#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা পর্ব ৩৯

0
414

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা পর্ব ৩৯
-Farhina Jannat

৩৯.
তিরতির করে কাঁপতে থাকা নদীর পানির দিকে কিছুক্ষণ নিস্পলক তাকিয়ে রইল সিদ্রা, তারপর ধীরে ধীরে উচ্চারণ করল,
“আমি মুনিরাকে সময় দিতে চাই”

“কি!?” রাইয়্যান অন্তত মুনিরাকে নিয়ে কিছু এক্সপেক্ট করেনি, আফটার অল মুনিরাই তো দায়ী সিদ্রার এ অবস্থার জন্য, আর সেটা জেনেও……

“না, কিছুনা। এবার আপনার পালা” রাইয়্যানের চিন্তা বাধাগ্রস্ত করল সিদ্রা।

“আমার পালা!” একটু অবাক হল রাইয়্যান, আমার সম্পর্কে ও জানতে চায়! “ঠিক আছে, বলো কি জানতে চাও”

“উম্ম, আপনি অবসর সময়ে কি করেন?” কথা ঘুরানোর জন্য বলেছিল কথাটা কিন্তু এখন কি জিজ্ঞেস করবে বুঝতে পারছেনা সিদ্রা।

“অবসর সময়!” হাসল রাইয়্যান, “আমার কোন অবসর নাই, আমি অসম্ভব কাজপাগল মানুষ। তবে হ্যাঁ, মাঝে মাঝে ফারহানের সাথে টাইম স্পেন্ড করতাম সময় বের করে। সেটাকে যদি অবসর ধরে নেয়া যায়, তাহলে মুভি দেখা, ঘুরতে যাওয়া, ভিডিও গেম খেলা, বলতে গেলে যা ফারহান চাইতো! বাট এজ হি ইজ নো মোর, দেয়ার ইজ নো নিড অফ অবসর!”

ইশ! সবকথা ঘুরেফিরে জিলাপির প্যাঁচের মত ফারহান আর মুনিরাতে গিয়েই কেন থামে? ভাবল সিদ্রা, প্রসঙ্গ পালটাল ও।

“আপনার গলা তো মা শা আল্লাহ্‌ অনেক সুন্দর! কিন্তু আপনি বাংলা গান জানেননা?”

“কেন? গানদুটো তোমার পছন্দ হয়নি?”

“না, শুনতে তো ভালই লাগছিল, কিন্তু কথাগুলো বুঝতে পারলে আরো ভালো লাগতো, এই আর কি”

“তুমি হিন্দী বোঝোনা?” হতভম্ব দেখাচ্ছে রাইয়্যানকে।

“নাহ!” বলেই জিভে কামড় দিল সিদ্রা। মুনিরা নিশ্চয় হিন্দী সিনেমা দেখার গল্পগুজব করেছে ফারহানের সাথে, লোকটার কাছে আবার মিথ্যুক হয়ে গেলাম। এতো মিথ্যে টলেরেট করতে না পেরে কখন যে বার্স্ট হবে, আল্লাহ্‌ মালুম।

আর এদিকে রাইয়্যান বেচারার হৃদয়খানা বেদনায় টুকরো টুকরো হওয়ার জোগাড়। ঢকঢক করে কাপের বাকি চাটুকু শেষ করে কাপটা হাত দিয়ে দুমড়ে মুচড়ে যেন সেই কষ্ট কিছুটা লাঘব করার চেষ্টা করল ও। মনের কথা পরোক্ষভাবে জানানোর এতো সুন্দর প্ল্যান যে এভাবে মাঠে মারা যাবে, কল্পনাও করেনি। কোনমতে ধাক্কাটা হজম করে নিয়ে জবাব দিল, “বাংলা গান একদমই জানিনা তা না, তবে সংখ্যায় কম। আর এ গানগুলো পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে অনেক ভাল ম্যাচ করছিল, সেজন্যই গাইতে ইচ্ছে হল আর কি!”

