শাপলা ও সেতুর গল্প [পর্ব-১৪]

0
164

#শাপলা_ও_সেতুর_গল্প
#প্রভা_আফরিন
[পর্ব-১৪]

কবুল বলার মাধ্যমে একটি নতুন সম্পর্কের সূচনা হলেও কবুল বলার সময়টা অনেক মেয়ের কাছে সবচেয়ে দুঃসহ হয়ে দাঁড়ায়। এই একটি শব্দের জাদুতেই কিনা সে বাবা মায়ের থেকে দূরে চলে যাবে। যার ফলে কবুল উচ্চারণের সময় আবেগপ্রবণ মেয়েরা একটু বেশি সময় নেয়। কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞানও হয়ে পড়ে কেউ কেউ। কিন্তু লিখির বিয়েতে চিত্রটা ভিন্ন হলো। বর-কনে মুখোমুখি বসার পর কাজি যখন বিয়ে পড়ানো শুরু করলো রাসিফ দরদর করে ঘামতে লাগলো। কাজি কবুল বলতে বললে লিখি সময় ব্যয় না করেই শব্দটি উচ্চারণ করে ফেলেছে। মুনিয়া বলেছিলো একটু সময় নিতে, কাঁদতে। লিখি চেষ্টা করেছে। কান্না আসছিলো না বিধায় সময় নষ্ট করার কারণ পায়নি সে। অন্যদিকে রাসিফ কবুলের বিপরীতে উচ্চারণ করলো,
“পানি খাবো।”

নবীন পর পর তিন গ্লাস শরবত খাইয়ে দিলো রাসিফকে। তবুও তার তৃষ্ণা মিটলো না। মনে হচ্ছিলো গলায় সাহারা মরুভূমি ঢুকে গেছে। কিন্তু পেটে যায়গাও অবশিষ্ট নেই। উল্টে অতিরিক্ত পানি পান করার ফলে তলপেটে বেশ চাপ পড়লো। লিখি দুই ভ্রুর মাঝে ছোট একটা ভাজ ফেলে রাসিফের দিকে তাকিয়ে আছে। সে বিরক্ত নাকি রেগে আছে বোঝা যাচ্ছে না। রাসিফ ওর দিকে তাকাতেই আরো নার্ভাস হয়ে পড়ছে। একটু আগের ঘটনার বিব্রতভাব এখনো তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। যদিও রাসিফ বলেছে কান্ডটা তার নয়, অপরপক্ষ বিশ্বাস করেছে কিনা বোঝা যায়নি। রাসিফও বিশ্বাস করানোর চেষ্টা না করে দাপট দেখিয়ে রিথীকে বলেছে,

“তোমারে বিশ্বাস করানোর এত ঠ্যাকা কিসের আমার? আমি কি তোমায় বিয়ে করছি নাকি খালাম্মাবোন থুক্কু শা’লি? নাকি তুমি না মানলে বিয়েটা আটকাবে? পারলে আটকাও তো দেখি তোমার কত ক্ষমতা।”

কথাটা মুখে বললেও রাসিফ মনে মনে চাইছিলো রিথী এমন কিছু করুক যেন বিয়েটা ভেঙে যায়। মনে মনে সত্যিই লজ্জায় ম’রিম’রি অবস্থা। কোন কু’ক্ষণে এই পরিবারের সাথে সম্পর্ক হচ্ছে তার! ওদের সামনে এলেই মানসম্মানও বেইমানি করে তল্পিতল্পা গুটিয়ে পালাতে চায়। এখন তো জীবনের সাথেই জুড়ে যাচ্ছে। রাসিফ মনে মনে নিজেকে সান্ত্বনা দিলো ভাগ্যের ওপর দোষ দিয়ে। কপালে ছিলো বলেই লিখি তার বউ হয়ে আসছে।

জামাই কবুল বলছে না দেখে আশেপাশের সবাই উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে। এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে রাসিফ কিভাবে তলপেটের চাপের কথা বলবে ভেবে পেলো না। মুনিয়ার স্বভাব বিব্রতকর মুহূর্তে হেসে ফেলা। এবারও সে রাসিফের অবস্থা দেখে হেসে ফেললো। সবাই বোকার মতো মুনিয়ার দিকে তাকাতেই মুনিয়া মুখ চেপে ধরলো। লজ্জা পেয়ে রাসিফ এক নিশ্বাসে আলহামদুলিল্লাহর সাথে তিনবার কবুল উচ্চারণে করলো। দোয়া সম্পন্ন করে নওশাদের সাহায্যে রাসিফ কোনোমতে ওয়াশরুমে ছুটলো।

বরযাত্রী বউ নিয়ে রওনা হলো রাত করে। বিদায়ের সময় লিখির চোখ ছলছল করলেও সে বিশেষ কাঁদতে পারলো না। ওকে কাঁদতে না দেখে কেউই কান্নার সুর করুন পর্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হলো না। শুধু গাড়িতে ওঠার আগে বাবাকে জড়িয়ে ধরে দুফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দিলো লিখি।

