ্চ করার এক্সপেরিয়েন্স হত কি?”

“হুম, তা অবশ্য ঠিক” খাওয়া শুরু করল সিদ্রা। এই লোক ওকে সারপ্রাইজ দিচ্ছে, এও সম্ভব!

খিদে ভালই পেয়েছিল, গপগপ করে খেয়ে যাচ্ছিল সিদ্রা। আর রাইয়্যান, খাওয়ার থেকে বেশি মনযোগ দিয়ে তাকিয়ে রইল সিদ্রার দিকে। খাওয়া শেষে রাইয়্যান বলল,
“আমরা এখানে একটু রেস্ট নিয়ে তারপর আবার যাত্রা শুরু করব, কেমন?”

মাথা নেড়ে সায় দিল সিদ্রা, একটু পরে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা আমরা এখান থেকে ফিরব কখন?”

“এইতো, এবার আমরা ফিরতি পথে রওনা দিব, কেন?”

“যোহরের নামাজটা পড়তে হবে……”

“ও আচ্ছা, আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি, ওয়েট” বলে আবার বৈঠাটা হাতে তুলে নিল রাইয়্যান। সামনে আরেকটু এগিয়ে পাশাপাশি দুটো গাছের মাঝে নৌকা ঢুকিয়ে দিল ও। তারপর সিদ্রাকে বুঝিয়ে দিল,
“গাছদুটোর মাঝ বরাবর বসে পড়ো, ওইদিক পশ্চিম, উল্টোদিক দেখাল রাইয়্যান”

তারপর সিদ্রা কিছু বলার আগেই নিজে থেকেই উঠে সিদ্রাকে পেছন করে বসে পড়ল আর ব্যাগ থেকে একটা ছোট টাওয়েল বের করে এগিয়ে দিলো ওর দিকে। খুশি হল সিদ্রা, নামাজ পড়তে বসে সেই খুশি বেড়ে গেল বহুগুণে।

রাইয়্যানের দেখিয়ে দেয়া দিকে মুখ করে বসে ইশারায় নামাজ পড়ে ফেলল সিদ্রা। নামাজ শেষে মুখ ঘুরিয়ে রাইয়্যানের দিকে তাকাল ও। এখনও একইভাবে বসে আছে লোকটা, মোবাইলে কিছু একটা করছে। লোকটার প্রতি অসম্ভব শ্রদ্ধায় মনটা ভরে উঠছে ওর। নামাজ পড়তে গিয়েই বুঝেছে, লোকটা কেন এমন জায়গায় নৌকাটা রেখেছে। অন্য নৌকাগুলো যেদিক দিয়েই যাক, দুইপাশে গাছ আর পেছনে লোকটা বসে থাকার কারণে ও আড়ালে থাকবে। সামনের দিকটাও এমন, নৌকা যাওয়ার উপায় নেই, নেকাব খুলে নামাজ পড়ল ও, কোন সমস্যাই হলনা। যদিও পাব্লিক প্লেসে উপায় না থাকলে নেকাব পরেই নামাজ পড়া যায়, তবু উনি যে এতটা ভেবেছেন সেটাই তো অবাক করার মতো!

রাইয়্যানের আজকের ব্যবহার সিদ্রার ভাবনার দুয়ার যেন খুলে দিল, চিন্তার ধারা অন্যদিকে বইতে লাগল ওর মনে। নকল স্ত্রী বা বন্ধু যাই মনে করুন, তাতেই যদি উনি এতো কেয়ার করেন, সম্মান করেন, সুবিধা অসুবিধার এত সুন্দর করে খেয়াল রাখেন, তাহলে নিজের স্ত্রীর জন্য উনি কি আরো বেশি করবেননা? আমি তো এমন কাউকেই চেয়েছিলাম, যে আমার ঈমান আমলের হেফাজত করবে। বাকি রইল উনার ভেতরে মুসলমানের কোন চিহ্ন না থাকা। খালা যদি সবকিছু জানার পরেও আমাকে ভালবেসে, আমার থেকে নামাজ শিখতে পারে, বাইরে যাওয়ার সময় বড় ওড়না পরা শুরু করতে পারে, তাহলে আমি কি উনাকে বদলাতে পারবনা? আবার কখনও বিয়ের প্রস্তাব দিলে কি আমার রাজি হয়ে যাওয়া উচিত?

