তোমাকেপর্ব 7.2

0
255

তোমাকেপর্ব 7.2

ওদের বাসটা যখন ডিপার্টমেন্টের সামনে এসে পৌঁছল তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে I চারিদিকে নিয়নের আলো জ্বলে উঠেছে I ছাত্র ছাত্রী শিক্ষক সবাই খুব ক্লান্ত বিধ্বস্ত ক্ষুধার্ত I অনিমা বাস থেকে নেমে গাড়ির জন্য ফোন দিল I জানা গেল গাড়ি হাসান সাহেবের সঙ্গে আছে তাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে অনিমা কে নিতে আসবে I অনিমা অপেক্ষা করতে লাগলো I বাকিরাও সবাই যে যার মত বাড়ি ফেরায় ব্যস্ত হয়ে গেল I নীলা অবশ্য একবার জানতে চাইল অনিমা ওর সঙ্গে যেতে চায় কিনা অনিমা জানালো ওর গাড়ি আসছে I নীলা সহ অন্যান্যরা বিদায় নিয়ে চলে গেল I অনিমা বাড়ির ল্যান্ড ফোনে ফোন দিয়ে মিঠু খালাকে খাবার তৈরি করে রাখতে বলল I

মনির তাড়াহুড়া করে সব কাজ গোছাচ্ছে I হলে পৌঁছে লাগেজ রেখে ওকে আবার বেরোতে হবে I কাল ওর স্টুডেন্ট এর পরীক্ষা I আজকে একবার না গেলেই নয় I

অনিমা দূর থেকে দেখলো সব ভলান্টিয়াররা বাস থেকে জিনিস পত্র নামাতে ব্যস্ত I সব নামানো হয়ে গেলে বাসটা ও চলে গেল I ভলান্টিয়াররা সব জিনিসপত্র গুছিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে I অনিমা ই শুধু একা একা দাড়িয়ে রইল I

হাসিব আর মনির হলে যাওয়ার জন্য রিকশা নিতে যাবে তখন লক্ষ করল অনিমা একা একা দাঁড়িয়ে আছে I হাসিব বলল

তোমার গাড়ি এখনো আসেনি অনিমা ?

না , বুঝতে পারছি না এত দেরি কেন হচ্ছে

একটা ফোন করে দেখো

অনিমা ফোন করলো I জানা গেল গাড়ি মহাখালীতে জ্যামে পড়েছে আসতে ঘন্টাখানেক লাগবে I হাসান সাহেব অনিমাকে বাড়ি চলে যেতে বললেন I হাসিব বলল

মনির তোর স্টুডেন্টের বাসা তো ওদিকেই তুই অনিমা কে নামিয়ে দিয়ে চলে যা I আমি তোর লাগেজ নিয়ে হলে যাচ্ছি I

আচ্ছা , চলো অনিমা

অনিমা লক্ষ্য করেছে কাল থেকে মুনির খুব আনমনা হয়ে আছে I কথা ও বলছে না বেশি I সারাদিন খাইওনি কিছু I বাসে যখন খাবার দিতে এসেছিল অনিমা একবার জিজ্ঞেস করল

তুমি সবাইকে খাবার দিচ্ছে নিজে খাচ্ছ না

আমি আসলে জার্নিতে খেতে পারিনা I হলে গিয়ে একবারে খাব

অনিমা আর কথা বাড়ায়নি I তবে ওর নিজেরও খাবার ইচ্ছেটা চলে গিয়েছিলো

তোমার কি হয়েছে মনির ? তুমি কি কোন কারনে আপসেট ?

রিকশা চলতে শুরু হলে অনিমা জানতে চাই

কিছু হয়নি এমনি একটু টায়ার্ড লাগছে

আমি কি তোমাকে ঝামেলায় ফেলে দিলাম?

কিসের ঝামেলা ? আমি তো এমনিতেও ওইদিকে যাচ্ছিলাম

অনিমা আর কিছু বলল না I বাকিটা পথ দুজন চুপচাপ বসে রইল I

মনির যখন অনিমাকে বাসায় নামিয়ে দিল অনিমা কিছুতেই ওকে ছাড়লো না I বলল উপরে গিয়ে একটু কিছু খেয়ে যেতে I মনির কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না I অনিমা বলল

তুমি না আসলে আমি উপরে যাব না এখানেই রাস্তায় বসে থাকবো

মনির হেসে ফেললো I বলল আচ্ছা চলো

অনিমা দের বাসায় ঢুকে মনির একটা বড়সড় ধাক্কা খেলো I অনিমাকের দেখে বোঝা যায় না ওদের আর্থিক অবস্থা এমন I অনিমা খুব সাধারণভাবে থাকে I ওর মধ্যে কোন অহংকার নেই I সবার সঙ্গে খুব সহজ ভাবে মিশে I মনির অনিমার বাবার নাম ও জানতো না I নেমপ্লেট দেখে বুঝতে পারল I অনিমার বাবা একজন বিশিষ্ট শিল্পপতি I

