#মৃত_কাঠগোলাপ – ৩০
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
________________________________
আয়েশী এখনও বিছানায় শুয়ে আছে। জ্ঞ্যান ফেরে নি। ধ্রুব একবার এসে দেখে গেছে তাকে। আয়েশীর কপালে ছোট্ট চুমু খেয়ে বলেছে, ‘ এবার থেকে শুরু হবে তোমার এবং আমার ভালোবাসার খেলা। দ্রুত সুস্থ হও, রক্তজবা! ‘
ধ্রুব রান্নাঘরে মিল্কশেক বানাচ্ছে। ছাব্বিশ বছরের জীবনে ধ্রুব এই প্রথম রান্নাঘরে এসেছে। ধ্রুবকে রান্নাঘরে দেখে সার্ভেন্ট সবাই হতবাক হয়ে গেছে। মুখে হাত চাপা, চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসছে সবার। প্রধান রাধুনী ধ্রুবর দিকে এগিয়ে এসে বলে,
‘ স্যার, কি বানাবেন আমায় বলুন। আমি বানিয়ে দিচ্ছি। ‘
ধ্রুব কঠিন চোখে তাকায় তার দিকে। বলে, ‘ বেশি কথা বলা আমার পছন্দ নয়, জানোনা ফকরুল? ‘
ফকরুল মাথা নত করে সরে যায়। ধ্রুব মিল্কশেকের গ্লাসে শেষবারের মত চামচ নাড়ে। হঠাৎ উপর থেকে কিছু ভা’ঙার শব্দ পাওয়া যায়। ধ্রুব চামচ নাড়া ছেড়ে ভ্রু কুঁচকে উপরে তাকায়। উপরের ঘর থেকে ক্রমশ কিছু ভা’ঙার শব্দ আসছে, সেই সাথে ধপাধপ পা ফেলার শব্দ। মনে হচ্ছে ছাদটাই বোধহয় ভেঙে গুঁড়িয়ে পড়বে। সার্ভেন্ট বলে,
‘ স্যার আমার মনে হচ্ছে ম্যাডামের জ্ঞান ফিরেছে। ‘
ধ্রুব মাথা নুয়ে মিল্কশেকের গ্লাস হাতে নেয়। সার্ভেন্টদের শাসিয়ে বলে, ‘ আমি না বলা অব্দি কেউ উপরে যাবে না। বুঝেছ? ‘
ধ্রুব হনহন পায়ে সিড়ি ভেঙে উপরে উঠে। আয়েশীর ঘরের দরজা খোলা। ভেতর থেকে একটার পর একটা কাঁচ ভা’ঙার শব্দ আসছে। ম্যাডাম ক্ষেপেছে! ধ্রুব মুচকি হাসে। আজকের মত আয়েশীর ক্ষেপা মনকে শান্ত করতে পারলে, জীবনভর তার আদর সহ্য করতে পারবে। ভাবতেই ধ্রুবর সুখ সুখ অনুভব হচ্ছে। ধ্রুব তার হাসি লুকিয়ে চেহারা করুন করে। তারপর হেঁটে কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করে।
আয়েশী সম্পূর্ণ কক্ষ এলোমেলো করছে। নিজের জামা কাপড় ছিঁড়ে বেহাল অবস্থা। সবসময় বিন্যস্ত চুল এলোমেলো হয়ে মুখের উপর লেপ্টে আছে। আয়েশী একটার পর একটা জিনিস ভাঙছে আর কাঁদতে কাঁদতে বলছে, ‘ কেন ঠকালি আমায়? কেন কেন কেন? এভাবে কেন মেরে ফেললি আমায়? এখন আমি কি নিয়ে বাঁচব, কার জন্যে বাঁচব? ইয়া আল্লাহ! ‘
ধ্রুব দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসে আয়েশীর পানে। আয়েশী উন্মাদের ন্যায় ব্যবহার করছে। ধ্রুব আয়েশীকে শান্ত করতে তাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে, তবে পারে না। আয়েশী সরে যায়। চিৎকার করে বলে, ‘ কেউ ছুঁবে না আমায়। কেউ না! ‘