ও আচ্ছা, এমন একটা চেহারা করে মাথা ঝুঁকাল সিদ্রা, কিন্তু আর মুখ খুললনা।

রাইয়্যান বাইরে বের করে রাখা জিনিসগুলো ব্যাগে ভরে ফেলল, তারপর বলল, “এবার কিন্তু তোমার পালা”

“আমরা যেতে যেতে কথা বলি, নাহলে মনে হয় বনের মধ্যেই রাত নেমে যাবে” আবার বেফাঁস কিছু বলে ফেলার ভয়ে কাটানোর চেষ্টা করল সিদ্রা।

“আরে না, এতক্ষণ তো ঘুরে বেড়িয়েছি, সেজন্য সময় লেগেছে, সোজা যেতে আধঘন্টার বেশি লাগবেনা, আর বেশি ধীরে গেলে ম্যাক্সিমাম একঘণ্টা” একথা বলে রাইয়্যান উঠে গিয়ে নিজের জায়গায় বসল, কিন্তু হাতে বৈঠা তুলে নিলনা। “এবারের প্রশ্ন হল, মুনিরাকে সময় দিব বলতে কি বোঝাতে চেয়েছো তুমি? প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড, আই এম জাস্ট কিউরিয়াস”

ধুর! সেই কথা নিয়ে এখনও পড়ে আছে। কি আর করা, সত্যিটাই বলি, কিছু বুঝতে পারবেনা আশা করি, ভাবল সিদ্রা।

“আসলে আমরা দুইবোন একটু আলাদা তো, যে যার পছন্দমতো কাজ নিয়ে ব্যস্ত থেকেছি সবসময়। দুজনে মিলে ছোটবেলায় একসাথে পড়াশোনা খেলাধুলা করলেও বড় হওয়ার পর আমরা কেমন ছাড়াছাড়া হয়ে গেছি। পাশাপাশি থেকেও একটা অদৃশ্য দুরত্ব তৈরি হয়েছে আমাদের মধ্যে। তাই সময়কে পিছিয়ে নিতে পারলে আমি সেই দুরত্বটা সবার আগে ঘোঁচাতে চাই, ওকে বুঝতে চাই আমি। ওর পছন্দের কিছু করে হলেও দুজন মিলে একসাথে সময় কাটাতে চাই, এনজয় করতে চাই। আমি তো বেশি কথা বলিনা, তাই আমাদের মধ্যে গল্পগুজব কম হয়, সেটাও আমি বদলাতে চাই। অন্য মানুষদের সাথে না হোক, নিজের বোনের সাথে প্রাণখুলে গল্প করতে চাই আর সেই সাথে ওর এমন বোন হতে চাই যাতে ওও আমার সাথে প্রাণখুলে সবকিছু শেয়ার করতে পারে। আমি চাইনা…….”

“আর ইউ ইনসেন!?” চিৎকার করে উঠল রাইয়্যান।

ব্যস, এটারই অপেক্ষা করছিলাম! আমার কপালে এই জলাবনের পানিতে ডুবে মরাই লেখা আছে। রাইয়্যানের অগ্নিমূর্তি দেখে ভয়ে কাঁপতে লাগল সিদ্রা।

“এনাফ ইজ এনাফ! যে বোনের জন্য আজ তুমি এতো বড় বিপদে পড়ে আছো, তোমার সারাটা জীবন নষ্ট হওয়ার পথে, তার জন্য কিনা নিজেকে বদলাতে চাইছো? তোমার কি মিনিমাম সেল্ফ রেসপেক্ট বলে কিছু নেই?” রাগের চোটে সত্য বেরিয়ে গেল রাইয়্যানের মুখ থেকে।

“কি বললেন আপনি?” বিস্ফোরিত চোখে বলল সিদ্রা, নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেনা।

