অরোনী,তোমার জন্য~২
লিখা-Sidratul Muntaz
রাফাত সেই যে বের হয়েছিল, এখনও ঘরে ফেরেনি।আজ যে বাড়িতে চড় নিয়ে বড়সড় একটা হাঙ্গামা হবে তা বোঝাই যাচ্ছে। অরোনীর রুমের বাহিরে বের হতে কিঞ্চিৎ ভয় করছে। সে মোবাইল হাতে নিয়ে মাকে কলব্যাক করল। মায়ের ফোনেই তার ঘুম ভেঙেছে। এতোক্ষণ সে ঘুমিয়ে ছিল।
শারমিন ফোন রিসিভ করেই কড়া কণ্ঠে বললেন,” হ্যালো অরো, এসব কি শুনছি আমি?”
” কি শুনেছো আম্মু?”
” তুই নাকি রাফাতকে থাপ্পড় মেরেছিস? তোর কাছে সে একগ্লাস পানি চেয়েছিল বলে! এটা কেমন ব্যবহার অরো?”
অরোনী আশ্চর্য গলায় বলল,” তোমাকে এসব কে জানালো?”
” কে জানালো সেটা কোনো বিষয় না। তুই কি ভেবেছিস? তোর কান্ড-কীর্তি আমার কানে আসবে না? সবই জানি আমি। রোজ খবর পাই। কাজটা কিভাবে করলি আমার মেয়ে হয়ে?আগে তো তুই এমন ছিলি না। বিয়ে হওয়ার পর কি মাথা-টাথা খারাপ হয়ে গেছে? শ্বশুরবাড়িতে আমাদের মান-সম্মান ডোবাতে চাস? শাশুড়ীর মুখে মুখেও নাকি তর্ক করছিস ইদানীং? তোকে এই শিক্ষা দিয়েছিলাম আমরা?রাফাত প্রতিদিন আমার কাছে তোর নামে বিচার দিচ্ছে। আমি এতোদিন চুপ ছিলাম। কিন্তু আজ তো তুই লিমিট ক্রস করে ফেলেছিস একদম…”
অরোনী মায়ের ধমকের রেলগাড়ী থামিয়ে বলল,” এক মিনিট, কে তোমার কাছে বিচার দিচ্ছে আমার নামে? রাফাত?”
শারমিন চুপ হয়ে গেলেন। রাগের মাথায় বোকামি করে ফেলেছেন। রাফাতের নাম বলা নিষেধ ছিল। এখন তো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আবার ঝগড়া শুরু হবে। যদিও বিয়ের পর এখন পর্যন্ত রাফাত আর অরোনীর ঝগড়া কখনও থামেনি। ঝগড়ার কারণে বিশেষ রাতেও তারা আলাদা ছিল। শারমিনের ধারণা বিয়ের একমাস হয়ে যাওয়ার পরেও তারা আলাদাই আছে। তাদের প্রথম রাতের সেই ঝগড়া এখনও অব্যাহত আছে। ছেলে-মেয়ে দু’টোর মধ্যে মিল-মোহাব্বত কি কোনোদিন হবে না?
