তনয়া,১০,১১

0
226

#তনয়া,১০,১১
#সিতু
#পর্ব -১০

বেশ কিছু মাস পার হয়েছে আয়রার বিয়ের।এরই মধ্যে আয়রা বেশ গুছিয়ে নিয়েছে নিজেকে।একটু একটু করে সংসার বুঝে উঠতে শিখছে।রাফাতের পুরো পরিবার তাকে আগলে রাখে সবসময়।বাড়ির জন্য মন খারাপ হলেই রাফাত প্রায় সময় অফিসে যাওয়ার পথে আয়রাকে নামিয়ে দিয়ে যায় আবার ফেরার পথে নিয়ে আসে।তবে আজ আয়রা বেশ চিন্তিত হয়ে আছে। একটু আগেই শ্বাশুড়ি ডেকেছিল।শ্বাশুড়ির ভাষ্যমতে,

“আজ বিকেলে রাফাতের বড় খালা আসবেন।আয়রাকে নিয়ে আগামীকাল তনুকে দেখতে যাবেন।আরাফ নাকি তনুকে খুব পছন্দ করেছে।যদিও একি ঘরে দুবোনের আত্মীয়র সম্পর্ক হোক তাতে নাকি আয়রার খালা শ্বাশুড়ির আপত্তি ছিল।আরাফ একমাত্র ছেলে হওয়ার দরুন না করতে পারেননি।তাছাড়া তনুকে অপছন্দও হয়নি।সবমিলিয়ে কথা হচ্ছে, বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আয়রাদের বাড়িতে যাবে।”

কথা গুলো শোনার পর থেকেই আয়রা অস্থির হয়ে আছে।শ্বাশুড়িকে কিছু বলতে পারেনি।তনুর কথা ভেবে কান্না পেয়ে যাচ্ছে। এসব ব্যাপার নিয়ে তনুকে ঘাটানো মানে পুরোনো ক্ষতয় আঘাত করা।বাবা এখনো কিছুই জানে না তনুর বিষয়টা নিয়ে।এরকম ভালো একটা বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে বাবা নিশ্চয়ই খুশি হবে।আরও একটা ব্যাপার আছে,বলতে গেলে প্রস্তাবটা আয়রার শ্বশুর বাড়ি থেকেই যাচ্ছে!এটা নিয়ে তেমন আপত্তি করা মানে ঝামেলা তৈরি হওয়া।সমস্যাটা খুলে বলতে হবে না হয় একদম মানা করে দিতে হবে।সরাসরি মানা করে দেয়াটা আয়রার শ্বশুড় শ্বাশুড়ি ভালো ভাবে নেবে না।এসব ব্যাপার আয়রা আগে বুঝত না।বিয়ের পর অনেক বিষয় এখন বুঝতে শিখেছে। আয়রা ঠিক করেছে মাকে আগে জানিয়ে রাখবে।এখন প্রায়ই এই ধরনের পরিস্থিতিতে পরতে হবে।তাই বাবাকে সবটা জানানো প্রয়োজন। দূ্র্বলতা কখনো ঢেকে রেখে চলা যায় না।প্রকাশ করতেই হয়।আর সম্পর্কের মধ্যে স্বচ্ছতা থাকা খুব প্রয়োজন।যে তনুকে ভালোবাসবে সে সবটা জেনেই ভালোবাসবে।সৃষ্টিকর্তা চাইলে তনুর জীবন অনেক সুন্দর হবে।যেটা দেয়ার ক্ষমতা মানুষের নেই সেটা নিয়ে আঘাত দেয়ার অধিকারও নেই।

