#৫ম_তলার_মেয়েটাপর্ব_২৩
হাজেরা অসম্ভব ঘামছেন আর তাঁর দম বন্ধ বন্ধ লাগছে। গাড়ীর গ্লাস সব খুলে দেয়া হলো। তবুও খারাপ লাগছে হাজেরার। হাজেরা নওমির হাত চেপে ধরলো যেন একটু উষ্ণতা পাবার চেষ্টা। নওমিও আরেকটা হাত হাজেরার হাতের উপর রেখে বোঝাতে চাইছে আমি আছি তো।নওমি বুঝতে পারলো হাজেরার খুব কষ্ট হচ্ছে।কষ্টে হাজেরার চোখ,মুখ কুঁচকে যাচ্ছে বারবার।
ড্রাইভারকে নওমি বলল-
—মামা একটা হসপিটালে নিয়ে চলেন, যেইটা সব চেয়ে কাছে হয়।আন্টিকে এখনই ডাক্তার দেখাতে হবে। তাড়াতাড়ি।
ড্রাইভার, হাজেরার ভাই হাফিজকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিলো।উনি চলে এলেন।
নওমি কিছু করতে পারবে না জেনেও অপেক্ষা করতে লাগলো।তার কিছুতেই হাসপাতালের বাইরে পা রাখতে ইচ্ছে করছিল না।ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে হাজেরার ভাই সব কিছু ব্যবস্থা করলেন।
ড্রাইভার, নওমিকে দেখিয়ে হাফিজকে বলল-
—স্যার উনি ম্যাডামের সঙ্গে ছিলেন। উনিই বলেছিলেন তাড়াতাড়ি করে হাসপাতালে নিয়ে আসতে।
হাফিজের চোখে কৃতজ্ঞতা।
হাফিজ বললেন –
—তুমিই তাহলে হাজেরার সাথে ছিলে? খুব ভালো করেছ হসপিটালে তাড়াতাড়ি নিয়ে এসেছ।ডাক্তার বলল ,দেরি হলে অনেক খারাপ কিছু ঘটে যেতো।
কিন্তু আমি তোমাকে চিনতে পারছিনা।কে তুমি বলো তো।
—আমি নওমি।আন্টিদের ৫ম তলায় থাকি।
এবার হাফিজের চোখের রং পাল্টে গেল। ধমকের স্বরে বলতে লাগলেন-
—তুমিই নওমি? তোমার জন্যই হাজেরার এই অবস্থা! তোমার সাহস কি করে হয় ,এখনো দাঁড়িয়ে থাকার?
নওমি একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। অসম্ভব ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পরল। কেন এই লোক তার সঙ্গে এমন করছে বুঝতে পারলো না।
তার চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে যাচ্ছিলো।
—এই মেয়ে তোমার বাবা কই?
নওমি আমতা আমতা করতে লাগল।
—আমার বাবা.. আমার বাবা তো অনেক আগেই মারা গেছে।
এবার হাফিজের মনে পড়লো মেয়েটা তো কিছুই জানে না। অতিরিক্ত রাগে মাথা গুলিয়ে গেছে তাঁর।
এমন সময় সে দিক দিয়েই হেঁটে আসছিলেন স্বর্ণার বাবা।নওমিকে দেখতে পেয়ে কাছে এলেন-
—আরে নওমি মা!তুমি এখানে? তোমার কোন পেশেন্ট এখানে ভর্তি আছে?
নওমি কথা বলতে পারছিল না।
স্বর্ণার বাবা ডাঃ সিরাজুল ইসলাম নওমির মাথায় হাত রেখে বললেন-
—আরে মা কাঁদে না। আল্লাহতালা রোগ দিয়েছেন তিনিই ভালো করে দিবেন।
তিনি ভাবছেন নওমি কাঁদছে তার আত্মীয় অসুস্থ বলে। ডাক্তার সিরাজুল ইসলাম একজন হার্ট স্পেশালিস্ট।ডাক্তারের পেছনে একদল ইন্টার্ণ ডাক্তার।
ডাক্তার সিরাজুল ইসলাম হাফিজের সাথে কথা বলে হাজেরার অবস্থা জেনে নিলেন।হাজেরা বেগমের জরুরী কিছু টেস্ট করা হচ্ছে এর পরেই বোঝা যাবে প্রকৃত অবস্থা। সন্দেহ করা হচ্ছে হার্টের কোন সমস্যা।এর আগে কখনো হার্টের সমস্যা বুঝতে পারেননি তবে ব্লাড প্রেসার সবসময় হাই থাকত। ডাঃ সিরাজুল ইসলাম উনাকে বললেন, এখন উনি রাউন্ডে আছেন। একটু পরেই হাজেরা বেগমকে দেখতে যাবেন।
সিরাজুল বললেন-
—নওমি তুমি বাসায় চলে যাও। এখানে শুধু শুধু থাকবে। পেশেন্টের সঙ্গে দেখা করতে পারবেনা।
উনার জন্য দোয়া করতে থাক।ও জানা হলো না তো উনি তোমার কে হন?
