#মৃত_কাঠগোলাপ- ৮
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
আজ আয়েশীর বিয়ে। প্রিয় মানুষের সাথে সারা জীবনের জন্য এক পবিত্র সম্পর্কে বাঁধা পড়া, এ যেন স্বর্গীয় সুখ! বিয়ের আসরে বসে প্রিয়তমের জন্যে অপেক্ষার প্রহর গুনছে আয়েশী। মৃদুল আসবে, আয়েশীকে তার বাম পাজরের হাড় বানাবে। ইশ, আয়েশীর তো সুখে গা কাপিয়ে কান্না আসছে।
বিয়ের সাজে আয়েশীকে আজ ভীষন মিষ্টি দেখাচ্ছে। আয়েশীর মা মনোয়ারা আয়েশীর ঘাড়ে ছোট্ট একটা নজর টিকা এঁকে গদগদ কণ্ঠে বলেছেন,
‘ খুব সুন্দর দেখাচ্ছে আমার মেয়েটাকে। আল্লাহ যেন হাজার বছর বাঁচিয়ে রাখে আমার সোনার টুকরাকে। ‘
আয়েশী মায়ের কথা শুনে কেঁদে আটখানা। মা বাবাকে ছেড়ে চলে যেতে একটুও ইচ্ছে হচ্ছে না আয়েশীর। কিন্তু মৃদুলের ঘরের ঘরণী হওয়ার লোভটাও যে ছেড়ে দেওয়া সম্ভব না। আয়েশী মুখ বুজে সারাটাক্ষণ শুধু কেঁদেই গেল।
বরপক্ষ আসতে ইতিমধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আয়েশীর বাবা চিন্তিত হয়ে বরপক্ষকে কল করেছেন। তারা জানিয়েছে মৃদুল ও তার চাচাতো ভাই আয়ুশ এক ঘন্টা আগেই বেরিয়ে পড়েছে। আয়েশীর বাবা শুনে আশ্বস্ত হলেন। মৃদুলদের বাড়ি থেকে আয়েশীদের বাড়ি দেড় ঘণ্টার রাস্তা। আর জ্যামে আটকে গেলে আরো দ্বিগুণ সময় কেড়ে নেয়। অগ্যতা আয়েশীর বাবা অপেক্ষা করতে লাগলেন।
ধ্রুব এতক্ষন একজন দায়িত্বশীল বন্ধুর মত বিয়ের খাবার-দাবারের দিকটা দেখছিল। ধ্রুবর এমন খাটুনি দেখে আয়েশীর বাবা রীতিমত লজ্জায় মরে যাচ্ছেন। এত বড় লোক, তাদের বিয়েতে এসেছে সেই তো অনেক। আর এখন নিজের বাড়ি ভেবে বিয়ের দিকটা সামলাচ্ছে, কত বড় মন তার। আয়েশীর বাবা ধ্রুবর পাশে এসে দাঁড়ালেন। ধ্রুব তখন মেহমানদের অ্যাপায়নের দিকটা দেখছিল। আয়েশীর বাবা তা দেখে লজ্জায় আলুথালু হয়ে বললেন,
‘ ধ্রুব বাবা? ‘
ধ্রুব তাকালো কামরুল হাসানের দিকে। অবিরাম কাজ করার দরুন ধ্রুবর শার্ট ঘামে জবুথবু। আসার সময় গায়ে দিয়ে আসা ধূসর রঙের ব্লেজারটিও ভাজহীন পড়ে রয়েছে এক কোণায়। ধ্রুব চমৎকার হেসে বললো,
‘ জি আঙ্কেল? কোনো দরকার? ‘
‘ মেহমান হয়ে তুমি কেন কাজ করছ? কাজ করার জন্যে মানুষ আছে তো। চলো, ওদিকটায় গিয়ে বিশ্রাম নাও। ‘
ধ্রুব চোখে হেসে বলল,
‘ আঙ্কেল, আমি আপনার নিজের ছেলে হলে কি বলতেন তাকে বিয়ে বাড়ির এত কাজ ফেলে বিশ্রাম নেওয়ার কথা? ‘
কামরুল হাসান লজ্জায় পড়ে গেলেন। দ্রুত সুধালেন,
‘ আরে না না। তুমি তো আমার নিজের ছেলে-ই। আজ তোমার জন্যেই তো আয়েশী ও মৃদুল বাবার বিয়েটা হচ্ছে। আসলে তুমি এত পরিশ্রম করছ, দেখে খারাপ লাগছে। ‘
‘ খারাপ লাগার কোনো কারণ নেই। আপনি গিয়ে বিশ্রাম নিন। আমি সব সামলে নেব। ‘
কামরুল হাসান হেসে উঠলেন। কি ভালো ছেলে! কথাবার্তা কত মার্জিত! একদম সোনার টুকরা ছেলে। এমন ছেলে আজকাল পাওয়া যায় নাকি? যেমন বড় মানুষ, তেমনি তার বড় মন! কামরুল হাসান ধ্রুবর কাধে হাত রাখলেন। কাধে হাত বুলিয়ে বললেন,