তনুর দিনগুলো ভালোই কাটছে।নিয়মিত ভার্সিটিতে যাওয়া,মাঝে মধ্যে বান্ধবীদের সাথে বেড়াতে যাওয়া,বাড়িতে থাকলে পড়াশোনা, মায়ের সাথে টুকটাক কাজ করা,ছাঁদের দোলনাটায় বসে বই পড়া এভাবেই বেশ ভালো সময় পার করছে।আয়রার বিয়ের পর প্রায় একা হয়ে গেছে।তন্ময় দিনের বেশি সময় স্কুলে থাকে,বাবা অফিসে। শায়লা বেগম সংসারের কাজে ব্যস্ত থাকেন।সময় চলছে তার নিজস্ব গতিতে সেই সাথে তনুও এগিয়ে চলছে নিজের মতন।নতুন করে ওঠা ঝড়টা খুব দ্রুত সামলিয়ে নিয়েছে।মিশকাত নামটা খুব করে ভুলে থাকতে চাইছে।তনু নিজের মতো বাঁচতে চায়।সামাজিক নিয়মের বাইরে বেরিয়ে নিজের নিয়মে চলতে চায়।পড়াশোনা শেষে চাকরি করবে।কাজের মধ্যে থাকলে ভালো থাকবে সে।সময় পেলে শহরের কোলাহল থেকে দূরে যাবে।কিছুটা সময় প্রকৃতির বুকে শুয়ে কাটিয়ে দেবে।এইতো,জীবনে আর কি চাওয়া?সবাইকেই যে ধরাবাঁধা নিয়মের মধ্যে থাকতে হবে,পরিপূর্ণ থাকতে হবে এমনটাও নয়।কিছু অপূণর্তা থাকুক না,ক্ষতি কি?

বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে জানতে পারলো, আয়রার শ্বশুর বাড়ি থেকে মেহমান আসবে । তাই আজ কিছু রান্নাবান্না করে রাখছে।তনুকে শুধু বলেছে ড্রয়িংরুমটা ভালোভাবে গোছাতে।

তনু ঘরে এসে শুয়ে পরলো।ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।ভার্সিটি থেকে ফিরলে খুব ক্লান্ত লাগে।কাল আপা আসবে ভাবতেই মনটা ভালো হয়ে গেল।গোসল করার জন্য উঠে কার্বাড থেকে কাপড় বের করতেই ফোনটা বেজে উঠলো।অচেনা নম্বর দেখা ফোনটা রিসিভ করবে কিনা ভাবতেই বন্ধ হয়ে গেল।সাথে সাথেই আবার ফোনটা বেজে উঠলো।এবার সে রিসিভ করে সালাম দিলো,

ওপাশ থেকে কোনো জবাব পেল না।তনু কয়েকবার হ্যালো বললেও কোনো সাড়া না পেয়ে কেটে দিলো।বিরক্ত হয়ে ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।

ওপর প্রান্তে থাকা মিশকাত তখনও ফোনটা কানে চেপে ধরে আছে।অনেকদিন পর তনুর কথা শুনতে পেল,নিশ্বাসের শব্দ অনুভব করতে পারলো!সেই রাতে ছাঁদে বলা তনুর কথাতেই আঁটকে ছিল এতদিন।মনটাকে আর দমিয়ে রাখতে না পেরে আজ তনুকে ফোন করে বসলেও গলা দিয়ে আওয়াজ বের করতে পারেনি।কি দরকার তনুর তিক্ততা বাড়িয়ে তোলার?

সেদিন জ্বরের ঘোরে তনু যখন লুটিয়ে পরেছিল মিশকাতই তাকে আঁকড়ে ধরেছিল।তনুর শরীরের তীব্র উষ্ণতা খুব করে টের পাচ্ছিলো।সেই প্রথম ছিল দুজনের উষ্ণ আলিঙ্গন। না ভুল হলো,দুজনের নয় তার একার।তনু তো নিজের জ্ঞানেই ছিল না।ছিল না জন্যই মিশকাত তনুর কাছাকাছি আসতে পেরেছিল।তনুকে অসুস্থ দেখে বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠেছিল।তনুকে পাঁজাকোলা করে ছাঁদ থেকে নামিয়ে ঘরে নিয়ে এসেছিল।ঘন্টাখানেক পাশে বসে তনুর হাত চেপে ধরেছিল।পরে মারুফের সাহায্য নিয়ে শান্তাকে ডেকে এনেছিল।ব্যাগ থেকে ওষুধ এনে শান্তাকে দিয়েছিল তনুকে খাইয়ে দেয়ার জন্য। এরপর সে রাতেই ব্যাগ গুছিয়ে পরেরদিন সকালেই বেরিয়ে পরেছিল ফুফু আর বাবাকে বলে।পরিক্ষার অযুহাত দেয়ায় খুব সহজ হয়েছে আসাটা।অসুস্থ তনুকে ছেড়ে আসতে খুব কষ্ট হয়েছিল।সে কষ্টটাও সহ্য করে নিয়েছিল শুধুমাত্র তনুর জন্য!একদিন সে ঠিক তনুকে বুঝিয়ে দেবে তার ভালোবাসা কোনো ঠুনকো বিষয় নয়।মিশকাতের কাছে তনুকে ভালোবাসা গোটা একটা জীবনের নাম!