—আমার বাড়ীওয়ালা আন্টি।
ডাক্তার মনে মনে কিছুটা অবাক হলেন, বাড়িওয়ালির জন্য নওমি এভাবে কাঁদছে!
স্বর্ণার বাবা ডাঃ সিরাজুল ইসলাম অনেক ভালো একজন মানুষ। বেশ কয়েক বার ওদের বাসায় গেলেও ওর বাবার সঙ্গে দেখা হয়েছে হাতে গোনা দুই বার। তাতেই উনি নওমিকে মনে রেখেছেন! তার মানে কি তাশফি যে তার মাকে তার কথা বলেছিল।তার মা নিশ্চয়ই ডাক্তার সিরাজুল ইসলামকে বলে দিয়েছেন নওমিকে তাঁদের ছেলে পছন্দ করে।
হসপিটাল থেকে বের হয়ে নওমির এলোমেলো লাগছে।এখন আর ভার্সিটিতে যাওয়ার মানেই হয় না ,ইমপোর্টেন্ট ক্লাসগুলো শেষ হয়ে গেছে। হঠাৎ মনে হলো বাড়ীওয়ালা আঙ্কেল তো এলো না, তাঁকে কি খবর দেয়া হয়নি? কিন্তু নওমির কাছে তো উনার নাম্বার নেই। দারোয়ানের নাম্বার আছে। দারোয়ানকে জানালেই খবর পৌঁছে দিবে বাসায়।
নওমি দারোয়ানকে ফোন করে সব কিছু বলল। আর খুব তাড়াতাড়ি খবরটা পৌঁছে দিতে বলল।
নওমির এলোমেলো ভাবে হাঁটছে, তার মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না হাজেরার ভাই কেন তাকে এমন ভাবে ঐ সব কথা বলল। কেন তাকে দোষারোপ করছে। হাজেরার অসুস্থ হওয়ার পেছনে সে কিভাবে দায়ী হতে পারে?আর তার বাবার কথাই জিজ্ঞেস করলো কেন? এমনভাবে বলল যেন তার বাবা বেঁচে আছে।কি জানি, কিছুই বুঝতে পারছে না।
বাসায় যাওয়ার সময় দোতলায় একবার দেখা করে যাবে ঠিক করলো ।দাদু তো নিশ্চয়ই আছে। কিছু হলেও তো বুঝতে পারবে।বাড়ীওয়ালার বোন জামাই রশিদের ঘটনার জন্যই কি তাকে দোষারোপ করছে তাঁরা?এটা নিয়েই কি বাসায় ঝামেলা হয়েছে?আর বাড়ীওয়ালা আন্টি রাগ করে চলে যাচ্ছেন? এমনটা হলে খুব খারাপ হবে।সে তো এমন কিছু করেনি যে তাকে দোষ দিচ্ছে।তার মামা হোসেন কি কিছু বলেছে তাদের?হাজারো চিন্তা নওমির মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল।
নওমির মাথাটা কেমন ভোঁতা হয়ে আছে।কারো সাথে কথা বললে মনে হয় ভালো লাগতো।তাশফিকে কল দিলো সে।
নওমি এই প্রথম তাশফিকে কল দিলো।তাশফি কল দিলে সে কথা বলে।কখনো তাশফিকে সে কল করেছে কিনা মনে করতে পারলো না। তাশফি খুব অবাক হয়ে জানতে চাইলো-
—নওমি তুমি ঠিক আছ?কোন সমস্যা হয়নি তো?
—না কোন সমস্যা হয়নি,ঠিক আছি।
—তুমি কি কাঁদছিলেন?আমাকে সত্যি করে বল তো কি হয়েছে?
—আমার ল্যান্ডলর্ড হসপিটালে।আমি এতক্ষণ সেখানেই ছিলাম।
—এই জন্য কাঁদছ?
