#শাপলা_ও_সেতুর_গল্প
#প্রভা_আফরিন
[পর্ব-১৩]
পাকা আমের রঙিন ও রসালো টুকরোগুলো একটি বড় প্লেটে সাজিয়ে রাখা। সেই প্লেটের অবস্থান বর্তমানে লিখির কোলের ওপর। সদ্যস্নাতা লিখি আশেপাশের ব্যস্ত মানুষগুলোকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে একটু পর পর এক টুকরো আম তুলে নিচ্ছে মুখগহ্বরে। গ্রীষ্মের মধুময় ফলের স্বাদ আস্বাদন শেষে পাতলা প্রলেপের খোসাটি ফেলে দিচ্ছে বাড়ির সামনের অযত্নে জন্ম নেওয়া ঘেসোস্তুপে। বড় মেয়ের বিয়েতে করবে না করবে না করেও বেশ জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন করেছেন জাহিদুল ইসলাম। বাড়িতে আত্মীয়, পরিচিত, স্বল্প পরিচিত মানুষের আনাগোনা বাড়ছে। কেউ ব্যস্ত বিয়ে বাড়ির কাজে আবার কেউ নিজেকে নিয়ে। উঠানের একপাশে বানানো শামিয়ানার নিচে বাবুর্চিরা রান্নার জিনিসপত্র গোছাচ্ছে। পাশেই বিশাল ছাই লেপা ডেকচিতে রান্না চড়েছে। কালো ধোয়ারা কুন্ডলি পাকিয়ে উর্ধ্বে মিশে যাচ্ছে, চুলার তাপ পরিবেশ আরো গরম করে তুলেছে। সেখান থেকে উড়ে আসা মশলার গন্ধ পুরো বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেওয়ালে ধাক্কা খাচ্ছে।
লালরঙা তাতের শাড়ি পড়া লিখি বাইরের দরজার পাশে চেয়ার পেতে বসে মন দিয়ে সব কিছু দেখে চলেছে। সাদা টাইলসে সকালের মিঠে রোদের ঝলমলে প্রতিফলন ওর গায়ে লেগে আলাদা জৌলুস ছড়িয়ে দিয়েছে। রিথী মুখ ভার করে এসে লিখির পাশে বসলো। বললো,
“এখানে কেনো বসে আছো আপু? একটু পরই পার্লার থেকে লোক আসবে। মা তোমাকে বাইরে বসতে মানা করেছে। ঘরে চলো আমি তোমার চুল শুকিয়ে দেই।”
লিখি বোনের দিকে তাকালো। রিথীর মুখ নত। ঠোঁট ঈষৎ উল্টানো। গতকালের গায়ের হলুদের ভারী সাজের ছোঁয়ানো কাজল এখনো মুছে যায়নি চোখ থেকে। লিখি বললো,
“মন খারাপ?”
“হু।”
“তোকে না দিয়ে আম খাচ্ছি বলে?”
“তোমার শ্বশুরবাড়ির আম তুমিই খাও।”
কম্পিত কন্ঠে কথাটা বলে রিথী সঙ্গে সঙ্গে আপুকে জড়িয়ে ধরে মুখ লুকিয়ে ফেললো। খানিক সময় যেতেই উষ্ণ স্পর্শ বেয়ে গেলো লিখির ঘাড় বেয়ে। মেয়েটা কাঁদছে! লিখি আমের প্লেটটা কোল থেকে নামালো। চটচটে হাতেই বোনের বাহু আগলে বললো,
“এই বোকা মেয়ে, কাঁদছিস কেনো? আমি কি ম’রে যাচ্ছি?”
রিথীর গলা কাঁপে। আপুর হাতে চিম’টি কে’টে বলে,
“আমি যে ম’রে যাচ্ছি। আমাকে ফেলে চলে যেতে তোমার একটুও কষ্ট লাগবে না?”