***

শায়লা বেগম মনে মনে ছটফট করছেন।এমন একটা সময় তনুর জন্য এমন ভাবে বিয়ের প্রস্তাব আসবে তা কি ভাবতে পেরেছিল?তনুর বাবা নিশ্চয়ই খুব খুশি মনেই প্রস্তাবটা গ্রহণ করবেন!তনুর মতামত জানতে চাইলে তখনই হবে আসল সমস্যা। তনু কিছুতেই রাজি হবে না।বিয়ে বিষয়টা ভাবলেই তনু অন্যরকম হয়ে যায়।এবার বোধহয় তনু চুপ করে থাকবে না?বাবাকে সবটা জানিয়ে দেবে মেয়েটা।মেয়েটার বুকে যে কষ্টের পাহাড় জমে আছে!

“মা, তনুকে তো কিছুই বলা হয়নি?ওরা এখন হয়ত বাবার সামনে কথা গুলো বলবে।তনু যে কি কান্ড ঘটিয়ে বসে কে জানে?আয়রা ফিসফিসিয়ে মায়ের কানের কাছে এসে বলল।”

“তাই তো ভাবছি।এতদিন যা চেপে ছিল তা আজ বলে বসবে?তনু রেগে গেলে তোর শ্বশুর বাড়ির মানুষজন কি ভেবে বসে কে জানে?”

“আমি বা কি করবো? নিজের বোনের কথা তো ওভাবে বলা যায় না!আর তনুকে ছোট করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।ওরা যা ইচ্ছে ভাবুক, তনু শুধু কষ্ট না পেলেই হয়।”

“কষ্ট নতুন করে আর কি পাবে?আমার এত ভালো মেয়েটার জীবনে এতকষ্ট কেন আসলো বলতো?বড় ভাবীর কাছ থেকে যেদিন জেনেছিল সেদিন থেকেই ওর সমস্ত সুখ হারিয়ে গেছে?মাঝে মাঝে গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখতাম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।হুট করে এসে আমায় প্রশ্ন করে বসতো,মা আমার বাচ্চা না হলে কি খুব সমস্যা হবে?বাচ্চা না থাকলে কি সুখ থাকে না?এটা কি খুব বড় দোষ আমার?ও যখন নিজেকে বোঝাতে পারতো না তখন এসব বলতো।এখন দ্যাখ, এসব প্রশ্ন ভুলেও কখনও করে না।ধীরে ধীরে মেনে নিয়েছে,স্বাভাবিক হয়েছে।ভুলেও বুঝতে দেয় না ওর কষ্ট গুলো।”শায়লা বেগম শাড়ির আঁচলে চোখ মুছলেন।

আয়রাও প্রায় কেঁদে ফেলেছে। তনুর জীবনটা কেন এত এলোমেলো?আয়রা মনে মনে ঠিক করে নিলো যতদিন না তনুর জীবনটা সুন্দর হচ্ছে ততদিন সে বাচ্চা নেবে না!তনুর দুর্বল জায়গায় আঘাত সে কখনো করবে না।নিজের বোনটা গুমরে গুমরে শেষ হয়ে যাবে আর সে হাসি আনন্দে জীবন কাটাবে তা হতে পারে না!