ছিঃ ছিঃ এসব কি ভাবছি আমি! মাথা খারাপ হয়ে গেছে আমার! সিদ্রার নাক-কান-গাল সব লাল হয়ে গেল লজ্জায়। আর তাছাড়া একদিনের ব্যবহারেই এতকিছু ভেবে নেয়া উচিত নয়। কিন্তু শুধু আজকে তো না, এর আগেও কম কিছু করেননি উনি, শুধু পরিস্থিতি অন্যরকম ছিল। এসময় রাইয়্যান নড়ে উঠলে ধ্যান ভাঙল সিদ্রার। দেখল, ব্যাগ খুলে ফ্লাস্ক আর পেপার কাপ বের করছে রাইয়্যান। একটা কাপে চা ঢেলে চুমুক দিল ও, কিন্তু পেছনে তাকালনা। সিদ্রা গলা দিয়ে আওয়াজ করতেই রাইয়্যান ঘুরে বসল। আরেকটা কাপে চা ঢেলে সিদ্রার দিকে এগিয়ে দিল।
বিনাবাক্যব্যয়ে কাপটা নিয়ে চুমুক দিল সিদ্রাও। হঠাৎ কথা বলে উঠল রাইয়্যান,

“আচ্ছা, এসময়ে তুমি কি করতে?”

“ঠিক বুঝলামনা”

“এমন সময়ে তুমি বাসায় কি করতে? মানে এখানে আসার আগে”

“সেটা জেনে আপনি কি করবেন?” আচমকা মনটা খারাপ হয়ে গেল সিদ্রার।

“বলেছিনা, আজকের জন্য আমাদের সম্পর্কটা বন্ধুর মতো, তাই একটু নরমাল গল্প করতে ইচ্ছে করছে”

“এসময় সাধারণত মাদ্রাসা থেকে ফিরে এসে গোসল-নামাজ-খাওয়ার পর্ব চলত”

“তারপর কি করতে?”

“তারপর একটু রেস্ট নিতাম”

“তারপর?”

“আরে, আমি কি মাই ডেইলি লাইফ প্যারাগ্রাফ লিখছি নাকি? যদিও লেখলে সব পাস্ট টেন্স হয়ে যাবে, প্রেজেন্ট হবেনা” বিষণ্ণ কন্ঠে বলল সিদ্রা।

“ধরে নাও তাই, প্লিজ বলোনা” ততক্ষণে আরেক কাপ চা ঢেলেছে রাইয়্যান।

“এরপর আসরের নামাজের পর একটু হাদীস পড়তাম, তারপর ছাদে গিয়ে গাছে পানি দিতাম। মাগরীবের নামাজের পর নাস্তা করে পড়তে বসতাম। পড়াশুনার মাঝে উঠে নামাজ খাওয়া সেরে নিতাম। আব্বু বাসায় আসার পর একটুখানি গল্পগুজবও করতাম। তারপর সবশেষে কুরআন শরীফ পড়ে, জিকির আজকার করে ঘুম। ব্যাস, প্যারাগ্রাফ শেষ” কিন্তু চিন্তায় পড়ে গেল সিদ্রা, মুনিরা কি না কি লেখে রেখেছে, লোকটা কিছু আঁচ করতে পারবেনা তো! আরে ধুর, উনি তো ভাবেন যে আমি মিথ্যে বলছি, এখনও সেটাই নাহয় ভাববেন।

“আচ্ছা, যদি কোনভাবে সময়কে পেছাতে পারো, ফিরে যেতে পারো তোমার আগের জীবনে, এমন কিছু কি করতে চাও তুমি, যা আগে করনি বলে এখন আফসোস হচ্ছে?”

হাসল সিদ্রা, বিদ্রুপের হাসি।

“আপনার কাছে হুটহাট করে এটা সেটা ভেবে নেয়া খুব সহজ, তাইনা? আমার কাছে কিন্তু না। আমার কাছে বর্তমান আর বাস্তবটা অনেক বেশি প্রকট। আপনি আমার জায়গায় নেই তো, আপনি ফিল করতে পারবেননা”

“স্যরি, আমি সেভাবে বলিনি। মানুষ অনেকসময় বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়লে অনেক কিছু রিয়েলাইজ করে, তোমারও তেমন কিছু মনে হয়েছে কিনা, জাস্ট সেটাই জানতে ইচ্ছে হল, এর বেশি কিছু না”

তিরতির করে কাঁপতে থাকা নদীর পানির দিকে কিছুক্ষণ নিস্পলক তাকিয়ে রইল সিদ্রা, তারপর ধীরে ধীরে উচ্চারণ করল,
“আমি মুনিরাকে সময় দিতে চাই”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here