শাপলা ও সেতুর গল্প [পর্ব-১৫]

0
165

#শাপলা_ও_সেতুর_গল্প
#প্রভা_আফরিন
[পর্ব-১৫]

লিখির বিয়ে থেকে ফিরতে ফিরতে নবীনের রাত দশটা বেজে গেলো। ঝিমিয়ে পড়া দেহ টেনে বাসায় ফিরতেই তার মা দরজা খুলে দিলেন। নবীন নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালে মা বললেন,
“অনিমারা এসেছে। তুই কোণার ঘরে যা।”

নবীন হতাশ চোখে রাস্তা পরিবর্তন করলো। দুই সন্তানের জননী অনিমা নবীনের তিন বোনের মাঝে বড়। নিলীমার মেয়ের জন্মদিনে আসার কথা থাকলেও এবার অনেকদিন পরে এসেছে। ওরা এলেই সবার শেষের ঘরটার থাকতে হয় নবীনকে। বলা যায় এটাই ওর সাময়িক নামধারী স্থায়ী বেডরুম। আর যেটা স্থায়ী সেটাকে গেস্টরুম বললে মন্দ হবে না। এই ঘরের দরজায় ছিটকিনি নেই। পুরোনো কাঠের দরজাটাও বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছে। যে কোনোদিন খুলে চলে আসতে পারে। নবীন আস্তে করে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। পাঞ্জাবীর বোতামে হাত দিতেই মা বললেন,

“এত দেরি করে যে এলি, আমাদের কি কোনো দরকার থাকতে পারে না?”

“লিখির পরিবার রাতের খাবার না খাইয়ে ছাড়লোই না। দরকার হলে ফোন দিতে একবার।”
বলতে বলতে নবীন খেয়াল করলো ফোনটা বন্ধ হয়ে আছে। সঙ্গে যোগ করলো,
“চার্জ নেই বোধহয়। কোনো দরকার ছিলো?”

“তোর বাবার একটা ঔষধ আনাতে হবে।”

নবীন ভ্রু কুচকালো। বললো,
“দুপুরেই না সব এনে দিলাম!”

“অনিমার ছেলেটা যা দুষ্টু হয়েছে না, খেলতে খেলতে ঔষধের কাঁচের বোতলটা ফেলে দিয়েছে। রাতে তোর বাবাকে ঔষধ দিতে পারিনি। তোকে যে বলবো ফেরার সময় আনতে, ফোনটাও বন্ধ রাখলি। এখন এনে দে। হাসপাতালের ফার্মেসী তো সারারাত খোলা থাকে।”

নবীনের বাবা ইফতেখার উদ্দিন পাশের ঘর থেকে আওয়াজ দিলেন,
“ছুটির দিনেও ছেলেটাকে অবসর দেবে না? একবার আমাকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটলো আরেকবার বিয়ে বাড়িতে। আবার সকাল হলেই অফিসে দৌড়াবে। রাতটা তো বিশ্রাম করতে দেবে নাকি?”

নবীনের মা খেকিয়ে উঠলেন,
“পারো তো খালি ভুল বুঝতে। আমি কি আমার ভালোর জন্য বলছিলাম?”

“এতই যখন আমার ভালোটা বোঝো তো ঔষধগুলো তুলে রাখলে না কেনো? জানোনা বাচ্চারা যা পাবে তাই নিয়ে খেলবে।”

“আমার চোখ আল্লাহ তোমাদের মতো দুইটাই দিছে। সবদিকে নজর দেওয়া তো সম্ভব না।”

ইফতেখার উদ্দিন মহা বিরক্তি নিয়ে বললেন,
“তো বাড়িতে আর কেউ ছিলো না ফার্মেসীতে পাঠানোর জন্য?”

“আর কে আছে? বড় জামাইকে কি পাঠাতে পারি? কতদিন বাদে তারা বেড়াতে এসেছে।”

“বাড়িতে এসে থাকার সময় ছেলে, আবদার করার সময় ছেলে। যেই কাজের কথা ওঠে ওমনি তারা জামাই হয়ে যায়, তাই না?”
ইফতেখার উদ্দিন খানিক চাপা চিৎকারেই কথাটা বললেন।

নবীন বাবার কাছে গেলো। ষাটোর্ধ ইফতেখার উদ্দিন বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছেন। নবীন থামানোর চেষ্টা করে বললো,
“আস্তে বাবা। ওরা শুনলে কষ্ট পাবে।”

ইফতেখার উদ্দিন ছেলেকে ধমক দিলেন,
“তুই থাম, গা’ধা। এদেরকে লাই দিয়ে তুই ই মাথায় উঠিয়েছিস। আমার বড় ছেলেটা বাপের মতো বুদ্ধিমান হয়েছে। তাই সময় থাকতে বউ নিয়ে আলাদা হয়ে গেছে।”
এরপর স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“তোমার ছোট মেয়ে বাসায় বসে কি করে? ওকে দিয়েও তো ঔষধটা আনানো যেত। যেত না?”

“তোমার আক্কেল কি গেছে? নিধিকে সন্ধ্যায় আমি বাইরে পাঠাবো?”