অনিমাদের বাসাটা একটা বহুতল ভবনের টপ ফ্লোরে I দুটো ফ্লোর নিয়ে করা I নিচতলায় বিশাল হল লিভিং ডাইনিং লাগোয়া বিশাল বারান্দা I প্যাচানো সিড়ি দিয়ে উপরে উঠলে লম্বা বারান্দা আর সারি সারি শোবার ঘর I

অনিমা মনিরকে ফ্রেশ হতে বলে তাড়াতাড়ি উপরে গিয়ে চেঞ্জ করে নিল I হাত মুখ ধুয়ে নিল চট করে I পাছে মনির চলে যায় তাই দেরি না করে নিচে চলে এল তাড়াতাড়ি I টেবিলে খাবার পরিবেশন করাই ছিল I পরোটা ,সবজি, গরুর মাংস ভুনা ,বুটের ডাল আর ডিম ভাজি I অনেকদিন পর মনির খুব তৃপ্তি করে খেলো I খাওয়া শেষ হলে অনিমা বলল

কফি দিতে বলি ?

না আজকে আর সময় হবে না I আমাকে এখনই বের হতে হবে তা নাহলে হলে ফিরতে দেরি হয়ে যাবে

অনিমা মনিরকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিল I গেটের কাছাকাছি এসে অনিমা ডাকলো

মনির

কি বলো
না কিছুনা সাবধানে যেও

মনির কিছু বলল না একটু হাসলো

অনিমার মনে হল এর চেয়ে একটু কম সুন্দর করে হাসলে ও চলত I এখন আর সারা রাত ঘুম আসবে না I

পর্ব 7.1

এদেশে গ্রীষ্মের দিনগুলো বেশ দীর্ঘ I সন্ধ্যা হতে হতে প্রায় নটা বেজে যায় I অনিমা সাধারণত রাতের খাবার খায় সাড়ে সাতটায় I আজও তার ব্যতিক্রম নয়I সেজুতিকে ড্রয়িং ক্লাস থেকে এনে অনিমা রাতের খাবারের প্রস্তুতি নিচ্ছিল I আশিক বেঁচে থাকতেও এ সময় কখনো বাসায় থাকত না I রাতের খাবারটা অনিমা আর সেঁজুতি খায় একসঙ্গে I অনিমার হঠাৎ করে মনে হল মনির তো জার্নিতে খেতে পারে না I আসার পর থেকে বাইরে ও যেতে দেখেনি ওকেI তারমানে এতটা সময় না খেয়ে আছে I অনিমার খুব খারাপ লাগলো I ভদ্রতা করে হলেও খেতে বলা উচিত I অনিমা মনিরের আগের ফোন নাম্বারে ফোন দিল I নট রিচেবল দেখাচ্ছে I হয়তো ওই নাম্বারটা আর নেই I বেসমেন্টে একটা ইন্টার কম আছে I আশিক লাগিয়েছিল I পার্টির সময় কিছু দরকার হলে ফোন করে জানিয়ে দিত I অনিমা একটু অস্বস্তি নিয়ে ফোনটা করেই ফেললI

হ্যালো মনির

হ্যাঁ অনিমা বল

তুমি কি ঘুমাচ্ছিলে?

না আজকে মনে হয় আর ঘুম আসবে না

খেয়েছো কিছু ?

এখনো খাইনি I কি খাব ভাবছিলাম

তুমি চাইলে আমাদের সঙ্গে ডিনার করতে পারো

তোমাদের সমস্যা হবে না তো

সমস্যা কি, তোমার জন্য তো আলাদা করে কিছু করছি না I তবে আগেই বলে রাখছি আমরা কিন্তু একেবারেই দেশি খাবার খাই I তোমার সমস্যা হবে না তো?

আমিতো দেশ থেকে এলাম I
তাহলে চলে এসো I

অনিমা ভেবেছিল মনির হয়তো আসতে চাইবে না I কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে মনির সত্যি সত্যি চলে এলো I

অনিমা সেজুতির সঙ্গে মনিরের পরিচয় করিয়ে দিতে নিলে আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলো মনির সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ সেঁজুতি সঙ্গে কথা বলছে I ওরা নিজেদের মতই পরিচয়পর্ব সেরে নিল I

অনিমা হতভম্ব হয়ে গেল I জিজ্ঞেস করল

তুমি সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ জানো?

