#ভুলবশত_প্রেম পর্ব ৭
#লেখনীতে:সারা মেহেক
৭
ইমাদ ভাইয়াকে কিছুক্ষণ মনমতো শখানেক কথা শুনিয়ে আদ্রিশ উনার পাশে এসে বসলেন। আপুর উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলেন,
” কেমন আছেন ভাবী?”
আপু মুচকি হেসে বললো,
” আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি?
” জ্বি, আমিও ভালো আছি। আপনি কিছু মনে করবেন না আবার। একটু রেস্ট নিচ্ছিলাম রুমে। কিন্তু ইমাদ আমার রেস্টের বারোটা বাজিয়ে ছাড়লো। ”
আমাদের মাঝে পুনরায় হাসির রোল পড়ে গেলো। আপু এবার জিজ্ঞেস করলো,
” এতো শীতে ওভাবে বসে ছিলেন যে?”
আদ্রিশ মৃদু হেসে জবাব দিলেন,
” রুম হিটার অন করে রেখেছিলাম। হালকা গরম গরম ফিল হওয়ায় গেঞ্জিটা খুলে রেখেছিলাম। কে জানতো, আমার এ গেঞ্জি খোলাটাই আমার ইজ্জত নিলামে তুলে দিবে। ”
ইমাদ ভাইয়া দুষ্টু হাসি দিয়ে বললেন,
” তুই দেখেছিস না যে আমি ফোনে কথা বলছিলাম? তাহলে গেঞ্জিটা তখন পরে নিলেই তো পারতি। ”
আদ্রিশ বিস্মিত চাহনিতে চেয়ে বললেন,
” আজব যুক্তি দিস কেন? তুই কথা বলছিস, তো বল। এখানে আমার গেঞ্জি পরার সাথে এই কথা বলার কি সম্পর্ক ছিলো!”
” ওসব তুই বুঝবি না৷ আচ্ছা, তুই যা তো রুম থেকে। তুই ওদের সাথে কথা বলতে দিচ্ছিস না আমাকে। ”
আদ্রিশ নাছোড়বান্দা হয়ে বললেন,
” আমি তো এখানেই থাকবো। তোর কথা বলতে সমস্যা হলে তুই অন্য রুমে যেতে পারিস। ”
ইমাদ ভাইয়া এবং আদ্রিশের এহেন অবস্থা দেখে আমরা মিটিমিটি হেসে চলছি। আপু দুজনের উদ্দেশ্যে বললেন,
” আচ্ছা, আজ রাখছি। অনেক কথা হয়েছে। পরে আবার কথা হবে।”
ভিডিও কলে দেখতে পেলাম, ইমাদ ভাইয়া আপুর এ কথায় বেশ মনঃক্ষুণ্ন হলেন। কিন্তু আর উপায় না পেয়ে মনে যেনো ভীষণ কষ্ট নিয়ে তিনি কল কেটে দিলেন। উনি যে রাতে আবারো আপুকে কল করবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ইমাদ ভাইয়া কল কাটতেই আমরা পাঁচজনে একে অপরের সাথে কিছুক্ষণ পূর্বে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি নিয়ে হাসাহাসি করতে লাগলাম।
.
