একটি রূপকথার গল্প’ পর্ব-১৪

0
321

#একটি_রূপকথার_গল্প’১৪’
#জেরিন_আক্তার_নিপা
(রিচেক দেওয়া হয়নি। বানান ভুল ক্ষমা করবেন।)

আরমান অবাক নয়নে মেয়েটাকে দেখছে। না অথৈ সহজ ভাবেই কথাগুলো বলছে। মায়ের মৃত্যু বাবার দ্বিতীয় বিয়ের গল্প বলতে গিয়ে চেহারার ভাবের কোন পরিবর্তন হচ্ছে না। বরং নিজে নিজেই হাসছে। আরমান এতদিন ভাবত, দুনিয়ায় তার মা বাবা ভাই বোন আপনজন কেউ নেই। সে-ই হয়তো এরকম একজন মানুষ যে এক আকাশ সমান দুঃখ বুকে নিয়ে পৃথিবীর মানুষের সামনে নিজেকে কতই না সুখী প্রমাণ করে। কিন্তু অথৈ তো নিজের ভেতর তার থেকেও বড় গল্প লুকিয়ে রেখেছে।

~ চার বছর বয়সী একটা মেয়ে আছে শুনেও নতুন মায়ের বাবা মা তাকে এমন একটা লোকের সাথে বিয়ে দিতে রাজি হলেন। কারণ ছোট মা’র মা হওয়ার ক্ষমতা ছিল না। এটা জেনে কেউ তাকে বিয়ে করতে চায়নি। এটুকু শুনে কি আপনার মনে হচ্ছে না আমার ফুপি ভীষণ বুদ্ধিমতী একজন মহিলা। তিনি খুঁজে খুঁজে এমন একজনকে বের করেছেন যাকে আমার মা হয়েই সারাজীবন কাটিয়ে দিতে হবে। নিজের সন্তান পেয়ে আমাকে অবহেলা করার কোন অবকাশ থাকবে না। এতে অবশ্য ফুপির কোন স্বার্থ নেই। ফুপি যা করেছে সব আমার জন্যই করেছে। নতুন মা’কে পেয়ে আমি যেমন খুশি ছিলাম, তেমনি আমাকে পেয়ে নতুন মা-ও তেমন খুশি ছিলেন। খুব অল্প সময়ে তিনি আমার নতুন মা থেকে শুধু মা হয়ে উঠলেন। তার কোন আচরণেই আমাকে এমনটা ভাবার সুযোগ দেয়নি যে, আমার নিজের মা হলে এটা করত না। আমি দেখতে পুরোটাই আমার আসল মায়ের মত হয়েছি। আমার মায়ের ছবি দেখলে মিলাতে পারবেন। শুধু চোখ দু’টো বাদে মুখের পুরো আদলই মায়ের মত। আমি বড় হওয়ার পর এটাও আবিষ্কার হলো মায়ের আঁকাআকির গুণটাও আমার মাঝে আছে। তাই মেয়ের এই গুণে ছোট মা খুশি হতে পারেন নি। তিনি সবসময় চাইতেন আমি যেন উনার মেয়ে হয়ে থাকি। কিন্তু আমার কোনোকিছুই উনার সাথে মিলত না৷ এটা নিয়ে মনে মনে উনি দুঃখ পেলেও আমাকে কখনও বুঝতে দিতে চাইত না। কিন্তু বাবার ভালো ছাত্র, আপনি তো জানেনই আমি কতটা বুদ্ধিমতী। যে মানুষটা আমাকে খুশি করতে জীবনটা উৎসর্গ করে দিলেন তার খুশির জন্য আমি আঁকাআঁকি ছেড়ে দিলাম। এবং মনে প্রাণে উনার মেয়ে হওয়ার চেষ্টা করতে লাগলাম। মা যে জিনিস গুলো অপছন্দ করত তার ধারের কাছ দিয়েও গেলাম না। আমার জীবনের সব সিদ্ধান্ত মায়ের হাতে ছেড়ে দিলাম।’

