#মৃত_কাঠগোলাপ – ১৭
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
হাসপাতালের করিডোর ভীষন ব্যস্ত। মানুষের আনাগোনা ব্যাপক হওয়ায় দম বন্ধ লাগছে। স্যাভলন, ঔষুধের ভ্যাপসা গন্ধ বমি আসার জোগাড়। আয়েশী ক্লান্ত গা নিয়ে চেয়ারে বসল। অপারেশন কক্ষে লাল বাতি জ্বলছে। কামরুল হাসানের ছোটোখাটো স্ট্রোক হয়েছে। তাই ডাক্তার কোনো রিস্ক না নিতে চান নি। পুরনো যুগে শুধু বৃদ্ধ লোকদের হার্টের সমস্যা দেখা যেত। আজকাল যুবক থেকে বৃদ্ধ সবার দিলে ময়লা পড়ে গেছে। সবাই অসুস্থ! কেউ শারীরিক ভাবে তো কেউবা মানুষিক! তবে আমরা সবাই অসুস্থ, এটা বলা বাহুল্য।
আয়েশী চোখ ঘুরিয়ে অপারেশন কক্ষের দিকে তাকাল। বাবা এখনো বের হচ্ছেন না কেন? আয়েশীর গা মৃদমন্দ কাপছে। ভয় হচ্ছে নিজের জীবনের আরো রিয়া ভরসাপূর্ন বুক হারানোর। আয়েশীর কান্না পাচ্ছে। তবে সামলালো সে। মা বসে আছেন পাশে। আয়েশী নিজেকে ভেঙে না পড়তে দিয়ে মাকে আগলে নিল। আশ্বস্ত করে বলল,
‘ বাবা ঠিক হয়ে যাবে, মা। চিন্তা করো না। ‘
‘ হ্যাঁ আমি অফিসের লোকদের সাথে কথা বলে নিয়েছি । ওরা দুইদিন পর ডেইট ফিক্স করে ফেলবে। ‘
করিডোর দিয়ে হেঁটে ধ্রুব ও তুষার এল। ধ্রুবর কানে ফোন ধরে রাখা। কথা বলতে বলতে আয়েশীর পাশে এসে দাঁড়াল। তুষার মায়ের পাশে বসল। ধ্রুব এর বসার আর জায়গা নেই। একটা মাত্র চেয়ার বাকি। সেটা আয়েশীর পাশে। ধ্রুব ওতসব ভাবলো না। আয়েশীর পাশের চেয়ারে বসে গেল। আসার সময় তুষার হাতে করে দুটো সবজির রোল এনেছিল। একটা মায়ের জন্যে, একটা আয়েশীর জন্য। সকাল থেকে তারা কিছুই মুখে তুলে নি। তুষার রোলের র্যাপিং পেপার খুলে রোলটা মায়ের হাতে দিল। বলল,
‘ খাও। ‘
তুষারের মা মানা করতে চাইলেন। তবে ছেলের রাগী মুখের দিকে চেয়ে পারলেন না। না চাইতেও খাবার মুখে তুললেন।
ধ্রুব এখনো ফোনে কথা বলছে। আয়েশীর বিরক্ত লাগছে। সে কি বসার জন্যে কোনো জায়গা পায়নি? খারাপ লোক! দেখে দেখে আয়েশীর পাশেই বসতে হল?