আজ বাসার সবারই নানারকম ব্যস্ততায় সময় কেটেছে। কাল বিয়ে বলে আপুর জিনিসপত্রের গোছগাছ, ভেন্যু সাজানো নিয়ে ছোটখাট একটা গোলামালও বেঁধেছিলো। তবে খুব দ্রুতই তার সমাধান হয়ে গিয়েছিলো।
আমাদের বোনদের দিনের আজ পুরোটা সময় কেটেছে আপুকে ঘিরে। আপুর টুকটাক রূপচর্চা, টুকটাক জিনিসপত্রের গোছগাছ করা নিয়ে পুরো দিন চলে গিয়েছে।
গতকালের ঘটনার পর আমরা কেউই আনোয়ারা দাদির সামনে পড়িনি এবং উনিও আমাদের সামনে পড়েননি। তবে দূর্ভাগ্যবশত উনার সাথে একটু আধটু দেখা হলেও আমরা এমন ভাবে তাকে এড়িয়ে চলছি যেনো আমরা তাকে চিনি না। অবশ্য এ নিয়ে আনোয়ারা দাদি আপাতত কিছু বলেননি আমাদের। তবে সময় সুযোগ পেলে হয়তো কিছু নয়, বরং অনেক কিছুই বলে বসবেন তিনি।
মাগরিবের পর পরই দুজন মেহেদি আর্টিস্ট এলো আপুকে মেহেদি দিয়ে দিতে। এই দুজন মেহেদি আর্টিস্ট এর জোগাড় করেছেন স্বয়ং ইমাদ ভাইয়া। তার কথা, ‘আমি শহরের বেস্ট এবং নামীদামী মেহেদি আর্টিস্টকে আনবো। কিন্তু এর বিনিময়ে আমার বউকে বেস্ট এণ্ড বেস্ট মেহেদি দিয়ে দিতে হবে।’ ইমাদ ভাইয়ার কথামতোই হয়তো তিনি মানুষ পাঠিয়েছেন। কারন আপুকে মেহেদি দিতে আসা মেহেদি আর্টিস্টদের সাজপোশাক দেখে মনে হচ্ছে তারা কোনো সাধারণ পার্লারের কাজ করে না। বরং শহরের নামীদামী পার্লারের একটিতে কাজ করে।
মেহেদি আর্টিস্ট দুজনে আপুকে আপুর রুমেই মেহেদি দিয়ে দিচ্ছে। আপু বিছানায় বসে দু পাশে দু হাত ছাড়িয়ে মেহেদি দিয়ে নেওয়াচ্ছে। যেহেতু মেহেদি পর্ব শুরু হয়ে গিয়েছে সেহেতু আমরা কাজিনরাও মেহেদি নেওয়া শুরু করলাম। তবে এী পূর্বে বাসার ছোট বাহিনীর সদস্যগুলোকে মেহেদি দিয়ে দিলাম। পিচ্চিদের মেহেদি দেওয়া শেষ হতে হতে আপুর ফোনে ইমাদ ভাইয়ার ভিডিও কল এলো। আপুর ফোন আমার কাছে থাকায় আমি চট করে ইমাদ ভাইয়ার কল রিসিভ করে ঝলমলে গলায় বললাম,
” সারপ্রাইজ ইমাদ ভাইয়া। কলটা আপনার বউয়ের রিসিভ করার কথা থাকলেও দূর্ভাগ্যবশত আমি রিসিভ করলাম। ইশ, খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না?”
ইমাদ ভাইয়া আমার কথায় হেসে দিলেন। স্বাভাবিক সুরেই বললেন,
” আমি জেনেশুনেই ফোন দিয়েছি মিম। আমি জানি, এখন আমার বউটা ফোন রিসিভ করার মতো পরিস্থিতিতে নেই। কারণ সে এখন আমার জন্য সাজতে ব্যস্ত।”
ইমাদ ভাইয়ার এহেন কথায় মেহেদি আর্টিস্ট দুজনে মিটিমিটি হাসতে লাগলো। এদিকে আপু লজ্জায় নতমুখে বসে রইলো। উনার কথার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ এবার আভা আমার পাশ হতে বলে উঠলো,
” আপনি তো ভীষণ দুষ্টু কোয়ালিটির লোক ইমাদ ভাইয়া। আমার আপুকে তো আপনি লজ্জায় ফেলেই মেরে ফেলবেন। ”
আভার কথা শুনে ইমাদ ভাইয়া তৎক্ষনাৎ ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললেন,
” কই কই, দেখি তো আমার বউয়ের লজ্জায় রাঙানো মুখখানা।”