সব ফাঁস হয়ে গেছে বুঝতে পেরে হঠাৎ শান্ত হয়ে গেল রাইয়্যান, “আমি……. সত্যিটা জেনে গেছি। আসল দোষী যে তুমি নও, মুনিরা, সেটা আমি জানতে পেরেছি” ধীরকন্ঠে বলল কথাগুলো।

“কবে? কখন? কিভাবে?” নিজের চিন্তা বাদ দিয়ে এবার মুনিরার চিন্তায় শঙ্কিত হয়ে উঠল সিদ্রা।

“এবার যখন ঢাকায় গেলাম, তখন। আর কিভাবে জেনেছি অত ডিটেইলসে না যাই”

সাথে সাথে সিদ্রা বুঝে গেল এবার ফেরার পর থেকে রাইয়্যানের অদ্ভুত ব্যবহারের রহস্য। তার মানে উনি আমি নির্দোষ জেনে আমার সাথে এতো ভাল ব্যবহার করছেন, এমনি এমনি না! আর আমি কি না কি ভাবছিলাম। কিন্ত…. ভাবনা হোঁচট খেলো রাইয়্যানের কথায় আর নৌকার দুলুনিতে।

“তুমি আমাকে ক্ষমা করতে পারবে, সিদ্রা?” হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে রাইয়্যান, দুহাত সামনে জড়ো করা, দৃষ্টি নিচু। “আমি জানি, আমি যা করেছি তার কোন ক্ষমা হয়না। তোমার মত একটা মেয়েকে বিনাদোষে দিনের পর দিন আমি কষ্ট দিয়েছি। তুমি কতবার বলেছো, বোঝানোর চেষ্টা করেছো যে এসবের সাথে তোমার কোন সম্পর্ক নেই। অথচ আমি সেগুলোকে মিথ্যে ভেবে অত্যাচারের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছি” দম নিল রাইয়্যান।

“আমি…… আমি তোমার গায়ে হাত পর্যন্ত তুলেছি! ছিঃ মেরে মেরে তোমাকে অজ্ঞান করে ফেলেছি! হাউ কুড আই?” দুহাত দিয়ে মুখ ঢাকল রাইয়্যান।

সিদ্রা আগের মতই বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে আছে, যেন বুঝতে পারছেনা এসব কি ঘটছে। এই লোক এভাবে ওর কাছে ক্ষমা চাইছে! এও সম্ভব?

“ওইসব দিনগুলোর কথা ভাবলে নিজেকে আমার অমানুষ বলে মনে হয়। এমনকি তোমাকে নিজের মিথ্যে স্ত্রীর পরিচয় দিয়ে, তোমার বোনের প্রতি ভালবাসাকে কাজে লাগিয়ে ব্ল্যাকমেইল করেছি! সেই বোন, যে কিনা আসল দোষী। আর তুমি! সেই বোনের জীবন বাঁচাতে মুখ বুজে সব সহ্য করে গেছো” একটুখানি থামল রাইয়্যান, মুখটা বেদনায় পাংশু হয়ে গেছে ওর।

“আমি যেদিন ভুল করে পাপোশের উপর চাবি ফেলে গিয়েছিলাম, সেদিন তুমি সব জানতে পেরেছো, তাইনা?” সিদ্রার দিকে তাকাল রাইয়্যান।

হতবিহবলের ন্যায় উপর নিচে মাথা দোলাল সিদ্রা। প্রথমে বিস্ময়, তারপর আতঙ্ক, পরমুহূর্তেই আবারও বিস্মিয়। একের পর এক অনুভূতির দমক যেন ওকে মূর্তিতে পরিণত করেছে।

“তাহলে কেন? তোমার বোন তোমাকে ফাঁসিয়েছে জেনেও তুমি ওকে বাঁচানোর জন্য সবকিছু কেন মেনে নিলে? আমাকে সত্যিটা বলে দিলেনা কেন?”

