#মৃত_কাঠগোলাপ- ১০
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
অবশেষে আয়েশীর অপেক্ষার অবসান হল। সদর দরজা পেরিয়ে পাঁচ-ছয়জন মানুষ প্রবেশ করল। সবার সামনে রয়েছে ধ্রুব স্বয়ং। তার চোখ মুখ অন্ধকার। চোখের পাপড়ি ভেজা। তাদের সবার মাথায় বহন করা একটি স্ট্রেচার। স্ট্রেচার, স্ট্রেচার কেন? আয়েশী পাগল হয়ে গেল। চেয়ার ছেড়ে উঠে দ্রুত তাদের দিকে এগিয়ে গেল।
‘ ত-তোমরা স্ট্রেচার এনেছ কেন বিয়ে বাড়ীতে? হ্যাঁ? এই স্ট্রেচারে কে শুয়ে আছে? ‘
আয়েশী পাগলের ন্যায় ব্যবহার করছে। পায়ের উপর ভর দিয়ে পা উঁচু করে স্ট্রেচারে শুয়ে থাকা মানুষকে দেখতে চাইছে। তবে দেখতে পারছে না। স্ট্রেচারে শুয়ে থাকা মানুষটাকে সাদা কাপড় দিয়ে মোড়ানো। দুজন মহিলা এসে আয়েশীকে আটকালেন। আয়েশীকে জোরপূর্বক সদর দরজা থেকে সরিয়ে আনলেন। আয়েশী হাত পা ছুঁড়ছে। নিজেকে ছাড়াবার জন্যে মহিলাদের হাতে, শরীরে আঁচড় কাটছে। বারবার বলছে,
‘ ছেড়ে দাও আমায়। আমার মৃদুল কই? সে আসেনি কেন? এই লাশবাহী অলুক্ষণে স্ট্রেচার কেন আমার বিয়েতে এল? ছেড়ে দাও আমায়। আমার মৃদুল কোথায়? ‘
মহিলারা আয়েশীকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। নড়তে দিচ্ছে না। তার হাত নিজেদের দুহাতে দিয়ে বেধে রেখেছে। আয়েশী শুধু ছটফট করছে। মহিলারা আয়েশীর মাথার ওড়নার ক্লিপ খুলে চুলগুলোকে উন্মুক্ত করলেন। কেঁদে কেঁদে আয়েশীর মাথা গরম হয়ে গেছে। তালুতে হাত রাখলে যেন হাত পুড়ে যায়।
ধ্রুব নিজের হাতে স্ট্রেচার ঘরের মাঝখানে রাখল। আস্তে আস্তে স্ট্রেচারে শুয়ে থাকা মানুষটার মুখ থেকে সাদা কাপড় সরিয়ে দিল। শুয়ে থাকা মানুষটার মুখ দেখতে পেরে কক্ষে উপস্থিত সবাই মুখে হাত চেপে সজোরে বলে উঠলেন,
‘ ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। ‘
মৃদুল ভীষন আরামে শুয়ে আছে স্ট্রেচারে। মুখ হা করা, চোখ খুলে রাখা। স্ট্রেচারে শুয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে আয়েশীর ছটফটানি এক মুহূর্তেই বন্ধ হয়ে গেল। আয়েশী কতক্ষণ নিস্তেজ হয়ে চেয়ে রইল মৃদুলের লাশের দিকে। চোখের পাতা ফেলল না কয়েক মুহূর্ত। কান্না থেমে গেছে তার। চুপচাপ শুধু দূর থেকে দেখেই যাচ্ছে মৃদুলকে।