ধ্রুব সরে আসে। আয়েশীকে শান্ত করতে বলে, ‘ শান্ত হও, আয়েশী। কি হয়েছে তোমার? কাঁদছ কেন? আস্তে, পা কেটে যাবে। ‘
আয়েশী ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে। দুহাতে মাথার চুল খামচে ধরে চিৎকার করে বলে, ‘ মৃদুল কেন এমন করলি? আমি তোকে ভালোবাসি। আমি তোকে ঘৃনা করতে পারছি না। কিন্তু ঘৃনা করা উচিত! কারণ তুই খা’রাপ, নোং’রা, জ’ঘন্য লোক। তুই কারোর ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না। কারোর না। ‘
আয়েশী কাদঁছে। কাদতে কাদতে নাকের ডগা লাল হয়ে গেছে। চোখ ফুলে গেছে। চোখের নিচে রক্ত জমাট বেঁধেছে। আয়েশী আজ কিছুতেই নিজের কান্না সংবরণ করতে পারছে না। ধ্রুব এতক্ষণ আয়েশীর কান্না নির্নিমেষ দেখছিল। অন্য পুরুষের জন্যে আয়েশীর চোখের জল ফেলা ধ্রুবর সহ্য হচ্ছে না। ধ্রুবর নিজের দুহাতের মুঠো মুষ্টিবদ্ধ করে। দু চোখে বুজে রাগ সামলানোর চেষ্টা করে, লাভ হয়না। আয়েশীর কান্নার শব্দ যত করুন হচ্ছে, ধ্রুবর রা’গের পাল্লা ঠিক ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধ্রুবর মন চাইছে সবকিছু তছ’নছ করে দিতে। আয়েশীর গলা চে”পে ধরে বলতে, ‘ কিরে? আমি এত ভালোবাসছি দেখে ভালো লাগছে না? ভালোবাসা সহ্য হচ্ছে না? রা”গ দেখবি? দেখলে এই কান্না, মাতম সব ফুস করে উড়ে যাবে। বেশি উড়িস না, নাহলে আমার রা’গের আগুনে পুড়ে ধ্বং’স হয়ে যাবি। ‘
অথচ, ধ্রুব বলতে পারল না। কারণ, সে আয়েশীকে ভালোবাসে। পূর্বে ধ্রুব অনেক মেয়েকে ভালোবেসেছে, তবে তাদের সবার ভালোবাসা ধ্রুবকে এতটা মাতাল করতে পারেনি। আয়েশী পেরেছে। আয়েশী যখন ধ্রুবর সামনে আসে, ধ্রুব থমকে যায়। আয়েশীর নরম তুলতুলে গালে চুমু খাওয়ার জন্যে ধ্রুবর পশম দাঁড়িয়ে যায়। আয়েশীর মখমলে হাত স্পর্শ করার জন্যে ধ্রুব ব্যাকুল হয়ে পড়ে। আয়েশী যখন কাঁদে, আয়েশীর নাক লাল হয়। ধ্রুবর তখন ইচ্ছে হয়, আয়েশীর টকটকে লাল নাক কা’মড়ে শেষ করে দিতে। অথচ,ধ্রুব এসব কিছুই করতে পারছে না। কারণ, ওই মৃদুলের বাচ্চা। শালা মরে গিয়েও পিঁছু ছাড়ছে না। আয়েশীকে ঠিকই অর্জন করে গেছে। তার ভালোবাসার এত জোর যে আয়েশীর সামনে বিলাস বহুল জীবন, ধ্রুবর মত সুদর্শন জীবনসঙ্গি থাকার পর আয়েশীর মন শুধু একজনাতে আটকে। সেই একজন হল মৃদুল! স্যালুট তার ভালোবাসাকে।
আয়েশীর কান্নার বিকট শব্দে ধ্রুবর ধ্যান ভাঙে। ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে তাকায় আয়েশীর দিকে। আয়েশী নাকের জলে চোখের জলে একাকার। ধ্রুব চোখ উল্টে ফেলে। ফুস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে আয়েশীর দিকে এগিয়ে যায়।
‘ আয়েশী, তাকাও আমার দিকে। ‘