“কারণ ও আমাকে ফাঁসায়নি” শক্ত কন্ঠে বলল সিদ্রা। বোনের প্রতি করা অভিযোগ আবারও যেন নিজের মধ্যে ফিরিয়ে আনল ওকে। “হ্যাঁ, ও মিথ্যে পরিচয় দিয়েছে ঠিক আছে, কিন্তু তার মানে এই না যে ও ইচ্ছে করে আমার ক্ষতি চেয়েছে। আমি আমার বোনকে খুব ভাল করে চিনি। ওর সাথে আমার মনের মিল না থাকতে পারে, তাই বলে কি আমি ওর শত্রু নাকি! তাহলে শুধু শুধু আমাকে বিপদে ফেলতে চাইবে কেন? এর পেছনে কি কারণ আছে আমি জানিনা। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, ও যদি ঘুণাক্ষরেও জানত যে আমার নাম ব্যবহার করলে আমি এতোবড় বিপদে পড়ব, তাহলে ও কখনওই এমন করতনা”

এবার বিস্মিত হওয়ার পালা রাইয়্যানের, মুখের কথা যেন হারিয়ে গেছে ওর।

“আর ফারহানের সাথে ও যা করেছে, আমি জানিনা ঠিক কতটা গভীরে গিয়েছিল ওদের সম্পর্ক। কিন্তু আমি যেটুকু বুঝেছি, ও ফারহানের পাগলামি আঁচ করতে পেরেই সরে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু বিশ্বাস করুন, ও যদি জানত ফারহান এমন কিছু করবে, ও সেটা আটকানোর চেষ্টা করত। আমার বোন এতটা পাষাণ নয়, বিশ্বাস করুন আপনি। এমনকি এখনও যদি ও জানতে পারে যে ওর জন্য একটা মানুষ মারা গেছে, তার ইহজীবন পরজীবন সব নষ্ট হয়ে গেছে, ও জাস্ট পাগল হয়ে যাবে, নিজেকে কোনওদিন ক্ষমা করতে পারবেনা ও” মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে সিদ্রা, মুনিরার ওপর লোকটার রাগ কিছুটা হলেও লাঘব করার।

“আর ওর এসব কান্ডের পেছনে আমারও কিছুটা দোষ আছে বৈকি। আমি ওর বোন হয়েও এতটা ক্লোজ হতে পারিনি যে এই কথাগুলো ও আমাকে শেয়ার করবে। হয়ত আমি ওকে সময় দিইনি, নিজের পছন্দমত কাজে ব্যস্ত থেকেছি বলেই ও ফেসবুকে নিজের সময় কাটানোর ব্যবস্থা খুঁজে নিয়েছে, জড়িয়ে পড়েছে হারাম সম্পর্কে। আশা করি এবার বুঝতে পেরেছেন, কেন আমি সময়কে ফেরাতে পারলে মুনিরাকে সময় দিতে চেয়েছি?” এতগুলো কথা বলে থামল সিদ্রা।

“স্যালুট তোমাদের দুজনের বিশ্বাসকে। তোমরা একজন আরেকজনকে এত ভালবাসো, এতটা বিশ্বাস করো, আমি তো ভাবতেই পারছিনা” সিদ্রার কথাগুলো হজম করে অবশেষে মুখ খুলল রাইয়্যান।

“দুজন মানে?” সিদ্রার অবাক হওয়ার পর্ব যেন আজকে শেষ হওয়ার নয়।

“হ্যাঁ, মুনিরাও তোমাকে ঠিক এতটাই বিশ্বাস করে। আমি ওকে পরীক্ষা করার জন্য ফোন দিয়ে বলেছিলাম যে তুমি একটা ছেলের সাথে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে নিয়েছো! ও আমাকে জুতা দিয়ে পিটাতে চেয়েছে, জানো তুমি?”

