তনয়া,২,৩

0
260

#তনয়া,২,৩
#সিফাতী সাদিকা সিতু
#পর্ব- ২

দরজার অনবরত কড়াঘাতে পাশে থাকা বোনটা দৌড়ে দরজা খুলে দিলে সবাই হুড়মুড় করে ঢুকে আমার পাশে এলো।আমি তখনো ভয়েই আছি।সত্যি বলতে আমি প্রচন্ড ভীতু একটা মেয়ে।রাতে ইলেক্ট্রনিক লাইটে চারপাশ আলোকিত হয়ে থাকলেও আমি বারান্দায় কারও ছায়া দেখলেও চিৎকার করে উঠি।কিন্তু আজ অন্যরকম হয়ে গেছে সব।লাইট জ্বালানোর পর সবাই আমার দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে,

মা এসে বলল,ভয় পেয়েছিস তনু?তোর জামা ভেজা কেন? সারা মুখে তো পানি লেগে আছে।রাতে মুখ ধুতে গেলি কেন?মা নিজেই দিশেহারা হয়ে গেল প্রশ্ন করে।

মায়ের কথায় চমকে উঠলাম।পরখ করে দেখলাম সত্যি জামার গলার কাছটা ভেজা।
এর মানে ঠান্ডা শীতল স্পর্শটা পানি ছিলো!
কিন্তু আমি তো পানি খেতে উঠিনি বা ওয়াশরুমেও যাইনি?তাহলে এতসব হলো কখন?
আমি এভাবে ভিজলাম কেন?প্রশ্নগুলো মনে জাগছে আর শিউরে শিউরে উঠছি।ভুতের ভয় জেঁকে বসলো মনে।মায়ের আঁচল আঁকড়ে ধরলাম।

বাবা বলল,ও হয়ত পানি খেতে গিয়ে অন্ধকারে সব ভিজে ফেলেছে।

আমি কোনোমতে মাথা নাড়লাম।কারণ সবার সামনে যদি বলি আমি কিছু করিনি,ভুতে সব করেছে তাহলে সবার কাছে এই মাঝরাতে হাসির খোরাক হতে হবে।বড় মামা এসে আমার মাথায় হাত রেখে বললেন,তুই তো বেশ ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি আমাদের!

বড়মামাকে দেখে আমার মনে পরলো মিশকাত ভাইয়ের কথা।চট করে সোজা হয়ে বসলাম।ভালো ভাবে তাকিয়ে কোথাও দেখতে পেলাম না সেই, ‘কুপুরুষ’ কে!

মনে মনে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।একটু পর সবাই চলে গেল।মাকে ফিসফিসিয়ে বললাম, আমার সাথে ঘুমোনোর জন্য।

এই নিয়ে মায়ের কাছে অনেক বকা খেতে হয় আমায়।মা নাকি চিন্তা করেন এতসব মেয়ে এখনো ভুতের ভয় পায়,সে শ্বশুর বাড়ি গেলে কি করবে?সব মায়েরই একি চিন্তা, মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে গেলে কি করবে?শ্বশুরবাড়িটাই মনে হয় মেয়েদের একমাত্র পরিক্ষা ক্ষেত্র।

আচ্ছা, “মায়ের কি মনে হয় তার তনয়া কখনো শ্বশুর বাড়ি যেতে পারবে?”

মা যখন আলো নিভিয়ে আমার সাথে শুয়ে পরলো তখন আমি ভাবতে লাগলাম,আমার মুখে পানি আসলো কিভাবে?কিন্তু ভেবে কোনো সঠিক কারণ বের করতে পারলাম না।একবার মনে হলো বাবা ঠিক বলেছে,আমি হয়ত ঘুমের ঘোরে পানি খেতে গিয়ে এই অবস্থা করেছি।কিন্তু মন সায় দিলো না।হঠাৎ আমার মিশকাত ভাইয়ের কথা মনে পরে গেল।আমি একটু কেঁপে উঠলাম এবং সেই সাথে মনে পরে গেল তিনবছর আগে ঠিক এমনই একটা ঘটনা ঘটে ছিল।মিশকাত ভাইকে এড়িয়ে চলার কারণে আমার মুখে ঠান্ডা পানি ছুঁড়ে বলেছিল,”নিজেকে এত রূপবতী মনে করিস না,তোর ওই বান্দর মার্কা মুখটা না দেখলে কেউ মরে যাবে না।আমার সাথে ভাব নিয়েছিস তার একটু ছোট শাস্তির নমুনা দিলাম।এরপর থেকে তোর ভাব গুলোকে বস্তা বন্দী করে পঁচা ডোবায় ফেলে দিয়ে আসবি!”

