#Fearপর্ব ৫
Writer: Tanjima Islam
ভ্যাটিকানে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামছে, সূর্য ডোবা রক্তিম আকাশে এক ঝাক “কালেম” পাখি নীড়ে ফিরে যাচ্ছে।
এক মগ কফি হাতে ব্যালকনিতে একটা রকিং চেয়ারে বসে আছে ডক্টর সার্জিও হ্যালোরান।
সেলজার ফ্যামিলির বিষয়টা নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন সে।
দুপুরে মি. প্রিয়েতোর সাথে তার রুমে যাওয়ার পর, প্রিয়েতো আর সার্জিও মুখোমুখি সোফায় বসল।
বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা কাটিয়ে প্রিয়েতো বলল,” ব্যাবসায়িক কাজে জীবনের বেশিরভাগ সময়টা আমার লন্ডনেই কেটেছে। সেখানে “লরা” নামের এক মেয়ের সাথে রিলেশনে জড়িয়ে পড়ি আমি। বেশ কাটছিল আমাদের দিন গুলো, এদিকে ফ্যামিলি থেকে ঠিক হওয়া বিয়ে নিয়েও বেশ চিন্তিত ছিলাম। একসময় ঠিক করি ফ্যামিলিতে জানিয়ে দেবো, আমি অন্য কাউকে ভালবাসি। সেইবার আমার ফিয়ন্সে মানে যার সাথে আমার বিয়ের কথা ঠিক হয়ে ছিল, সে লন্ডনে গেল তাদের একটা ফ্যামিলি প্রোগ্রাম এটেন্ড করতে। আমার সাথেও দেখা করার কথা ছিল, ভাবলাম এটাই সময়। মেয়েটাকে বুঝিয়ে বললে সে নিশ্চয়ই বুঝবে।
বলেই একটু থামল প্রিয়েতো, টি টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে ঢকঢক করে খেল। বুঝতে পারছি, বেশ নার্ভাস হয়ে পড়ছে সে। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে আবার বলতে লাগল প্রিয়েতো,” সেদিন ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিল বাইরে, আমার প্রিয়তমা লরার বাসায় গেলাম, উদ্দেশ্য লরাকে সাথে নিয়ে ফিয়ন্সের সাথে দেখা করতে যাবো।
দরজা খোলাই ছিল, ভেতরে গিয়ে কাউকে দেখলাম না। কিন্ত কিচেন থেকে কেমন অদ্ভুত সব শব্দ আসছিল, ধীর পায়ে কিচেনে গিয়ে ঢুকলাম। কিন্ত গিয়ে যা দেখলাম তাতে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল, কিচেনের কৃত্রিম লাইট অফ করা, বেশ কয়েকটা মোমবাতি জ্বলছে, কিচেনের ফ্লোরে বিশাল পঞ্চভুজ আকানো, তার সামনে বসে অদ্ভুতভাবে মন্ত্রপাঠ করছে লরা। বুঝতে বাকি থাকল না, লরা একটা ডাইনী। আমার সব আশা, ভরসা, ভালবাসা জলেপুড়ে ছাই হয়ে উড়ে গেল।
হটাৎ লরা আমার দিকে তাকিয়ে হকচকিয়ে বলল,” ওহ প্রিয়েতো! কখন এসেছো!! আমায় ডাকোনি কেন!?
লরাকে এগিয়ে আসতে দেখে ভয়ের শীতল স্রোত শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল আমার। আমি একছুটে বেরিয়ে আসতেই খপ করে ধরে ফেলল লরা আমাকে। তার সূচালো নখগুলো দিয়ে আকড়ে ধরল আমার শার্ট, ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে লরা করুনভাবে তাকিয়ে বলল,” আমি তোমার সন্তানের মা হতে চলেছি প্রিয়েতো, আমাকে ছেড়ে যেওনা। আমি সত্যিই খুব ভালবাসি তোমাকে।
মুহুর্তের জন্য থমকে গেলাম, মনেমনে আনন্দে ভাসতে লাগলাম, আমি বাবা হতে চলেছি!!! পৃথিবীর সব পুরুষের কাছেই এই সংবাদটা বিশ্বজয়ের সমান। আমিও তার ব্যতিক্রম নই, কিন্ত লরার দিকে তাকাতেই সেই বিশ্রি বাস্তবতা স্পষ্ট হয়ে উঠছে চোখের সামনে।
রাগে ক্ষোভে লরাকে সজোরে চড় মেরে উঠে চলে এলাম।
ছোটবেলার পর সেই প্রথম আমি কাদলাম, খুব কেদেছিলাম সেদিন। আমার চোখের জল গুলো বৃষ্টির জলে মিশে গেছিল, কেউ দেখেনি সেই কান্না। সেই কান্না ছিল প্রিয়তমাকে হারানোর, সেই কান্না ছিল অনাগত সন্তানকে হারানোর।
বলতে বলতে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলেন মি. প্রিয়েতো। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখমুখ মুছে আবার বলল,” সারাদিন রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছি, কোথায় যাবো কার কাছে যাবো!? কোথায় গেলে শান্তি পাবো বুঝতে পারছিলামনা। এদিকে বিকেল হয়ে গেছে, হাটতে হাটতে ভিক্টোরিয়া স্ট্রিটের একপাশে গিয়ে বসলাম।
অদুরে “ওয়েস্টমিনস্টার ক্যাথিড্রাল” গীর্জা দাঁড়িয়ে আছে, ধীর পায়ে এগিয়ে চললাম গীর্জার দিকে। বিশাল কাঠের দরজার সামনে গিয়ে দাড়ালাম, সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে দরজা খুলে ভেতরে গেলাম। হলরুমটা বেশ ফাকা লাগছে, বিকেলের প্রার্থনা শেষ। একে একে সবাই বেরিয়ে যাচ্ছে, আমি সোজা যীশু খ্রিস্টের সামনে গিয়ে দাড়ালাম। অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব হল, হটাৎ কারও হাতের স্পর্শ পেলাম কাধে। ভাবলেশহীন ভাবে পেছনে ফিরলাম, গীর্জার প্রিস্ট!