মায়ের চুপ করে যাওয়া দেখে অরোনী এবার শতভাগ নিশ্চিত হলো যে রাফাতই সবকিছু বলেছে। অবশ্য মা না বললেও অরোনী বুঝে ফেলতো। ওই খাটাশ ছাড়া এই কাজ আর কে করবে? কতবড় হিংসুক সে! নিজের পরিবারের কাছে তো অরোনীকে এক পয়সার মূল্য দেয় না। এখন অরোনীর পরিবারের কাছেও তাকে ছোট করার জন্য উঠে-পরে লেগেছে। এর একটা বিহিত করতেই হবে। মায়ের পাশাপাশি ছেলেকেও টাইড দিতে হবে। রাগে অরোনীর চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। শারমিন নরম কণ্ঠে বোঝানোর উদ্দেশ্যে বললেন,” তুই কাজগুলো ঠিক করছিস না। যত দ্রুত সম্ভব নিজেকে শুধরে নে। নাহলে নিজের তো বদনাম হবেই সাথে আমাদেরও বদনাম হবে।”
অরোনী এখন মাকে কি করে বোঝাবে যে সে রাফাতকে পানি চাওয়ার জন্য চড় মারেনি। মেরেছে মায়ের চামচামি করার জন্য। রাবেয়ার সমস্ত কথা রাফাত অন্ধের মতো বিশ্বাস করে। অরোনীর দিকটা একবার ভেবেও দেখে না। রাবেয়া যদি বলেন,” রাফাত, তোর বউ মরে গেছে বাবা। যা কবর দিয়ে আয়।”
নিঃসন্দেহে রাফাত সেটাই করবে। অরোনীকে জ্যান্ত অবস্থায় কবরে রেখে আসবে। অরোনী যদি বলে,” আমি তো বেঁচে আছি..” তখন রাফাত ধমক দিয়ে বলবে,” আমার মা কি তাহলে মিথ্যে বলেছে? আমার মাকে তুমি মিথ্যুক বানাতে চাও?”
অরোনী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। শারমিন উপদেশ দেওয়া থামালেন না। দীর্ঘ পঞ্চাশমিনিট ধরে তিনি অরোনীকে অনেক কিছু বোঝালেন। অরোনী শুধু কথাগুলো শুনে গেল। কিন্তু কিছুই মানবে না। সে শুধু একটা কথাই মানে, অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। এখানে যার অবস্থা যেমন তার ব্যবস্থাও সেরকম ভাবে করতে হবে। সবাই যদি অরোনীকে আপন করে নেয় তাহলে অরোনীও মিলে-মিশে থাকবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এখানে কেউ অরোনীকে আপন করে নেয়নি। বরং এমনভাবে বাড়ির সবাই একযোগ হয়ে সারাক্ষণ তার নামে ষড়যন্ত্র করতে থাকে যে মনে হয় অরোনী যেন তাদের চিরশত্রু। আর অরোনী তো কপাল করে বরও পেয়েছে মাশআল্লাহ। মায়ের কথায় উঠ-বস করা ছাড়া বিশেষ কিছু পারে না সে। জীবনে শুধু একবারই মায়ের আদেশ অমান্য করেছিল রাফাত। মায়ের কথা না মেনে অরোনীকে বিয়ে করে এনেছিল। সেই থেকেই রাবেয়ার ক্ষোভ অরোনীর প্রতি। তিনি মনে করেন অরোনী বুঝি রাফাতকে বশ করে ফেলেছে। কি রিডিকিউলাস!
অরোনী মায়ের ফোন রেখে রুম থেকে বের হলো। পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে করিডোরে। অরোনী আর রাফাতের বেডরুমটা দুইতলায়। বেডরুমের সাথে লাগোয়া ছাদ। সেই ছাদের সাথে স্টিলের সিঁড়ি দেওয়া। সেই সিঁড়ি দিয়ে সরাসরি বাগানে যাওয়া যায়। ঘরের ভেতর আরেকটা সিঁড়ি আছে। সেই সিঁড়ি দিয়ে যেতে হয় নিচতলায়। যেখানে সারাক্ষণ হাউকাউ লেগে থাকে। অরোনী সেই জায়গায় খুব কদাচিৎ যায়। বেশির ভাগ সময় সে নিজের রুমে থাকে। নতুবা শাশুড়ীর ঘ্যানঘ্যানানি শুনতে শুনতে অতিষ্ট হতে হয়।