“কি!?” এই সিরিয়াস সময়েও ফিক করে হাসি বেরিয়ে গেল সিদ্রার মুখ দিয়ে।

“হুম, এমনকি আমি প্রমাণ দেখাতে চেয়েছি, তাও শুনেনি। তুমি হাসছো! কি পরিমাণ কথা যে শুনিয়েছে আমাকে, চিন্তা করতে পারবানা। আমি জীবনেও কোনদিন কারো থেকে এত কথা শুনিনি। বাপরে বাপ! তুমি ভাবছো, তোমরা দূরে সরে গেছো, কিন্তু আমি বুঝতে পারছি তোমাদের ভালবাসা কতটা মজবুত। মুনিরাও তোমাকে অনেক ভালবাসে সিদ্রা, এতটা বেশি যে তুমি কল্পনা করতে পারছোনা”

আসলেই আমি কল্পনা করতে পারছিনা! মনে মনে বলল সিদ্রা।

“সো, তুমি যা যা করতে চেয়েছো, আশা করছি ফিরে যাওয়ার পর সেসব খুব সহজেই করতে পারবে। তুমি যখন চাও ফিরে যেতে পারো নিজের পরিবারের কাছে। আমি ফিরে আসার পরদিনই তোমাকে কথাগুলো বলতে পারতাম। কিন্তু আমি তোমাকে কিছু ভাল সময় উপহার দিতে চেয়েছিলাম। যদিও বুঝতে পারছি আনন্দের থেকে সেগুলো তোমাকে অপ্রস্তুত বেশি করছে। তাই, এ নাটকের আজ এখানেই সমাপ্তি। এখন, এই মুহূর্ত থেকে তুমি আমি সম্পূর্ণ আলাদা দুজন মানুষ, কোন সম্পর্ক নেই আমাদের মধ্যে, তুমি চাইলে আমি লিখে দিতে পারি” একটু থামল রাইয়্যান।

“আর আমি তোমার কাছে আমার কৃতকর্মের জন্য হাতজোড় করে ক্ষমা চাইছি। যদিও সত্যি সত্যি ক্ষমা পাবার আশা করছিনা, জানি সেটা সম্ভব না। তবে ভবিষ্যতে যদি কোনদিন পারো, ক্ষমা করে দিও আমাকে। আর তুমি যদি ক্ষমা না করে আমাকে শাস্তি দিতে চাও, কোন আপত্তি নাই আমার, যেকোনো শাস্তি আমি মাথা পেতে নিব।” দুহাত জোড় করে মাথা নিচু করে রইল রাইয়্যান।

বাকশূন্য হয়ে গেলো সিদ্রা। যেখানে আমি ভাবছি উনি সত্যি জানার পর মুনিরার সাথে কি না কি করবেন, সেখানে উনি উলটে উনাকেই শাস্তি দেয়ার কথা বলছেন! আমাকে বিনাদোষে কষ্ট দেয়ার অপরাধবোধ এতটা পীড়া দিচ্ছে উনাকে? আমি তাহলে ঠিকই ভেবেছিলাম, উনার যে রূপ আমি আগে দেখেছিলাম, সেটা উনার আসল রূপ নয়, এটাই আসল। ওইটা জাস্ট ভাইয়ের প্রতি ভালবাসা আর রাগের বহিঃপ্রকাশ ছিল।

“আমি আপনাকে বহু আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি। সত্যিটা জানার পর আমি আপনাকে দোষ দিতে পারিনি, কারণ আসল দোষী তো আমারই বোন। আজ যদি পরিস্থিতি উল্টো হত, আল্লাহ না করুন, আপনার ভাইয়ের জায়গায় আমার বোনের এ পরিণতি হত, আমি কি আপনার ভাইকে কোনদিন ক্ষমা করতে পারতাম? পারতামনা” অকপটে নিজের মনের কথা বলে ফেলল সিদ্রা।