অথৈ থেমে দম নিচ্ছে। আরমানকে সে মন থেকে গ্রহণ করেছে। তাই তার জীবনের সবকিছু আরমানকে জানাতে চায়।

~ এক মা হারিয়ে আরেক মা পেয়েছি। আমার থেকে ভাগ্যবান আর কে হতে পারে ভাবুন তো। একটা সময় আমি নিজেকে ভীষণ ভাগ্যবতী ভাবতাম। কিন্তু আমি যতটা ভাবতাম আমার ভাগ্য ততটাও ভালো ছিল না৷ মাধ্যমিক পরীক্ষার দিন কয়েক আগে আল্লাহ আমার এই মাকেও নিজের কাছে ডেকে নেন। তিনি আমাকে আবারও এতিম বানিয়ে দেন। তখন থেকেই আমি মনে করি যে জিনিসটা আমার সবথেকে প্রিয় থাকে তা বেশিদিন আমার কাছে থাকে না। আমি যে জিনিসটাকে জীবনের অংশ বানিয়ে নিই সেটাই সবার আগে আমার থেকে দূরে চলে যায়। তাই আমার কোন প্রিয় জিনিস নেই।’

আরমান আর কিছু শুনতে চাচ্ছে না। সে অথৈর মন খারাপের গল্প শুনতে চায় না। অথৈকে নিয়ে মন ভালো করার স্মৃতি বানাতে চায়। অথৈর ঠোঁটে হাসি ফোটাতে চায়। আরমান অথৈর কাছাকাছি ঘেঁষে এসে ওর হাতটা নিজের হাতে নিয়ে নিল। এই প্রথম অথৈর হাত ধরেছে সে। অথৈ হাত সরিয়ে নিল না। কিছু বললোও না।

~ অথৈ…

~ বাবা ফুপি মনে করে আমার নিজস্ব কোন পছন্দ নেই। আমি নিজের পছন্দে একজোড়া জুতোও কিনতে পারি না। আসলে আমি নিজের পছন্দ প্রকাশ করতে ভয় পাই। ভয় হয় যদি ওই জিনিসটাও আমার থেকে দূরে সরে যায়। বাবা আমার ভীষণ প্রিয়। বাবাকে এই কথা কোনদিন বুঝতে দেইনি। ফুপিও আমার ভীষণ প্রিয়। কিন্তু ফুপিকে এই কথা কোনদিন বলতে পারিনি। ফুপা যেন কীভাবে বুঝে গেছে আমি ফুপাকে কতটা পছন্দ করি। ফুপার অনেক বুদ্ধি। আপনি জানেন ফুপা উনার সব গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী আরও নানান প্রতিষ্ঠান আমার নামে রেখেছে। ফুপার জন্য আমার কষ্ট হয়। মানুষটা কোনদিন বাবা ডাক শুনতে পেল না। এত স্নেহ মমতা উজাড় কারো উপর ঢালতে পারল না।’

~ তুমি আছো তো অথৈ। একা সবার অভাব পূরণ করছো। তোমাকে পেয়ে ওদের আর কাউকে লাগবে না।
……
আশরাফ হোসেন ক্লাস শেষ করে বেরিয়েছেন এমন সময় মারজিয়ার কল আসে। তিনি অফিসের দিকে হাঁটতে হাঁটতে কল রিসিভ করলেন।

~ হ্যাঁ বুবু বলো।’

~ কই তুই বাবু?’