আরাফের মায়ের পাশে বসে তনু উসখুস করছে। সেই কখন থেকে বসে আছে!ভদ্রমহিলা তার হাত ছাড়ছেই না।অথচ বড়দের কথার মাঝে একটু থাকতে ইচ্ছে করছে না তার।তনু খেয়াল করেছে ভদ্রমহিলা নিজের ছেলের গুনগান করছেন খুব।আরাফের ছোট বেলা থেকে পড়াশোনা চাকরি,প্রমোশন সবকিছু বলা শেষ করেছেন।তনু বুঝতে পারছে না কেন এত আরাফের কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাকে শোনানো হচ্ছে। বিয়ের দিন উনি অনেক প্রশ্ন করছিল কথাটা মনে হতেই তনু খুব সহজেই বিষয়টা বুঝে গেল।সাথে সাথেই শিরদাঁড়ায় শিরশিরে অনুভূতি হলো।বুকের ভেতর কাঁপন ধরলো।চট করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

আন্টি আপনারা বসেন আমি একটু আসছি।কথাটা বলে দ্রুত পায়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো।এমন পরিস্থিতিতে যে তাকে পরতে ত অনেক আগে থেকেই বুঝেছিল।।মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিল এসবের মুখোমুখি হওয়ার জন্য। তবু আজ নিজেকে হঠাৎ অসহায় লাগছে।আরাফের মায়ের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে বিধ্বস্ত হয়ে গেল কেন?কেন নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারলো না?

এরপরের ঘটনা গুলো খুব দ্রুতই ঘটে গেল।তনুর বাবা খুশি মনে প্রস্তাবটা গ্রহণ করলেন।আয়রার খালা শ্বাশুড়ি সবাই নিজের বাড়িতে আসার নিমন্ত্রণ জানিয়ে গেলেন।তনুর মতামত থাকলেই দ্রুত সবকিছু করার ইঙ্গিত দিয়ে গেলেন।তনুর বাবাও আস্বস্ত করেছেন,তনুর মতামত অবশ্যই থাকবে।

শায়লা বেগম আয়রা অসহায় হয়ে সবটা দেখে গেল।শায়লা বেগম নিজের ভুলটা এতদিনে বুঝতে পারলেন।তনুর বাবার থেকে এতবড় একটা বিষয় লুকোনো মোটেও ঠিক হয়নি।এই ব্যাপারটা লুকিয়ে তিনি তনুকেও কষ্ট দিয়েছেন।কারণ,মা হতে না পারাটা কোনো অন্যায় বা দোষের নয়!এই বিষয়টা তনুর গোটা জীবন হতে পারে না বড়জোড় জীবনের একটা অংশ হতে পারে।সত্যি তো এতবড় দুর্বলতাও নয় যে এভাবে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক করে তুলতে হবে?যেটা মানুষের হাতে নেই তা নিয়ে দুর্বল হওয়ারও কিছু নেই!

চলবে..

#তনয়া
#পর্ব -১১

তনয়া সন্ধ্যার পর ঘর থেকে বের হয়ে রান্নাঘরে চা বানাতে এলো।শায়লা বেগম আয়রা অবাক হয়ে তনুকে দেখছে।তনুকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে সেই বিকেল থেকে ওর মনে কি ঝড় বয়ে চলছে।

শায়লা ইশারা করায় আয়রা বলল,

তনু তোর খিদে লেগেছে? কিছু বানিয়ে দেব?

না আপা শুধু চা খাব।আমি বানাচ্ছি তুমি খাবে?মা তোমাকেও দেই?

শায়লা বেগম মাথা নাড়ালেন।কেউ বুঝে উঠছে না তনু কি চাইছে?

মাথা ব্যাথা করছে তোর?

হ্যাঁ রে আপা।মাথাটা খুব ধরেছে।একটু তেল লাগিয়ে দেবে?

আচ্ছা, চল ঘরে যাই।

দাঁড়াও বাবাকে চা দিয়ে আসি।

শায়লা যা বোঝার বুঝে গেলেন।তবে মনে মনে খুশিও হলেন।তনু নিজেই কথা গুলো বলতে পারবে এটাই তো আনন্দের। শুধু শুধু কেন গুটিয়ে রাখবে নিজেকে?বিষয়টা তনুর সমস্যা কোনো অপরাধ নয়!