“তাই আমিও আমার বোনের জন্য আপনার কাছে ক্ষমা চাইবনা। আপনি যদি মুনিরাকে কোর্টে তুলতে চান, কিংবা অন্য কিছু করেন, আমি বোন হিসেবে ওর পাশে দাঁড়াব, ওকে বাঁচানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করব, কিন্তু আপনাকে কিছু করতে আমি নিষেধ করবনা” নিচের দিকে দৃষ্টি সিদ্রার।

চোখ তুলে তাকাল রাইয়্যান। বলল,”আমাকে তোমার এতটা অমানুষ বলে মনে হয়? আমি খারাপ হতে পারি, কিন্তু সম্পূর্ণ মনুষ্যত্ব এখনো বিলিয়ে দিইনি। বিনা অপরাধে তোমাকে তিনমাস ধরে শাস্তি দেয়ার পর আবার আমি তোমার বোনের বিরুদ্ধে একশন নিয়ে তোমাকে আবারও কষ্ট দিব, এতোটা অমানুষ আমাকে ভেবোনা প্লিজ। তুমি যদি আমাকে এতকিছুর পরও নির্দ্বিধায় ক্ষমা করতে পারো, তাহলে আমি কেন পারবনা?”

“আর ওই যে বললে, সবটা জানতে পারলে অনুশোচনায় দগ্ধ হবে মুনিরা, আর তার সাথে যুক্ত হবে নিজের দোষে বোনের শাস্তি পাওয়ার অপরাধবোধ। খুব কম শাস্তি হবেনা ওর জন্য। আর তাছাড়া, দোষ যে শুধু মুনিরার ছিল তা তো নয়। ফারহানও সমান দোষে দোষী ছিল, এক হাতে তো আর তালি বাজেনা। ও সবসময়ই একটু বেশি ইমোশনাল, আর আমাদেরও দোষ ছিল। সবসময় আদর আহ্লাদ দিয়েছিলাম, পৃথিবীতে সবকিছুই যে পাওয়া যায়না, দুঃখ কষ্ট বলে যে কিছু আছে, এসব বুঝতে দিইনি। সেজন্যই প্রথমবারের মত এতোবড় আঘাত পেয়ে আর সহ্য করতে পারেনি” চোখের পানি গড়িয়ে পড়ল রাইয়্যানের, ত্রস্ত হাতে মুছে ফেলল ও। “কিন্তু এসব তো আর তখন মনে হয়নি। রাগের চোটে নিজের ভাইয়ের কোন দোষই চোখে পড়েনি আমার” থামল রাইয়্যান।

“স্বাভাবিক! এতবড় আঘাত পেয়ে আপনিও তো সঠিক চিন্তা করার মতো অবস্থায় ছিলেননা। আর বললাম তো, আপনার জায়গায় যে কেউ থাকলে সেও একই কথাই ভাবতো। শুধু হয়ত আবেগ বা রাগের বহিঃপ্রকাশটা আলাদা হত!” নরম কণ্ঠ সিদ্রার।

“থাক! এসব কথা বাদ দাও। বেটার লেট দ্যান নেভার। পাপের ঘড়া আরো ভারী হওয়ার আগেই যে আমি সবটা জেনে গেছি, সেজন্য আল্লাহ্‌র দরবারে শুকরিয়া। এখন বলো, কবে ফিরতে চাও তুমি? চাইলে নৌকা থেকে নেমে নেক্সট ফ্লাইটেই রওনা দিতে পারো, আমি এরেঞ্জ করে দিব” বুকে পাথর চেপে কথাগুলো উচ্চারণ করলো রাইয়্যান, শেষ মুহূর্তে হালকা কেঁপে গেল কণ্ঠ। ওর মনে হল যেন নিজের মৃত্যুদন্ডের অধ্যাদেশ জারি করছে।

“না, আমি খালা আর বুবুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তারপর ফিরতে চাই”

খুশিতে মুখটা ঝলমল করে উঠল রাইয়্যানের, অন্তত আরো একটা দিন তো ও থাকছে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here