গীর্জার প্রিস্ট ফাদার এন্ড্রুকে সব খুলে বললাম। তিনি বললেন,” দুশ্চিন্তা করোনা, মাই চাইল্ড। সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা রাখো, সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি তোমার ফিয়ন্সেকেই বিয়ে করে নাও, এতেই সবার মঙ্গল।
ফাদারকে জিজ্ঞেস করলাম, ” আর আমার সন্তান!?
ফাদার একটা দীর্ঘশাস ফেলে বললেন,” সে তোমার সন্তান, সে অবশ্যই অভিশাপ মুক্ত। কিন্ত সে তার মায়ের গর্ভে আছে, তার মায়ের সম্মতি ছাড়া তাকে তুমি নিতে পারবেনা প্রিয়েতো।
এক সপ্তাহ পর ইতালিতে ফিরে এসে বিয়ে করলাম আমার ফিয়ন্সে “ফিয়না”কে, যে এখন আমার বর্তমান স্ত্রী। কিন্ত লরাকে কিছুতেই ভুলতে পারছিলাম না। এর মধ্যে ব্যবসায়িক কাজে লন্ডনে ফিরতে হল। সাথে ফিয়নাকেও নিয়ে গেলাম, সেদিনের পর থেকে লরার সাথে আর কোনো যোগাযোগ রাখিনি। কিন্ত মনের মধ্যে অনাগত সন্তানকে কাছে না পাওয়ার কষ্ট বয়ে বেড়াতাম। ভাবলাম, আমাদের একটা বাচ্চা হলে হয়তো সব ভুলে নতুনভাবে জীবন শুরু করতে পারব।
ঠিক করলাম বাচ্চা নিব কিন্ত প্রায় পাচ ছয় মাস চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। ধীরে ধীরে ফিয়নার মনোবল ভাঙতে শুরু করল, আমারও দুশ্চিন্তা বাড়তে লাগল। একদিন ফিয়নাকে নিয়ে ডক্টরের কাছে গেলাম।
মি. প্রিয়েতো করুনচোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ” ডক্টর কি বলল জানেন!? স্যরি মি. প্রিয়েতো, আপনার স্ত্রী কখনও মা হতে পারবেননা।
আমি মি. প্রিয়েতোর কাধে হাত রাখলাম।
প্রিয়েতো নিজেকে সংযত করে আবার বলল,” একদিন সন্ধ্যায় আমি বাজার করছিলাম, হটাৎ একপাশে মানুষের শোরগোল শুনে এগিয়ে গেলাম। এক প্রেগন্যান্ট মহিলা নিচু হয়ে কি যেন তুলছে। সামনে এগোতেই বুঝলাম কারও সাথে ধাক্কা খেয়ে মহিলার বাজারের ব্যাগ ছিড়ে গেছে। এগিয়ে গিয়ে সব ওঠাতে সাহায্য করলাম। মহিলা ব্যাগ নিয়ে ঘুরে দাড়াতেই চমকে উঠলাম, মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে এল,”লরা”!!
লরাকে বাসায় দিয়ে এলাম, এখনও দোতলা বাসাতেই থাকে। গেটের মুখে দাঁড়িয়ে লরা আবেগভরা কন্ঠে বলল, ” বাসায় আসবেনা প্রিয়েতো!?
