#মৃত_কাঠগোলাপ – ১৫

0
571

#মৃত_কাঠগোলাপ – ১৫
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

তপ্ত দুপুর। সূর্যের ঝাঁঝালো আলো মেখে বিষন্ন মনে পার্কের বেঞ্চে বসে আছে তুষার। যন্ত্রণায় মাথা বোধহয় ফেঁটে যাচ্ছে। তুষার নখ খুঁটছে। মাথাটা ডানে কিছুটা হেলিয়ে রাখা। চিন্তা হচ্ছে নিজের জন্যে, পরিবারের জন্য, সবার ভবিষ্যৎ জীবনের জন্যে। বাবা রিটায়ার্ড করেছেন আজ প্রায় এক বছর। বেসরকারি বিদ্যালয়ে চাকরি করায় পেনশনের টাকাও পাওয়া হয়নি। বাবা রিটায়ার্ড করার পর সংসারের হাল ধরেছে তুষার। একা হাতে পুরো সংসার সামলেছে। ফসকে যাওয়া চাকরি মোটামুটি ভালো বেতনের ছিল। এখন এমন চাকরি কোথায় পাবে সে? তুষার গলা জ্বলছে। পানি খেতে পেলে ভালো লাগত।

‘ পানি। ‘
চেনা কণ্ঠ শুনে তুষার মাথা তুলে তাকাল। ধ্রুব দাড়িয়ে আছে। ধ্রুবর হাতে মিনারেল ওয়াটার। তুষারের দিকে পানির বোতল এগিয়ে হাস্যোজ্জ্বল মুখে চেয়ে আছে।
‘ তুমি এখানে? ‘
‘ অফিস থেকে ফিরছিলাম। এ রাস্তা দিয়ে যাওয়ার পথে আপনার দিকে চোখ গেল। গোমড়া মুখে বসে আছেন, তাই দেখতে এলাম। ‘
তুষার হাফ ছাড়ল। পানির বোতল হাতে নিয়ে কয়েক ঢোক পানি খেয়ে বোতলের ছিপি আটকাল। ধ্রুব তুষারের পাশে বসল। কিছুক্ষণ দুজনের মধ্যে কোনো কথা হল না। তুষার নিশ্চুপ বসে আছে। ধ্রুব সময় দিচ্ছে তুষারকে। ভেবেছিল, তুষার হয়তো নিজ থেকে বলবে। অথচ তুষার কিছু বলছে না। তাই ধ্রুব নিজ থেকে কথা বাড়াল।

‘ কিছু নিয়ে টেন্সড? ‘
তুষার কিছুক্ষণ চুপ থাকল। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ধ্রুব বলল,
‘ একটা কথা জানেন। দুঃখ আর দীর্ঘশ্বাস দুজন ভাই ভাই। তারা আমাদের জীবনে সবসময় একসঙ্গে দলবেধে আসে। আমাদের জীবনে যত বেশি দীর্ঘশ্বাস থাকবে, দুঃখও তত বেশি হবে। তাই আমাদের উচিৎ দীর্ঘশ্বাসকে আটকে রাখা। আর দুঃখের সাথে যুদ্ধ করে তাকে হারিয়ে দেওয়া। ‘

ধ্রুব কথার ছলে তুষারকে গুমরাহ করল। ধ্রুবর কথা হয়ত তুষারের মনে ধরল। তুষার কিছুক্ষণ পর নিজে থেকে বলল,
‘ চাকরিটা হাতছাড়া হয়ে গেছে, ধ্রুব। কি হবে এখন? আমি কিছু ভাবতে পারছি না। টেনশন হচ্ছে। ‘