আমার কেন জানি কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া অদ্ভুত ব্যাপারটার সাথে সেদিনের মিশকাত ভাইয়ের করা আচরনের মিল খুঁজে পাচ্ছি। আমি যে সুকৌশলে মিশকাত ভাইকে এড়িয়ে চলছি সেটা কি মিশকাত ভাই বুঝে গেল?আমার সারা গায়ে কাঁটা দিলো।চোখ বন্ধ করে মায়ের আরও কাছে ঘেষে শুয়ে ঘুমোনোর চেষ্টা করলাম।

বেশ বেলা করে ঘুম থেকে উঠলো, মিশকাত।রাতে ভালো ঘুমোতে পারেনি।সকাল বেলা সেই ঘুম একটু পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে।নিচে আসতেই ফুপি তাকে ঠেলে বসিয়ে দিলো নাস্তার টেবিলে।বেলা এগারোটায় সে নাস্তা করছে একা একা।স্যান্ডউইচে কামড় বসিয়ে চারপাশে একটু চোখ বুলিয়ে নিলো।বেশ শান্ত লাগছে বাড়িটাকে!রান্নাঘরের টুকটাক শব্দ ছাড়া তেমন কোনো আওয়াজ আসছে না।মিশকাত হঠাৎ খাওয়া থামিয়ে দিলো।এই স্যান্ডউইচটার স্বাদ এতো চেনা লাগছে কেন?

মিশকাত বসা থেকে উঠে এসে সোজা রান্না ঘরে ঢুকলো।

“ফুপি তুমি বানিয়েছ স্যান্ডউইচ? ”

“কেন রে খেতে মজা হয়নি বুঝি,কিন্তু তনু তো খুব ভালো স্যান্ডউইচ বানায়!”

মিশকাত শুধু নিরবে হাসলো।বলল,

“নাহ্ তেমন কিছু নয়,অন্য কিছু থাকলে দাও আমি স্যান্ডউইচ খাব না।”

“সবাই তো সকালে খিচুড়ি খেয়েছে।তোকেও দেব?”

“দাও।”

“তুই গিয়ে বস আমি নিয়ে আসছি?”

মিশকাত গেল না।সে আবার বলল,

“আয়রা আপারা কি বাড়িতে নেই?মাকেও দেখছি না?”

“সবাই তো বাইরে গেছে।অল্পকিছু কেনাকাটা বাকি আছে। তাই আমি বড় ভাবীকে পাঠালাম।”

শায়লা বেগম একটু থেমে বলল,”তুইও যাবি নাকি একটু?”আজ রাফাত আসবে! ”

মিশকাত সানন্দে রাজি হয়ে গেল।ঠিকানাটা জেনে তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে বেরিয়ে পরলো।

শপিংমলের পাশের ক্যাফেতে রাফাত আয়রা বসে আছে।আয়রা লজ্জায় কুঁকড়ে গেছে।রাফাতের অবস্থাও একি।সে বোধহয় আয়রার থেকেও লজ্জা বেশি পাচ্ছে। আয়রার সাথে কথা বলতে গিয়ে তোতলাচ্ছে,চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারছে না।বুকের ভেতরটা ধুকপুক করছে।ফোনে কথা বলতে এত লজ্জা লাগে নি কখনো।অথচ আজ যেন পৃথিবীর সমস্ত লজ্জা গুলো এসে ভীড় করেছে দুজনের মাঝে।

“তুমি কফি নেবে আরও?”