“যেই মেয়ে পরিবারের কথা না ভেবে টাকার সংকটের মাঝেও গার্ডিয়ান ছাড়া বান্দরবান ঘুরে আসতে পারে সে সামান্য ফার্মেসী যেতে পারবে না এসব আমাকে বোঝাতে এসো না। মেয়েদের কোথায় ভালো আর মন্দ আগে সেটা বুঝতে শেখো, বেয়া’ক্কেলে মহিলা। আমার পা গেলেও আক্কেল যথেষ্ট মজুদ আছে।”

নবীন বাবা-মায়ের ঝগড়া থামাতে বললো,
“মা ভালোই করেছে নিধিকে না পাঠিয়ে। নিধির কাছে তো টাকা ছিলো বাবা। ও ঔষধ আনবে কি করে?”

“শোন তুই টিভি সিরিয়ালে নাম লেখা। ওখানে তোর মতো কিছু অতি সরল ক্যারেক্টারের বেশ কদর আছে।”
বাবার কথায় নবীন হেসে ফেললো। ইফতেখার উদ্দিন আবার বললেন,
“একদম হাসবি না। নিধির বিয়ের ব্যবস্থা কর। একদম দেশের বর্ডারের কাছে বিয়ে দিবি যেন ছয়মাসেও বাপের বাড়ি না আসতে পারে। তারপর নিজ দায়িত্বে নিজের বিয়েটা সম্পন্ন করবি। এদের পছন্দের ওপর আমার কোনো ভরসা নেই।”

হঠাৎ জোরে দরজা লাগানোর শব্দ হলো। শব্দটা অনিমার ঘর থেকেই এলো। বোঝা গেলো সে সব কথাই শুনেছে। যদি খুব বেশি গায়ে লাগে তাহলে সকাল হতেই বাপ-ভাইয়ের ওপর দোষ দিয়ে বাড়ি ছাড়বে সে। নবীনের মাও মুখ বেকিয়ে ঘর ছাড়লেন। নবীন সেদিকে তাকিয়ে বললো,
“কি দরকার ছিলো এসবের বাবা? অনিটা তো এবার অনেকদিন পর রে এসেছে। কষ্ট পেয়েছে বোধহয়।”

“ওদের চিন্তা ছাড়। কোত্থাও যাবি না এখন। হাত-মুখ ধুয়ে লম্বা একটা ঘুম দে।”

“সব হবে। তুমি আরেকটু জেগে থাকো। আমি চট করে যাবো আর ফিরে আসবো।”

ছেলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ইফতেখার উদ্দিনের চোখ ভিজে যায়। তার এই ছেলেটা এত ভালো কেনো হলো?
_____________

পাখির কিচিরমিচির শব্দে রাসিফের ঘুম ভাঙেনা, আর না গলা ফাটানো মোরগের ডাকে। তার ঘুম বিদায় হয় মায়ের কিংবা আপার ধা’ক্কাধা’ক্কিতে। আজকের ঘুম অবশ্য মা কিংবা আপার ধা’ক্কাধা’ক্কিতে ভাঙলো না। রাসিফের ঘুমন্ত মুখে হুট করে লিখির চুলের ঝাপটা লেগেছে। চোখ মেলে একটি নারীদেহ নিজের পাশে আবিষ্কার করে কিছুক্ষণ থম ধরে রইলো সে। কিছুটা সময় নিয়ে মস্তিষ্ক আগের সব স্মৃতি মনে করিয়ে দিতেই রাসিফ স্থির হলো। পাশের ঘুমন্ত মেয়েটা তার বউ। বউ! কথাটা মাথা এলে রাসিফের দেহে খানিক শিহরণ খেলে যায়। বউ হবে মনের খুব কাছের কেউ। কিন্তু সাথের মানুষটা কি কাছের হবে! রাসিফের মনে হয় কোনোদিন যদি দুজনে দম্ভ ভুলে ভালোবাসা তৈরি করতে চায় লিখি তার বিখ্যাত পাঁচ টাকার কয়েন বের করে বলবে, ‘টস করে দেখি। যদি শাপলা হয় তো ভালোবাসবো আর সেতু হলে বাসবো না।’ এই মেয়ে এত আজব কেনো?

রাসিফের ভাবনার মাঝেই লিখি নড়ে উঠলো। সে সঙ্গে সঙ্গে চোখ বুজে ঘাপটি মেরে রইলো। লিখি আড়মোড়া ভেঙে উঠে যাওয়ার সময় কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
“চু’রি করে দেখার কি আছে? আমি কি পাশের বাসার ভাবী?”
রাসিফ ধরা পড়ে চোখ মেলে তাকায়। লিখির মুখোমুখি বসে বলে,
“তুমি কি করে বুঝলে? তারমানে তুমিও চু’রি করে দেখেছো?”