ধ্রুব তুষারের অগোচরে মুচকি হাসল। লাইনে এসে গেছে। ধ্রুব এবার নিজের সাজানো নাটক শুরু করল। তুষারের দিকে চেয়ে বলল,
‘ তো কি হয়েছে? একটা গেলে আরেকটা আসবে। এতে এত চিন্তার কি আছে?’
‘ তুমি বুঝছ না। এই চাকরিটাই আমাদের ভাত দেয়। চাকরি চলে গেলে এত ভালো বেতনের চাকরি পাওয়া আমার জন্যে মুশকিল হয়ে যাবে। আজকাল চাকরি পাওয়া খুব কঠিন। এই চাকরি অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে পেয়েছিলাম। এটাও হাত ফসকে গেল। ধুর! ‘
‘ আর যদি আপনি এর থেকেও ভালো বেতনের চাকরি পান, তবে আফসোস থাকবে? ‘

তুষার ভীষন অবাক হলো। চোখ তুলে চেয়ে রইল ধ্রুবর দিকে। বলল,
‘ কিন্তু এখন হুট করে এমন চাকরি কোথায় পাব? ‘
‘ আমার অফিসের একটা পোস্ট খালি করব। এখনকার ম্যানাজার খুব লোভী। ফাঁকফোঁকর পেলে টাকা চুরি থেকে শুরু করে ইনফরমেশন লিক করে। অনেকদিন ধরে ভাবছি তাকে পাল্টে দেব। তবে ভালো যোগ্যতাসম্পন্ন ম্যানাজার পাচ্ছিলাম না। এখন যেহেতু তুমি আছ, তবে তুমি নাহয় দায়িত্ত্বটা নাও। এক মাস চাকরি কর। তোমার কাজ দেখে তোমার গদি পাকাপোক্ত করা হবে। জানো তো, আমি কাজের ব্যাপারে কখনো কম্প্রোমাইজ করিনা। কি বলো? ‘
‘ না, না। তোমার কষ্ট করতে হবে না। আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেব। ‘
‘ আপনি আমার বড় ভাইয়ের মত। আপনার বিপদে সাহায্য করা আমার কাছে আনন্দের। তবে ভাববেন না দয়া করছি। আমি আসলেই একজন বিশ্বস্ত ম্যানাজারকে খুজছি। আর আমি জানি আপনি আমার কোম্পানিকে নিজের মনে করেই কাজটি করবেন। আমি আপনাকে ভরসা করি। ‘

ধ্রুবর কথা একেবারে ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না। তুষার কিছুক্ষণ ভাবল। চাকরিটা কি তার নেওয়া ঠিক হবে? এই চাকরি গ্রহন করলে ধ্রুবর দয়ার নিচে কি তারা দমে থাকবে? ধ্রুব বেঞ্চে হেলান দিয়ে বসে আছে। ঠোঁটে মুচকি হাস। সে জানে, তুষার রাজি হবে। হাতি কাদায় পড়লে চামচিকাও লাথি মারে। তুষারের বিষয়টা খানিক এমন। রাজি না হয়ে তুষারের হাতে আর কোনো উপায় রাখে নি ধ্রুব।
তুষার কিছুক্ষণ ভাবল। মা বাবা, বোনের চেহারা চোখে ভেসে উঠল। তুষার চাকরি না করলে তারা খাবে কি? বোনেরও এখন অনেক টাকার ঔষধ লাগে। এত টাকা কোথায় পাবে সে? তুষার আর উচিত অনুচিত ভাবতে পারল না। চট করে রাজি হয়ে গেল। ধ্রুব হাসল। তুষারের কাধে হাত রেখে বলল
‘ দ্যাটস গুড ডিসিশন। এখন আমি যাই। এখন আবার সেই ভূতুরে বাড়িতে প্রবেশ করতে হবে। কি আর করার। ‘