গাড়ি সাঁ সাঁ করে জাহিদুল ইসলামের বাড়ি ছাড়তেই লিখি দুইহাতে মুখ ঢেকে ফেললো। রাসিফ ভ্রু কুচকালো। লিখির দিকে খানিকটা ঝুকে এসে বললো,
“আপনি কি কাঁদছেন?”
“নাচছি। আমার সাথে নাচবেন?” লিখির ক্ষ্যাপা স্বরের বিপরীতে রাসিফ চুপ করে গেলো। তার আপার বিয়ের বিদায়ের সময়টা ভেবে এই মূহূর্তে হঠাৎ তার মনে লিখির জন্য একটু খারাপ লাগার উদ্রেক হলো। তাই বাঁকা কথাটা গাড়ির চলতি হাওয়ার সাথে টুপ করে গিলে ফেললো সে।
____________

বাসর রাত নিয়ে প্রতিটি মানুষের মনেই গোপন কিছু আকাঙ্খা, আবেগ ও স্বপ্ন আঁকা থাকে। প্রিয় মানুষের কাছ থেকে ভালোবাসা পাওয়া, ভালোবাসা দেওয়ার পবিত্রতম সূচনা হয় এই রাতের মাধ্যমে। রাসিফের মনেও বাসর রাত নিয়ে গোপন অভিসারের নীলনকশা অঙ্কিত আছে। কিন্তু বিপরীতের মানুষটাকে ভাবলে প্রেমের নীলনকশার বদলে ষ’ড়যন্ত্রের নীলনকশা ভেসে ওঠে। ওর জীবনে কি এই মেয়ে প্রেম আনতে দেবে?

বাসর ঘরে ঢোকার আগে হঠাৎ লিখিকে জ্বা’লানোর ইচ্ছে জাগ্রত হলো মনে। সে মুচকি হেসে নিজের ঘরে পা বাড়ালো। রাসিফ ভেবেছিলো নতুন বউ আধ হাত ঘোমটা দিয়ে খাটের মাঝখানে বসে থাকবে। কিন্তু গিয়ে দেখলো লিখি বিছানার সব ফুল একটা একটা করে পরিষ্কার করে ঝুড়িতে রাখছে। সে ব্যা’থিত মনে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো। লিখি ওকে দেখে বললো,

“ফুলের মাঝে ঘুম হবে না। পরিষ্কার করে ফেললাম।”

“অন্তত আমার দর্শন অবধি অপেক্ষা করতেন। বাসর রাত কি বারবার আসে? বাসর রাতের স্মৃতি হিসেবে আমার মনে সারাজীবন ফুলের দৃশ্যের বদলে গেঁথে থাকবে এক কামের বেটির দৃশ্য। যে শাড়ি পরে, কোমড়ে হাত দিয়ে ফুল পরিষ্কার করছে।”

লিখি ক্ষে’পে গেলো। নিজের দিক রক্ষা করতে বললো,
“আর আমার মনেও বিয়ের স্মৃতি হিসেবে গেঁথে থাকবে এক দুর্গন্ধযুক্ত ঘটনা।”

রাসিফ থতমত খেয়ে গেলো। “দেখুন, আবারও বলছি এসব আমার কাজ নয়। আপনার দুর্গন্ধযুক্ত আত্মীয়দের দোষ আমার মতো নিষ্পাপ পুরুষের ওপর চাপাবেন না।”

রাসিফের অবস্থা দেখে লিখির হাসি পেলো। যদিও রাসিফ সত্যি বলছে কিনা লিখি জানে না। কিন্তু সারাজীবন প’চানোর জন্য হলেও লিখি কথাটা বলতেই থাকবে। রাসিফও দমে যাওয়ার পাত্র নয়। সে বুকে হাত গুজে বললো,
“বিয়েটা যেহেতু হয়েছে সুতরাং আপনি আমার বউ। আর বউকে আমি আপনি আজ্ঞে করতে পারবো না। আজ থেকে আপনাকে তুমি ডাকবো। তুউউউমি। আমার তো অধিকার আছে বলো।”

লিখি চোখ ছোট করে তাকালে রাসিফ চোখ টিপলো। কাছে এসে ফিসফিস করে বললো,
“অনেককিছুর অধিকার আছে। তাই না?”