“চু’রি করে দেখবো কেনো? সরাসরি দেখেছি। ঠোঁট দুই ইঞ্চি ফাঁক করে হা হয়ে ঘুমাতে দেখেছি আপনাকে। কিছুক্ষণ হেসে গড়াগড়িও খেয়েছি।”

লিখি উঠে এলোমেলো শাড়ি ঠিক করে চলে গেলো। রাসিফের হতাশ হয়ে তাকিয়ে রইলো। এখন কি ঘুমের মাঝেও সতর্ক থাকতে হবে যেন এই মেয়ের হাসির খোরাক না হতে হয়!

শ্বশুরবাড়িতে প্রথম সকালটা লিখির মন্দ লাগছে না৷ নতুন বউ দেখতে আত্মীয়-প্রতিবেশিরা আসছে। কেউ হাসিমুখে কথা বলছে কেউ বা দূর থেকে দেখে ফিসফিস করছে। লিখি মুখে হাসি টেনে রেখেছে। রুনি ওকে দেখে বললো,

“তোমার নার্ভাস লাগছে না? আমি প্রথম দিন নার্ভাস হয়ে শুধু পানি খেয়েছি আর বাথরুমে গেছি। আমার আবার নার্ভাস বা টেনশনে পেট গুড়গুড় করে।”

লিখি হেসে বললো,
“নার্ভাস হলে আমার হাসি পায়।”

“এ্যা! নার্ভাস হলে হাসি কিভাবে আসে?”

“নার্ভাস হয়ে মুখে অস্থিরতা ফুটিয়ে অন্যকে দুর্বলতা দেখানোর চেয়ে হেসে অপরপক্ষকেও নার্ভাস করে দেওয়া সহজ।”

সকালে সবাই একসাথে খেতে বসলে লিখি হঠাৎ শ্বাশুড়িকে উদ্দেশ্য করে বলে বসলো,
“আম্মা, বাড়িতে নাকি গরু-ছাগলের খামার করা হবে?”

রাসিফ সবে খাবার মুখে নিয়েছিলো। লিখির কথায় তা আর গলা দিয়ে নামতে চাইলো না। জাহানারা বললেন,
“না তো। কে বলেছে এসব?”

লিখি রাসিফকে দেখিয়ে বললো,
“উনিই তো বললেন আমি যেন চাকরি-বাকরি ছেড়ে দেই। ওনার খুব শখ গরু-ছাগল পালবেন। আমাকেই সব দেখভাল করতে হবে।”

জাহানারা অবিশ্বাস্য চাহনিতে ছেলের দিকে তাকালেন। রাসিফ পানির সাহায্যে খাবারটুকু গলাধঃকরণ করে বললো,
“আমি একটু মজা করেছিলাম। ও সিরিয়াসলি নিয়ে ফেলেছে।”

লিখি অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বললো,
“কিন্তু আমি তো চাকরি ছাড়ার জন্য মনস্থির করে ফেলেছি। এখন বলছেন মজা করছেন?”

রাসিফ দাত দিয়ে নিচের ঠোঁট কা’মড়ে ধরলো। মেয়েটা ইচ্ছে করে ওকে ফাঁ’সাতে চাইছে। জাহানারা বললেন,
“পাগলদের কথায় নাচবে না। চাকরি করবে কি না সেটা একান্তই তোমার ব্যাপার। এই বিষয়ে পূর্ণ স্বাধীনতা পাবে। আশা করি আমার পুত্রবধূ সেই স্বাধীনতার অপব্যবহার করবে না।”

লিখি মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। এরই মাঝে রুনি হঠাৎ হা হা করে হাসতে গিয়ে বিষম খেয়ে কেশে হুলুস্থুল বাধিয়ে ফেললো। নওশাদ পানি খাইয়ে, মাথায় চাপড় মেরে ধমক দিলো,
“খাবারের সময় এত কিসের হাসি আসে তোমার?”

রুনির চোখে পানি এসে গেছে। কাশি থামার পরও ওর হাসি মুছলো না। বললো,
“একটা কথা মনে পড়ে গেলো। স্কুলে থাকতে একবার শিংওয়ালা ছাগলের তাড়া খেয়ে ভাই আমার কোলে চড়ে গেছিলো। বড় হয়েও কখনো গরু-ছাগলের হাটে যেত না ভয়ে। আর সে করবে গরু-ছাগল পালন? এখন দৌড়ানি খেলে তো নির্ঘাত বউয়ের কোলে চড়বে।”

রুনির কথায় রাসিফ সকলের হাসির খোরাক হলো। লিখি প্রশস্ত হেসে রাসিফের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমার তো এবার সত্যি সত্যিই গরু-ছাগলের খামার দিতে ইচ্ছে করছে।”

রাসিফ ভঙ্গুর মানসম্মান নিয়ে উঠে যাওয়ার সময় নওশাদকে উদ্দেশ্য করে বলে গেলো,
“দুলাভাই, আপনার মালামাল আপনি নিজ দায়িত্বে নিয়ে যাবেন। নাহলে রাস্তার মোড়ের পাগলের কাছে ছেড়ে আসবো।”

চলবে…

(সামনের সপ্তাহে পরীক্ষা। গল্প দিতে একটু অনিয়মিত হবো। আশাকরি বুঝবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here