আয়রা মৃদুস্বরে বলল,”নাহ।”

রাফাত কি বলবে কথা খুঁজে পেয়ে বলল,

“বিয়ের শাড়ি পছন্দ হয়েছে?”

“হ্যাঁ।”

“তোমার কি ভালো লাগছে না?”

আয়রা মাথা তুলে তাকালো।

না মানে,তুমি কথা বলছো না,যা জিজ্ঞেস করছি সব হ্যাঁ না তে উত্তর দিচ্ছো তাই। তোমার ভালো না লাগলে উঠি চলো।”

আয়রার মনটা খারাপ হয়ে গেল।সে লজ্জায় ঠিক মতো কথা বলতে পারছে না।রাফাতের শুধু শুধু সময় নষ্ট করছে।অন্যদিকে উঠতেও ইচ্ছে করছে না।মনে হচ্ছে সারাজীবন এভাবেই বসে পার করে দিতে।

“না তেমন কিছু নয়।আমার খারাপ লাগছে না।”

রাফাত মুচকি হাসলো।মেয়েটা তারই মতো নার্ভাস।

তনু ওদের থেকে একটু দূরে বিরক্তি নিয়ে বসে আছে।বিরক্তির কারণ,”সামনে বসা রাফাতের কাজিন আরাফ।”ছেলেটা আঁড়চোখে বারবার তার দিকেই তাকাচ্ছে।তনুর অসস্তি হচ্ছে। কিছু বলতেও পারছে না। কয়েকদিন পরেই আত্মীয় হতে চলেছে।

“আপনি কি বিরক্ত হচ্ছেন? ”

“না।শুধু বসে থাকতে ভালো লাগছে না।”

“তাহলে চলুন আশেপাশে কোথাও হেঁটে আসি।”

“ইচ্ছে তো করছে কিন্তু উপায় নেই।আপা আমায় কোথাও যেতে বারন করেছে।দেখছেন না দূর থেকেও বোঝা যাচ্ছে দুজনেই লজ্জায় কাত হয়ে আছে।”

আরাফ জোরে হেসে উঠলো। বলল,
“আপনিও কি লজ্জা পাচ্ছেন?”

“আমি লজ্জা পাবো কোন?”

“নাহ, এমনি জানতে চাইলাম।” আপনি আমার অনেক ছোট হবেন।আমি কি তুমি বলতে পারি?”

“অবশ্যই। আমার কোনো সমস্যা নেই।”

“আচ্ছা বেশ,তুমি তাহলে কবে বিয়ে করছো?তোমার আপার পরেই তো তোমার সিরিয়াল।”

তনু কেঁপে উঠলো আরাফের কথায়।কি বলবে ভেবে পেল না।মানসপটে শুধু মিশকাতের মুখটা ভেসে উঠলো হঠাৎ। তনু সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ফেললো।

“কিরে বসে বসে ঘুমাইতেছিস ক্যান?ভদ্রতা এখনো শিখলি না!”

তনু চট করে চোখ জোড়া খুলে আবার বন্ধ করে নিলো।কি দেখলো সে।তার সামনে মিশকাত ভাই বসে আছে!

মিশকাত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো তনুর দিকে।তার পাশে থাকা আরাফ অবাক হয়ে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে।আসলে সে কিছু বুঝতে পারছে না।কোথা থেকে যেন এই ছেলেটা এসে বসে পরলো!

কিরে তোর কি ব্যারাম ট্যারাম ধরলো নাকি।ব্যারামী মুরগীর মতো টুপতেছিস কেন?

তনু এবার চোখ খুললো।সোজা হয়ে বসে সোজা মিশকাতে চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,

“তুমি এখানে কেন?”