‘ বড় হও, বাবা। অনেক অনেক বড় হও। ‘
ধ্রুব হাসল। কামরুল হাসান চোখের পানি আড়ালে মুছে নিয়ে অন্য দিকে চলে গেলেন।
কামরুল হাসান চলে গেলে, ধ্রুবর ঠোঁটে বক্র হাস ফুটে উঠে। ধ্রুব কাউকে কল করে।
‘ কাজ হয়েছে? ‘
‘ জি স্যার। ‘
‘ আমি আসছি। গাড়ির দিকে নজর রাখো। ‘
‘ ওকে স্যার। ‘
ধ্রুব ফোন কেটে পকেটে পুড়ে নিল। অতঃপর সবার অলক্ষে বেরিয়ে পড়ল বিয়ে বাড়ি থেকে।
মৃদুলদের গাড়ি মোহাম্মদপুর একটা ব্রিজের উপর দিয়ে অতিক্রম করছিল। মৃদুলের তর সইছে না। অনেক দেরি হয়ে গেছে। আয়েশী তার জন্যে অপেক্ষা করছে। মৃদুল আয়ুশকে তাড়া দিয়ে বলল,
‘ গাড়ীর স্পিড বাড়িয়ে দে, আয়ুশ। আমাদের দ্রুত যেতে হবে। ও অপেক্ষা করছে। ‘
আয়ুশ বন্ধুর অস্থিরতা বুঝতে পেরে ব্যঙ্গাত্মক হেসে বলল,
‘ কি ভাই? তর সইছে না, নাকি? ‘
মৃদুল আয়ুশের কথার ভঙ্গিমায় হেসে ফেলল। বলল,
‘ তিন বছর প্রেমের পর ফাইনালি বিয়ে করতে যাচ্ছি। তর সইবে কেন? ‘
‘ বাহ,বাহ, বাহ। এত প্রেম। ভাবির তো কপাল খুলে গেল। ‘
মৃদুল চমৎকার হেসে বলল,
‘ ওর কপাল খুলেছে কিনা জানিনা। তবে ওকে বিয়ে করে আমি জিতেছি, সেটা হলফ করে বলতে পারি। ‘
‘ ভীষন ভালোবাসো ভাবীকে, ভাই? ‘
মৃদুল আয়ুশের চোখে চোখ রাখল। প্রবল আত্মবিশ্বাসের সুরে বলল,
‘ ভীষন! ‘
‘ আয়ুশশশ, সামনে তাকাআআ……….’
মৃদুলের চিৎকার শুনে আয়ুশ ঘাড় ঘুরিয়ে দ্রুত সামনে তাকালো। একটা ট্রাক গাড়ীর সামনে চলে আসতেই আয়ুশ হন্তদন্ত হয়ে গাড়ির স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে নিল। কিন্তু ততক্ষণে যা দু*র্ঘটনা হওয়ার হয়ে গেছে। একটা মালবাহী বিশাল ট্রাক এসে ধাক্কা খেয়েছে মৃদুলদের গাড়িতে। সঙ্গেসঙ্গে গাড়ির সামনের কাঁচ ফেঁটে চৌচির হয়ে গেছে। সমস্ত ভাঙা কাঁচ মৃদুল ও আয়ুশের মুখে ঝড়ের বেগে ঢুকে গেছে। একটা বড় ভাঙা কাঁচের টুকরো আয়ুশের গলায় বিঁধে যেতেই আয়ুশ দুবার গা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো। তারপরই ক্রমশ তার গা ঠান্ডা হয়ে গেল। স্টিয়ারিংয়ে থাকা হাত নিস্তেজ হয়ে নেমে এলো সিটে।
মৃদুলের সম্পূর্ন মুখ ভর্তি কাঁচের টুকরো। তার মুখ বেয়ে র*ক্তের ফোয়ারা বইছে। মৃদুলের বাম চোখে কাঁচ ঢুকে চোখের মনি কোটর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। মৃদুল আ*হত চোখ এক হাতে ধরে, আয়ুশের গা ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে ডেকে উঠল,
‘ আ-আ-আ-য়ুশ, এই আ-আয়ুশ? উঠ না রে। এই আ-আয়ুশ? ‘
আফসোস, মৃদুলের কান্না মাখা কণ্ঠ আয়ুশের কান অব্দি পৌঁছালো না। আয়ুশ তখন ম*রন ঘুমে মগ্ন। যে ঘুম আর কখনো ভাঙবার নয়।
আয়ুশকে কথা বলতে না দেখে, মৃদুলের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল জলের ফোয়ারা। নোনতা জল কাঁটা চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়তেই কাঁ*টাস্থান আগুনের ন্যায় জ্বলে উঠল।