“একদমই না। এবার থেকে তো আরামে ঘুমাতে পারবো। কারো সাথে বিছানার যায়গা নিয়ে টানাটানি করতে হবে না।”
“আমি কখনোই যায়গা নিয়ে টানাটানি করি না।”
“হ্যাঁ, শুধু হাত পা ছড়িয়ে অন্যের যায়গা মে’রে দিস।”
“এ্যাহ! তুমি ভালো না। আমাকে একা ফেলে চলে যাচ্ছো। একটা দেবর দেখেও তো বিয়ে করতে পারতে। তাহলে আজ আমিও তোমার সাথে বিয়ে করে চলে যেতাম।”
লিখি শব্দ করে হেসে ফেললো। হাসতে হাসতেই চোখে পানি এসে গেলো। সেটা আড়াল করে বললো,
“তাহলে আমার দেবরের অভাবে এমন ম’রা কান্না জুড়েছিস, তাই তো?”
রিথী কান্না ভুলে ক্ষেপে উঠলো, “তোমার ওই বরের যে নমুনা, ওনার বোন হলো আরেক মাস্টারপিস। তাদের ভাই কেমন হতো জানা আছে আমার। দেবর থাকলেও আমি বিয়ে করতাম না।”
লিখি আদর করে বোনের কপালে চুমু দেয়। বলে,
“কাদিস না বোকা। তোকে বিয়ে দেবো না। নাহলে মা ব’কা শোনানোর মানুষ না পেয়ে পেটের ভেতর ব’কা আটকে অসুস্থ হয়ে পড়বে।”
“মা খুশি হবে। মা তো চায়ই আমরা দূরে সরে যাই।”
মুনিয়া নিঃশব্দে আবেগঘন চাদরে আবদ্ধ দুই বোনের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। রিথীর শেষ কথাটা শুনে বললো,
“এভাবে বলতে নেই, রিথীমনি। মায়েরা কখনো সন্তানের খারাপ চায় না। শুধু তাদের ভালো চাওয়াটার প্রকাশের ধরন আলাদা হয় বলে আমরা ভুল বুঝি। আমরা মধ্যবিত্ত মানুষ। মামী চায় লিখির সংসার হোক। এবং সেটা সময়মতো হোক। নাহলে একসময় ওকেও আমার মতো মানুষের উচ্ছিষ্ট কথাগুলো হজম করে চলতে হবে। মামী আমার পরিস্থিতি অনুভব করতে পারে বলেই না লিখিকে তাড়া দিচ্ছিলো। মেয়ের জীবনে এমন পরিস্থিতি আসুক তা কোনো মা’ই চায় নারে।”
রিথী নাক-মুখ কুচকে তাকালো। গোল গোল চোখে চেয়ে বললো,
“এসেছিলাম হালকা হতে আর তোমরা আমার ওপরে ভারী ভারী কথা চাপিয়ে দিচ্ছো। ভাল্লাগে না।”
রিথীর প্রতিক্রিয়ায় মুনিয়া ও লিখি একসঙ্গে হেসে ফেললো। রেবেকা একটু দূর থেকে মেয়েদের হাসিমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। বুকের ভেতর কেমন জ্বালা করে ওঠে।
______________
রাসিফ-লিখির বিয়ের থিম রঙ হলো বেগুনি ও সোনালী। এই দুই রঙেই সেজেছে বিয়ের আসর। লিখি পড়নেও সোনালী জড়ি সুতোর কাজ করা বেগুনি রঙা ভারী লেহেঙ্গা। রঙটা হুট করেই লিখির অতি প্রিয়তে পরিনত হয়ে গেছে। তাই বিয়ের সবকিছু সে এই রঙেই রাঙাতে সম্মতি দিয়েছে।
