#Fearপর্ব ৩
Writer: Tanjima Islam
শীত চলে গেছে, বাতাসে গোলাপি ফুলে ছেয়ে থাকা পিচ ট্রি গুলো হালকা দুলে উঠছে। বসন্তের আগাম বার্তা জানাচ্ছে প্রকৃতি, দূরে সারি সারি পাম গাছ দাঁড়িয়ে আছে।
“লা ফরনেজ” রেস্টুরেন্টের এক কর্নারে বসে আছে ডক্টর সার্জিও হ্যালোরান। ব্ল্যাক জিন্স আর ডিপ ব্লু কালারের শার্ট পরেছে সে। শার্টের হাতা ফোল্ড করে রেখেছে, ঝাকড়া চুল গুলো বাতাসে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। ফ্লোরা সেলজারের সাথে বিকেল চারটায় এখানেই মিট করার কথা ছিল তার, বেশিক্ষণ ওয়েট করতে হয়নি।
ডার্ক গ্রিন কালারের জাম্প সুট পরেছে ফ্লোরা, চুল ছেড়ে রেখেছে। রেস্টুরেন্টে ঢুকে এদিক ওদিক তাকালো ফ্লোরা, বেশি খুজতে হয়নি। সার্জিওর অপজিটের চেয়ারে বসল ফ্লোরা। সার্জিও মুগ্ধ হয়ে দেখছে ফ্লোরাকে, মেয়েটার এক এক সময় এক এক রূপ মুগ্ধ করে তাকে।
সার্জিও এসেই কফি অর্ডার করেছিলো, ফ্লোরা এসে বসতেই ওয়েটার কফি নিয়ে এল।
ফ্লোরা কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলল,” আপনাকে এই শার্টটাতে বেশ ভালো লাগছে।
সার্জিও সলজ্জ হেসে বলল, ” থ্যাংকস, আপনাকেও অনেক সুন্দর লাগছে।
ফ্লোরা স্মিত হেসে বলল, “থ্যাংকস।
কিছুক্ষণ নিরব থাকল দুজনেই, ফ্লোরা বুঝে উঠতে পারছেনা কোথা থেকে শুরু করবে। সব কথা গুছিয়ে রেখেছিল, কিন্ত কেন জানি সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। নিরবতা কাটিয়ে সার্জিও বলল,” আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল।
ফ্লোরা তাকিয়ে বলল, ” জি বলুন।
সার্জিও কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল, “আপনার বাবা কি ইংল্যান্ডের বাসিন্দা!?
ফ্লোরা বলল, ” না, আমরা ইটালিয়ান, তবে ব্যাবসায়িক কাজে তিনি ইংল্যান্ডে ছিলেন বহুবছর। সেই সুবাদে আমার শৈশব লন্ডনেই কেটেছে।
সার্জিও বেশ অবাক হল, ফ্লোরার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “ইতালিতে কবে এসেছেন!?
ফ্লোরা মনে মনে কথা গুছাচ্ছিল, বিরক্ত হল সার্জিওর প্রশ্নে কিন্ত তা বুঝতে না দিয়ে স্মিত হেসে বলল, “আমার বয়স যখন নয় বছর, তখন থেকেই ঐ অদ্ভুত দুঃস্বপ্ন দেখতে লাগলাম। ডক্টর নাকি বলেছিল আমাকে দূরে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যেতে, তাহলে ঠিক হয়ে যাবো। পরে আব্বু-আম্মু ঠিক করলেন ইতালিতে আসবে। ভ্যাটিকান সিটিতে আব্বুর কেনা একটা বাগানবাড়ি ছিল, আমরা যেখানে এখন থাকি। লন্ডনে থাকতে প্রায়ই ছুটিতে ভ্যাটিকানের বাগানবাড়িতে বেড়াতে আসতাম আব্বু-আম্মুর সাথে।
একটু থেমে আবার বলল ফ্লোরা,” ভ্যাটিকানে চলে এলাম, তারপর আর লন্ডন ফিরে যাইনি। এখানেই সেটেল হয়ে গেলাম।
সার্জিও কফি শেষ করে মাথা নাড়ল, তারপর বলল,” তো, আপনি কিছু বলতে চাইছিলেন।
ফ্লোরা একটু নড়ে চড়ে বসল, সার্জিওর দিকে তাকিয়ে বলল, ” প্রথমেই বলে রাখি, আপনাকে অনেক বিশ্বাস করে কথা গুলো বলছি। শোনার পর আপনি কি ভাববেন সেটা আপনার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার।
আমি আমার নয় বছর বয়স থেকেই ঐ অদ্ভুত দুঃস্বপ্ন দেখছি। প্রথম প্রথম ভয়ে রুমেও একা থাকতে পারতাম না, প্রতিরাতে ঘুম ভেঙে যেত। ধীরে ধীরে এটা আমার অভ্যাসে পরিণত হল,। ডক্টর দেখালে বলত, আমি মজা করছি বা হরর মুভি দেখে কল্পনা করছি বা ভয় দেখানোর জন্য বানিয়ে বানিয়ে বলছি ব্লা ব্লা ব্লা।
