তনয়া,৪,৫

0
338

#তনয়া,৪,৫
#সিতু
#পর্ব-৪

তনুর সব থেকে কষ্টের ব্যাপার হচ্ছে,সাজগোজ করলে তাকে বেশি খারাপ দেখায়।সাদামাটা থেকে এমন অভ্যাস হয়ে গেছে যে হুটহাট একদিন সাজলে কেমন অসস্তি হয়।লজ্জায় ঘর থেকে বের হতে ইচ্ছে করছে না।সবাই যদিও বলছে খুব ভালো লাগছে দেখতে!

তনু লাল সবুজ মিশেলের একটা শাড়ি পরেছে।টান টান করে বেনুনি করেছে। দুহাতে গোলাপ ফুল দিয়ে বানানো মালা জড়ানো। মুখে মেকআপ। সব মেয়েরা একি ধরনের শাড়ি পড়েছে আজ।লাল সবুজ মিশেলের শাড়ি গুলো অর্ডার দিয়ে তৈরী করা হয়েছে।ছেলেদের জন্য সবুজ পাঞ্জাবি।আয়রার জন্য অবশ্য বাসন্তী রংয়ের শাড়ি,কাঠগোলাপের গয়না।

সবাই মিলে গায়ে হলুদের থিমটা এভাবেই ভেবেছে।ছাঁদেও টাটকা গোলাপ ফুল দিয়ে স্টেজ সাজানো হয়েছে।চারপাশে রঙিন পর্দার আবরণ। সবাই তাড়া দিচ্ছে বের হবার জন্য। অনুষ্ঠান শুরু করতে হবে।ফটোগ্রাফার তৈরী আছে।আয়রাকে নিয়ে ছাঁদে যেতে হবে।

তনু আয়নায় নিজেকে আর একবার পরখ করে নিলো।লজ্জাটা কমাতে পারছে না সে।আপাও তো এভাবে লজ্জা পাচ্ছে না!তাহলে তার হলো টা কি আজ?শাড়ি তো এর আগেও পরেছে সে অনেকবার।বিয়ে বাড়িতেই পরতে হতো বেশি তবু আজ লজ্জা গুলো তাকে কেমন কাবু করে ফেলছে!

এত লজ্জার কারণ কি,মিশকাত ভাই?

সবাই হলুদের ডালা হাতে দাঁড়িয়ে গেল ছবি তুলতে।তনু সামনের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলো। মিশকাত ভাই ফটোগ্রাফারের পাশে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে।সবুজ পান্জাবিটা খুব মানিয়েছে মিশকাতকে।তনুর অসস্তি হতে লাগলো।ছবি তোলা শেষ হতেই ছাঁদে উঠে গেল দ্রুত। সবকিছু ঠিকঠাক করে আয়রাকে বসিয়ে দিলো যথাস্থানে। সোজা হয়ে দাঁড়াতেই মিশকাতের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। তনু সরে যেতে চাইলো মিশকাতের রহস্যময় দৃষ্টির আচঁ থেকে।কিন্তু যেতে পারলো না।আয়রা টেনে পাশে বসালো তাকে।

আয়রার খুব নার্ভাস লাগছে।তনু বলল,

“পানি খাবে, আপা?”

“নাহ,তুই আমার পাশে বসে থাক শুধু। আমার কেমন যেন লাগছে। বুকের ভেতরটা কেমন উচাটন করছে।”

“মাকে ডাকবো,তোমার পাশে এসে বসবে?”

“না থাক।মা আমার থেকেও বেশি নার্ভাস।তুই আমার সাথে থাক তাহলেই হবে।”

তনুর চোখ জোড়া ভিজে উঠলো। আপাকে প্রবল স্নেহের চাদরে জড়িয়ে রাখতে ইচ্ছে করলো তার।আপা চলে যাবে ভাবতেই কেমন বিবশ হয়ে আসছে মনটা।তবু নিজেকে শান্ত রেখে বলল,

“এখানে সবাই তোমার আপনজন।নার্ভাস হচ্ছো কেন আপা?যেখানে যাচ্ছ তারাও তোমার আপনজন হয়ে যাবে।নিজের এই শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত গুলো মনের মতো করে উপভোগ করো।দেখবে খুব ভালো লাগবে।”

“আমি তো সেটাই পাচ্ছি না রে।কেমন যেন ভয় করছে।যদি খারাপ কিছু হয়?”