মহিলারা আয়েশীকে কাঁদতে না দেখে নিজেরাই কেঁদে উঠলেন। আয়েশীর চুলে হাত বুলিয়ে সুধালেন,
‘ আয়েশী, মা আমার। কেন চোখের পানি আটকে রেখেছিস? কাঁদ মা। কেঁদে নিজের মধ্যে জমে থাকা তুফানকে শান্ত কর। ‘
আয়েশী তখনো নিরুত্তর। অবশ হয়ে আসছে তার হাত পা। মন চাইছে, পা দুটোকে টেনে হিঁচড়ে মৃদুলের পাশে এসে বসতে। কিন্তু এখন মনের কথা শোনার মত অবস্থাতেই নেই সে। আশপাশে কি হচ্ছে, কে যাচ্ছে, কে আসছে, কে কাঁদছে কিছুই তার মাথায় প্রবেশ করছে না। শুধু চোখের সামনে একটাই দৃশ্য ভাসছে। প্রিয়তমের থেতলে যাওয়া ফ্যাকাসে মুখ।
আয়েশীর হাত আটকে আছে মহিলার হাতে। আয়েশী একসময় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল সেই মহিলার থেকে। মহিলা আয়েশীর হাত ছেড়ে আঁচলে মুখ চেপে কাঁদতে লাগলেন।
আয়েশী হেলেদুলে এগিয়ে গেল সামনে। শাড়ীর আঁচল মাটিতে ঘেঁষে ঘেঁষে যাচ্ছে। আয়েশী ধপ করে বসে পড়ল মৃদুলের লাশের পাশে। ঘাড় হালকা কাত করে অপলক দেখেই চলেছে তার কলিজার টুকরোকে। এটাই কি শেষ দেখা তবে?
আয়েশী নিজের হাত আস্তে করে এগিয়ে আনলো। মৃদুলের চোখের পাতা আস্তে করে বন্ধ করে দিল। ঘর ভর্তি লোকের সামনে মৃদুলের রক্তে মাখা কপালে নিজের শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল। দীর্ঘ সময় ধরে নিজের ঠোঁট ঠেসে রাখলো মৃদুলের কপালে। অতঃপর আচমকা ডুকরে কেঁদে উঠল। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে মৃদুলের সারা মুখে অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিল। ক্ষান্ত হচ্ছে না সে। কাঁদছে আর পাগলের মত মৃদুলের সারা মুখে চুমু দিচ্ছে। ঘর ভর্তি মানুষ, অথচ আজ আয়েশী একটুও লজ্জা পাচ্ছে না। এই প্রথম মৃদুলের গায়ে সে তার স্পর্শ আঁকলো। কত স্বপ্ন ছিল, বিয়ের পর তারা একজন আরেকজনকে প্রথম আলিঙ্গন করবে। সারারাত ধরে ডুবে থাকবে একজন অন্যজনাতে। মিশে রইবে, প্রেমিকের দেহমনের সাথে। অথচ আফসোস। উপরওয়ালার তা হতে দিলেন না। তাইতো বিয়ের আগে তাদের সমস্ত স্বপ্ন ধুলিস্মাৎ করে দিলেন। আয়েশীর কাছ থেকে তার কলিজার টুকরোকে কেড়ে নিলেন। কি নির্দয় তিনি!