এমনকি আমার আব্বু-আম্মুও এসব শুনেও শুনত না, এদিকে একটু ঘুমের তৃষ্ণায় দিনদিন আমার অবস্থা খারাপ হতে লাগল। আমি প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে রাতে স্লিপিং পিল খেয়ে ঘুমিয়েছি। সেটার ব্যাড ইফেক্ট পড়ে আমার অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেল। পরে আব্বু-আম্মু আমাকে স্লিপিং পিল নেওয়াই বন্ধ করে দিলেন।
একসময় এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম আমি, কিন্ত গত রাতে ঐ মেয়েটার কথা স্পষ্ট শুনতে পেলাম।
এটুকু বলে একটু থামল ফ্লোরা, ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে পানি খেল। সার্জিও বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনছে, ফ্লোরা বোতল রেখে আবার বলতে লাগল, ” ঐ মেয়েটা জানালায় দাঁড়িয়ে বাচ্চাটার দিকে ফিরে বলল, ওরা কেড়ে নিল তোকে! হা ঈশ্বর আমাকে ক্ষমা করো!! এ ছাড়া আমার আর উপায় নেই!!!আমি আবার ফিরে আসব!!!!
বলেই লাফ দিল মেয়েটা।
সার্জিও কিছুটা আঁতকে উঠল, অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে বলল, ” মানে!?
ফ্লোরা অসহায় চোখে তাকিয়ে বলল, ” হ্যাঁ এটাই বলেছে মেয়েটা।
সার্জিও কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,” গতরাতের কথা কি আপনার আব্বু-আম্মুকে বলেছেন!?
আব্বু-আম্মুর কথা শুনে সেদিন সন্ধ্যার কথা মনে পড়ল ফ্লোরার। কেন জানি মনে হচ্ছে সবকথা খুলে বলা উচিৎ, যদিও এতে কোনো কাজ হবে বলে মনে হচ্ছে না তার। ফ্লোরা মাথা নাড়িয়ে না করে বলল, ” তবে সেদিন আপনার চেম্বার থেকে ফেরার পর আম্মুর ভেতর অদ্ভুত অস্থিরতা দেখেছি।
সার্জিও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “যেমন!?
ফ্লোরা বলল, “সারাদিন রুম থেকে বের হয়নি, সন্ধ্যায় আম্মুর রুমে গিয়ে দেখলাম কারও সাথে ফোনে কথা বলছে। কথাবার্তায় বুঝলাম আব্বুর সাথে কথা বলছে। কিন্ত
সার্জিও ধৈর্য হারিয়ে বলল,” কিন্ত কি!!
ফ্লোরা বলল, ” আম্মুর কথায় বুঝলাম, আব্বু-আম্মু আমার কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছে।
সার্জিও আগেই সন্দেহ করেছিল মিসেস ফিয়নাকে, তাই অতটা অবাক হল না। কিন্ত সেও বুঝতে পারছেনা আসল ঘটনাটা কি।
ফ্লোরাকে বলল,” আমি আপনার আব্বুর সাথে দেখা করতে চাই।
ফ্লোরা অবাক হয়ে বলল,” কি বলবেন দেখা করে!?
সার্জিও বাকা হেসে বলল, ” এসবের উত্তর একমাত্র সেই দিতে পারবে।
রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে বাড়ির পথ ধরল ফ্লোরা, বিকেলের সূর্য উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। রোডের পাশে দাড়িয়ে ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করছে সে। সার্জিওর সাথে কথা গুলো শেয়ার করার পর বেশ হালকা লাগছে নিজেকে। কিন্ত সার্জিওর বলা কথাটা বেশ ভাবাচ্ছে তাকে, আব্বু-আম্মু কিছু একটা লুকাচ্ছে বুঝতে পারছি। কিন্ত আমার এই দুঃস্বপ্ন দেখার ব্যাপারে আব্বু কিভাবে জানবে!! কিছুই মাথায় ঢুকছেনা।
হটাৎ কারও ডাকে চমকে পেছনে ফিরলাম, এডমন্ড আমার দিকে ছুটে আসছে আর জোরে জোরে ডাকছে আমাকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই এডমন্ড এসে আমাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে ছিটকে পড়ল রোডের পাশে।
সাথে সাথে একটা মাইক্রোবাস দ্রুত গতিতে আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে গেল।
ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেলাম। এডমন্ড উঠে আমার মুখ ধরে বারবার জিজ্ঞেস করছে,” তুমি ঠিক আছো!! ফ্লোরা ঠিক আছো!?