—এখন কাঁদছি না।একটু আগে কেঁদেছিলাম।
—উনার অবস্থা বেশি ক্রিটিক্যাল?
—জানি না।ডাক্তার বলেছেন ,টেস্টের রিপোর্ট দেখে দ্রুত ব্যবস্থা নিবেন।
—কোন হসপিটালে?
—পি জি -তে। আঙ্কেলের সাথেও দেখা হলো।
—বাবার সাথে দেখা হলো?
—হু
—একদম চিন্তা করো না।সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।
—আমার একদম ভালো লাগছে না।সবাই শুধু আমাকেই দোষারোপ করে।আমি কি করেছি? কারো কোন ক্ষতি তো কোনদিন করিনি।
তুমি বলতে পার সব সময় কেন আমাকে সবাই দোষারোপ করে?
নওমি এর আগে কখনো তাশফিকে তুমি করে বলেনি।তুমি শুনে তাশফির খুব ভালো লাগছে কিন্তু আবার চিন্তাও লাগছে খুব ,কারণ মনে হচ্ছে নওমি কোন কারণে খুব কষ্ট পেয়েছে।সে এখন নিজের মধ্যে নেই।তার মনের ভিতরে লুকানো কথাগুলোই বেরিয়ে আসছে।
নওমি এখন কোথায় জেনে নিল তাশফি।নওমিকে বলল,’কাছাকাছি কোন কফি শপে গিয়ে ওয়েট কর।যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি আসছি।’
—না তোমাকে আসতে হবে না।আমি বাসায় চলে যাচ্ছি।
—নওমি একটু ওয়েট করো প্লিজ।যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি আসছি।
অফিসে এই মুহূর্তে অনেক কাজের চাপ। তার পরেও ইমার্জেন্সির কথা বলে দুই ঘণ্টার ছুটি নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে গেলো তাশফি।নওমি এক কাপ কফি নিয়ে আস্তে আস্তে চুমুক দিতে লাগলো।মনে হচ্ছে কোন দুষ্প্রাপ্য জিনিস সে খাচ্ছে । তাড়াতাড়ি কিছুতেই শেষ করা যাবে না। এই সময় কফি শপে তেমন একটা ভিড় নেই। ওয়েটার বার বার জিজ্ঞেস করছে আর কিছু লাগবে কিনা?নওমি একা বসে আছে তাকে ডিস্টার্ব করার জন্যই এমন করছে। আবার দূরে দাঁড়িয়ে দুইটা ছেলে মিলে কি যেন বলছে আর পিট পিট করে হাসছে। নওমির একটু একটু ভয় লাগছে।
নওমির মনে হলো বাসায় চলে গেলেই ভালো হতো। খুব অস্বস্তি লাগছে তার।একা একা কখনও সে এই সব জায়গাতে আসেনি। এইজন্য হয়তো আরো বেশি ভয় আর অস্বস্তি লাগছে। এখন মনে পড়লো তাশফির তো অফিস আছে। ছুটি ম্যানেজ করে আসতে হয়তো কষ্ট হবে। শুধু শুধু তাশফিকে কল করতে গেলো।
তাশফি শপের দরজায় দাঁড়িয়ে চোখ বুলিয়ে নিলো ।এর পরে নওমির সামনে বসেই জিজ্ঞেস করল-
—কিছু অর্ডর করেছ?
—এই কফি খেলাম।আর কিছু খাবো না।আপনি কিছু খেতে চাইলে অর্ডার করেন?
তাশফি তাকিয়ে রইল নওমির দিকে।একটা মেয়ে, যাকে সে ভালোবাসে সেই মেয়েটা তার জন্য অপেক্ষা করছে এটা ভাবতেই সে রোমাঞ্চিত হচ্ছে। তাশফি তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।নওমি এটা খেয়াল করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিলো।
নওমির কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে।
—তুমি কিছুক্ষণ আগে ফোনে আমাকে তুমি করে বলেছিলে।এখন আবার আপনি করে বলছ কেন?