অন্যদিকে রাসিফের সবচেয়ে অপছন্দের সবজি হলো বেগুন আর অপছন্দের রঙ বেগুনি। কিন্তু ভাগ্যের নিষ্ঠুর পালাবদলে তাকে আজ সেই রঙেই নিজেকে রাঙাতে হবে। রাসিফের মনে হচ্ছে লিখি ইচ্ছে করেই তার অপছন্দের রঙটা এই স্মরণীয় দিনটির জন্য নির্ধারণ করেছে। এইতো সেদিন বিয়ে নিয়ে মা ও নানির থেকে বিস্তর সব অভিজ্ঞতা, ভালোমন্দ কথা শুনে মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলো, বিয়েটা যখন হচ্ছেই তাহলে সব রেষারেষি ভুলে দুজনে মিলে সংসারটা সুস্থ ও সুন্দর করে করতে হবে। এ নিয়ে লিখির সাথে শান্তিচুক্তি করার প্রস্তুতিও নেওয়া হয়ে গেছিলো তার। কিন্তু মেয়েটা বোধহয় ওকে এত সহজে শান্তি দেবে না। তার নমুনা বিয়ের দিন থেকেই দেখানো শুরু করে দিয়েছে।
রুনি আজ বেজায় খুশি। ভাইয়ের বিয়েতে সে নতুন করে বউ সেজেছে। এই আইডিয়াটা ওকে লিখি দিয়েছে। সেই সাথে লিখির মতোই সেইম ডিজাইনের লেহেঙ্গা আনিয়ে দিয়েছে। পার্থক্য হলো লিখির লেহেঙ্গায় বেগুনি জমিনে সোনালী রঙের বুনন, আর রুনিরটায় সোনালী জমিনে বেগুনী রঙের বুনন। এই একটা কারনেই লিখিকে ভাইয়ের বউ হিসেবে মেনে নিতে রুনি মৌন সম্মত। তবে ওর এই শরীরে ভারী পোষাক ও মেকআপ করা নিয়ে বাড়ির প্রত্যেকেই আপত্তি তুলেছে। রুনি তার বাবুর আব্বুর মুখ চেয়ে থাকায় নওশাদ আপত্তি করতে পারেনি। কিন্তু কড়া সুরে বলেছে যদি সামান্যতম খারাপ লাগা অনুভূত হয় তবে যেন সাথে সাথে পোষাক বদলে নেয়। এর জন্য অতিরিক্ত একটা শাড়ি আগেই গাড়িতে তুলে রেখেছে।
বরযাত্রী রওনা হওয়ার কিছুক্ষণ আগে জেসমিন এসে রাসিফকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে বললো,
“রঙটায় আপনাকে বর বর না লেগে ভিলেন ভিলেন লাগছে কেনো বলুন তো, রাসিফ ভাই?”
“কারণ ভিলেনরা সব সময় বীরের মতো যু’দ্ধ করে, আর আমি জীবন যু’দ্ধের শুভ সূচনা করতে যাচ্ছি।”
“উহু, ভিলেনরা যু’দ্ধ করে না, যু’দ্ধ বাধায়। আপনি তাহলে সেই পাতলা ভিলেনদের দলে যারা হিরোর এক ঘু’সিতে কাগজের মতো উড়ে যায়। লিখি ভাবীর ঘু’সিতেও উড়ে যাবেন, হা হা।”
রাসিফ শীতল চোখে জেসমিনের দিকে তাকিয়ে রইলো। এই মেয়ের সাথে বিয়ে হলে কেমন হতো? নিশ্চয়ই তার জীবনটা অপমানে অপমানে ভরে যেত। শুধু পার্থক্য এই যে, জেসমিন না জেনে অপমান করে ফেলে আর লিখি জেনে বুঝে। না জেনে অপমান করা মানুষ মানসম্মানের জন্য অতি বিপদজনক। রাসিফ তাড়াতাড়ি জেসমিনের কাছ থেকে কেটে পড়লো।
______________
নবীন একটা গিফট বক্স হাতে নিয়ে অতি ভদ্রবেশে বিয়ে বাড়িতে এসেছে। লিখি বিভিন্ন পোজে ছবি তুলতে ব্যস্ত ছিলো। নবীনকে দেখে বললো,
“এত দেরি করে এলেন, নবীন ভাই? আমি ভেবেছিলাম আপনি আসবেনই না।”
“আসলে বাবাকে চেকআপে নেওয়ার ডেট ছিলো তো। তুমি মন খারাপ করো না। তোমাকে বিদায় না দিয়ে যাবো না।”
লিখি পুনরায় ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে বললো,