তুষার অবাক হল। বলল,
‘ তোমার বাড়ি ত ভালোই সুন্দর। ভুতুড়ে বলছ কেন? ‘
ধ্রুব দুঃখ পাওয়ার ভান করে বলল,
‘ যে বাড়িতে লক্ষ্মী নেই, সেই বাড়ি তো ভুতুড়ে বাড়ীর মতই।’
‘ মানে? তোমার মা নেই? ‘
ধ্রুব মলিন হেসে বলল,
‘ না। কেউ নেই আমার। আমি একা । ‘
‘ তাহলে বিয়ে করছ না কেন? ‘
ধ্রুব এবার মুচকি হাসল। বলল,
‘ যাকে ভালোবাসি, সে তো অন্যের প্রেমে মজে আছে। তাকে ভালবেসে দুঃখ পুষছে। কিন্তু আমার কোনো আফসোস নেই। আমি তাকে দূর থেকেই ভালোবাসব। ‘

তুষার হয়তো কিছু একটা আন্দাজ করতে পারল। বাবার কাছে বিষয়টা শুনেছে সে। সে ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ তুমি কি আয়েশীর কথা বলছ? ‘
ধ্রুব মলিন হেসে, দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তুষার অবাক হল। কি করবে ভেবে পেল না। আয়েশী কি কখনো রাজি হবে ধ্রুবকে বিয়ে করতে? মৃদুলকে আয়েশী এখনো অনেক ভালোবাসে। মৃদুলের জায়গা ধ্রুবকে কি দিয়ে দিতে পারবে আয়েশী? কিন্তু ধ্রুব তাদের পরিবারকে এত সাহায্য করছে। তার একটা আশা কি তারা পূরণ করতে পারবে না? তাছাড়া ধ্রুব আয়েশীকে ভালোবাসে। আয়েশী ধ্রুবর সংস্পর্শে এলে দ্রুত সুস্থ হবে। একসময় মৃদুলকে ভুলতে সক্ষমও হতে পারে। তুষার চিন্তায় পড়ে গেল। ধ্রুবকে বিদায় জানিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে পা বাড়াল। দেখা যাক কি করা যায়?

ধ্রুব পায়ের উপর পা তুলে আরাম করে বসল। দুহাত বেঞ্চের হাতলে ছড়িয়ে দিয়ে বাবু সাজল। রহস্যময় হেসে বলল,
‘ সঠিক জায়গায় ঢিল মে*রে দিয়েছি। বাকি কাজটা এই বোকা কুকুরটাই অপস সরি, শালামশাই-ই করে দেবে। এভাবেই তোদের মত চুনোপুটিদের একে একে হাত করব। তারপর একদিন টুপ করে রাঘব বোয়ালকে খাচায় পুড়ে নেব। তারপর, তারপর…..সব ফিনিশড! হা হা হা! ‘
__________________________
তুষার পড়ার টেবিলে মাথা ঝুঁকে বসে আছে। আজকে বিকেলের কথা চিন্তা করছে। একটু পর তুষারের মা এক কাপ চা এনে তুষারের ঘরে প্রবেশ করেন।
‘ তুষার, তোর চা। বিস্কুট লাগবে? ‘
‘ না, লাগবে না। কাপ টেবিলের উপর রেখে যাও। ‘
তুষারের মা চলে যাওয়ার জন্যে পা বাড়ালেন। তবে পেছন ডাকল তুষার। বলল,
‘ মা, আয়েশী কে ডেকে দাও তো। কথা আছে ওর সঙ্গে। ‘
‘ ডেকে দিচ্ছি। ‘

