একটি রূপকথার গল্প’ পর্ব-১৫

0
248

#একটি_রূপকথার_গল্প’১৫’
#জেরিন_আক্তার_নিপা
বোনাস পার্ট

অথৈ বার কয়েক আরমানকে ফোনে ধরার চেষ্টা করল। কিন্তু আরমান কল তুলছে না। আজকে ওর বন্ধুদের সাথে লাঞ্চ করার কথা ছিল। অথৈ আগেই এসে পড়েছে। ওর বন্ধুরাও অপেক্ষা করছে। কিন্তু যার পক্ষ থেকে সমস্ত আয়োজন সে-ই লাপাত্তা। অথৈর বন্ধুরা মজা করে বলছে,

~ কিরে আমাদের ভয়ে তোর বর পালালো নাকি? আগে বললেই হতো উনি এতো ভীতু। তাহলে আমরা আর ট্রিট চাইতাম না।’

অথৈকে চিন্তিত দেখে মিনহা ধমক দিয়ে ওদের থামিয়ে দিল।

~ বাজে কথা বলিস না তো। তিনি হয়তো কোন কাজে আটকে গেছে।’

অথৈ নিজেও মনকে এটাই বোঝ দিল আরমান হয়তো কোন কাজে আটকে গেছে। তাই আসতে পারছে না। কিন্তু এরকমটা হলে কল করে তাকে জানিয়ে দেওয়া উচিত ছিল না!
আরমান আসেনি। অথৈ নিজের তরফ থেকে বন্ধুদের ট্রিট দিল। কিন্তু ওর মনটা পড়ে আছে আরমানের কাছে। লোকটা তো এতটাও কাণ্ড জ্ঞানহীন না। তাহলে এমন করার মানে কী?
….
স্যার আজ তাকে ডেকেছিল। ওইদিকে অথৈর বন্ধুরা তার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু স্যার ডেকেছে আর সে যাবে না এমনটা এই জীবনে হবে না। আরমান ভেবেছিল ওদের বিয়ে নিয়ে কথা বলতেই স্যারের এত জরুরি তলব। কিন্তু ওখানে গেলে স্যার যা বলেছে তার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। এক মুহূর্তে আরমানের সব স্বপ্ন আশা আকাঙ্ক্ষা শেষ হয়ে গেল। অথৈকে না দেখেই স্যারের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গিয়েছিল সে। অথৈকে দেখার পর না করার কোন কারণই অবশিষ্ট থাকল না। বিয়েটা ঠিক হয়ে গিয়েছিল। অথৈর অসুস্থতার জন্য হতে গিয়েও শেষে আর হলো না। এবার সে লম্বা ছুটি নিয়ে এসেছে। হানিমুনে কোথায় যাবে মনে মনে এটাও ঠিক করে ফেলেছে। কিন্তু স্যার এখন তার কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে চাচ্ছে না! আরমান ফুরফুরে মনে স্যার কী বলতে চায় কথাটা শোনার জন্য বসেছিল। আশরাফ হোসেন ইতস্তত করছে দেখে সে নিজেই বলল,

~ আমাকে কিছু বলবেন স্যার?’

~ হ্যা! হুম। আরমান তুমি জানো আমি তোমাকে কতটা পছন্দ করি। তুমি মানুষটাই এমন। কেউ তোমাকে অপছন্দ করতে পারবে না।’

হবু শ্বশুরের মুখে নিজের প্রশংসা শুনে আরমান লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। স্যার হঠাৎ তাকে এসব কথা বলছে কেন?

~ আমার মেয়ের জন্য তোমাকে আমিই পছন্দ করেছি। তুমি একটি চমৎকার ছেলে। কিন্তু বাবা..’ আশরাফ হোসেন কোনভাবেই কথাগুলো বলতে পারছেন না। ছেলেটার মুখের দিকে তাকালেই সব গোলমাল লেগে যাচ্ছে। এই ছেলেকে তিনি অতীব স্নেহ করেন। কোনভাবেই ওকে কষ্ট দিতে চান না তিনি।’

~ তোমার আর অথৈর বিয়ে নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। আমার মেয়েটা নিজেকে কঠোর দেখালেও ও অতন্ত্য ইমোশনাল একটা মেয়ে। তোমার সাথে বিয়ে হলে অথৈর জীবনের অর্ধেকটা সময়ই ভালো কাটবে না। যেই সময়টুকু তুমি ওর সাথে থাকবে অথৈ ভীষণ ভালো থাকবে। কিন্তু তোমার অপেক্ষায় অথৈর সেই সুখের সময়টুকু কম পড়ে যাবে।’