তনুর কথায় মিশকাত অপমান বোধ করলো।রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।বলল,

“কেন তুই কি এই ক্যাফের মালিক।তুই শুধু একা আসতে পারিস আমি পারি না।তাছাড়া ফুপি আমাকে পাঠিয়েছে আয়রার আপার হবু বর দেখার জন্য। তোর মতো অসভ্য বেয়াদবের কাছে আসিনি।আর কে জানতো আয়রা আপার সাথে তোর টাও দেখে ফেলব!”মিশকাতের চোখ জোড়া লাল হয়ে গেছে রাগে।

তনু মনে মনে হাসলো।সে ঠিক জানতো মিশকাত তাকে দেখতে না পেয়ে এখানে এসেছে।তবে একটু চমকালো সে।আরাফকে মিশকাত অন্য ভাবে ভেবে নিয়েছে।যা ভাবার ভাবুক সে কিছু বলবে না।

আরাফ এবার বলল,

তনয়া,আমি কিছু বুঝতে পারছি না।কে এনি?

আমার বড় মামার ছেলে।বড় আপার বিয়ের জন্য এসেছে।

ওহ,তোমার মামাতো ভাই হন!

নাহ,আমি ওর মামাতো ভাই নই।মিশকাত প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো।

তনু আরাফ হতভম্ব হয়ে গেছে হঠাৎ মিশকাতের এমন চেঁচানোয়।

তনু চোখ মুখ খিঁচে বসে আছে।সে শুধু ভাবছে রাফাতের সামনে যেন মিশকাত ভাই কোনো সিনক্রিয়েট না করে।

তনু যে বলল আপনি ওর বড় মামার ছেলে।তাহলে তো মামাতো ভাই হলেন।

হ্যাঁ আমি ওর বড় মামার ছেলে হতে পারি কিন্তু ওর মামাতো ভাই নই।

তনু চট করে তাকালো মিশকাতের দিকে।খুব করে বুঝতে চাইলো মিশকাতের কথার অর্থ।

তনুকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মিশকাত বলল,আসলে ওর মতো অসভ্য মেয়ের মামাতো ভাই হিসেবে আমি নিজেকে পরিচয় দিতে চাই না।বাই দ্যা ওয়ে, আমি মিশকাত। আপনি?

আমি আরাফ।রাফাতের কাজিন।

তনু বিড়বিড়িয়ে বলল,”মিশকাত নাম না হয়ে তেমার নাম হওয়া উচিত মিচকা শয়তান! ”

বড় মামকে চা দিতে এসে মামির মুখোমুখি হয়ে গেল তনু।মামা ঘরে নেই।মামি বসে আছে জামাকাপড় গোছাচ্ছে। তনু কি বলবে ভেবে পেল না?

তনুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মামি বললো,

বোনের বিয়েতে তো তুই বেশি কাজ করছিস রে তনু?

তা বলতে পারো।কাজ করতে ভালো লাগে মামি।আর বড় আপার বিয়েতে নিজের হাতে কাজ করতে পারাটা আমার জন্য অনেক আনন্দের।

তা ঠিক।তোর অনেক গুন বলতে হবে।

তনু দীর্ঘশ্বাসটা চেপে রইলো।মামি তাকে ঠিক জায়গায় খোঁচাটা মেরে বুঝিয়ে দিলো তনুকে সীমা অতিক্রম না করতে।নতুন করে বুঝিয়ে দেয়ার কোনো দরকার ছিল না।তনু নিজেকে চেনে।সে কখনো সীমা অতিক্রম করবেও না।

চলবে..

#তনয়া
#পর্ব-৩

অনেক ধরনের আত্মীয় স্বজনদের দিয়ে বাড়ি ভর্তি হয়ে গেছে।দুদিন পরেই হলুদ। কাজিনরা সবাই বায়না করছে এবার মেহেদী অনুষ্ঠান আলাদা ভাবে করবে।হলুদের আগের রাতে মেহেদীর আয়োজন হবে ঘটা করে।সেখানে নাচ গান হৈ-হুল্লোড় সবকিছু হবে।সকাল থেকেই সব ভাই বোনরা এ নিয়ে কুটকুট করছে।তনু অবশ্য এসবের মাঝে থাকলেও নিজে থেকে কিছু বলছে না।কারণ তার মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। মিশকাত ভাই তাকে উঠতে বসতে অপমান করছে।তনুর এখন হাসি পায় মাঝে মাঝে।মিশকাত দু নৌকায় পা দিয়ে চলতে চাইছে।না ঘৃণা করতে পারছে না ভালোবাসা ভুলতে পারছে।দুটোর মধ্যে জট পাকিয়ে ফেলেছে।তাই তনুর সাথে ঠিক কি করা উচিত মিশকাত সেটাই বুঝে উঠতে পারে না।