অরোনী যা ভেবেছিল তাই। বাগানে পাটি, চাদর দিয়ে বিছানা পাতা আছে। ছোটরা এখানে বসে সন্ধ্যায় খেলাধুলা করে, গল্প-গুজব করে। আর রাফাত মাঝে মাঝে অরোনীর সাথে রাগ করে এখানে এসে ঘুমায়। অরোনী বুঝে না ড্রামা করে সবাইকে বোঝানোর কি দরকার যে তাদের ঝগড়া হয়েছে? এমনিও তো তারা একসঙ্গে থাকে না। রাফাত বিছানায় শুলে অরোনী সোফায় চলে যায়৷ ড্রয়িংরুম থেকে একটা সোফা এনে তাদের বেডরুমে রাখা হয়েছে। অরোনী যে ওই সোফায় ঘুমায় এই কথা কেউ জানে না। সবাই ভাবে সোফাটা আরাম করে বসে টিভি দেখার জন্য আনা হয়েছে।
অরোনী রাফাতের ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে রইল। দেখে মনে হচ্ছে কত নিষ্পাপ! জীবনের জটিল কোনো অংকই সে বোঝে না। তার মধ্যে শুধু সরলতা আর সরলতা! কেউ রাফাতের চেহারা দেখলে এমনটাই ভাববে। কেবল অরোনী জানে এই লোক কত বদমাশ, হিংসুটে আর অসভ্য! অরোনীর মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে থাপড়াতে থাপড়াতে রাফাতের গাল চিরজীবনের জন্য লাল বানিয়ে দিতে। কখনও সে কল্পনা করে, রাফাতকে একটা পিলারের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। অরোনীর হাতে বক্সিং গ্লাভস। সে শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করে রাফাতের চেহারায় ঘুষি মেরে যাচ্ছে। ঢিসুম, ঢিসুম, ঢিসুম! রাফাতের নাক,ঠোঁট ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। অরোনী এসব দেখে হো হো করে হাসছে। আর বলছে,” বল, বল,মায়ের চামচা! আর করবি চামচামি? মায়ের কথা শুনে আমার উপর চিল্লাবি? আমাকে অপমান করবি?”
রাফাত জবাব দিতে পারে না। মাথা নেড়ে বোঝায়, না। সে কিছুই করবে না। উফ, কি উল্লাস! অরোনীর এই স্বপ্নটা কবে যে পূরণ হবে!
রুমে এসে দরজা বন্ধ করল অরোনী। আজ সে স্বাধীনভাবে বিছানায় ঘুমাতে পারবে। পুরো রুমটাই তার। ভাবতেই ভালো লাগছে। প্রতিদিন সোফায় ঘুমানোর কারণে সকালে উঠলেই অরোনীর ঘাড় ব্যথা করে। আজ সকালে উঠলে ঘাড় ব্যথা করবে না। অরোনী আরাম করে বিছানায় শুয়ে রইল। রাফাতের সাথে তার একটা গোপন চুক্তি আছে। যে চুক্তির কথা কেবল সে আর রাফাত ছাড়া পৃথিবীর অন্যকেউ জানে না!
অরোনী যেদিন বউ হয়ে এই বাড়িতে এসেছিল রাবেয়া সেদিনই রূঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন,” কি জাদু-মন্ত্রে আমার ছেলেটাকে বশ করেছো আল্লাহ মা’বুদ জানেন। তোমার জন্য এই প্রথম রাফাত আমার অবাধ্য হলো। সেজন্য তোমার প্রতি আমি অসন্তুষ্ট। সরাসরিই বলছি। আমি আবার সরাসরি সব বলে দেই। তোমার মাথায় আরও যত কুচিন্তা আছে সব ঝেড়ে ফেলো। এখানে থাকতে হলে আমার আদেশ মেনে থাকতে হবে। আর খবরদার, আমার বিরুদ্ধে আমার ছেলেকে কুমন্ত্রণা দেওয়ার চিন্তা মাথাতেও আনবে না। তাহলে এই বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে হবে। অবশ্যই তুমি একা বের হবে। আমার ছেলেকে নিয়ে নয়।”