~ এই সময়ে আমার যেখানে থাকার কথা।’

~ আরমান তো ফিরেছে। এবার ওদের বিয়েটা হয়ে গেলেই তো ভালো হয়। এই বিয়েতে এত বাধা পড়ছে কেন কে জানে? এক বছর ধরে বিয়ে হবে হবে করেও হচ্ছে না। এবার কাজি ডেকে আগে শুভ কাজ শেষ কর তো। তারপর অনুষ্ঠান ফনুষ্ঠান করা যাবে।’

~ হুম।’

~ হুম না। আমি আজ বাড়ি আসছি। রাতেই সব ঠিকঠাক করে ফেলব।’

মারজিয়া কল কেটে দিলে আশরাফ হোসেন অন্যমনস্ক হয়ে কিছু ভাবতে লাগলেন। আরমানকে অথৈর জন্য তিনিই পছন্দ করেছিলেন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তিনি ভুল করেছেন। নিঃসন্দেহে আরমান ছেলে হিসেবে ফার্স্টক্লাস। আরমানকে নিয়ে কোন অভিযোগ নেই তার। সমস্যাটা তার মেয়েকে নিয়ে। আরমানের যে পেশা তাতে ওকে বছরের অর্ধেকটা সময় বাইরে থাকতেই হবে। সে চাইলেও সবটা সময় অথৈর পাশে থাকতে পারবে না। অথৈ এটা বুঝে। তবুও আরমান চলে গেলে মেয়েটা কেমন মনমরা হয়ে যায়। স্বাভাবিক জীবন থেকে সরে যায়। আরমানের সাথে বিয়ে হলে অথৈর জীবনটা এভাবেই কাটবে। প্রিয় মানুষের অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকতে হবে। সেই অপেক্ষার প্রহরও কতটা দীর্ঘ হবে তা তিনি জানেন না। সমুদ্র সবসময় শান্ত থাকে না। মাঝে মাঝেই জাহাজ ঝড়ের কবলে পড়ে। সেই সময়টা অথৈ বাড়িতে কীভাবে পার করবে? অথৈ বাইরে থেকে নিজেকে যতটা কঠিন দেখাক কিন্তু ওর বুকের ভেতরে যে একটা কোমল মন আছে তা সামান্য বিষয়েই কষ্ট পেয়ে ফেলে তা তো বাবা হয়ে আশরাফ হোসেন জানেন।
…..
রাত হবার অপেক্ষা করতে পারলেন না তিনি। রাত হতে এখনও অনেক সময় বাকি আছে। মারজিয়া অথৈর বিয়ের ব্যাপারে ভাইয়ের সাথে কথা বলতে এসেছেন। গতবার অথৈর অসুস্থতার জন্য ঠিক হওয়া বিয়েটাও হলো না। এবার আর পাঁচ ছয় দিনের আয়োজন করে বিয়ে হওয়ার দরকার নেই। কাজি ডেকে সাধারণ ভাবে বিয়ে পড়িয়ে দিলেই হবে। মারজিয়া এসে বসে আছেন কিন্তু তার ভাইয়ের কোন খবর নেই। বসে থেকে বিরক্ত হচ্ছেন তিনি।

~ ওই ঠ্যাঙা মাস্টারের আমার থেকে বেশি ব্যস্ততা নাকি? আমি আজকের সব অ্যাপয়েন্টমেন্ট বাতিল করে তার সাথে দেখা করতে এসেছি আর তিনি আমাকে ব্যস্ততা দেখাচ্ছেন!’

মারজিয়ার রাগ আরও এক স্তর বেড়ে যাওয়ার আগেই আশরাফ হোসেন বাড়ি ফিরলেন। উনাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। মারজিয়া ভাইকে কড়া করে ধমক দিতে গিয়েও দিলেন না। আশরাফ হোসেন বুবুকে দেখে এগিয়ে এসে বললেন,

~ কখন এসেছ বুবু?’

~ অনেকক্ষণ।’

~ তুমি তো বলেছিলে রাতে আসবে।’

~ এখন আসাতে কি পাপ হয়েছে? তোর আসতে এত দেরি হলো কেন?’