” আপা তুমি কি জানো,তুমি যখন স্কুল থেকে মায়ের কোলে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে তখন আমার তখন মনে হতো, কে আমার এত ভালো আপাকে কষ্ট দেয়? আমার অবুঝ মন তখন তোমার কান্নার পেছনে যে দায়ী তাকে খুঁজতে চাইতো।খুব কঠিন শাস্তি দিতে চাইতো।আমি তখন শুধু বুঝতাম আমার আপার সুন্দর কোমল গাল গুলো দিয়ে কেন কষ্ট ঝরবে?আমার আপাকে সবাইকে ভালোবাসবে।আমার আপা তো খুব করে ভালোবাসার মতো একজন।তাকে কষ্ট দেয়ার অধিকার কারো থাকতেই নেই।”

আয়রা ছলছল চোখে তনুর দিকে তাকিয়ে আছে।

তনু বলে চলল,

“পৃথিবীতে যতই নোংরা থাকুক না কেন তোমার মতো শুভ্র কোমল নারীকে সেই ময়লা কখনোই ছুঁতে পারবে না আপা।আমার আপা শুধু ভালোবাসা পেতেই এই পৃথিবীতে এসেছে।কোনো কষ্ট তোমার ধারে কাছেও আসবে না।তুমি দেখে নিও সৃষ্টিকর্তা তোমায় ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখবে।এত ভালোবাসা পাবে যে তুমি মুঠো ভরে নিলেও হাতের পাশ বেয়ে চুঁয়ে চুঁয়ে পরবে।আমার যখন ভালোবাসার দরকার হবে আমি তোমার কাছ থেকে চেয়ে নেব,দেবে তো আমায়, আপা?”

আয়রা শব্দ করে কেঁদে উঠে তনুকে জড়িয়ে ধরলো।

সবাই এদের দুবোনকে দেখে অবাক।এত সেজেগুজে এসে কিনা এমন জড়াজড়ি করে কাঁদছে।

বড় মামা এসে ধমক দিলো।তনুকে বলল,

“তোরা এমন শুরু করলি কেন?তোর মা এসে দেখলে সেও তো শুরু করে দেবে।এতসব আয়োজন করে কি লাভ হলো? ”

তনু চোখ মুছে বলল,

“তুমি যাও মাকে ডেকে এনো।আমরা একদম ঠিক আছি।মা, প্রথম হলুদ লাগাবে আপাকে।”

তনু টিস্যু চেপে চেপে আয়রার চোখের কোণের পানিটুকু মুছে দিলো।

মিশকাত একট দূর থেকে সবটা দেখছে। তার তনুর ছলছলে চোখ দুটো মোটেও ভালো লাগছে না দেখতে।চোখের পাতা গুলো কেমন ভিজে লেপ্টে গেছে।শাড়িতে সারা অঙ্গ জড়িয়ে একটা মেয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছে,থেমে থেমে চোখের কোণটুকু আস্তে মুছে নিচ্ছে।আহা কি সুন্দর দৃশ্য! মিশকাতের মনে হলো সে যদি এই কান্নারত রমনীর মুখটা একটু আলতোভাবে ছুঁয়ে দিতে পারতো তাহলে বেশ হতো।মসৃণ ত্বকের ফুলে ওঠা গাল দুটো টিপে দিয়ে বলত,

“এমন বোকার মতো কাঁদছিস কেন পাগলি?জানিস না তোর কষ্ট গুলো অন্য কারো রক্তক্ষরণের কারণ হয়!”

একে একে সবাই হলুদ লাগানো শুরু করলো। গান বাজছে,বড়দের হৈহুল্লোড়, বাচ্চাদের চেঁচামেচি, আনন্দ, দুঃখ সব মিলে মিশে অদ্ভুত মুগ্ধতা বিরাজ করছে পুরোটা সময় জুড়ে।

তনু আপাকে বলে একটু উঠে আসলো।সে একটু নিচে যাবে প্রয়োজনীয় কাজে।সিঁড়ির কাছে আসতেই মিশকাত তাকে তাড়াতাড়ি টেনে নামালো নিচে।আঁতকে উঠেছে তনু এমন কান্ডে।ভয়ে একটু চেঁচিয়েও উঠেছিল কিন্তু এত কোলাহলে সবটা চাপা পরে গেছে।

“আমার হাত ছাড়, মিশকাত ভাই।”

“অনন্তকাল তোর হাত ধরে বসে থাকার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।নিজেকে ক্যাটরিনা কাইফ ভেবে বসে থাকিস না।”

তনু ঝটকা মেরে মিশকাতের হাতের মুঠো থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলো।বলল,

“তুমি আমায় এভাবে টানলে কেন?কেউ দেখে ফেললে কি হতো?”