“মুনিয়া আপুর ফোনটা পাওয়া যাচ্ছে না বুঝলেন তো। আপনি কি একটু কল করবেন? বাজলে নিশ্চয়ই খুঁজে পাওয়া যাবে।”
নবীন ফোন বের করে লিখির দিকে এগিয়ে দিলো।
“আমার কাছে তো নাম্বার নেই৷ তুমিই ডায়াল করো।”
লিখি ডায়াল করলো। কলটা বাজলো নবীনের ঠিক পেছনটায়। নবীন চমকে পেছনে তাকাতেই দেখলো মুনিয়া ফোন হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সে মাত্রই তৈরি হয়ে এসেছে। শাড়িতে আরো মোটা লাগতে পারে ভেবে মুনিয়া প্রথমে শাড়ি পড়তেই চাইছিলো না। লিখির জোড়াজুড়িতে শেষমেষ হার মানতে হলো। ঢেউ খেলানো উন্মুক্ত চুলে ওকে দেখতে বেশ স্নিগ্ধ লাগছে। লিখি মুচকি হেসে বললো,
“তোমাকেই খুঁজছিলাম আপু। নবীন ভাইকে খাওয়ার যায়গায় নিয়ে যাও।”
“দাঁড়া, আমার একটা কল এসেছে।”
লিখি কল কেটে নবীনের ফোন ফেরত দিয়ে বললো,
“কলটা আমিই করেছি। ওটা নবীন ভাইয়ের নাম্বার। সেভ করে রাখো।”
নবীন ও মুনিয়া দুজনই বোকার মতো লিখির হাসি দেখতে লাগলো।
_____________
গেইটে বরের চাঁদা নির্ধারণ হয়েছিলো বিশ হাজার টাকা। উভয়পক্ষের চরম ঝগড়া, কথা কাটাকাটি, ফাজলামি শেষে আদায় করা গেছে মাত্র নয়শো আশি টাকা। পাঁচশো টাকার ভেতর বিশ টাকার নোট ভরে মুঠোয় পুরে দেওয়ায় আন্দাজ পেতে পেতে বরযাত্রী ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে ফেলেছে। রিথী মুখ ভার করে তার বন্ধুদের সাথে দুলাভাইকে পরিচয় করিয়ে দিতে গেলো। বরকে ঘিরে অতিথিদের ভীড়। রাসিফ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হবু শ্বশুরের বন্ধুদের সাথে সাক্ষাৎ বিনিময় করছিলো। ওনারা চলে যেতেই রিথী এক ফাঁকে তার চার বন্ধু নিয়ে রাসিফের সামনে এলো পরিচয় দিতে। ঠিক তখনই রাসিফের পেছন দিয়ে যাওয়ার সময় কেউ শব্দ করে দুর্গন্ধযুক্ত বাতাস নিক্ষেপ করে গেলো। রিথী চোখ বড় বড় করে রাসিফের দিকে তাকালো। ওর বন্ধুরা হাসছে। রাসিফ নিজেও চোখ বড় বড় করে, অসহায় ভঙ্গিতে ডানে-বামে মাথা নাড়লো। বোঝাতে চাইলো কাজটা তার নয়।
রাগে দুঃখে রিথীর চোখে জল চলে এলো। একে তো তার দুলাভাইকেই অপছন্দ, তারওপর গেইটে টাকা দেওয়ার নামে ঠকিয়েছে। এখন আবার বন্ধুদের সামনে নিজেরসহ রিথীর মানসম্মানও বিনাশ করে দিলো। রিথী ধপধপ করে পা ফেলে লিখির কাছে গিয়ে বললো,
“তোমার বিয়ে আমি বয়কট করলাম।”
“সেকি! কেনো রে?”
“তোমার বর আমার বন্ধুদের সামনে শব্দ করে গ্যাস ছেড়েছে। এই গন্ধওয়ালা দুলাভাই আমার চাই না।”
লিখি উঠে যাওয়া লিপস্টিকের ওপর পুনরায় প্রলেপ দিচ্ছিলো। বোনের কথায় তার হাত ঠোঁট থেকে সোজা পথ ধরে গালে চলে গেলো। মুনিয়া হতবাক, লিখি নির্বাক।
চলবে…