#মৃত_কাঠগোলাপ-৭
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
হলুদের অনুষ্ঠান যখন শেষ হলো, তখন প্রায় সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। বাড়ির পাশের মসজিদ থেকে মাগরিবের আযানে আয়েশীদের গলি মুখরিত। আযান শুনে মনোয়ারা বাড়ীর ছেলেদের সবাইকে মসজিদে পাঠিয়ে দিলেন। মেয়েদের ঘরে নামাজের জায়গা করে দিয়ে আয়েশীকে আসন ছেড়ে তুলে গোসলখানা অব্দি এগিয়ে দিলেন। আয়েশীর সারা গা ভর্তি কাঁচা হলুদ। গা থেকে হলুদের গন্ধ বেরুচ্ছে। আয়েশী মায়ের দিকে চেয়ে আহ্লাদী হয়ে উঠল। আর মাত্র কটা দিন। তারপরই আপন মানুষদের ছেড়ে চলে যেতে হবে একঝাঁক অচেনা মানুষের ভিড়ে। বউ থেকে ভাবী হবে, ভাবী থেকে মামী, মামী থেকে আরো নাম না জানা সহস্র সম্পর্কের ভিড়ে আয়েশী হয়তো নিজেকে ভুলে বসবে। কিন্তু এই যে এত এত সম্পর্ক, এসবে কি মায়ের আঁচলের গন্ধের ন্যায় স্বস্থি আছে? আছে বাবার সেই আদুরে ‘মা’ ডাকের ন্যায় বিশুদ্ধ সম্বোধন? কিছুই নেই! শুধু আছে গুটিকয়েক না পাওয়ার দীর্ঘশ্বাস। জীবন যত এগুবে, দায়িত্বের এ কাঁটাতারে আয়েশী ক্রমশ পেঁচিয়ে যাবে। কি আর করার। এই পৃথিবীটাই যে স্বার্থপর! এই পৃথিবীর বিশাল গোল অংশ জুড়ে-ই আছে শুধু দায়িত্ত্ব আর দায়িত্ত্ব!
আয়েশী বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো। মৃদুল কল দিয়েছে। প্রেমিকের ডাক শুনে আয়েশীর ঠোঁট হেসে উঠল। ফোন ধরে সালাম দিতেই ওপাশ থেকে মৃদুল বলল,
‘ ক্লান্ত নাকি? ‘
আয়েশী লম্বা এক হাই তুললো। ভীষন ঘুম পাচ্ছে তার। আয়েশী সত্যিই ক্লান্ত। গায়ের প্রতিটা অঙ্গ বোধহয় ভেঙে-চুরে একাকার হয়ে যেতে চাইছে। সারা গায়ে কি এক অসহ্য ব্যথা! আজ সারাদিন বিছানার চোখ দেখে নি সে।
আয়েশী মলিন হাসল। ক্লান্ত গা বিছানায় এলিয়ে দিয়ে বলল,
‘ কেমন করে বুঝলি? ‘
মৃদুল হাসল। প্রিয় মানুষের হাসির শব্দে আয়েশীর প্রাণ বোধহয় লুটিয়েই পড়ল। ইশ, এত সুন্দর করে হাসে কেন সে? এই যে আয়েশী তার হাসিতে বারবার খুন হয়ে যায়, সে কি তা বুঝে না? আয়েশী মন্ত্র মুগ্ধের নিয়ে শুনে গেল মৃদুলের হাসি। মৃদুল বলল,
‘ কিভাবে জানলাম, সে কথা নাই বা বলি? ‘
আয়েশী বলল,
‘ তুই খুব মেপে মেপে নিয়ে কথা বলিস রে। কথা সবসময় মন খুলে বলতে হয়। কথা বলার সময় কৃপণতা করতে নেই।’
‘ ও, তাই নাকি? ‘
‘ হ্যাঁ, তাই। ‘
‘ যা, মেনে নিলাম। আচ্ছা শোন, ক্লান্ত হলে একটা প্যারাসিটামল খেয়ে নে। আর একটা গ্লুকোজ স্যালাইন খেয়ে নিস। তাহলে শরীরের দুর্বল ভাবটা চলে যাবে। ‘
আয়েশী হেসে প্রশ্ন করল,
‘ এত খেয়াল রাখিস কেন? আমার অভ্যাস খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ‘
‘ খারাপ হলে হোক। আমি তো আছি, এই খারাপ মেয়েটাকে সামলে নিতে! কি? আছি না? ‘
আয়েশী মুচকি হাসল। উত্তর দিলো না। মৃদুল অবশ্য উত্তরের অপেক্ষাও করল না। সে জানে, আয়েশীর উত্তর কি? প্রেমিকার মন পড়া মৃদুলের জন্যে খুব একটা কঠিন বিষয় না। সহজ বৈকি।
রাত নয়টা বেজে গেছে। কাল সকালে বিয়ে। আয়েশীর এখন ঘুমের প্রয়োজন! মৃদুল বললো,
‘ আচ্ছা, রাখছি। তুই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়। বেশি রাত জাগিস না। শরীর খারাপ করবে। ‘
মৃদুল ফোন রেখে দেবে শুনেই, আয়েশীর মন হুট করে খারাপ হয়ে গেল। আজ সকাল থেকে আয়েশীর মনটা ভালো নেই। হুট করে মৃদুলকে হারিয়ে ফেলার ভয় তার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। ইদানিং মনটা সারাক্ষণ ব্যাকুল হয়ে থাকে। মনে হয়, এই বুঝি মৃদুল হাওয়ার ন্যায় মিলিয়ে গেল। এই বুঝি আয়েশী নিঃশেষ হয়ে গেল! এই বুঝি মৃদুলকে ছুঁতে না পেরে আয়েশীর মরন হলো!