তনু সিঁড়ির দিকে আনমনা হয়ে তাকাতেই
দেখতে পেল মিশকাত ভাই নামছে।কালো টিশার্টে মিশকাতকে দারুণ লাগছে। মিশকাতের গায়ে রং ফর্সা হওয়ায় কালো রং খুব ভালো মানায়।তনু চোখ সরিয়ে নিলো।বুকের ভেতর কোথাও খুব জ্বলছে। সে নিজের দিকে তাকালো। তার পরনে বটল গ্রিন কালারের সালোয়ার কামিজ।রাতের করা বিনুনিটাও খোলা হয়নি।মাথার ওপরটায় একটু চিরুনি চালিয়ে বের হয়েছে। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা।তনু নিজের ঠোঁট কামড়ে নিরবে হাসলো।সে কোনো দিক থেকেই মিশকাত ভাইয়ের জন্য নয়!শুধু মিশকাত কেন সে কি কখনো কারও যোগ্য হতে পারবে?

মিশকাত এসে তনুর থেকে একটু দূরত্ব রেখে পাশে বসলো।তনু আরও গুটিয়ে গেল।তা খেয়াল করে মিশকাতের রাগ উঠে গেল।কি ভাবে নিজেকে তনু? কোন রাজ্যের পাটরানী সে?মিশকাতের জেদ চেপে গেল।সে তনুর আরও কাছ ঘেঁষে বসলো।তনু চমকে উঠলো মিশকাতের এমন আচরণে।

“তুমি সরে বসো মিশকাত ভাই।”

“তুই সরে বস।” মিশকাত দাঁতে দাঁত চেপে উওর দিলো।

“আর তো জায়গা নেই।পরে যাব তো আমি!”

“যা পরে,পরে মরে যা তুই।”

তনু ফাঁকা ঢোক গিললো। মিশকাত এই কয়দিনেই অন্য রকম হয়ে গেছে।ভালোই তো ছিল এতদিন ধরে। কেন যে বড় আপার বিয়েটা ঠিক হয়ে গেল আর কেনই বা আবার মিশকাতের সাথে দেখা হলো তার?নিজেকে সে আর কত নিয়ন্ত্রণে রাখবে?মাঝে মাঝে মন ও মস্তিষ্কের যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।মনটা জিততে খুব চেষ্টা করে।তনুর মনে হয় সে হাঁপিয়ে উঠেছে।এভাবে নিজের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করা যায় না।

তনু উঠতে চাইলো কিন্তু পারলো না।তার ওরনার ওপর বসে আছে মিশকাত।তনু মহা ফ্যাসাদে পরলো।কি চাইছে মিশকাত ভাই?মানুষটা এখনো কি সেই সময় গুলো থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি।

তনু জোরে একটা শ্বাস নিলো।ধীর স্বরে বলল,

“আমার ওরনার ওপর বসেছ কেন?”

মিশকাতের কোনো ভাবান্তর হলো না।সে অন্যদের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত।

তনু বাধ্য হয়ে সবাইকে বলল,

“গোল টেবিল বৈঠক শেষ করো তাড়াতাড়ি সবাই।বসে বসে কথা বললে তো হবে না সব আয়োজনও তো করতে হবে।”

“শান্তা ভ্রু কুঁচকে তাকালো তনুর দিকে।বলল,
সেটা নিয়েই তো আলোচনা হচ্ছে।তুই কি কানে শুনতে পাস না?”

আরেক কাজিন মারুফ বলল,
“তোর মন কোথায় রে?এত উসখুস কেন করছিস?”