“কি হতো?”মিশকাত দু পকেটে হাত রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল।

তনু কিছু বলল না।রাগ লাগছে তার।হঠাৎ করে এই যন্ত্রণা কেন যে উদয় হলো?

“তোকে কেমন খ্যাত লাগছে জানিস?এভাবে খিঁচে গরুর লেজের মতো চুল গুলো বেঁধে রেখেছিস কেন?দেখতে খুব বাজে লাগছে। তার ওপর আবার ঠোঁট উল্টে ভ্যাঁভ্যাঁ করে কাঁদছিলি।তোর কোনো হুশ জ্ঞান নেই?ফটোগ্রাফার তো ছবি তুলেই যাচ্ছে।যখন ছবি গুলো দেখতি তখন হাত পা ছুঁড়ে কাঁদতে বসতি নিজেকে এই রূপে দেখে।”

তনু হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এত গুলো কথায় তার মাথায় ভনভন করছে। মিশকাত তাকে এভাবে অপমান করছে কেন?

“যাইহোক,চুল যখন বেঁধেই নিয়েছিস তখন তো আর করার কিছু নেই।”পকেট থেকে দুটো গোলাপ বের করে তনুর দিকে বাড়িয়ে ধরে আবার বলল,

“এদুটো ফুল চুলে গেঁথে নে।তাহলে ভালো লাগবে।তোর তো কমনসেন্স বলতে কিছুই নেই।এত ফুল হাতে পরে আছিস অথচ চুলে একটা ফুল গুঁজে দিতে পারিস নি!এই হলো তোর রুচি!ভালো জিনিস চিনতে পারিস না।”

ফুল দুটো তনুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে মিশকাত আর দাঁড়ালো না।গটগট করে হেঁটে চলে গেল ছাঁদের দিকে।

তনু তার জায়গা থেকে নড়লো না।সবকিছু কেমন তালগোল পাকিয়ে গেছে।মিশকাত আসলে কি বোঝাতে চাইলো?তাকে অপমান করলো নাকি অন্যকিছু?তনু দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফুল দুটোর দিকে তাকিয়ে রইলো।

“এইটুকুর জন্য এত ঘুরিয়ে, এত পেঁচিয়ে, এত কথা! ”

তনু ঠোঁট কামড়ে হাসলো।সরাসরি তাকে বলতে না পেরে কতগুলো কথা বলতে হলো বেচারাকে।তনুর মনটা খারাপ হয়ে গেল।মানুষটা যে অসম ভালোবাসা বুকে চেঁপে আছে তার কোনো ভবিষ্যত নেই।তনু তো প্রতিনিয়ত পুড়ে মরেছে এটা ভেবে যে মিশকাত ভাই অন্তত ভালো থাকুক!এখন দেখছে তার পথেই পা বাড়িয়ে আছে মিশকাত!

তনু যখন ছাঁদে উঠলো তখন রাফাত ভিডিও কলে আয়রার সাথে কথা বলছে। ফোনটা হাতে নিয়ে আছে মিশকাত।তনু আর সেদিকে গেল না।বড় মামার কাছে দাঁড়াতেই বড় মামি কেমন সরু চোখে তাকালো।তনু সেখানেও বেশিক্ষণ দাঁড়ালো না।সে সোজা বাবার কাছে চলে এলো।ছোট চাচার সাথে বাবা বসে আছে।চোখ মুখ গুলো কেমন শুকিয়ে গেছে।তনু বাবার পাশ ঘেষে বসলো।

“কিরে, খুব মন খারাপ হচ্ছে আপার জন্য?”