আয়েশীর গালে হাত রেখে ধ্রুব কোমল কণ্ঠে বলে। আয়েশী তখন দুহাতের মুঠোয় চুল খামচে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। ধ্রুব আবার বলে,
‘ আয়েশী? তাকাও এদিকে। ‘
ধ্রুবর কঠিন কণ্ঠের বাণী শুনে আয়েশী হেঁচকি উঠে। ঘাড় কাত করে তাকায় ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব আঙ্গুল দিয়ে আয়েশীর চোখের জল মুছে দেয়। পরক্ষণেই আয়েশীর চোখ আবার জলে টুইটুম্বর হয়ে উঠে। ধ্রুব আবার চোখ মুছে নরম কণ্ঠে বলে,
‘ ভালোবাসো মৃদুলকে? ‘
আয়েশী কথা বলে না। অন্যসময় হলে আয়েশী কোনোরূপ জড়তা ছাড়া বলত, হ্যাঁ, ভীষন।
অথচ আজ বলতে পারছে না। কারণ আয়েশীর মনে মৃদুলকে নিয়ে ঘৃণার উদ্রেক হয়েছে। ধ্রুব এবার জিজ্ঞেস করল, ‘ মৃদুলের মত শুদ্ধ প্রেমিক এই ধরায় দুটো নেই, কাল অব্দি আমি এটাই জানতাম। তোমার এবং মৃদুলের ভালোবাসা আমাকে অবাক করত। তুমি কখনো জিজ্ঞেস করো নি, আমি তোমাকে কখন থেকে ভালোবাসি। আমি আজ নিজেই বলতে চাই সেসব কথা। মনে আছে, তোমাদের ভার্সিটির সেই বিদায় অনুষ্ঠানের কথা। আমি সেদিন তোমায় প্রথম দেখেছি, প্রথম ভালোবাসেছি। কিন্তু যখন শুনলাম,তুমি এবং মৃদুল একে অন্যকে ভালোবাসো, আমি সরে দাঁড়িয়েছি। আমি চাইনি, আমার জন্যে কারো ভালোবাসা ধ্বং’স হোক। কিন্তু যেদিন মৃদুল মারা গেছে, আমি হতভম্ব হয়েছিলাম। বিশ্বাস করতে চাইনি আমার এত ভালো একজন বন্ধুর এত জঘন্য মৃত্যুর কথা। তোমার কান্না আমি সেদিন দেখেছিলাম। আমার রুহ কেঁপে উঠেছিল। পাগল হয়ে গিয়েছিলাম আমি। তোমাকে নিজের করে নিতে অস্থির হয়ে গিয়েছিলাম। তোমার বাবাকে আমাদের বিয়ে করার কথা বললে, তিনি রাজি হন। আমি জানি, তুমি আমার ঘৃনা করো। আমার দোষ কি আমি জানিনা। কিন্তু আমি কখনোই মৃদুলের জায়গা নিতে চাইনি। বরং নিজের একটা জায়গা করতে চেয়েছিলাম। তবে আমি পারিনি। আমি আমার হার স্বীকার করেছিলাম। আয়েশী, কি প্রয়োজন একজন ধোকাবাজের জন্যে নিজের চোখের জল নষ্ট করার? সে চলে গেছে, তাকে ভুলে যাও। সকল খারাপ অতীত পেছনে ফেলে আগে বাড়ার চেষ্টা করো। আমি জানি তুমি পারবে। কি পারবে না? ‘
আয়েশী এতক্ষণ ধ্রুবর কথা মনযোগ দিয়ে শুনছিল। ধ্রুব প্রশ্নে আয়েশীর মনোযোগ ছিন্ন হয়। আয়েশী মাথা হেলায়। ক্ষীণ কণ্ঠে বলে,’পারবো।’
ধ্রুব গর্বের হাসি হাসে। আয়েশীর মুখের উপর পড়ে থাকা চুল কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে বলে,’ যাও, ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসো। ভূত লাগছে দেখতে। ‘
আয়েশী বাক্য ক্ষয় না করে চুপচাপ ওয়াশরুমে চলে যায়। ওয়াশরুমের ঝর্নার নিচে বসে আরো এক দফা কেঁদে তারপর একদম গোসল করে বের হয়।