হ্যাঁ জানি তোI I সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ এমন কোন রকেট সাইন্স নয় I ইংরেজি খবর এর সময় ইনসেটে দেখবে I একটু চেষ্টা করলেই শিখে ফেলা যায় I

আমার কিন্তু অনেক সময় লেগেছিল

তুমি একটা স্ট্রেস এর মধ্যে ছিলে I শিখতে না পারলে মেয়ের সঙ্গে কমিউনিকেট করতে পারবে না I তাই হয়তো তোমার কাছে কঠিন মনে হয়েছে I আনন্দ নিয়ে শিখলে দেখতে কোন ব্যাপার না I

অনিমা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো ওরা সঙ্গে কথা বলার সময় ও মনির সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করছে যাতে করে সেঁজুতি ও আলোচনার মধ্যে থাকতে পারে I মনির বলেই যাচ্ছে

সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ তো একটা ভাষা তাই না ? আমি যেমন আর সাতটা ভাষা শিখেছি তেমনি এটাও শিখলাম I

সেঁজুতি সাধারণত খাওয়ার সময় কথা বলে না I অনিমাকে অবাক করে দিয়ে আজকে বলল

ওয়াও আঙ্কেল তুমি সাতটা ভাষা জানো

তা জানি I নতুন ভাষা শেখা টা আমার একটা হবি

তুমি কটা ভাষা জানো সেঁজুতি?

তিনটা বাংলা ইংরেজি আর ফ্রেঞ্চ

এক্সেলেন্ট তুমি ফ্রেঞ্চ জানো I যাক ভাল হলো তোমার কাছ থেকে আমি ফ্রেঞ্চটা শিখে ফেলতে পারব

তুমি কি জার্মান ও জান আঙ্কেল ?

না জার্মান জানিনা তবে জাপানিস জানি I আমি জাপানে ছিলাম এক বছর

ওয়াও that’s ওয়ান্ডারফুল

তোমাদের ভাষা বিষয়ক আলোচনা শেষ হলে এবার খাওয়া শুরু করি ?

ওরা দুজনই হেসে ফেললো I অনিমা কখনো সেজুতিকে এত স্বতঃস্ফূর্তভাবে কার সঙ্গে গল্প করতে দেখেনি I মজার ব্যাপার হচ্ছে মুনির সেঁজুতির সঙ্গে গল্প করছে একেবারে সমবয়সীদের মত I এদেশে ছেলেমেয়েরাও এটা বেশ পছন্দ করে I

খাবারের আয়োজন দেখে মনির অবাক হয়ে গেল I ভাত ,বেগুন ভর্তা , পালং শাক আর রুই মাছের ঝোল I এ দেশে এসেও এরকম খাবার খেতে পারবে মনির ভাবতে পারেনি I যেখানে দেশে এখন অনেকেই স্যান্ডউইচ পিজ্জা দিয়ে ডিনার করে I মনির খুব তৃপ্তি করে খেলো I অনিমার রান্না বেশ ভালো I নিশ্চয়ই খুব কষ্ট করে হাত পুড়িয়ে শিখেছে একা একা I

খাওয়া শেষে সেঁজুতি শুভরাত্রি বলে উপরে চলে গেল I অনিমা টেবিল গোছাতে গোছাতে বলল

কফি খাবে ?

খাওয়া যায়

খাবার টেবিলের একপাশে সোফা I মনির সোফায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে অনিমা কে লক্ষ্য করতে লাগলো I অনিমা একটা লেবু হলুদ রঙের কামিজ পরেছে সঙ্গে সাদা ঢোলা পাজামা I লেবু হলুদ রঙের ফুলকারি ওড়না I আচল তুলে দিয়েছে মাথায় I ওকে কেমন বউ বউ লাগছে I অনিমা কফির জল চাপিয়ে টেবিল পরিষ্কার করল , এঁটো বাসন ধুয়ে রাখল I কফি বানানো হলে একটা মগ মনিরের হাতে দিয়ে বলল

বাগানে যাবে আমি সাধারণত এসময় বাগানে বসে কফি খাই

চলো যাই

খাবার ঘরের পরেই একটা বারান্দা I সিঁড়ি নেমে গেছে উঠান পর্যন্ত I ওরা নিচে নেমে সিঁড়ির শেষ ধাপে বসলো I এখন গ্রীষ্মকাল তাই সাড়ে আটটার সময় ভালোই আলো চারদিকে I মনির লক্ষ করল অনিমার মাথা থেকে ওড়না পড়ে গেছে I অনিমা সিঁড়ির ধাপে কফির মগ রেখে আবার মাথায় আচল তুলে দিল I মনিরের একটু মন খারাপ হলো I অনিমা ওর থেকে অনেক দূরত্ব রাখছে I যেন মনির এখন অনেক দূরের কেউ I আগে তো এমন ছিলনা I আগেও তো ওরা শুধু বন্ধুই ছিল কিন্তু তখন তো এত দূরত্ব ছিল না I মনির অনিমার হাতের দিকে তাকালো I কতবার এই হাত ধরেছে মনির I মনে আছে একবার অনিমা ওর কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল I কিরকম স্বপ্নের মতো ছিল সেই দিনগুলো I অনিমা কি আর কখনো ওর এত কাছে আসবে না ?

চলবে
লেখনীতে
#অনিমা হাসান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here