“তোমারও তো হচ্ছে! ”

“তানভীর সাহেব হাসলেন।তনুর যে কষ্ট হচ্ছে তা বেশ বুঝলেন।তার নিজেরও তো থেকে থেকে বুকটা ভারী হয়ে আসছে।শায়লা তো হলুদ ছুঁয়েই চলে গেছে।এখানে থাকলে নাকি কান্না আটকাতে পারবে না। এই সুন্দর পরিবারের একটা সুন্দর গুরুত্বপূর্ণ অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। আয়রার জন্মের পর সবথেকে খুশি হয়েছিলেন তিনি।ছোট শরীরটাকে কোলে নিতে পারতেন না ঠিকঠাক তবুও সারাক্ষণ লেগে থাকতেন মেয়ের কাছে।তিনি শখ করে” আয়রা” নাম রেখেছিলেন।।এরপর তনুর জন্মের পর সে খুশি দ্বিগুণ বেড়ে গেছে।”তনয়া” নামের ছোট মেয়েটার আধো বুলিতে প্রথম কথা “বাবা ” বলতে শিখেছিল। সবাই তনু নামে ডাকলেও তিনি সবসময় পুরো নাম ধরেই ডাকেন।এরপর ছোট ছেলে তন্ময়।পরিবার ভরে উঠেছে তখন থেকেই।হাসি আনন্দে কেটে গেল কতগুলো বছর!আজ সেই বড় রত্নটাকে পরের ঘরে পাঠানোর সময় এসে গেছে!তানভীর সাহেবের বুকটা ভার হয়ে এলো।

তনু বাবাকে দেখেই বুঝে গেল।সে বাবার বুকে মাথা রাখলো।বিড়বিড়িয়ে বলল,

“তুমি কষ্ট পেয় না বাবা।তোমার আয়রা না থাকলেও তোমার তনয়া কখনো তোমায় ছেড়ে যাবে না।তোমার বুকটা ছাড়া যে কোথাও কোনো জায়গাও হবে না তোমার আয়রার।”

…………….

আরাফ বিকেল থেকে অনেক চেষ্টা চালিয়ে রাফাতকে রাজি করাতে পারলো অবশেষে। বিয়ের আগে হবু শ্বশুর বাড়িতে যেতে প্রচন্ড আপত্তি রাফাতের।অনেক বোঝাতে হয়েছে এজন্য।

এখন সবাই বর কনের হলুদ একসঙ্গে আয়োজন করে।তাড়াছা হলুদ অনুষ্ঠানের মাঝে বর হুট করে এসে সারপ্রাইজ দেয় এমন রীতি চলছে আজকাল।এজন্য ভিডিও ফোনে আয়রাকে দেখিয়েছে।বলেছে,দ্যাখ তোর বউকে কত সুন্দর লাগছে?সামনাসামনি দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে না তোর?।তাড়াছা খেয়াল করেছিস ভাবীর মুখটা কেমন শুকনো লাগছে!বেচারা সবাইকে ছেড়ে তোর কাছে আসবে আর তুই তাকে একটু সারপ্রাইজ দিয়ে খুশি করতে পারবি না?এমন অনেক ধরনের কথা বলে অবশেষে রাজি করিয়েছে।

রাফাতকে তো আর বলা যায় না যে, তার মন ছটফট করছে তনয়াকে এক নজর দেখার জন্য।ঘন পাপড়িতে ঘেরা কাজল কালো চোখ জোড়া যে তার রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছে!

“আরাফ মা যদি জানতে পারে খুব বকবে, দেখিস?”

“বকা খাবি না হয়।বউয়ের জন্য সামান্য বকা খেতেও তোর এত ভয়!তুই শালা বিয়ে করবি কিভাবে?শোন, “পেয়ার কিয়া তো ডারনা কেয়া”।

“উফ,আজ যে কপালে কি আছে কে জানে?”রাফাত আরাফের সাথে পেরে না উঠে গাড়ি স্টার্ট দিলো।