কিন্তু, এমন কেন মনে হচ্ছে? কোনো ধ্বংসাত্মক ঝড় আসবে কি? আয়েশীকে চুপ থাকতে দেখে মৃদুল নরম গলায় ডেকে উঠল,
‘ আয়েশী? ‘
আয়েশীর ভাবনার সুতো ছিঁড়ে গেল। হুট করে তার কান্না আসছে। আকাশ বাতাস মিথ্যে করে ফেলার মত তীব্র এক কান্না হৃদয়টাকে ছিঁড়ে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলছে। আয়েশী কান্না আটকালো না। প্রিয়তমার ডুকরে কেঁদে উঠার শব্দে মৃদুল শশব্যস্ত হয়ে পড়ল। বললো,
‘ এই আয়েশী? কি হয়েছে? কাদছিস কেন? ‘
কান্নায় আয়েশীর মুখ চোখ ফুলে গেছে। আয়েশী কাদতে কাদতে বলল,
‘ আমি তোকে খুব ভালোবাসি মৃদুল। এতটা ভালো বোধহয় আমি আর কাউকে এখনও বেসে উঠতে পারিনি। ”
এই নিয়ে দ্বিতীয়বার আয়েশী মৃদুলকে ভালোবাসি বলেছে। নাহলে শত অভিযোগ শুনালেও আয়েশীর মুখ থেকে ভালোবাসি শব্দটা বের করা যায়না। এই ছোট্ট একটা শব্দ বলতে লজ্জায় মেয়েটা কেমন যেন গুটিয়ে যায়। মুখ তুলে তাকাবার বোধটুকু পায়না। তবে আজ কোনো কসরত ছাড়া প্রিয়তমার কণ্ঠে সেই বহু আকাঙ্ক্ষিত শব্দটা শুনতে পেয়ে জীবনকে বিধাতার দেওয়া শ্রেষ্ট উপহার বলে মনে হলো মৃদুলের। মৃদুল তৃপ্তির হাসি হেসে বলল,
‘ আমি জানি সেটা। ‘
আয়েশী পুনরায় নাক টেনে বলল,
‘ কাল আমি তোর জন্যে বিয়ের শাড়ি পড়ে অপেক্ষা করব। তুই আসবি তো মৃদুল? ‘
আয়েশীর কণ্ঠে কাতরতা, অদ্ভুদ অস্থিরতা। প্রিয় মানুষকে ঘিরে হাজারো ব্যাকুলতা! প্রাণের চেয়েও প্রিয় মানুষকে হারিয়ে ফেলার মত বিশ্রী এক ব্যথা তার ছোট্ট হৃদয়কে ঘুন পোকার ন্যায় কুটকুট করে খেয়ে ফেলছে। আয়েশীর কাতর কন্ঠের বুলি শুনে মৃদুল কিছুটা অবাক হলো বটে। পরক্ষণেই আয়েশীকে শান্ত করতে বললো,
‘ আমি আসবো। যত বাঁধা আসুক না কেন, আমি তোকেই কবুল বলে আমার বাম পাঁজরের হাড় বানাবো। কথা দিলাম। ‘
_________________________________
‘ বর পক্ষের গাড়ি কাল মোহাম্মদপুর রোডের দিকে যাবে। তৈরি থাকবে। যদি কোনো গন্ডগোল হয় তবে জানো তো, তোমাদের কি হাল হবে? প্রাণ নিয়ে আর বাড়ি ফেরা লাগবে না। বুঝেছ? ‘
ধ্রুবর কথা শুনে ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল দুজন বিশাল দেহি কৃষ্ণবর্ণের পুরুষ। ধ্রুবর ঠোঁটে হিংস্র হাস! চোখদুটি নিংড়ে যেন আগুন ঝড়ছে। যেকোন মুহূর্ত সেই আগুনে ভস্ম করে দেবে ভুবন। এমন ভয়ঙ্কর ধ্রুবকে আগে কেউ কখনো দেখেনি। এ যেন এক নতুন ধ্রুব! যার শিরা উপশিরা বেয়ে প্রবাহিত হচ্ছে হিংস্রতার কালো র-ক্ত! যে ভালোবাসার মোহে পড়ে ভুলে গেছে সকল মানবিকতা, বন্ধুত্ব, দয়া-মমতা! ধ্রুবের কাছে ভালোবাসা, কি ভীষন হিংস্র অনুভূতির নাম!
#চলবে
কেন যেন, এই পর্বটা কিছুতেই আমার মনের মত লিখতে পারছিলাম না। কোথা থেকে যেন একটা খাপছাড়া ভাব এসে যাচ্ছিল। অনেক চেষ্টার পর হার মানলাম। একদিন নাহয় খাপছাড়া পর্ব-ই পড়ে নিন।
লেখিকার গ্রুপ,
আভার পাঠকঘর📚-stories of Ava Islam Ratri