বাবা একটু আগে চা খেয়েছে।তুই চল আমি তেল দিয়ে দেই।

তনু কিছু বলার আগে শায়লা বললেন,চা টা নিয়ে যা।তোর বানানো চা খুব পছন্দ করে।

তনু অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকালো। শায়লা বেগমের চোখের কোণ চিকচিক করছে।তনুর সস্তির শ্বাস ফেলে বাবার কাছে এলো।

তনুকে দেখে খুশি হলেন তানভীর সাহেব। ভেবেছেন মেয়েটা হয়ত মন খারাপ করেছে।হুট করেই এমন অভাবনীঅভাবনীয় প্রস্তাব পেয়ে তিনি কোনো কিছু চিন্তা না করেই মোটামুটি মত দিয়েই ফেলেছেন।না করার তো কারণ নেই।রাফাতকে যদি পছন্দ হয় তাহলে আরাফ কে কেন অপছন্দ হবে?আরাফও ভালো ছেলে।তবু তিনি খোঁজ খবর না নিয়ে এগোবেন না।তাছাড়া রাফাত ভালো জন্য আরাফও ভালো হবে এমনটা নাও হতে পারে।কিন্ত আত্মীয়দের মুখের ওপর না করে দেয়াটা খুব খারাপ হয়ে যেত।

তানভীরের পাশে বসে তনুর নিরবে চায়ে চুমুক দিচ্ছে।

তুমি কি আমায় কিছু বলবে বাবা?

তানভীর এতক্ষণে সুযোগ পেলেন।বললেন,

তুই কি আমার ওপর রেগে আছিস?

উহু, আমি তো কখনো রাগী না।বলতে পারো আমার রাগ খুব কম।যেটুকু আছে তাও অপ্রকাশ্য।

তা অবশ্য ঠিক।তুই তো রেগে থাকিস নীরবে।কিন্তু জানিস কি তোর চাপা রাগটাকে আমি আর তোর মা খুব ভয় পাই।

তনুর মনটা আসলেই ভালো হয়ে গেল।বাবার কাছে কিছুক্ষণ থাকলেই মন ভালো হয় তার।এর আগেও এমন হয়েছে।একটু গুছিয়ে নিয়ে বলল,

সবকিছু তো আমাদের হাতে থাকে না বাবা।তাহলে অপ্রত্যাশিত কিছু বিষয় নিয়ে রাগ অভিমান করার মতো বোকা আমি নই।তুমি তো জানতে না ওরা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবে।

আয়রা তো আমাদের সেভাবে কিছু বলে নি।আমি সত্যিই কিছু জানতাম না।

তুমি আরও একটা সত্যি জানো না বাবা! তোমার মেয়ে কোনোদিন “মা” হতে পারবে এই কথাটা এখনও তোমার অজানা।তোমার মেয়ের রিপোর্টে Polycystic Ovarian Syndrome এ সমস্যা লেখা আছে।এটা শোনার পর কি তোমার খারাপ লাগবে বাবা?

তানভীর স্থীর হয়ে বসে আছে।বোঝার চেষ্টা করতে চাইছে তনু কি বলছে!সব কথা গুলো জট পাকিয়ে উঠছে।

তনু আবার বলল,

আমি জানি তোমার খারাপ লাগবে।রাগও হবে প্রচুর এতদিন এই বিষয়টা গোপন রাখার জন্য।সবথেকে যেটা বেশি হবে সেটা হলো কষ্ট!তোমার মনে আছে বাবা,অফিস থেকে ফিরে আগে আমার হাতে চকলেট তুলে দিতে এরপর আয়রা আপাকে দিতে।ছুটির দিন গুলোতে তুমি আমায় বেশি সময় দিতে।সবসময় ছায়ার মতোন ছিলে আমার পাশে।মা বাবার কাছে সব সন্তান এক হলেও আয়রা আপাকে যেভাবে মা আঁকড়ে রেখেছে তুমিও সে ভাবেই আমায় স্নেহের চাদরে জড়িয়ে রেখেছ।তুমি পারবে না বাবা তোমার তনয়াকে এভাবেই আগলে রাখতে?