চলবে…

#তনয়া
#পর্ব-৫

হলুদ অনুষ্ঠানের আনন্দ তিনগুন বেড়ে গিয়েছে রাফাতের আগমনে।অথচ এখানে আসার পর থেকে রাফাত লজ্জায় কাবু হয়ে আছে।আয়রার অবস্থাও একি।কিছুক্ষণ আগেই তো মানুষটা ভিডিও কলে কথা বলল।অথচ হুট করে চলে আসলো কাউকে কিছু না জানিয়ে।আরাফ সবাইকে বলছে,তাকেই নাকি সারপ্রাইজ দেবার জন্য এসেছে ওরা।আয়রার খুশি হলেও লজ্জায় রাঙা হয়ে বসে আছে।বড়রা সবাই নিচে নেমে গেছে।অনেকে তো মুখ টিপে হাসছিল।
তার এক কাজিন ফিসফিসিয়ে কানের কাছে এসে বলে গেছে,

“কিরে,তোর হবু বর তো দেখছি বউপাগল হবে।একরাতও ধৈর্য্য ধরতে পারলো না।তোর কপাল খুব ভালো রে, জামাই তোর আঁচলের তলায় থাকবে। ”

আয়রার লজ্জায় মরি মরি অবস্থা। কেন যে এমন কান্ড করে বসলো মানুষটা? ভেবে পেল না সে। দরকার ছিল এসবের?সেই তো কাল বিয়ে হয়ে সারাজীবনের জন্য রাফাতের হয়ে যাবে সে!
তবে বুকের ভেতরটা অনাবিল সুখের ফোয়ারায় ভেসে যাচ্ছে।

তনু চোখমুখ কুঁচকে বোঝার চেষ্টা করছে সবটা।রাফাত যদি সারপ্রাইজ দিতে এসেই থাকে তাহলে এত লজ্জা পাচ্ছে কেন?আপার সাথে নাচ করতে কিছুতেই রাজি হলো না।আপাকেও তো নড়ানো গেল না।দুজনেই একি ধরনের।কিন্তু রাফাতের যদি এতই তো এখানে আসতে লজ্জা করেনি?ঠিক মেলাতে পারছে না কিছু!এদিকে আরাফ আসছে থেকে তার আশেপাশেই ঘুরছে। বলছে,

“সে তনু আর আয়রাকে ছাড়া কাউকে না চেনায় অসস্তি হচ্ছে। রাফাত তাকে জোর করে এনেছে।আয়রার কাছে তো আর থাকতে পারে না তাই তনুর কাছেই আসছে।”

এমন অকাট্য যুক্তির বিপরীতে কিছু বলার মতো খুঁজে পায় নি।বাধ্য হয়ে তনুকে কথা বলতে হচ্ছে। তনুই জোর করে আরাফকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে শুধু, মিশকাত ছাড়া।মিশকাতকে তো চেনার কথা!সেদিন কফি শপে দুজনের পরিচয় হয়েছিল।কিন্ত আপাতত ছাদের কোথাও মিশকাতকে দেখতে পেল না তনু।এ দিকে আরাফকে কেমন বিরক্ত লাগছে।একটু পরেই ওরা আড্ডা বসাবে।নাচ গানে মেতে উঠবে সবাই।তনু তন্ময়কে ডাকলো,

“শোন, মিশকাত ভাই কোথায় রে?”

“জানি না। ছাঁদে তো দেখতে পাচ্ছি না।নিচে আছে হয়তো।”

“ডেকে আন একটু।বলবি, আমি ডাকছি।”

তন্ময় ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে নিচে নেমে গেল।

মিশকাত রাগ করে বসে আছে ঘরে।তার দেয়া ফুল তনু চুলে গুঁজে দেয় নি।ইচ্ছে হচ্ছে তনুর দুগালে দুটো থাপ্পড় দিতে।এত ভাব কেন মেয়েটার?মিশকাতকে কষ্ট না দিলে কি পেটের ভাত হজম হয় না?কি এমন হতো ফুল দুটো চুলে গুঁজলে।এমন নয় যে মিশকাতের ফুল চুলে দিলে সব চুল খসে পরবে! যেই না চুলের শ্রী তার আবার কত বাহার।সারাক্ষণ তো একটা গরুর লেজের মতো বেনুনি করে ঝুলিয়ে বেড়ায়।মিশকাত রাগে গজগজ করছে।

তন্ময় এ ঘর ঐ ঘর খুঁজেতে খুঁজতে পেয়ে গেল মিশকাতকে।দৌড়ে এসে বলল,

“ভাইয়া তোমায় তনুপি ডাকছে!”

“কে ডাকছে?”

“তনুপি!”