লিখি তড়াক করে সরে দাড়ালো। ওর নার্ভাস মুখ দেখে রাসিফের মজা লাগছে।
“আরে তুমি ভয় পাচ্ছো নাকি? আমি তো বউয়ের সেবা পাওয়ার অধিকারের কথা বলছিলাম। এখন থেকে আমার দেখভাল তো তুমিই করবে। ঘর গোছাবে, আমার জন্য নিজহাতে রান্না করবে, কাপড় আয়রন করে দেবে, ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরলে মাথা টিপে দেবে। শত ঝগড়া হোক, দিনশেষে আমরা দুজন স্বামী-স্ত্রী।”

কথে শেষ হতেই ঠাস করে শব্দ হলো। লিখি বাথরুমে ঢুকে গেছে। সেদিকে তাকিয়ে রাসিফ আপন মনেই হেসে ফেললো। আকাশে আজ সরু চাঁদ উঠেছে। ধোয়াটের মেঘের আস্তরণ থেকে তারাগুলো লুকোচুরি খেলছে। সেই সাথে মৃদুমন্দ হাওয়া। রাসিফের আফসোস হয়। নিঃসন্দেহে মিষ্টি একটি গল্পময়, অনুভূতিময় রাত হতে পারতো আজ।

“আপনার ঘরে সোফা নেই কেনো?”

লিখির কথায় রাসিফ জানালা থেকে চোখ সরালো। বললো,
“সমস্যা নেই, তুমি আরামছে নিচে শুতে পারো। এ ঘরে ইদুরের ভয় নেই। মোটা কাঁথা পেতে সুন্দর ঘুম হবে।”

“আমি নয়, আপনি শোবেন।”

“মামা বাড়ির আবদার?”

“শ্বশুরবাড়ির আবদার।”

রাসিফ কোমড়ে হাত রেখে বলে,
“ঘর আমার, বিছানা আমার। আমি কেনো নিচে শোবো? তোমার অসুবিধা হলে তুমিই শোও।”

লিখি চোখ ছোট করে তাকিয়ে রইলো। বললো,
“গিভ সাম রেসপেক্ট। একটা মেয়ে আপনার ঘরে এসে নিচে শোবে, তা দেখেও খাটে ঘুমাতে আপনার বাধবে না।”

“একদম না। আমি তো বলিনি আলাদা ঘুমাও। তুমিই বলেছো।”

রাসিফ লম্বা হয়ে খাটে শুয়ে পড়লো। লিখিও দমে যাওয়ার পাত্রী নয়। ভেজা হাত-পা নিয়ে সেও রাসিফের পাশে দুরত্ব রেখে শুয়ে পড়লো। রাসিফ পাশ ফিরে বললো,
“আমার কিন্তু অধিকার আছে, মনে রেখো।”

রাসিফের ইঙ্গিত ধরতে লিখির অসুবিধা হয় না। একই স্বরে বললো,
“আপনার ক্ষমতা সম্পর্কে আমারও ধারণা আছে, দুর্গন্ধযুক্ত স্বামী।”

একে অপরকে ভেঙচি কে’টে মাঝখানে বিশাল দূরত্ব রেখে দুজন দুদিক ফিরে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ পর রাসিফ আবারও পাশ ফিরে জিজ্ঞেস করলো,
“সত্যি সত্যি একটা কথার উত্তর দাও তো।”

“কি কথা?”

“তুমি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হলে কেনো?”

“আপনি কেনো হয়েছেন?”

“উল্টো প্রশ্ন না করলে পেটের ভাত হজম হয় না না?”

লিখি বিরক্ত হয়ে হাই তুললো। চোখ বুজে ঘুমুঘুম ভাব নিয়ে বললো,
“আপনি যেমন আমার বাবাকে ফেরাতে পারেননি আবার আপনার মাকেও মানাতে পারেননি, তেমনই আমিও বাবাকে কখনো মানা করি না। তাই ফেঁ’সে গেলাম।”

রাসিফের বিশ্বাস হতে চাইলো না কথাটা। সে সংশয় প্রকাশ করে বললো,
“শুধুই তাই… এক মিনিট এক মিনিট। আঙ্কেল বলেছিলেন তুমি দ্বিধায় পড়লে টসে বিশ্বাস করো। কোথাও তুমি বিয়ে নিয়েও টস করোনি তো?”

লিখি পুনরায় পাশ ফিরে গেলো। রাসিফ অধৈর্য হয়ে বললো,
“কি হলো আমার উত্তরটা দাও।”

“শাপলাকে হারিয়ে সেতু জিতে গেছিলো। তাইতো আপনি আমাকে জিতলেন। এবার লাইটটা নেভান তো। ঘুমাবো।”

রাসিফ লিখির বাহু ধরে একটানে নিজের কাছে এনে ফেললো। দাত কিড়মিড় করে বললো,
“বের করো।”

“কি?” লিখি আঁতকে উঠলো।

“ওই পাঁচ টাকার কয়েনটা বের করো। ওটাকে আমি ডোবায় ফেলে আসবো। বজ্জাত কয়েনটার জন্যই তুমি আমার জীবনে ঢুকলে। আর আমার স্বপ্নের বাসর রাত জলে গেলো।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here