স্যারের এত ঘুরানো পেঁচানো কথার একটাই মানে অথৈর বিয়ে স্যার ওর সাথে দিতে চাচ্ছে না।

আরমান কেমন একটা ঘোরের মধ্যে বাড়ি চলে আসে। তার পৃথিবীটা রংহীন মনে হচ্ছে। যেন সব রঙ শুষে নেওয়া হয়েছে। এই বেরঙ পৃথিবীতে সে বাঁচবে কীভাবে? অথৈকে ছাড়া জীবন যে এখন কল্পনারও বাইরে।
….
অথৈ বাড়ি চলে এসেছে। তার মনটা ভালো নেই। আরমানের আজকের এই ঘটনার জন্য এক সপ্তাহ রাগ করে ওর সাথে কথা বলবে না ঠিক করে ফেলেছে। লোকটা পেয়েছে কী? সবসময় তাকে অপেক্ষা করতে হবে!
ফুপিকে এই সময় বাড়িতে দেখে অথৈ বলল,

~ কখন এসেছ ফুপি?’

মারজিয়া অথৈর বাবার রাগ অথৈর উপর দেখিয়ে বলল,

~ তা জেনে তোর কী? আমি তোদের কে? এখন তো সবাই সবার মত যার যার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারিস।’

অথৈ বোকার মতন ফুপির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। এই মহিলা আজ এত হট হয়ে আছে কেন? নিশ্চয় বাবার সাথে কিছু নিয়ে লেগেছে। অথৈ মিছেমিছি অভিমান করে বলল,

~ তোমার ভাইয়ের রাগ তুমি আমার উপর দেখাচ্ছ কেন? এমনিতে আমার মন ভালো নেই। তুমিও যদি এখন বকো তাহলে কেঁদে ফেলব কিন্তু।’

~ ওই গাধাটা কোনভাবেই আমার ভাই হতে পারে না। ওই গাধাকে কোথাও থেকে কুড়িয়ে পেয়েছে তোর দাদা দাদী।’

অথৈ হেসে ফেলল। বলল,

~ তার পরেও তোমাদের ভাই বোনের চেহারায় কত মিল!’

~ তোর মন খারাপ কেন?’

~ পরে বলব। আগে বলো বাবা আবার কী করেছে?’

~ কী করেছে জানিস না? শুনলে তুই-ই সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খাবি। সামাল দিতে পারবি কিনা আমি জানি না।’

~ কী হয়েছে তা তো বলবে?’

~ তোর বিয়ে ভেঙে দিয়েছে।’

এক্ষুনি অথৈর কানের কাছে বজ্রপাত হয়ে গেল যেন। ফুপির কথা বিশ্বাস করতে পারল না সে। হেসে ফেলল অথৈ। বাবা তার প্রিয় ছাত্র বলতে অন্ধ।

~ কোন বিয়ে ভেঙে দিয়েছে!’

অথৈর প্রশ্নে মারজিয়া বিরক্ত হলো। মেয়েটাও বাবার মতো গাধা।

~ কোন বিয়ে মানে? বাপের মত গাধা হচ্ছিস নাকি দিনদিন। কয়টা বিয়ে করবি তুই?’

~ বাবা নিজে তোমাকে বলেছে?’

~ তোর বাপ পাগল হয়ে গেছে। অতি শীঘ্রই ওকে পাবনা পাঠানো দরকার। নইলে দেখবি একটু পর তোকে আমাকে কামড়াতে আসবে। পাগলের বাচ্চা ছাগল একটা।’

অথৈ ভাবছে এই জন্যই কী আরমান তার কল তুলছে না। লোকটা তো স্যারের কথায় মরতেও রাজি হয়ে যাবে।

~ ফুপি বাবা আরমানকে এই বিষয়ে কিছু বলেছে?’