মিশকাত ভ্রু কুঁচকে তাকালো।মহারানী আবার তাকে ডাকছে কেন?সে কোনো উজির নাজির নয় যে পেয়াদা পাঠিয়ে ডাকা হচ্ছে। নিজে আসতে পারতো না!সবকিছুতেই এই মেয়েটার নকড়া!ভাব খানা এমন সে।তার নাম শুনলেই আমি ছুটে গিয়ে পায়ে পরে বলল,মহারানী আদেশ করুন!
যত্তসব,চড়িয়ে সোজা করতে পারলে মনটা শান্ত হতো।

“কেন ডাকছে?”

“জানি না।আমায় শুধু বলল তোমায় ডেকে আনতে।”

“তুই গিয়ে বলে দে,আমি এখন আসতে পারব না।”

তন্ময় ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল।বলল,

“সেকি! আমরা তো একটু পর ফানুস ওড়াব।তুমি আসবে না বলছ কেন?”

মিশকাত দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল,

” আচ্ছা, চল।”

মিশকাতের ছাঁদে উঠেই মেজাজ প্রচন্ড খিঁচে গেল।সেদিনের কফি শপের ওই ছেলেটার সাথে দাঁড়িয়ে তনু হেসে হেসে গল্প করছে।সে গটগট করে হেঁটে তনুর সামনে দাঁড়াল।

“ডেকেছিস কেন?”গলার ঝাঁঝটুকু লুকোতে পারলো না।

তনু ভেবে পায় না মিশকাত ভাই এর রাগ সবসময় কি নাকের ডগায় থাকে?নাকি তনুর বেলাতেই এত রাগের বাহার!

“হ্যাঁ।”

আরাফকে দেখিয়ে বলল,” উনাকে চিনতে পেরেছ তো?সেদিন কফিশপে পরিচয় হয়েছিল।রাফাত ভাইয়ার কাজিন উনি।”

আরাফ একবার তীক্ষ্ণ চোখে তনুকে পরখ করলো।এরপর আরাফের সাথে হ্যান্ডশেক করলো।

তনু বলল,” উনি একটু আনকমফোর্ট ফিল করছেন।তুমি একটু ওনার সাথে গল্প করো তো।

তনু আর কিছু না বলেই দ্রুত কেঁটে পরলো।

আরাফ তনুর যাওয়ার পানে অসহায় হয়ে তাকিয়ে রইলো।

মিশকাতের খটকা লাগলো।তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আরাফের দিকে তাকালো।ভেবে আশ্চর্য হলো যে, শিক্ষিত একটা ছেলে কিনা এরকম একটা পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারে না!

এছাড়া রাফাতেরও ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয় না সে সারপ্রাইজ দিতে এসেছে আয়রাকে।ঠিক বাচ্চাকে জোর করে তেতো ঔষুধ খাওয়ালে বাচ্চা যেমন করে! মনে হচ্ছে তাকে জোর করে আয়রার পাশে বসিয়ে রাখা হয়েছে।তবে ধীরে ধীরে মিশকাতের কাছে সবটা পরিষ্কার হয়ে গেল।সেই সাথে রাগ উথলে উঠলো যেন।আরাফের কোনো কথার জবাব না দিয়ে সরে গেল।

আরাফ কিছুই বুঝলো মা।তনুর হঠাৎ চলে যাচ্ছে, মিশকাতও এভাবে ফট করে উঠে চলে গেল।এদের কর্মকান্ড কেমন অদ্ভুত!

মিশকাত তনুর কাছে গিয়ে হিসহিসিয়ে বলল,তোর নাগরের সাথে তুই রসিয়ে গল্প কর,আমাকে কেন পাঠিয়েছিস?খবরদার যদি এমন আলতু ফালতু বিষয়ে আমায় ডেকেছিস তো তোর হাত পা ভেঙে ফেলবো একদম।

মিশকাতের যাওয়ার পানে হতভম্ব তাকিয়ে থাকলো তনু।কি বলে গেল এসব?”নাগর” কথাটার মানে কি?ছি!মিশকাত ভাই আসলেই বেশি বাড়াবাড়ি করছে।কে নাগর আর কেনই বা এমন আচরণ করলো কিছুই বোধগম্য হলো না।মনটা শুধু বিক্ষুব্ধ হয়ে রইলো।