—আপনার এভাবে অফিস ফেলে আসা ঠিক হয়নি।
—এটা আমার প্রশ্নের উত্তর হলো না।
নওমি মাথা নিচু করে বসে রইলো। খুব সুন্দর মিষ্টি একটা ঘ্রাণ নাকে লাগছে, তাশফির পারফিউমের ঘ্রাণ।তার মনে হতে লাগলো,চুলটা কি ঠিক আছে আমার,আজকের ড্রেসটাও খুব বেশি সুন্দর না, কেঁদে কেটে চোখও মনে হয় ফোলা ফোলা-দেখতে খুব বিশ্রী লাগছে মনে হয়।
আর তাশফি ভাবছে এই মেয়ে কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে বাচ্চাদের মত আদর আদর চেহারা বানিয়ে ফেলেছে। খুব ইচ্ছে করছে গালটা টিপে দিতে। কিন্তু নিজের কথা মনে হতেই, ড্রেসআপ, হেয়ার সব কিছু ঠিক আছে কি না কে জানে।এই প্রথম তাদের ডেটিং।যদিও এটাকে ডেটিং বলা ঠিক হবে কিনা কে জানে। সে এসেছে নওমিকে মানুষিক সাপোর্ট দিতে।এখন ব্যপারটা অন্য রকম লাগছে।ফোনে কথা বলার সময় যেমন মনে হয়েছিল এখন সেই দূঃখী ভাবটা নওমির মধ্যে নেই।ওকে দেখে মনে হচ্ছে খুব লজ্জা পাচ্ছে।
নওমির আসলেই খুব লজ্জা লাগছে।এভাবে তাশফিকে ফোন করা ঠিক হয়নি।কি জানি ভাবছে তাশফি। নিশ্চয়ই খুব নির্লজ্জ মেয়ে ভাবছে।
—নওমি কিছু এটা খাও।মেনু দেখ কি খাবে।
নওমি মাথা ঝাঁকিয়ে মানা করলো।
—এই প্রথম আমরা একসাথে বসেছি, একসাথে দুজনে কিছু খাই।
—তাহলে কফি খাই?
—আচ্ছা ঠিক আছে।
স্বর্ণা আর তাশফি দুই ভাইবোন তাদের লাইফের প্রতিদিনের ঘটনাই কমবেশি শেয়ার করে। এভাবে মুখে মুখে শুনে অনেকটা পরিচিত হয়ে গিয়েছিল নওমি। একদিন স্বর্ণার মোবাইলে ছবি দেখেই ভালোলাগা ঘিরে ধরলো তাশফিকে।এরপর স্বর্ণার সাথে ওর ভার্সিটিতে গেল শুধু নওমিকে দেখতে।
ছবির থেকে ওকে আরো বেশি ভালো লাগলো। এবার যেন ভালোলাগা ঘিরে ধরলো না একেবারে চেপে ধরলো।দম হাঁসফাঁস লাগতে লাগলো নওমির জন্য।
মনে মনে কত কল্পনা করে রেখেছিল প্রথম ডেটিং কেমন হবে, কোথায় হবে, কিভাবে নওমিকে সারপ্রাইজ দিবে। আচ্ছা যা হবার হয়ে গেছে এর পরেও এই সব করা যাবে।
একটা মানুষ কতটা ভালোবাসলে আরেকজনের মন জয় করে ফেলতে পারে , নওমি এটা ভাবলে অবাক হয়ে যায়।তাশফি আর তার বেলায় মেটা হয়েছে ।সেটাই হয়তো ভালোবাসার শক্তি আর সেই শক্তিই নওমিকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে তাশফিকে।আজকের আগে তাশফিকে এতটা অনুভব করেনি নওমি।হসপিটাল থেকে বেরিয়ে আর কাউকে না কেনই বা শুধু তাশফির কথা মনে হবে?
নিজের কঠিনতম সময়ে বা দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে মানুষ নিজের অজান্তেই চায় তার সবচেয়ে কাছের মানুষ, ভালোবাসার মানুষ যেন তার পাশে এসে দাঁড়ায়। কিছু কথা না হোক চোখে চোখ রেখে একটু সান্ত্বনা,একটা হাত হাতের উপর রেখে একটু উষ্ণতার পরশ ,এটাই তো যথেষ্ট।
নওমির মোবাইল বেজে উঠলে দেখলো স্বর্ণা কল করেছে।নওমি , স্বর্ণার কাছে ধরা পড়ে গেছে এমন একটা ভাব নিয়ে তার তাশফিকে বলল-
—স্বর্ণা কল করেছে। এখন ওকে আমি কি বলবো?
—আগে দেখো কি বলে? আর যেটা সত্যি সেটাই বলো।
নওমি অবাক হয়ে বলল-
—আমি আপনার সঙ্গে আছি, বসে বসে দু’জন কফি খাচ্ছি এটা স্বর্ণাকে বলবো?
চলবে…
#ফাহমিদা_লাইজু