ধ্রুব ততক্ষণে সার্ভেন্ট দিয়ে আয়েশীর ঘর পরিষ্কার করে ফেলেছে। আয়েশী টাওয়াল চুলে পেঁচিয়ে বিছানার উপর বসে। ধ্রুব আয়েশীর পাশে এসে বসে। আয়েশী তখন মাথা নত করে নীরবে কাঁদছে। ধ্রুব হাত বাড়িয়ে আয়েশীর চুলের টাওয়াল খুলে দেয়। সঙ্গেসঙ্গে আয়েশীর ভেজা চুলের মাতাল গন্ধ ধ্রুবর বুকে ঝড় তুলে দেয়। ধ্রুবর ইচ্ছে করে, আয়েশীর চুলে মুখ গুঁজে আয়েশীর ভেজা দেহের ঘ্রাণ শুঁকতে। কিন্তু ধ্রুব নিজেকে আটকায়। সবুরে মেওয়া ফলে, প্রবাদ বাক্য মাথায় রেখে ধ্রুব আয়েশীর চুল চিরুনি দিয়ে সুন্দর করে আঁচড়ে দেয়। আয়েশীর চোখে গাঢ় কাজলের রেখা এঁকে দেয়। আয়েশীর পাতলা ঠোঁট গোলাপী শেডের লিপস্টিক দিয়ে রাঙায়। প্রেয়সীকে মনের মাধুরী মিশিয়ে সাজানোর পর, ধ্রুব আয়েশীকে আয়নার সামনে আনে। আয়েশীর ঘাড়ে থুতনি রেখে বলে, ‘ সামনে তাকাও। ‘
আয়েশী চোখ তুলে তাকায়। আয়নায় নিজেকে নতুন রুপে আবিষ্কার করে আয়েশী। নিজের প্রতিচ্ছবির পানে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রয় সে। ধ্রুব বলে,
‘ আজ থেকে নিজেকে বদলে ফেলো। নতুন করে বাঁচতে শেখো। তোমার দুনিয়া গোলাপ দিয়ে সাজাও। গোলাপের সুবাস নিজের মধ্যে ধারণ করে হাসতে থাকো। পুরনো আয়েশীকে জলাঞ্জলি দিয়ে নতুন আয়েশীতে পরিণত হও। ‘
আয়েশী কিছুক্ষণ আয়নার দিকে তাকায়। অন্তরে উন্মাদনার জেদ তৈরি হচ্ছে। জেদের বশে আয়েশী মাথা নাড়ায়। হ্যাঁ, সে পুরনো আয়েশীযে জলাঞ্জলি দিবে। পরিণত হবে দুঃখবিহীন সম্পূর্ন নতুন আয়েশীতে। তবে কিছুদিন পর। আয়েশীকে আগে সেই মেয়েটার কথার সত্যতা যাচাই করতে হবে। আয়েশী যে মৃদুলকে চিনে, সে এমন কাজ করতেই পারে না। মৃদুলের সমগ্র দুনিয়া ঘিরে আয়েশী ছিল, আর সেই দুনিয়ায় অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারে না! শেষবারের মত আয়েশী মৃদুলকে বিশ্বাস করছে। আয়েশী মনেপ্রাণে চাইছে, মেয়েটা যেন মিথ্যা প্রমাণিত হয়, মৃদুল যেন আয়েশীর হয়েই রয়। আগামীকাল মৃদুলের মায়ের সাথে দেখা করতে হবে। দেখা করতে হবে, মৃদুলের বন্ধু বান্ধবের সাথে। আয়েশীর বিশ্বাস, মৃদুলের বিষয়ে তারা আয়েশীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে।
#চলবে ( শব্দসংখ্যা – ১২০০+)
গল্প পড়ে চুপচাপ চলে যাবেন না। যারা গল্পটা পড়বেন কষ্ট করে রেস্পপন্স করবেন প্লিজ। পেইজের রিচ অনেক কমে গেছে।
সেরা কমেন্টকারীদের নাম তাদের কমেন্টসহ লেখিকার গ্রুপে পোস্ট করা হবে। ( গত দুই পর্বের কমেন্ট বিজয়ীর নাম আজ সন্ধ্যায় গ্রুপে পোস্ট করা হবে )
লেখিকার গ্রুপ,
আভার পাঠকঘর📚-stories of Ava Islam Ratri