সারারাতের হইচই শেষে ভোরের দিকে সকলে গাদাগাদি করে শুয়ে ঘুমে কাত হয়ে পরে রইলো।তনু ওদের সাথে থাকলো সারাটা সময় মনমরা হয়েই ছিল।মিশকাত মাথা ব্যাথার অযুহাত ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে।অনেকে ডাকাডাকি করেও বের করতে পারেনি ঘর থেকে।বাধ্য হয়ে মিশকাতকে ছাড়াই আনন্দে মেতে উঠেছিল সবাই।

তনুর ঘুম হয়নি।সে সবার আগে উঠে পরেছে।বাড়ির সামনে ক্যাটারিং এর লোকজন কাজে ব্যস্ত।তনু রান্নাঘরে ঢুকে মা কে দেখতে পেল।আরও কয়েকজন মহিলাও আছে।সবাই তনুর দাদুর বাড়ির আত্মীয় স্বজন।তনু চা বানিয়ে নিয়ে ছাঁদে দিকে পা বাড়ালো।শায়লা বেগম বলে দিয়েছেন,একটু পর আয়রাকে ডেকে তুলে গোসলে পাঠাতে।এগারোটার মধ্যে পার্লারের মেয়ে গুলো চলে আসবে।

তনুর হাসি পায় মায়ের কথায়।আপার আজ বিয়ে তবুও আপাকে ছোট বাচ্চার মতো ঘুম থেকে ডেকে তুলে গোসল করার তাড়া দিতে হবে?
মা তার পুরোনো অভ্যাস এত সহজে ভুলতে পারবে না।হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে গেল।আজ আপা চলে যাবে।মা নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পাবে।আপাকে ছাড়া মা কখনো থাকে নি।কোথাও বেড়াতে গেলে আয়রা আপাকে একা ছাড়তেন না।মামা খালাদের বাসায় সে তন্ময় একা গিয়ে কিছু থেকে আসলেও আয়রা আপা তা কখনো করেনি?আচ্ছা, তার এত ভালো আপাটা কি এসব বাস্তবতার সাথে মানিয়ে নিতে পারবে?

তনু ছাঁদে উঠে থেমে গেল। মিশকাত এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে।ছেলেটা কি ঘুমোয় নি নাকি?এত সকালে এভাবে দাঁড়িয়ে আছে কেন?তনু দীর্ঘশ্বাস ফেললো।এভাবে মিশকাতকে দেখতে ভালো লাগে না, কষ্ট হয়।এসবের শেষ কোথায় সে জানে না তবে এবার সে মিশকাত ভাইকে সবটা জানাবে।মিশকাত ভাই জলন্ত আগুন নিয়ে খেলা শুরু করার আগেই থামানো উচিত।এভাবে আর চলতে পারে না।তনু ধীরে ধীরে নিচে নেমে গেল।আয়রা আপাকে ডাকতে গিয়ে দেখলো আয়রা ঘুম থেকে উঠে গেছে।কি মিষ্টি লাগছে দেখতে আপাকে!বিয়ের দিন সব মেয়েকেই বুঝি এত ভালো লাগে?

“আপা তুমি গোসলটা সেড়ে নাও।একটু পরেই হইচই পরে যাবে।”

“আচ্ছা।আমার না অনেক খিদে পেয়েছে তনু,আমি কিন্তু গোসল শেষ করেই খাবো?”
তুই মাকে বলিস।

তনু হেসে ফেললো এমন বাচ্চামো কথায়।বলল,

“তুমি বোধহয় একমাত্র বিয়ের কনে, যে ঘুম থেকে উঠেই খাবার চাইছে।আচ্ছা তুমি গোসল করে নেও আমি মাকে বলছি।দেখে যাবে তোমার গোসল শেষ হওয়ার আগেই মা খাবার নিয়ে হাজির হয়ে যাবে।”

তনু মাকে বলে নিজের ঘরে এলো।তার বিছানায় সব বোন গুলো এলোমেলো হয়ে ঘুমাচ্ছে। তনু খাতা কলম নিয়ে জানালার কাছটায় বসলো।কলমের খোঁচায় নিজের এতদিনের জমে থাকা কথা গুলো অনুভূতি, কষ্ট গুলো উগরে দিচ্ছে।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here