মৃদুল ব্য*থায়-জ্ব*লায় কুঁ*কড়ে গেল।
‘ আ-আয়েশী? ‘
মৃ*ত্যু*পথের যাত্রায় মৃদুলের মনে পড়ল প্রিয়তমার হাদিমাখা মুখটা! প্রিয়তমা অপেক্ষা করছে বর বেসে মৃদুলকে দেখতে। কিন্তু সে কি জানে, তার আর বর বেসে মৃদুলকে দেখা হবে না! সে দেখবে এক র*ক্তসমুদ্রে স্নান করে আসা এক নতুন মৃদুলকে! যার গায়ের প্রতিটা অংশ আ*ঘাতের শত চিন্হ। আয়েশী র*ক্তা*ক্ত মৃদুলকে দেখে কি করবে তখন? মৃদুলের গলা জড়িয়ে কেঁদে উঠবে? ম*রার আগে একবার বলবে কি, মৃদুল আমি তোকে ভালবাসি। ভীষন ভীষন ভালোবাসি। এতটা ভালো বোধহয় আমি আর কাউকে এখনো বেসে উঠতে পারিনি। ‘
না, না। শেষবারের মত আয়েশীর মুখে ভালোবাসি শব্দটা শুনতে হলেও মৃদুলকে আয়েশীর কাছে যেতে হবে। আয়েশী কোলে মাথা রেখে তার ম*রনও হবে সুখের ম*রন।
মৃদুল প্রচণ্ড কষ্ট নিয়ে গাড়ির দরজা খোলার চেষ্টা করল। গাড়ীর দরজা অর্ধেক ভেঙে গিয়ে মৃদুলের সিটে দেবে গেছে। মৃদুল অনেক কষ্ট নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে দাড়ালো। তাকে যেকোনো মূল্যেই পৌঁছাতে হবে আয়েশীর কাছে। তার আয়েশী অপেক্ষা করছে তার জন্যে। সে যদি আজ না যায়, আয়েশী ম*রে যাবে। জীবিত থেকেও জ্যান্ত লা*শ হয়ে যাবে তার প্রিয়তমা। মৃদুল বিড়বিড় করে আয়েশীর নাম জপ করতে করতে এগিয়ে গেল ব্রিজ ধরে।
কিন্তু কারো ধাক্কায় মুখ থুবড়ে পড়ে গেল মাটিতে। মাটিতে আ*ঘাত পেয়ে নাক ফেটে র*ক্ত ছিটকে রাস্তায় পড়ল। মৃদুল ব্যা*থায় চিৎকার করে উঠল। তবুও মৃদুল হার মানলো না। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই গায়ের শক্তিতে কুলিয়ে উঠতে পারল না। মুখ থুবড়ে পুনরায় পড়ে গেল মাটিতে। একটু দূরেই পড়ে আছে মৃদুলের মোবাইল। মৃদুল শেষ ভরসা এই মোবাইল। আয়েশীকে ফোন করে বলবে সে, ‘ তার মৃদুল কষ্ট পাচ্ছে। প্রচণ্ড কষ্ট পাচ্ছে। সে মরে যাচ্ছে। আয়েশী একবার যেন এসে যেন তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। মৃদুল কষ্ট পেয়ে ম*রতে চায়না। আয়েশীর কোলে মাথা রেখে সুখের ম*রন ম*রতে চায়। ‘
মৃদুল হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেল পড়ে থাকা মোবাইলের দিকে। কিন্তু আটকে গেল সে। বুট জুতো পরিধানকারী কেউ পা দিয়ে পি*ষে ধরল মৃদুলের ডান হাত। মৃদুল চমকে উঠল। মাথা তুলে তাকিয়ে দেখবার চেষ্টা করল সেই মানুষকে। এক চোখ অন্ধ। অপর চোখে ঝাপসা দেখছে সে। মৃদুল চোখের পাপড়ি ফেলল কয়েকবার। অতঃপর চোখ মেলে দেখল এ পৃথিবীর এক পাষণ্ড বিশ্বাসঘাতককে।
#চলবে
অভিযোগ শুনানোর আগে বলে দেওয়া ভালো, এই গল্পটা সাইকোগিরির উপর বেইজ করে লেখা। পুরো গল্পটা পড়ে তারপরই বাজে মন্তব্য করবেন। আশা করছি, পুরো গল্পটা পড়ার পর আপনাদের সমস্ত ক্ষোভ সমূলে ধ্বংস হবে।
লেখিকার গ্রুপ,
আভার পাঠকঘর📚-stories of Ava Islam Ratri