আশরাফ হোসেন বোনের পাশে এসে বসলেন। মারজিয়া বলল,

~ এখন আবার বসছিস কেন? এখানে না বসে ঘরে গিয়ে কাপড় ছাড়। ফ্রেশ হয়ে নিচে আয়। কথা আছে।’

~ এখনই বল। আমার ভীষণ ক্লান্ত লাগছে।’

ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মারজিয়ার মায়া হলো। আহারে তার ভাইটা কি বুড়ো হয়ে যাচ্ছে? দিনদিন এমন বয়স্ক দেখাচ্ছে কেন? নিজের শরীরের খেয়াল রাখে না। অথৈটা কী করে সারাদিন? বাবার দিকে একটু নজর দিতে পারে না।

~ অথৈ আর আরমানের বিয়েটা এবার সেরে ফেললেই…

~ বিয়ে হবে না বুবু।’

মারজিয়া কি কানে ভুল শুনলো? সে যা শুনেছে তার গাধা ভাইটা কি এই কথাটাই বলেছে! বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। প্রায় চেঁচিয়ে বললেন,

~ কী বললি তুই এটা! বিয়ে হবে না মানে কী?’

আশরাফ হোসেন বুঝতে পারছেন তার বোন রেগে যাচ্ছে। বুবুকে আরও না রাগিয়ে তিনি বললেন,

~ আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলব একসময়। কিন্তু এখন আমি বড্ড ক্লান্ত।’

~ চড়িয়ে দাঁত ফেলে দিব আমি তোর। বিয়ে হবে না মানে কী? তুই-ই তো আরমানকে অথৈর জন্য পছন্দ করেছিলি। অথৈ অসুস্থ না হলে এতদিনে বিয়েটা হয়েও যেত। এখন তুই বলছিস বিয়ে হবে না! ফালতু গিরি করার জায়গা পাস না আর। তুই কি জানিস না তোর মেয়েও আরমানকে পছন্দ করতে শুরু করে দিয়েছে।’

~ এইজন্যই আমি এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছি। আরমানের মত ছেলে হয় না৷ তাই ওকে আমি মেয়ের জামাই করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তখন আমি ভাবিনি। তুমি নিজেও কি দেখোনি বুবু আরমান চলে গেলে অথৈ কেমন মনমরা হয়ে যায়। আরমান ফিরেছে ওর মুখে হাসি ফিরেছে। বিয়ের পর আমি আমার মেয়েটাকে কষ্ট পেতে দেখতে পারব না।’

~ ছাগলের ছাগল রে! বিয়ে ভেঙে দেবার এটা কোন কারণ হলো! দরকার পড়ে আরমান অথৈকে সাথে নিয়ে সমুদ্রে সমুদ্রে ঘুরবে। আর তা না হলে ও চাকরি ছেড়ে দিবে। এখানে বিয়ে ভেঙে দেবার আমি তো কোন প্রয়োজনই দেখছি না।’

~ এরকম হয়না বুবু। তুমি নিজেও একটু আমার দৃষ্টিকোন থেকে ভেবে দেখো তখন তুমিই এই কথাই বলবে।’

~ কক্ষনো না। আমার এত ভাবাভাবির কোন দরকার নেই। অথৈর বিয়ে তো আরমানের সাথেই হবে। তুই রাজি থাকিস বা না থাকিস। আমি অথৈকে এই ছেলের সাথেই বিয়ে দেব। এই তুই আমার চোখের সামনে থেকে দূর হ তো। তোকে এখন বিষের মত লাগছে। ইচ্ছে করছে একটু বিষ এনে তোকে খাইয়ে মেরে ফেলি। মেয়েটা যখন রাজি ছিল না তখন ওকে জোর করে বিয়ে দিতে চেয়েছে। এখন অথৈ আরমানকে ভালোবাসে জেনেও বাংলা সিনেমার ভিলেন হতে এসেছে। গাধা একটা!’

চলবে_

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here