~ জানি না। আমাকে বলেছে তো বলেছে। তার ওই শিষ্যকে বল থাকলে তো কাজ হয়েই গেছে। ওই গাধা ছেলে তার গুরুদেবের কথা শুনে দেবদাস হয়ে কোথাও পড়ে আছে কিনা গিয়ে দেখ। সব গাধার দল আমার কপালে জুটেছে।’

অথৈ তাড়াহুড়োয় বেরুতে বেরুতে বলল,

~ ফুপি আমি আরমানের ফ্ল্যাটে যাচ্ছি। বাবা জিজ্ঞেস করলে বলে দিও তার মেয়ে জামাই নিয়ে ফিরবে। আর আমাদের বিয়েটা আজই হবে। ফুপাকে আসতে বলো তো তুমি। যত মিটিং ফিটিং থাকুক সন্ধ্যার আগে যেন আমাদের বাড়িতে উপস্থিত থাকে।’

অথৈর কথা শুনে মারজিয়ার সব টেনশন দূর হয়ে গেল। মুখে হাসি ফুটেছে তার। অথৈ যা বলে তা করেই ছাড়ে। বাপের মত গাধা না মেয়েটা। তাকে কী করবে হবে ঠিক জানে।
….
খালা দরজা খুলে দিয়ে অথৈকে দেখে চিনতে পারল না। অথৈ বিনীত গলায় জিজ্ঞেস করল,

~ এখানে কি আরমান সাহেব থাকেন?’

~ হ। কিন্তু আপনি কে?’

~ আমি আপনার সাহেবের হতে চলা বউ খালা।’

খালার মুখে হাসি ফুটে উঠল। অথৈকে না দেখলেও নাম শুনেছে। আরমানের মুখে ওকে নিয়ে কত গল্প শুনেছে।

~ মা তুমি! আসো আসো। তোমারে দেখার আমার কতদিনের ইচ্ছা আজ পূরণ হলো।’

~ সাহেব কি বাড়ি আছে খালা?’

~ হ ঘরেই আছে। বাইরে থেকে ফিরাই ঘরে গিয়া গুম হইয়া বইসা আছে। চোখ টোখ লাল। মুখ দেখে মনে হয় এক্ষুনি হাউমাউ কইরা কাঁনতে শুরু করব। কত জিগাইলাম কী হইছে? কোন উত্তর দিল না। আজকের আগে ওরে আমি কোনদিন এইরকম করতে দেখি নাই। জীবনটাই তো এই ছেলের কাছে পার করলাম। তুমি গিয়ে দেখো তো মা।’

অথৈ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আরমানকে দেখছে। তার রাগ লাগছে আবার একই সাথে হাসিও পাচ্ছে। তার বাবা পৃথিবীর এক আজব নমুনা। এখন দেখা যাচ্ছে বাবার ছাত্র বাবার থেকেও বড় নমুনা। তার জীবনে মজার অভিজ্ঞতার শেষ নেই। কারণ পৃথিবীর সব অদ্ভুত মানুষ গুলোই যে তার জীবনে আছে। বাবা, ফুপি এখন আবার আরমান সবার পাগলামি মিলিয়ে পুরো একটা কমেডি ড্রামা। অথৈ গলায় শব্দ করে আরমানকে ডাকল,

~ এইযে ভালো ছাত্র, আসতে পারি?’

অথৈর গলা শুনে আরমান হুড়মুড়িয়ে বসে দরজার দিকে তাকায়। অথৈকে চোখের সামনে দেখেও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না সে। অথৈ ভেতরে এলো যেন কিছুই জানে না।

~ আমাকে এবং আমার বন্ধুদের এতটা অপেক্ষা করালেন কেন? বললেই পারতেন আপনি ভীষণ ব্যস্ত মানুষ।’

~ অথৈ! তুমি! মানে…

~ আমার বন্ধুদের ট্রিট দেওয়ার কথা বলে বাড়িতে এসে লুকিয়ে আছেন!’

আরমান কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। অথৈ কি জেনে এখানে এসেছে? নাকি এখনও কিছুই জানে না সে। অথৈ খেয়াল করল আরমানের চোখ টলটল করছে।

~ আমি নিজে আপনার বাড়িতে এসেছি। এখনও কি হাঁ করে বসে থাকবেন?’

আরমানের বুকের ভেতর কালবৈশাখী ঝড় বয়ে যাচ্ছে। অথৈ এখনও কিছুই জানে না। আচ্ছা অথৈ যখন জানবে তখন কী করবে ও? নিজের বাবার বিরুদ্ধে যাবে? অথৈ কি তাকে এতটা ভালোবাসে!

~ অথৈ আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিবে?’

অথৈ চোখ বাঁকিয়ে ভাবল। তারপর বলল,

~ উত্তর জানা থাকলে দিব।’

~ তুমি কি আমাকে ভালোবাসো?’

চলবে_

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here