ধ্রুবর কাধ দিয়ে ফোন কানে ধরে রেখে, এক হাত দিয়ে কোকাকোলার স্ট্রিপ খুলল। ‘চ্যাক’ করে একটা শব্দ হল। ধ্রুব কোকাকোলার ক্যানটা আয়েশীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে ইশারা করল নেওয়ার জন্য। আয়েশী নিল না। স্পষ্ট বলল,
‘ আমি খাবো না। আপনি খান। ‘
ধ্রুব রাগ নিয়ে তাকাল এবার। আয়েশী ভ্রু কুঁচকে তাকাল। কিন্তু কিছু বলল না। ধ্রুব ফোনের অপাশের লোককে বলল,
‘ এক মিনিট হোল্ড করেন, প্লিজ। ‘
ধ্রুব ফোন মিউট করে জোরপূর্বক আয়েশীর হাতে ক্যান ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘ বেশি কথা না বলে খাও। ক্লান্ত দেখাচ্ছে তোমায়। ‘
আয়েশী তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল। কি পেয়েছে এই লোক? আদিক্ষেতা দেখানো হচ্ছে, আদিক্ষেতা? আজ বাবার এই হাল শুধুমাত্র এই লোকের জন্যে। আর সে কি না দরদ ভাগ করতে এসেছে? ছিঃ! আয়েশী ইচ্ছে হল, ক্যান দিয়েই ধ্রুবর মাথাটা ঠাস করে ফাটিয়ে ফেলতে। কিন্তু মা, তুষার ভাই পাশে থাকায় বেপরোয়া ইচ্ছেকে ধপ করে গিলে ফেলতে হল। ক্যান ফিরিয়ে দিতে চাইলে বাম পাশ হতে তুষার ধমক দিয়ে বলে,
‘ বারবার এমন করছিস কেন? ভালো ভাবে দিচ্ছে, নিলে কি হয়? ‘
আয়েশী দাতে দাঁত খিচে বসে রইল। ধ্রুবর মুচকি মুচকি হাসছে। আয়েশী ভাঙচুর করা রাগ নিয়ে, ছো দিয়ে ধ্রুবর থেকে কোকাকোলার ক্যান নিয়ে নিল। ধ্রুব মুচকি হেসে এবার ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে গেল।
আয়েশী একটু একটু করে কোকাকোলা খাচ্ছে আর অপারেশন কক্ষের দিকে তাকাচ্ছে। এত দেরি হচ্ছে কেন? তারা কি কোনো ষড়যন্ত্র করছে? বাবার হাত, পা নাড়ি ভুঁড়ি কি সব আজই কেটে ফেলছে? ইশ, কি সব ভাবছে আয়েশী? মৃদুল ঠিক বলত, আয়েশী এখনো ম্যাচিউর হতে পারেনি।
আয়েশী অন্যমনস্ক থাকাকালীন ধ্রুব ফোনে কথা বলতে বলতে আয়েশীর হাত থেকে ক্যান নিয়ে তাতে চুমুক বসাল। আয়েশী ধ্যান ভাঙল। ধ্রুবর এমন কাজে হতবম্ব হয়ে পড়ল। ধ্রুব তার এটো খাচ্ছে? ছিঃ!
কিন্তু এ নিয়ে আয়েশী বেশি মাথা ঘামালো না খেলে খাক। তার পেট খারাপ হবে। ওর কি তাতে? ফালতু লোক!
অপেক্ষা করতে করতে একসময় চেয়ারে হেলান দিয়ে আয়েশী ঘুমিয়ে পড়ল। মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের কারণে, মাথা বারবার ভারসাম্য হারিয়ে সামনে ঝুঁকে যাচ্ছে। আয়েশী ঠিকমত ঘুমাতে পারছে না। ধ্রুব এসব দেখে মুচকি হাসল। আয়েশীর মাথাটা নিজের কাঁধে বসাল। আয়েশী লম্বা করে হাই ফেলে ধ্রুবর কাধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেল।
ধ্রুবর কাছে মনে হচ্ছে, আয়েশীর মাথা তো মাথা নয় যেন ফুলের পাঁপড়ি। এত নরম! একটুও ওজন নেই। ধ্রুব আয়েশীর কপালের সামনে পড়ে থাকা চুল কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে ফোনে কথা বলায় মন দিল। ফোনে কথা বললেও চোখ ঘুরিয়ে বারবার আয়েশীর দিকে তাকাচ্ছে। একসময় বিরক্ত হয়ে ফোন’ই কেটে দিল। এখন তার রক্তজবাকে দু চোখ ভরে দেখার সময়! আজ সে দু চোখের বহমান এতদিনের তৃষ্ণা নেভাবে।
‘ আয়েশী, আয়েশী? ‘
ঘুমের মধ্যে আয়েশীর বোধ হল, মৃদুল তাকে ডাকছে। মৃদুলের সেই নেশা নেশা কণ্ঠ, তার ঠোঁটের ফাঁকে আয়েশীর নাম, সেই এক অনুভূতি! আয়েশী চট করে উঠে বসল।
‘ মৃদুল, মৃদুল ‘ বলে আশপাশে খুঁজতে লাগল। ধ্রুব হয়তো বুঝতে পেরেছে বিষয়টা। ধ্রুব আয়েশীকে শান্ত করতে বলল,
‘ আমি, আমি ডেকেছিলাম। ‘
আয়েশী ঘাড় কাত করে তাকাল ধ্রুবর দিকে। মৃদুল ডাকে নি, বুঝতে পেরে আয়েশী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চোখ উল্টে পাশে বসে থাকা ধ্রুবর দিকে তাকাল। ধ্রুবর মাথায় এখন আর্মি ক্যাপ ঝুলানো। গায়ে আর্মি টিশার্ট। এই লোক হুট করে আর্মি সেজেছে কেন?