আমি কেন জানি না করতে পারলামনা। বাসায় ঢুকে সোফায় গিয়ে বসলাম, আমার সাথে তোলা ছবি দিয়ে ব্লক করে রেখেছে পুরোটা দেওয়াল। কি সুন্দর দিন ছিল আমাদের!!! আপনমনেই হেসে উঠলাম।
লরা ড্রেস চেঞ্জ করে একটা শর্ট গাউন পরে দুই কাপ চা নিয়ে এল। সোফায় বসে এক কাপ চা নিয়ে চুমুক দিলাম, লরা চা নিয়ে বলল,” তুমি চলে যাওয়ার পর নিজেকে বদলে ফেলেছি, শুধু তোমার স্মৃতিটাই রেখে দিয়েছি।
বলেই পেটে হাত বুলাতে লাগল, জিজ্ঞেস করলাম, ” ডেলিভারি কবে!?
লরা খুশি হয়ে বলল,” নেক্সট মানথে!
আমার কেন জানি মনে হচ্ছে সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে লরার কাছে ফিরে আসি, আমি ভাল নেই। লরাকে ছাড়া সন্তানকে ছাড়া ভাল নেই আমি। সেই রাতটা লরার সাথে গল্প করেই কাটিয়ে দিলাম, মনে জমানো সব কথা শেয়ার করলাম একে অপরের সাথে। কিন্ত ফিয়নার সাথে বিয়ের ব্যাপারটা লুকালাম।
অফিস শেষে প্রতিদিন নিয়ম করে লরার সাথে দেখা করতে যেতাম। আর আমার অনাগত সন্তানকে আদর করে আসতাম।
একদিন ফিয়না আমার আর লরার ব্যাপারটা কিভাবে যেন জেনে গেল। আমার কেন জানি খুব খারাপ লাগল, আসলেই তো, স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও প্রাক্তন প্রেমিকার কাছে যাওয়া অপরাধ! এই অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পেতে আমি আরেক পাপ করে ফেললাম।
ফিয়নাকে বললাম,” মেয়েটার সাথে সম্পর্ক করেছি শুধু একটা বাচ্চা নেওয়ার জন্য। বাচ্চা হয়ে গেলেই টাকা দিয়ে বিদায় করে দিব মেয়েটাকে।
আমার কথা বিশ্বাস করল ফিয়না।
ডেলিভারির দিন বাচ্চা নিয়ে চলে এলাম অন্য হসপিটালে। অসুস্থ অসহায় অবস্থায় আমার সন্তানের মাকে ফেলে চলে এলাম।
তারপর প্রায় ছয়মাস কেটে গেল, আমি নির্দয়ের মতো একটাবার লরার খোজ নিলাম না। আমাদের ছোট্ট প্রিন্সেস “ফ্লোরা” কে নিয়ে দারুন কাটছিল দিন গুলো। একদিন সন্ধ্যায় আমি আর ফিয়না একান্ত সময় কাটাচ্ছিলাম। পাশের রুমে আমাদের মেয়ে ফ্লোরা গভীর ঘুমে। হটাৎ কলিংবেলের শব্দে সচকিত হলাম, ফিয়না নিচে গেল দরজা খুলতে আর আমি গেলাম মেয়ে ফ্লোরার কাছে। হটাৎ সিড়ি বেয়ে কারওর ধুপধাপ আওয়াজ করে আসার শব্দ পেয়ে ফ্লোরাকে রেখে রুম থেকে বের হলাম।
লরা এসেই আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফ্লোরার রুমে ঢুকল। আমি লরাকে আটকাতে গেলে, লরা ভেতর থেকে দরজা লক করে দিল। আমি ভয় পেয়ে গেলাম, লরা রাগের মাথায় আমার মেয়ের কোনো ক্ষতি করবেনাতো!?
দরজা ধাক্কাতে লাগলাম, দরজা ভাঙলো না। নিচে নামতেই দেখলাম ফিয়না সিড়িতে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। কপাল বেয়ে রক্ত পড়ছে তার, তা দেখে আরও ভয় পেয়ে গেলাম। দ্রুত হাতুড়ি নিয়ে ছুটলাম ফ্লোরার রুমে, সজোরে আঘাত করতে লাগলাম দরজার লকে। অশ্রাব্য গালাগাল করছি আর হাতুড়ি পেটাচ্ছি, বেশ কিছুক্ষণ পর দরজার লক ভেঙে গেল। ভেতরে ঢুকলাম, দেখলাম ফ্লোরা বেডে বসে কাদছে। রুমে লরা নেই, জানালা খোলা। দৌড়ে জানালায় গিয়ে নিচে তাকালাম, লরা ততক্ষণে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে!!
বলেই থামল মি. প্রিয়েতো। কি বলব ভেবে পেলাম না, বুঝতে বাকি নেই ফ্লোরার মৃত মা ফিরে এসেছে তার প্রতিশোধ নিতে।
এখন আমার কি করা উচিৎ!? মি. প্রিয়েতো অনেক বড় পাপ করে ফেলেছেন। মিসেস ফিয়নাও কম নন, তিনিও বাধা দেন নি। ফ্লোরা যখন সব জেনে যাবে, ওর বাবা আর সৎ মাকে কিভাবে ক্ষমা করবে!?
(চলবে)