নতুন বউ হয়ে শাশুড়ির মুখে এমন কথা শুনে অরোনী থতমত খেয়ে তাকিয়ে ছিল। সেই মুহূর্তেই বুঝতে পারে তার বিবাহিত জীবন খুব একটা সুখের হবে না। অরোনী যাকে মায়ের আসনে বসাতে চেয়েছিল সেই মা তাকে প্রথমদিনই শত্রু বানিয়ে ফেলেছেন। দিন দিন এই মহিলা তার জীবন অতিষ্ট করে তুলছেন। কিন্তু প্রথমে রাফাত ছিল অরোনীর প্রেমে দিওয়ানা। অরোনী বিষ খেতে বললে সে বিষ খাবে। সাগরে ঝাঁপ দিতে বললেও তাই করবে। এই সুযোগটাই কাজে লাগাতে চেয়েছিল বুদ্ধিমতী অরোনী। শাশুড়ীর সাথে এক বাড়িতে থাকার চেয়ে রাফাতকে নিয়ে আলাদা থাকাই তার ভালো মনে হলো। বাসর ঘরে বসে রাফাতকে যখন সে এই ব্যাপারে অনুরোধ করে তখন রাফাত সরাসরি বলে দেয়, মাকে সে যথেষ্ট কষ্ট দিয়েছে। আর কষ্ট দেওয়া সম্ভব না। অরোনী তখন শাশুড়ীর হুমকির কথা রাফাতকে জানায়। কিন্তু রাফাত বিশ্বাস করে না। কারণ রাবেয়া ছেলের সামনে অরোনীর সাথে খুব মধুর কণ্ঠে কথা বলেন। কিন্তু অরোনী ওই মহিলার সাথে ভালো করে কথা বলার রুচি পায় না। এভাবে রাফাতের সামনে রাবেয়া নিষ্পাপ সেজে থাকেন। আর অরোনী হয়ে যায় বেয়াদব, ঘাড়ত্যাড়া! তবে বিয়ের প্রথম রাতেই রাফাত বলেছিল, তার মা যা বলবেন তা মেনে নিতে হবে। এখানে কিছু করার নেই। মা এমনই। বাড়ির সবাই যেমন সহ্য করে, অরোনীকেও সহ্য করতে হবে। আস্তে আস্তে মায়ের মন জয় করতে হবে৷ অরোনী স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, সে কারো মন জয় করতে পারবে না৷ যে তাকে দেখতে পারে না তাকে তেল-চর্বি মেখে সেবা করার মেয়ে অরোনী নয়। সে কিছুই সহ্য করবে না। আর যতদিন রাফাত মায়ের চামচাগিরি বন্ধ না করবে ততদিন অরোনী রাফাতের কাছেও আসবে না। ছোঁয়াছুয়ি তো দূরের কথা! রাফাত ভেবেছিল অরোনী রাগের মাথায় এসব বলছে। দুইদিন পর ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুই ঠিক হয়নি। পরিস্থিতি আরও জটিল রূপ ধারণ করল। অরোনী বেডরুমে সোফা ঢুকিয়ে সেখানে ঘুমানো শুরু করল। একই বাড়িতে, একই রুমে, একই ছাদের তলায় থেকেও তারা আলাদা। তাদের এই দূরত্বের কথা কেউ জানে না। আর এই দূরত্বের প্রধান কারণ ইগো। রাফাত মনে করে তার জায়গায় সে সঠিক। অরোনী মনে করে সে নিজেই সঠিক। এভাবে কেউই কারো কাছে হার মানতে রাজি নয়। তবে রাফাত মাঝে মাঝে বলে, একদিন নাকি অরোনী নিজের ভুল স্বীকার করবে। তখন রাফাতের পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে কাঁদবে। রাফাত তাকে মাফ করে দিবে। অরোনী এই কথা শুনে প্রাণ খুলে হেসে বলেছিল,” ঠিকাছে। আমিও দেখার অপেক্ষায় আছি, কে কার পায়ে ধরে!”