ইমাদ ভাইয়ার কথা শুনে আমি এবং আভা সশব্দে হেসে ফেললাম। এদিকে উনার কথাবার্তার ধরণ শুনে মেহেদি আর্টিস্ট দুজনে উঠে পড়ে বললেন,
” আমরা একটু পড়ে আসছি৷ আপনারা কথা বলুন।”
এই বলে তারা মেহেদি রেখে রুম হতে বের হয়ে গেলেন। তাদের পিছু পিছু আভাও রুমে ছেড়ে বের হয়ে গেলো। কারণ আম্মুর ডাক এসেছে তার জন্য। আভা বেরিয়ে গেলেই তৎক্ষনাৎ আমি ইমাদ ভাইয়াকে কপট রাগ দেখিয়ে বললাম,
” আপনার কথাবার্তা শুনে মেহেদি আর্টিস্ট দুজন উঠে চলে গেলো। ইশ, আপনার মতো দুষ্টু লোক এ পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই বোধহয়। ”
ইমাদ ভাইয়া যেনো এ কথা শুনে খুব গর্বিত হলেন। বললেন,
” আমি তো লিমিটে থাকি। আদ্রিশের দুষ্টুমির কথা শুনলে তুমি মনে হয় লজ্জায় কান চেপে ধরবে। ”
(লেখনীতে:সারা মেহেক)
ইমাদ ভাইয়ার কথা শেষ হতে না হতেই চট করে আদ্রিশ ক্যামেরার সামনে এলেন। আমাদের কিছু বুঝে উঠবার পূর্বেই উনি ইমাদ ভাইয়ার হাত হতে ফোনটি নিয়ে নিজের দিকে তাক করে বললেন,
” আমার এতো এতো তারিফ কার কাছে করিস?”
এই বলে আদ্রিশ ফোনের ক্যামেরা দিয়ে আমার দিকে তাকালেন। আদ্রিশের এ কাণ্ডে আমি বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। ফলে মুখ দিয়ে টু শব্দটুকুও বের হলো না। কিন্তু আদ্রিশ আমাকে দেখে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না। বরং কিয়ৎক্ষণের জন্য একধরনের অনির্ণেয় চাহনিতে চেয়ে রইলেন আমার দিকে। উনার এ চাহনিতে আমার মাঝে অদ্ভুত এক অনুভূতির উদ্রেক হলো। আমার দু হাত ক্ষণিকের জন্য যেনো হিমায়িত হয়ে গেলো। আমার এ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলো তখন যখন ইমাদ ভাইয়া আদ্রিশের কাছ হতে ফোন নিজের হাতে নিলেন। উনার এ উদ্যোগে আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। ইমাদ ভাইয়া ফোন হাতে নিয়ে আদ্রিশের উদ্দেশ্যে বললেন,
” হুদাই ফোন হাতে দাঁড়িয়ে ছিলি কেনো? আজব মানুষ তো তুই! মিম, তোমার আপুকে ফোন দাও।”
আমি এ মুহূর্তে আর মজা করার মতো পরিস্থিতিতে রইলাম না। ফলে কোনোরূপ কথাবার্তা না বাড়িয়ে আপুর দিকে ফোন তাক করলাম। ইমাদ ভাইয়া ও আপু বেশ কিছুক্ষণ যাবত কথা বললো। এদিকে ফোন লাউড স্পিকারে থাকার সত্ত্বেও উনাদের একটি কথাও আমার কান অব্দি এসে পৌঁছুলো না। শুধু শুনতে পেলাম কথার শব্দ আসছে। কিন্তু কি কথা হচ্ছে তা বোঝার সাধ্য রইলো না আমার। কারণ এ মুহূর্তে আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও আদ্রিশের সেই চাহনি নিয়ে এপার ওপার ভাবনা ভাবতে লাগলাম। যদিও এ ভাবনার কোনো কূলকিনারা এবং উপযুক্ত কারণ খুঁজে পেলাম না আমি। তবুও এ নিয়ে ভাবলাম। কারণ অতিরিক্ত চিন্তাশীল মেয়ে হওয়ার দরুন এ ছোট্ট ঘটনা নিয়ে না ভাবলে যেনো আমার নিজের দেওয়া এ নামের সার্থকতা হতো না। যেনো এ নামের সার্থকতা সিদ্ধির জন্যই আমি এ ভাবনায় ডুবে ছিলাম এতোক্ষণ যাবত।
.