তনু বাবাকে প্রশ্ন করলো কিন্তু উত্তর শুনতে চাইলো।কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর দেয়ার প্রয়োজন হয় না।প্রশ্নটাই উত্তর হয়ে যায়।তনু উঠে দাঁড়াল। তানভীর সাহেবের সামন থেকে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চায়ের কাপটা নিয়ে চলে গেল।

***
মিশকাত ইন্টারভিউ শেষ করে বেরিয়ে এসে রাস্তার পাশে দাঁড়াল।প্রচন্ড গরমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে সে।আজ দুটো ইন্টারভিউ ছিল।একটা খুব খারাপ হয়েছে অন্যটা বেশ ভালো হয়েছে। ঠিক তনু যেরকম।বেশি খারাপ আবার খুব ভালো।টক ঝাল মিষ্টির সংমিশ্রণ। মিশকাতের ফাইনাল পরিক্ষার মাসখানেক বাকি।এরই মাঝে সে চাকরির পেছনে ছুটছে।পরিক্ষা নিয়ে ভাবছে না।তার এখন অন্যকিছু ভাবনা!শুধু ভাবনাতেই সীমাবদ্ধ নয় সেটা বাস্তবায়নেও নেমে পরেছে।এখান থেকে সোজা সে বাস টার্মিনালে যাবে।দুদিনের জন্য বাড়ি যাবে সে।রাস্তায় দাঁড়িয়ে মারুফের অপেক্ষা করছে।মারুফ এইদিকেই কাজে এসেছিল।দুজনে একসাথে বাড়ি ফিরবে।বাড়িতে থাকবে একদিন এরপর মারুফের কাছে যাবে।ওখানে সমস্ত কাজকর্ম সেরে আবার হলে ফিরবে।

পকেট থেকে টিস্যু বের করে গলায় জমা বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো মুছে নিলো।

কয়েক মিনিটের মধ্যে মারুফ এলো।দুজনেই রিকশা নিলো।

কিছু জানিস ওই দিকের খবর?

তুই বললেই জানতে পারব।

আরাফ বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে।ফুপা বোধহয় মত জানিয়ে দিয়েছে।

মিশকাত হাসলো দুপা ছাড়িয়ে আরাম করে বসলো।

এতসব কবে হলো?

গতকালই হয়েছে।আয়রার শ্বশুর বাড়ির কথা ভেবেই বোধহয় ফুপা এত দ্রুত রাজি হয়েছেন।তা না হলে দেখিস নি রাফাতের সময় কতদিন ধরে খোঁজ খবর চালিয়েছেন।

এবার খোঁজ নিয়ে কি করবে বিয়ে টাই তো হবে না!

কি বলছিস?কেন হবে না?তুই কি এখন বিয়ে ভেঙে দিবি তনুর?মারুফ অবাক হয়েছে ভীষণ।

মিশকাত এত সামান্য কিছু করে না।যা হবে তা এমনিই হয়ে যাবে।দুদিন পর শুনিস বিয়ের প্রস্তাব যেভাবে এসেছে সেভাবে ফিরে গেছে।

এত নিশ্চিত হচ্ছিস কিভাবে?তোর ধারনা তো ভুলও হতে পারে।

তনুর ব্যাপারে আমার কখনো ভুল হয়েছে?

মারুফ একটু ভেবে বলল,তা হয়নি।তুই বলেছিলি তনু তোর মাকে নালিশ করতেই পারে না!যদি করেও থাকে এর মধ্যে অন্য কোনো কারণ আছে।

আমার বিশ্বাসটা ঠিক মিলে গেছে।এখন দেখবি এটাও মিলে যাবে।কি বলতো,কাউকে ভালোবাসলে নিজের মাঝে সুপারন্যাচারাল পাওয়ার চলে আসে।তবে আমার দেরিতে এসেছে।তা না হলে অনেক আগেই বুঝে যেতাম তনু সেদিন রাতে দেখা করতে আসবে না!

তুই যে পথে হাঁটছিস তাতে কি মনে হয়?