আয়েশী যখন মৃদুলকে স্পর্শ করছিল, ধ্রুব তখন পাশে দাঁড়িয়ে রাগের সমুদ্রে স্নান করছিল। হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে, মুখে দুঃখী ভাব বজায় রাখছিল। মৃত মানুষকে নিয়ে এত আদিক্ষেতার কি আছে? কিন্তু ধ্রুব নিরুপায়। এখন দাঁতে দাঁত চেপে আয়েশীর এমন আলহাদিপনা সহ্য না করতে পারলে, সমস্ত প্ল্যান মাঠে মারা পড়বে।
আয়েশী মৃদুলের মরদেহ সর্বশক্তি দিয়ে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরল। চিৎকার করে বিলাপ করতে লাগল,
‘ আমি তোরে খুব ভালবাসতাম রে মৃদুল। তুই কেন আমাকে ফাঁকি দিলি? তুই তোর কথা রাখতে পারলি না মৃদুল। আমার আর তোর বাম পাঁজরের হাড় হওয়া হলো না রে, মৃদুল। এই মৃদুল, এই আমার কলিজা। একবার তাকা। কবরে যাওয়ার আগে একবার অন্তত বলে যা, তুই আমাকে ভালোবাসিস। বিশ্বাস কর, এই একটা শব্দ শোনার পর আমি আর তোকে নিয়ে অভিযোগ শুনাবো না। শুধু একবার ভালোবাসি বলে আমার মনের তৃষ্ণাটা নিভিয়ে দে। এই ভয়ঙ্কর তৃষ্ণা আমি সারাটাজীবন কিভাবে বয়ে বেড়াবো রে, মৃদুল। মৃদুল রে……’
আয়েশীর কান্না ও বিলাপ শুনে কক্ষে উপস্থিত সবার চোখে পানি এসে গেছে। মৃদুলের মা কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারাচ্ছেন বারবার। মৃদুলের বাবা মৃদুলের পাশে থম হয়ে বসে আছেন। এখন পর্যন্ত মুখে রা কাটেন নি। বিড়বিড় করে ক্রমশ ইয়াসিন সূরা পড়ছেন। নিমিষেই বিয়ে বাড়ির ঝকঝক করা আসর, মরা বাড়ির শোকে পরিণত হল। সবার মুখে কান্না, বিলাপ, আহাজারি। এই মুর্হুতে আয়েশীর মৃদুলের বাহুডোরে থাকার কথা ছিল। কিন্তু তার বদলে মৃদুলের মরদেহ নিজের বুকের সাথে চেপে রেখে আয়েশী পাগলের ন্যায় হাউমাউ করে কাঁদছে। ইশ, এই কষ্ট আর চোখে দেখা যাচ্ছে না।
আয়েশী কান্না করতে করতে নিজের চুল ছিঁড়ে ফেলছে। তুষারসহ আয়েশীর বাবা চাচা সবাই আয়েশীকে শান্ত করতে চাইছে। বুঝানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু আয়েশীকে মৃদুলের থেকে ছাড়িয়ে নেওয়া কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু আর কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃদুলকে কবর দেওয়া হবে। হাতে বেশি সময় নেই। তাই কোনো উপায় না পেয়ে সবাই মিলে আয়েশীকে ইনজেকশন দিয়ে অজ্ঞান করিয়ে দিলেন। আয়েশী বিড়বিড় করে দুবার মৃদুলের নাম জপে মায়ের বুকের মধ্যেই জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়ল।
অতঃপর আয়েশীকে তার কক্ষে দরজা আটকে রেখে মৃদুলের স্ট্রেচার কবরস্থানে নেওয়া হলো। আয়েশী জ্ঞান হারিয়ে মরার মত পড়ে রইল বিছানায়। ওদিকে তার প্রিয়তমের বুকের উপর মাটি ঢালা হচ্ছে। একসময় মৃদুলের শেষ অংশটুকুও মাটির নিচে চাপা পড়ল। সেই সাথে চাপা পড়ল, আয়েশী ও মৃদুলের এক অসমাপ্ত প্রেমকাহিনী। হায়, নিয়তির খেলা এত নিষ্ঠুর কেন?
#চলবে
আজকের পর্ব লেখার সময় আমার নিজের প্রচুর খারাপ লেগেছে। জানিনা, আমি পাঠকদের কাঁদাতে পেরেছি কিনা। যদি পেরে থাকি, তবে আমি লেখিকা হিসেবে স্বার্থক!
আর হ্যাঁ, গল্প পড়ে চুপচাপ চলে যাবেন না। একটা গল্প লেখার সময় লেখকের অনেক কষ্ট হয়। তাই আমি মনে করি পাঠকরা মন খুলে রিয়েক্ট ও কমেন্ট করার দ্বারা নিজেদের যোগ্য পাঠক বলে পরিচয় দেবেন। ভালোবাসা!
গল্প সম্বন্ধে সমস্ত আপডেট সবার আগে পেতে লেখিকার গ্রুপে জয়েন হোন,
আভার পাঠকঘর📚-stories of Ava Islam Ratri