পাঁচ মিনিট পর, আয়েশী তুষারের ঘরে এল। বলল,
‘ ভাই, ডেকেছিলে? ‘
তুষার চোখ তুলে তাকাল আয়েশীর দিকে। এ কদিনে নিজের এ কি অবস্থা করে ফেলেছে আয়েশী? যে মেয়েটা দুদিন পর পর নিজের ত্বকের যত্ন নিত। তার চোখের নিচে আজ দু ইঞ্চি জুড়ে ডার্ক সার্কেল। হাতে পায়ের নখ কাটেনি কয়দিন হল? শরীরের দিকে বিন্দুমাত্র নজর নেই। বোনের এহেন করুন অবস্থা দেখে চোখে জল ভরে তুষারের। তুষার চেয়ার টেনে বলে,
‘ বস আমার পাশে। ‘
আয়েশী বসে। গোমড়া মুখে চেয়ে রয় মাটির দিকে। তুষার আলতো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
‘ মা বললো দুপুরে ভাত নাকি খাস নি। এমন করলে চলবে, হু? শরীর খারাপ করবে তো। ‘
আয়েশী মৃদ কণ্ঠে জানায়,
‘ ক্ষুধা ছিল না। ‘
‘ ক্ষুধাকে হজম করে বসে থাকলে ক্ষুধা লাগবে কি করে? ‘
আয়েশীর কথা বলতে ভালো লাগছে না। আয়েশী বলে,
‘ কি বলার জন্যে ডেকেছিলে? ‘
তুষার বুঝতে পারল, আয়েশীর খারাপ লাগছে। তুষার সোজা মূল কথায় আসে। বলে,
‘ মৃদুলকে ভোলার চেষ্টা কর, বোন। আর কত এভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরবি? আমার তোকে এভাবে ছন্নছাড়া হয়ে দেখতে ভালো লাগছে না। ভীষন কষ্ট লাগছে। ‘
মৃদুলের নাম শুনে আয়েশীর চোখ ভিজে উঠে। গলা আটকে আসে। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। কথা বলতে পারে না। গলায় পাথর চাপে। আয়েশী কিছুটা কঠোর হয়ে বলে,
‘ মৃদুলকে ভোলার কথা কক্ষনো বলবে না, ভাই। আমার সহ্য হয়না। ‘
তুষার বোনের মাথায় হাত বোলায়। বলে,
‘ ভুলতে হবে, বোন। অতীত আকড়ে কেউ কখনো বাঁচতে পারেনি। অতীতকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে হয় সবার। নাহলে ভালো থাকা যায়না। তুই ভালো থাক, এটা চাওয়া কি আমাদের জন্যে খুব দোষের? ‘
আয়েশী কিঞ্চিৎ হাসল। বলল,
‘ মৃদুল আমার কাছে কোনো কালো কিংবা জঘন্য অতীত নয় ভাই, যে তাকে ভুলে যাব। মৃদুল আমার কাছে আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অতীত। সুন্দর জিনিস কখনো ভুলা যায়না। আমি মৃদুলকে ভুলতে চাইছি না, ভাই।’

তুষার আরো কথা বলতে চায়। কিন্তু আয়েশী চেয়ার ছেড়ে উঠে যায়। তুষারকে আর কথা বলতে না দিয়ে চুপ করে বেরিয়ে যায় তার ঘর থেকে। তুষার চেয়ে রয় শুধু। আয়েশীকে ধ্রুবর কথা বলা যাবে না। ক্ষেপে যাবে। এর চেয়ে ভালো বাবা মা সবাইকে বলে আয়েশীর সাথে কথা বলতে হবে। সবাই মিলে আয়েশীকে বুঝালে নিশ্চয়ই সে মানা করতে পারবে না। আগামীকাল-ই বাবার সাথে তুষার কথা বলবে।

#চলবে –
বিশাল এক পর্ব দিয়েছি আজ। এখন বিশাল বিশাল মন্তব্য করে আমার মন চট করে ভালো করে দিন তো।

আর হ্যাঁ, গল্প এক জায়গা আটকে গেছে বলে অনেকের কাছে মনে হচ্ছে। এখানে আমার কোনো হাত নেই। গল্প গল্পের স্রোত ধরে এগুচ্ছে। আমি চাইলেও গল্প টেনে নিয়ে যেতে পারবো না। এমন করলে গল্পের নিজস্ব সৌন্দর্য্য হারাবে। তবে অতি শীঘ্রই গল্পের মোড় পাল্টানো হবে। ভালোবাসা!

লেখিকার ফেসবুক আইডি লিংক,
https://www.facebook.com/abhaislam.ratri.1
লেখিকার গ্রুপ,
আভার পাঠকঘর📚-stories of Ava Islam Ratri

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here