তনু পরলো মহা বিপাকে।তার ভাই বোন গুলো সব বিচ্চুরদল।

মিশকাত শুধু ভাবছে তার পাশে বসতেও তনুর এত অসুবিধা হয় তাহলে বোঝাই যায় সে শুধু শুধু নিজের সম্মান নিচে নামিয়ে ফেলে।কিন্তু সে যে তনুর চোখের ভাষা পড়তে পারে।কখনো ভুল হয়নি সে ভাষা বুঝতে।একমাত্র সেটাকেই অবলম্বন করে সে এক বুক আশা নিয়ে দিন গুনতে থাকে।

মিশকাত তার মুখটা একটু এগিয়ে এনে ফিসফিসিয়ে বলল,

তোর এতো অহংকার কেন?নিজেকে মিস ইউনিভার্স মনে করিস?

তনু অসহায় চোখে তাকালো মিশকাতের পানে।বলল,

“নিজেকে আমি কিছুই মনে করিনা। তোমার অনেক কিছুই মনে হতেই পারে সেজন্য আমার করার কিছু নেই।তুমি তোমার ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারো না সেটা তোমার সমস্যা।আমি আমার মতোই আছি।”

মিশকাত চোখ বন্ধ করে রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলো। বিড়বিড়িয়ে বলল,
“কেন তুই এতো আঘাত করতে জানিস তনু।যেদিন তোর আঘাতে আমি শেষ হয়ে যাব সেদিন ঠিক বুঝবি!”

তনুর কানে এসে লাগে কথা গুলো।বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে।কান্না গুলো গলার কাছে এসে দলা পাকিয়েছে।

***

“শায়লা গহনা গুলো ব্যাংক থেকে নিয়ে এসেছ?”

“নাহ্,তুমি আনবে তো সেগুলো?”

“সেটা আগে বলবে তো?আমি কতবার বাইরে যাচ্ছি এক ফাঁকে নিয়ে আসতে পারতাম।”

“কাল যেও বড় ভাইজানকেও নিয়ে।তোমার একা যাওয়া তো ঠিক হবে না।”

“তা না হয় যাওয়া যাবে।” তা শুনলাম ছেলে মেয়ে গুলো নাকি ছাঁদে হলুদের আয়োজন করতে চাচ্ছে? ”

“হ্যাঁ, ওরা তো তাই বলল।অনেক ফুল লাগবে।লিষ্টটা আমার হাতে দিয়েছে।”

“ঠিক আছে আমায় দিও অর্ডার দিয়ে আসবো।” আমার আয়রার মায়ের জন্য কোনো কিছুর কমতি আমি রাখবো না।”

শায়লা বেগমের চোখ জোড়া ভিজে এলো।তার আদরের মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে পরের ঘরে পাঠাতে মন সায় দেয়া না।তবুও সমাজের,ধর্মের নিয়ম মানতে হবে।যখন তখন মেয়েটার মুখটা দেখতে পারবেন আর এটা ভাবলেই বুকটা ফেটে যায়।আয়রার তার প্রথম সন্তান। মাতৃত্বের অনুভূতি আয়রাকে দিয়েই পেয়েছেন।খুব যত্নে,স্নেহে বড় করেছেন।এখন বিয়ে দিচ্ছেন। এর মাঝে কতটা সময় পেরিয়ে গেছে! অথচ মনে হয় এই তো সেদিন কোল আলো করে এসেছে মেয়েটা।

“আরে কাঁদছ কেন আবার?আয়রা এসে দেখুক শুধু। মেয়ের জন্য তুমি তো নিজেই দেখে শুনে পাত্র ঠিক করলে তাহলে এত চিন্তা কেন করছো?”

“মানুষের ভেরতটা তো পড়তে পারা যায় না।কার মনে কি থাকে বোঝা যায় কখনো!”