আজ বাড়িতে অনেক আয়োজন। প্রচুর বাজার করা হয়েছে। অনেক রান্না-বান্না হবে। সকাল থেকে ব্যস্ত সবাই। অরোনী খবর পেয়েছে, আজ রুমাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। পাত্ররা নাকি অনেক উঁচু বংশ৷ তাদের কারি কারি টাকা। গোল্ডের ব্যবসা আছে। এলাহী অবস্থা! ছেলে দেখতেও সুদর্শন। রুমার ভালো লেগেছে৷ এবার এই পাত্র যদি রুমাকে পছন্দ করে ফেলে তাহলে আর কথাই নেই। সকাল থেকে সবার মুখে শুধু পাত্রের গল্প। উর্মি ছোট চাচার মেয়ে। ক্লাস সেভেনে পড়ে। অরোনীকে সে ভীষণ পছন্দ করে। আজ সকালে উর্মি অরোনীর কাছে চুল বাঁধতে এসেছিল৷ অরোনী খুব সুন্দর ফ্রেঞ্চ বেণী করতে পারে। উর্মির এটা পছন্দ। কথায় কথায় উর্মির থেকে পাত্র সংক্রান্ত সব খবর জানতে পারে অরোনী। কিছুটা অবাক হয় সে। বাড়িতে এতো কান্ড ঘটে যাচ্ছে অথচ কেউ তাকে কিছু জানালোই না! সকালে যখন সে ব্রেকফাস্ট খেতে নিচে গিয়েছিল তখন সবাই গুজুরগুজুর করে অনেক আলাপ করেছে। অরোনী এখন বুঝতে পারল যে সেগুলো ছিল পাত্র সংক্রান্ত আলোচনা। এই বাড়ির সবাই এমনি। অরোনীর সাথে কেউ সহজে কথা বলে না। অরোনী যদি নিজে থেকে তাদের সাথে কথা বলতে যায় তবেই তারা উত্তর দেয়। এমন একটা ভাব, যেন অরোনী বাহিরের মানুষ। তার সামনে বাড়ির যাবতীয় বিষয় নিয়ে আলাপ করাও নিষেধ। খুব অস্বস্তি লাগে অরোনীর। তাই সে সারাক্ষণ ঘরে বসে থাকে।
তবে আজ বিকেলে অন্যরকম কান্ড হলো। পুষ্পর মা অরোনীকে এসে জানালো, রাবেয়া তাকে রান্নাঘরে ডাকছেন। পুষ্পর মা এই বাড়িতে ছুটা বুয়ার কাজ করেন। শুধু সকালেই আসেন। কাজ শেষ করে দুপুরের মধ্যে চলে যান। কিন্তু আজ তাকে সারাদিনের জন্য রাখা হয়েছে। আজ বাড়িতে অনেক কাজ! অরোনী জানে তাকে কেন ডাকা হচ্ছে। প্রস্তুত হয়েই সে নিচে নামল।
রাবেয়া অরোনীকে দেখলে অযথাই সবার সাথে চেঁচামেচী করে কথা বলেন। প্রথমে অরোনী ভয় পেতো। কিন্তু এখন আর ভয় পায় না। পাত্তাও দেয় না। রাবেয়া গজরাতে লাগলেন,” বাড়িতে আজ কত কাজ! অথচ কেউ পটের বিবি সেজে সারাক্ষণ দুইতলায় বসে আছে। এতো কাজ, রান্না-বান্না কিভাবে হবে সেই চিন্তা কারো আছে? এতো সহজ না সংসার করা।”
অরোনী মিষ্টি হেসে বলল,” মা কি আমাকে মিন করে বলছেন? আসলে কি করবো বলুন? এই বাড়িতে তো আমার নিজেকে মেহমান মনে হয়। কেউ আমার সাথে পারিবারিক বিষয় নিয়ে আলোচনাই করে না। আজ যে রুমা আপুকে দেখতে আসবে সেটা জানতে পারলাম একটু আগে। তাও পুষ্পর মায়ের থেকে। এখন মনে হচ্ছে পুষ্পর মা ছাড়া এই বাড়িতে আমাকে বুঝি কেউ চেনেও না।”