আয়েশী চেয়ার ছেড়ে উঠে গেল। বাবার অপারেশনেরএক ঘন্টা হয়ে গেছে। এতক্ষণ অপেক্ষা করতে করতে আয়েশীর পানি পিপাসা পেয়েছে। আয়েশী করিডোর দিয়ে হেঁটে ক্যান্টিনের দিকে গেল। ধ্রুব নিজেও পিছু নিল। আয়েশী হাঁটার সময় একবার পেছনে ফিরল। ধ্রুবকে দেখে সে বড়ই বিরক্ত হল। মুখ চোখ তেতো করে বলল,
‘ আপনি আমার পিছু নিচ্ছেন কেন? ‘
ধ্রুব সহসা হেসে উত্তর দিল,’ সারাজীবন পিছু নিব যে! ‘
আয়েশীর রাগে ফেটে পড়ল। এত নির্লজ্জ কেন এই লোক! লোকটা জানে, আয়েশী মৃদুলকে ভালোবাসে, এখনো বাসে।তবুও কেমন বেহায়ার ন্যায় তার পিছু ঘুরছে। ফালতু!
আয়েশী ক্যান্টিন থেকে একটা মিনারেল ওয়াটার কিনল। বিল মেটাতে গেলে, ধ্রুব আগে আগেই বিল পে করে ফেলে। আয়েশী রেগে গিয়ে বলে, ‘ আপনি বিল দিলেন কেন? আমি কি ফকির? টাকা নাই আমার কাছে? আপনার টাকা আছে দেখে জনে জনে বিলিয়ে বেড়াবেন? ‘
কথাটা ধ্রুবর গায়ে লাগল।তবে উত্তরে মুচকি হেসেই বলল,
‘ আমার টাকা, পয়সা, সম্পত্তি সবকিছু আমার হবু স্ত্রীর জন্যে । সে চাইলে প্রাণটাও উৎসর্গ করতে পারি। করব নাকি? ‘
আয়েশী দাত খিচে বলল, ‘ হ্যাঁ, করুন। করে মরে যান। খুশি হব আমি। ‘
আয়েশী গটগট করে পা ফেলে চলে গেল ক্যান্টিন থেকে। করিডোরে পা রাখতেই ধ্রুব আয়েশীর হাত আটকে নিল। নিজের পুরুষালি কঠিন হাতে মুষ্ঠিবদ্ধ করল আয়েশীর পেখমের ন্যায় হাত। আয়েশী রাগ হল। ধাক্কা দিয়ে হাত সরাতে চাইলে ধ্রুব আরো শক্ত করে হাত চেপে ধরে। আয়েশী ব্যথা পায়। ধ্রুব আয়েশীকে দেয়ালের সাথে মিশে রাখে। আয়েশীর ছটফট করছে। ধ্রুব বাঁকা হেসে আয়েশীর চোখে চোখ রাখল। বলল,
‘ আমি কখনো একা মরব না, রক্তজবা। মরলে তোমায় সাথে নিয়ে মরব। আমি মরে গেলে তুমি অন্য কারো হবে, আমার তা সহ্য হবে না। তাই আমিও শ্যাষ, তুমিও শ্যাষ! ‘
#চলবে ( শব্দসংখ্যা – ১০০০)
এখন থেকে রেগুলার গল্প দেয়া হবে। আর কোনো অভিযোগ এর অবকাশ রাখব না, ইন শা আল্লাহ!
কিন্তু একটা শর্তে। যারা যারা গল্পটা পড়বেন, দু লাইন মন্তব্য করবেন। আপনাদের মন্তব্যই আমাকে লিখতে উৎসাহিত করে। এটা আমার অনুরোধ!
লেখিকার গ্রুপ,
আভার পাঠকঘর📚-stories of Ava Islam Ratri