মিশকাত সে কথা জবাব না দিয়ে বলল,

খোঁজ নে তো।তনু এ দুদিন ভার্সিটিতে আসবে কিনা?

তনুর সাথে দেখা করবি?

নাহ।ঠিক দেখা করবো না অন্যকিছু করবো!

ভালোভাবে বলতো কি চাইছিস তুই?

বলব,আগে কিছু খেয়ে নেই।বাসে উঠে তোকে সবটা বলছি।সকালে কিছু খেয়ে বেরোই নি আজ।

মারুফ রিকশাওয়ালা কে বলল,মামা সামনে কোনো ভালো রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়ায়েন তো।

আইচ্ছা মামা।

আরাফ মায়ের ঘরে মাথা নিচু করে বসে আছে।তার মা সমানে বকাঝকা করে চলেছে।কারণ,একটু আগেই তনুর বাবা জানিয়েছেন সবকিছু।তানভীর সাহেবে বলেছেন,

ওনার মেয়ের এই সমস্যাটা মানতে রাজি হলে হলে তবেই ওরা বিয়ের বিষয়ে ভাববে।তনুর সবটা ওনারা খোলামেলাই জানিয়েছেন।আরাফকেও বলে দিয়েছিলেন, তুমি বাবা বিয়ে করতে না চাইলে আমরা কিছু মনে করবো না।তবুও আগেই সব ভেবে চিন্তে নিও।বিয়ের পর আমার মেয়েকে অসুখী দেখতে পারব না।

তনুর বাবার এমন ব্যবহার ভালো লেগেছে আরাফের মায়ের।সত্যি লুকোনো হয় তাদের কাছে।আয়ারার পরিবার যে সত্যি ভালো পরিবার তা বুঝতে পেরেছেন।কিন্তু ছেলের কথা শুনে রেগে আগুন হয়ে গেছেন।

আরাফ বলছে,সে তনয়াকেই বিয়ে করবে।বাচ্চা লাগবে না তার।যদি প্রয়োজন হয় দত্তক দেবে।কত নিষ্পাপ শিশু এতিমখানায় বড় হচ্ছে। আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন আনা দরকার।নিজের ঔরসজাত সন্তান হতেই হবে এমন তো কোনো কথা নেই।এরকম সমস্যা তো তার নিজেরও হতে পারতো।

ছেলের এমন আবেগী ভাষণে গলে না গিয়ে বরং রেগেমেগে চড় বসিয়ে দিয়েছেন।একমাত্র ছেলের গায়ে হাত তুলেছেন অনেকদিন পর।এই যে এতবড় কথা বলছে ঠিক একদিন বলবে তার নিজের সন্তান চাই।তনুর সমস্যাকে আঙুল দিয়ে খুঁচিয়ে দেবে।যতই হোক তিনি একজন নারী।নিজেকে দিয়েই তো বোঝেন।আরাফ তার বিয়ের পাঁচ বছর পর এসেছে।এরপর তো অপারেশন করতে হলো।আরাফের বাবা প্রথম প্রথম ঠিক এমন কথাই বলেছিল।অথচ পাঁচটা বছরে কতশত ডাক্তার দেখিয়েছেন,কত মান অভিমান,অপমানের পালা চলেছে সেটা শুধু তিনিই জানেন।আরাফ একমাত্র ছেলে এখন যদি ছেলের বউও সন্তান জন্মদানে অক্ষম হয় তাহলে কি করে হবে?

***
তনু ভার্সিটির থেকে বেরিয়ে মারুফকে দেখতে পেল।হেসে এগিয়ে এসে বলল,

কেমন আছো ভাইয়া?

ভালো আছি, তোর খবর কি?

এইতো ভালোই।কাজে আসছিলে?

উহু,তোর কাছে এসেছি?

তনু একটু অবাক হয়ে বলল,

আমার কাছে কেন?

প্রয়োজন আছে।চল আমার সাথে একটা জায়গায় তোকে নিয়ে যাব।

কোথায় যাবো?

গেলেই দেখতে পাবি।

তনুকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে টেনে নিয়ে গেল মারুফ।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here