“তবুও ছেলে খুব ভালো।একদম আমাদের আয়রার মতই।”

“সে জন্যই তো আমি ছেলেটাকে এত পছন্দ করেছি।মেয়েটা আমার দুনিয়ার প্যাচগোজ কিছু বোঝে না।ওর জন্য রাফাত ঠিক আছে।”

“এখন চোখ মুছে ফেলো দেখি,তোমার তো এখন সুখের সময়।বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। দুদিন পর আমার তনয়ার বিয়েও হয়ে যাবে।তনয়ার জন্যও আমি ঠিক ভালো ছেলে খুঁজে পাব।”

শায়লা বেগমের দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল। তনুর কথা ভাবতেই কষ্টটা দ্বিগুণ বেড়ে গেল।

মিশকাত যে ঘরেই যাচ্ছে সে ঘরেই কেউ না কেউ আছেই।কোনো ওয়াশরুম ফাঁকা পাওয়া যাচ্ছে না।বিরক্ত লাগছে তার।সারা শরীর ঘেমে গেছে।এখন গোসল করতে না পারলে শান্তি পাবে না।আজ সন্ধ্যার পর মেহেন্দি অনুষ্ঠান।সকাল থেকে তাই নিয়ে ব্যস্ত।ছাঁদটাকে ওরা সবাই মিলে খুব সুন্দর ভাবে সাজিয়েছে। এত কাজ করে সকলে হাপিয়ে উঠেছে। এখন গোসল সেড়ে খাওয়া দাওয়ার পাঠ চুকিয়ে একটু বিশ্রাম করবে সবাই।এরপর বিকেলে রেডি হতে হবে।আজ সারারাত মজা করবে ওরা। নাচ গান আড্ডায় মেতে থাকবে।

তনু সদ্য গোসল সেড়ে বেরিয়েছে।মাথায় এখনো তোয়ালে পেঁচানো।তার খুব খিদে পেয়েছে তাই আগে খেতে যাবে। খেয়ে একটা ঘুম দেবে।কারন আজ রাতে যে ঘুমোনোর উপায় নেই তা বুঝে গেছে।হলুদের দিন সারারাত জাগলে বিয়ের দিন অনেকের সমস্যা হতে পারে ভেবেই আজকে এই ব্যবস্থা করা হলো।এতে মজা করাও হলো সবকিছু ঠিকঠাক থাকলো।তনু মিশকাত কে খেয়াল করে নি।সিঁড়ি দিয়ে নামার আগে মিশকাতের সাথে মুখোমুখি হয়ে গেল।তনু একটু হকচকিয়ে গেল। মিশকাত সারা মুখ ঘামে চিকচিক করছে। টিশার্টের বুকের কাছের বোতাম গুলো খোলা।লোমশ বুকেও ঘামের ফোঁটার অস্তিত্ব। মিশকাত স্থির চোখে তার দিকেই চেয়ে আছে জন্য সে তাড়াতাড়ি নেমে গেল।

“তনু!”

মিশকাতের আচমকা এই ডাকে থেমে যেতে হলো।নিচ থেকে ওপরে তাকিয়ে দেখলো সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে মিশকাত একি ভাবে তার দিকে আছে।

“কিছু বলবে?”

“আমায় একটু গোসল করার ব্যবস্থা করে দিবি?কোনো ওয়াশরুমে ফাঁকা পাচ্ছি না।”

তনু একটু থমকালো।এই জন্যই কি তাকে থামালো মিশকাত ভাই।সে তো অন্য কিছু ভেবেছে।একটু আগে মিশকাত ভাইয়ের চোখে সে তার প্রতি মুগ্ধতা দেখেছে।ভেবেছে কিছু হয়ত বলবে।তনু দীর্ঘশ্বাস গোপন করে আবার ওপরে উঠে আসলো।মিশকাত বলল,

“আমার সাথে এসো।আমার ঘরের ওয়াশরুম ফাঁকা আছে।”

মিশকাত মুচকি হেসে তনুর সাথে পা বাড়ালো। তনুকে খুব স্নিগ্ধ লাগছে।মিশকাতের ইচ্ছে করছে শুধু তাকিয়ে থাকতে।বলতে ইচ্ছে করছে,তোর দিকে অপলক ভাবে তাকিয়ে থাকার অনুমতি দিবি? কিন্তু পারলো না বলতে।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here