রাতের খাবার খেয়ে এসে মাত্রই আপুর পাশে শুয়েছি। এমতাবস্থায় একদম বাজখাঁই আওয়াজে আমার ফোনটা বেজে উঠলো। আপু ঘুমিয়ে পড়ায় আমি তৎক্ষণাৎ ফোনটা হাতে নিয়ে সাউন্ড কমানোর বদলে ভুলবশত রিসিভ করে ফেললাম। যেহেতু ফোন রিসিভ করেই ফেলেছি সেহেতু ফোনটা কানের কাছে নিয়ে নিচু স্বরে ‘ হ্যালো ‘ বললাম। আমার কণ্ঠস্বর শোনামাত্রই ওপাশের লোকটি কোনোরূপ ভূমিকা ছাড়া বলে উঠলেন,
” মিসেস ইকবাল, আই এম সরি টু সে দিস, আমরা আপনার প্রপোজাল একসেপ্ট করতে পারছি না। ঐ ফর্মূলাটা আপনার কাছে দেওয়া সম্ভব নয় আমাদের পক্ষে। আপনার হাজবেন্ডকে ফোনে………”
কথার আগামাথা কিছু বুঝতে না পারায় রং নাম্বার বলে ওপাশের লোকটির দ্রুতগতি সম্পন্ন কথা শেষ হবার পূর্বেই আমি কলটি কেটে দিলাম। লোকটি দ্বিতীয় দফায় আর কল করলেন না। এদিকে কল কেটে আমি কিয়ৎক্ষণের জন্য অকারণেই তার কথাবার্তা বিচার বিশ্লেষণ করলাম। স্বভাবতই এতে কোনো ফল পেলাম না। তবে লোকটির কণ্ঠস্বর আমাকে খানিক ভাবালো।
লোকটির কণ্ঠস্বর শুনে আমি প্রথম দফায় ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। মনে হয়েছিলো, কণ্ঠস্বরটি খানিক পরিচিত। তবে মুহূর্তেই নিজের এ ভাবনাকে ছুঁড়ে ফেললাম আমি। কারণ ফোনে দুজন আলাদা মানুষের কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন খুব কমই আঁচ করতে পারি আমি। বিশেষ করে প্রায় পুরুষ মানুষের কণ্ঠস্বর অর্থাৎ এ পর্যন্ত যত জনের কণ্ঠস্বর আমি ফোনে শুনেছি তাদের কণ্ঠস্বর আমার কাছে অদ্ভুত এক কারণে কাছাকাছি মনে হয়েছে। এই যেমন আমার আব্বু এবং চাচুদের কণ্ঠস্বর চেহারা দেখা ব্যতিত হঠাৎ করে শুনলে আলাদা করতে পারি না আমি। কারণ তাদের কণ্ঠস্বরের উঠানামা অনেকটা কাছাকাছি ধরণের। তেমনই রং নাম্বার হতে কল করা ব্যক্তিটির কণ্ঠস্বরও কিয়ৎক্ষণের জন্য ইমাদ ভাইয়ার কণ্ঠের সাথে মিল সম্পন্ন মনে হয়েছিলো আমার কাছে। কিন্তু এ ভাবনাটি এসেছিলো ক্ষণিকের জন্য।
হঠাৎ পাশ হতে আপুর ঘুমুন্ত কণ্ঠস্বর শুনে আমার ভাবনায় নোঙর পড়লো। আপু আমাকে ঘুমুঘুমু কণ্ঠে বললো,
” এতো রাতে কার সাথে কথা বলিস? ঘুমিয়ে পর। কালকে সকাল সকাল উঠতে হবে তো। ”
আমি আর ভাবনার নোঙর না তুলে ফোনটি রেখে চুপচাপ শুয়ে পরলাম।
®সারা মেহেক(যাদের গল্পের পরবর্তী পর্ব পেতে সমস্যা হয় তারা কমেন্ট করে রাখবেন প্রতি পর্বে। এতে আমি লিংক কমেন্টে দেওয়ার পর আপনারা নোটিফিকেশন পেয়ে যাবেন)
#চলবে
গ্রুপ: সারা’র গল্পকুঞ্জ