রাবেয়া অরোনীর দিকে তাকালেন না। মেঝো জায়ের দিকে চেয়ে বললেন,” মুখে মুখে তর্ক না করে একটু কাজে হাত লাগাও। দেখছো না কত রান্না বাকি আছে? ওরা সাতটার মধ্যে চলে আসবে। অরোনী, তুমি আজ রুপচাঁদা মাছ ভুনা আর খাসির রেজালা করবে। মাছ কাটতে জানো তো? থাক বাদ দাও। পুষ্পর মা কেটে দিবে৷ তুমি খালি রান্নাটা সেরে আমাকে উদ্ধার করো।”
অরোনীর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। জীবনে সে মুরগীও রান্না করেনি। রাবেয়া এই কথা জানেন। তবুও ইচ্ছে করে অরোনীকে রান্নার দায়িত্ব দিচ্ছেন। অথচ বাড়িতে রান্না করার মানুষের অভাব নেই। এখন যদি অরোনী নিষেধ করে তাহলে তাকে অপমানিত হতে হবে। আবার নিষেধ করতে না পারলে রান্না করে দেখাতে হবে। অরোনী কি করবে? রাবেয়া শীলা চাচীকে তাড়া দিলেন,” তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন? আমার সাথে চলো। অনেক কাজ আছে।” শীলা অরোনীকে পছন্দ করেন। তাই অরোনীর সমস্যাটা বুঝতে পারলেন হয়তো। নরম কণ্ঠে বললেন,” ও এতো রান্না কিভাবে করবে রাবু আপা? বাচ্চা একটা মেয়ে! ও কি এর আগে রান্না-বান্না করেছে? আমি বরং ওকে সাহায্য করার জন্য এইখানে থাকি।”
” কোনো প্রয়োজন নেই৷ এইটুকু না পারলে আর কি পারবে সে? আর তুমি ওকে সাহায্য করবে কিভাবে? তোমার আলাদা কাজ আছে না? অরোনী একাই পারবে। কি অরোনী, পারবে না?”
অরোনী বুঝতে পারছে রাবেয়ার চালাকি। তার উদ্দেশ্য কেবল অরোনীকে শাস্তি দেওয়া। অরোনী মুখে মুখে সব কথার জবাব দেয় তো, তাই রাবেয়া তাকে সহ্য করতে পারেন না। সেই ক্ষোভ তিনি এইভাবে প্রকাশ করছেন। অরোনী মুখ ফুলিয়ে বলল,” পারবো। চেষ্টা করলে সব পারা যায় মা।”
” ঠিকাছে। দেখি কেমন পারো।”
পুষ্পর মা অরোনীর দিকে শিল-নোড়া এগিয়ে দিলেন। মশলা বাটতে হবে। অরোনী অবাক হয়ে বলল,” ব্লেন্ডার নেই?”
রাবেয়া রান্নাঘর থেকে বের হতে হতে জবাব দিলেন,” ব্লেন্ডার দিয়ে মেহেন্দী বাটা হচ্ছে। এখন ওইটা দিয়ে আবার মশলা বাটতে গেলে মেহেন্দীর গন্ধ আসবে না? শিল-নোড়া দিয়েই কাজ চালিয়ে নাও।”
অরোনী অসহায় মুখে বলল,” পুষ্পর মা, আপনি মশলাগুলো একটু বেটে দিবেন আমাকে?”
রাবেয়া শয়তানি হাসি দিয়ে বললেন,” পুষ্পর মা, এদিকে আসো। তোমার এখানে জরুরী কাজ আছে। অরোনী তুমি দ্রুত মশলা বেটে রান্না শুরু করে দাও। আমি এসে যেন দেখি মশলা বাটা হয়ে গেছে।”
পুষ্পর মাকে নিয়ে রান্নাঘর থেকে চলে গেলেন রাবেয়া। অরোনী নিঃসঙ্গের মতো দাঁড়িয়ে রইল। সে কিভাবে মশলা বাটবে? নোড়াটাই তো হাতে তুলতে পারছে না! খুব কষ্ট হচ্ছে!
দজ্জাল মহিলা অরোনীর সাথে এমন করলেন তো! ঠিকাছে, অরোনী আজ এমন রান্নাই করবে যে পাত্রপক্ষ কেবল খাবারের চেহারা দেখেই হাত ধুঁয়ে পালাবে। অরোনী গায়ের ওরনাটা ভালোমতো কোমড়ে বেঁধে নিল। সে জন্মের রান্না করবে আজ।
চলবে