আমি শুধু মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম। বুঝতে পারছিনা ট্যাক্সির জন্য দাঁড়িয়ে থেকে হটাৎ রোডের মাঝে কিভাবে গেলাম!! আর এডমন্ড! এডমন্ড এসে না বাচালে তো, এতক্ষণে আমার পরকাল নেমে আসত!!
কোনোমতে উঠে দাড়ালাম, খেয়াল করলাম এডমন্ডের দুই হাতের বেশ অনেকটা ছিলে কেটে গেছে, কপালের এক পাশে কেটে গেছে। ওকে এমন রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে আমার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। আশপাশের লোকজন দ্রুত একটা ট্যাক্সি ডেকে দিল, আমি এডমন্ডকে নিয়ে ট্যাক্সিতে উঠলাম। এডমন্ডের গায়ের সাদা শার্টে ছোপ ছোপ রক্ত লেগে আছে, খুব কান্না পাচ্ছে আমার।
হসপিটালে পৌছতেই কিছু নার্স এসে নিয়ে গেল ওকে, সাথে আমাকেও নিয়ে গেল। আমি বললাম,” ওর ট্রিটমেন্ট করুন, আমি ঠিক আছি। ডক্টর এসে বলল, ” হ্যাঁ, তা তো দেখতেই পাচ্ছি। আমার বাম হাতের কব্জি ধরে কনুইতে হেক্সিসল টাইপ তরল কিছু একটা লাগিয়ে দিল ডক্টর। সাথে সাথে জালাপোড়া অনুভব হল আমার, হাত উল্টো করে দেখলাম বেশ খানিকটা ছিলে গেছে। নার্স ড্রেসিং করে এডমন্ডের হাতে ব্যান্ডেজ করে দিল, ডক্টর ওকে কিছু মেডিসিন লিখে দিল।
হসপিটাল থেকে বেরিয়ে এডমন্ডকে নিয়ে ওর বাসায় গেলাম। এডমন্ডের মা মিসেস এলিটা উইলিয়াম বেশ ভয় পেয়েছে ছেলেকে এই অবস্থায় দেখে।
আমি কিছু বলার আগেই এডমন্ড বলল,” আমাকে এক্সিডেন্ট থেকে বাচিয়েছে ফ্লোরা।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম এডমন্ডের দিকে।
কিছুক্ষণ এডমন্ডের বাসায় থেকে বেরিয়ে পড়লাম। এলিটা আন্টি রাতে ডিনার করে যেতে বলছিলেন। কিন্ত অন্য একদিন করব বলে বেরিয়ে এলাম।
সন্ধ্যা হতে চলেছে, এর মধ্যে আম্মু বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছে, বলেছি এক ফ্রেন্ডের বাসায় আছি, আসতে লেইট হবে।
এডমন্ডের বাসা থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে বাসায় চলে এলাম। বাসার সামনে নেমে ভাড়া দিয়ে ঢুকলাম, বাইরের লাইটটা অফ, সন্ধ্যা নেমেছে এখনও লাইট জালায়নি কেন!! ভাবতে ভাবতে এগিয়ে চললাম।
হটাৎ মনে হল আমার পেছন পেছন কেউ আসছে, একটু থেমে দাড়ালাম। আবার হাটতে লাগলাম, সিড়ির কাছাকাছি যেতেই কানে একটা নারী কন্ঠঃ এলো, ফিসফিস করে ডাকছে,”ফ্লোরা”!ফ্লোরা”!! এদিকে এসো!!
চমকে পেছনে ফিরলাম, দমকা বাতাস বয়ে গেল আমার ওপর দিয়ে। শরীরটা কেমন ভার ভার লাগছে, ঘুরে সামনে তাকাতেই চমকে উঠলাম, আবছা অন্ধকারের মাঝে সাদা নাইট গাউন পরে এক নারীমূর্তি দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। সাদা ফ্যাকাশে মুখ, তার চোখ জোড়া যেন শূন্য কোটর!! ভয়ে আতংকে মুখ থেকে রক্ত সরে গেল আমার!!
(চলবে)
পেইজে প্রায় আড়াইশো জন গল্প পড়েন, কিন্ত লাইক কমেন্ট পাইনা। রেসপন্ড না পেলে এত কষ্ট করে লেখার উৎসাহ হারিয়ে যায়🙂। রেসপন্ড না পেলে নেক্সট আর দিবনা।