নিজের পরিচয়ে বাঁচতে চাই।(পর্ব–৭)
কলমে–পারমিতা মন্ডল।
অমৃতা চলে গেছে এবাড়ি থেকে তিন মাস হলো। যখন কাছে ছিল তখন এতোটা মনে হয়নি। এখন কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। আসলে ওর প্রতি আমিও খুব একটা নজর দেইনি। ওর চাওয়া- পাওয়া নিয়ে তেমনভাবে কখনো ভেবেই দেখিনি।সারাদিন বাড়িতে থেকে কাজকর্ম করতো , হাতের কাছে সব গুছিয়ে দিতো। কখনো কোন কিছুর অভাব বোধ হয়নি। ভালোমন্দ রান্না না হলে চিৎকার করেছি, বাজে কথা বলেছি । ও আবার চেষ্টা করেছে আরো ভালো ভালো রান্না করতে । কখনো প্রতিবাদ করেনি। মায়ের সাথে সাথে সব কাজ নীরবে করে গেছে। আমিও কখনো নজর দেইনি। এতো ক্ষোভ জমেছিল আমার উপর যে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল ? হ্যাঁ, কয়েকবার অবশ্য আমাকে কিছু বলার চেষ্টা করেছিল। আমি পাত্তা দেইনি। খুব একটা যে আমাদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছিল তাও না। হঠাৎ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে এটা আমার ধারনার বাইরে ছিল। আসলে ওকে খুব অবহেলা সহ্য করতে হয়েছে। মনে মনে ভাবে রাতুল।
তাও যদি বাবার কাছে যেত , তবে মানুষের কাছে এতো কথা শুনতে হতো না । কিন্তু অমৃতা সেখানে না গিয়ে বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে উঠেছে । তাই পাঁচজনে পাঁচ কথা বলছে। জানাজানি হয়ে গেছে সবার মধ্যে যে অমৃতা বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। এই তো সেদিন প্রনীলের সাথে নাকি দাসবাবুর অফিসে গিয়েছিল চাকরি চাইতে। অমৃতা হয়তো দাসবাবুকে চিনতে পারেনি,। কিন্তু দাসবাবু ঠিক অমৃতাকে চিনেছে। তাই তো সেদিন ট্রেনে বসে রসিয়ে রসিয়ে বলছিল “– তোমার বৌকে দেখলাম রাতুল। অন্য একটি লোকের সাথে আমাদের অফিসে চাকরি চাইতে এসেছিল। কি ব্যাপার বলো তো ? তুমি কি বৌকে ঠিক মত হাত খরচা দিচ্ছো না ? তার আবার কাজের দরকার পড়লো কেন ? তাও আবার অন্য একটি পুরুষের সাথে এলো আমার অফিসে ?” বলে ব্যাকা হাসি হাসছিল। পাশে যারা ছিল তারাও হাসছিল। আসলে ওরা তখনো জানতো না যে অমৃতা চলে গেছে। তাহলে আরো কি কি যে বলতো কে জানে ? তাইতো মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিল । খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছে গিয়েছিলাম সুজাতার ফ্ল্যাটে। কিন্তু ওখানে গিয়ে এভাবে বাজে কথা বলা আমার একটুও ঠিক হয়নি।
আমি তো সত্যিই অমৃতার সুখ- দুঃখ নিয়ে কখনো ভাবিনি। শুধু ভাত- কাপড়ের দায়িত্ব নিয়ে নিজের কর্তব্য শেষ করেছি।অন্য পরিবার থেকে আসা একটা মেয়ের সব নির্ভরতা ছিল তো আমাকে ঘিরে। আমি সেদিকে না দেখে মায়ের উপর সব দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছিলাম। কোনদিন জানতেও চাইনি তার কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা ? খুব ভালো গান করতো মেয়েটা। কিন্তু কখনো শুনতেই চাইনি। উৎসাহ দেওয়া তো দূরের কথা। বরং হারমোনিয়াম নিয়ে বসলে মা অসন্তুষ্ট হতো। আমার কানের কাছে গজগজ করতো। আর আমার সব রাগ গিয়ে পড়তো ওর উপর। এমন অশান্তি হতো যে শেষ পর্যন্ত বেচারী গানটাই ছেড়ে দিলো। ও একদম ঠিক কাজ করেছে। আমাকে ছেড়ে চলে গিয়ে। কিছুই তো পায়নি আমার কাছে। এবার যদি সুখী হয়।
যখন কাছে ছিল, তখন মনে হয়নি একবার ওর কথা শুনি। আজ ভীষণ একা লাগছে । অমৃতা হয়তো চেয়েছিল মায়ের অকারণে বকুনির একবার হলেও আমি যেন প্রতিবাদ করি। মায়ের অন্যায় আবদার গুলোকে আমি প্রশ্রয় না দেই। অন্তত একবার ওর পাশে দাঁড়াই। না, আমি কখনোই এসবের দিকে নজর দেইনি। এমনকি সন্তান না হওয়ার জন্য সবাই যখন ওকে দোষ দিচ্ছিল, তখনো আমি চুপ ছিলাম। আমি যে পুরুষ। বৌয়ের হয়ে প্রতিবাদ করতে আমার পৌরুষে লেগেছিল। কতবড় ভুল করেছি আমি ? কিন্তু আজ ? সবাই যখন বলছে-” তোর বৌ তোকে ছেড়ে চলে গেছে,” তখন আমার পৌরুষে লাগছে না ? কোথায় , আজ তো আমার মা, বাবা, বোন কেউ আমার পাশে নেই ? সব যন্ত্রণা তো আমাকে একা ভোগ করতে হচ্ছে। বড় ভুল হয়ে গেছে। আর শোধরানো যাবে না কোনদিন।
কিরে রাতুল ? ঘর অন্ধকার করে বসে আছিস কেন ? কি হয়েছে ? – রাতুলের মা এসে ঘরে লাইট জ্বেলে দিয়ে বলেন। এই নে চা এনেছি। এখন আর কিছু টিফিন বানাতে পারিনি। বিস্কুট দিয়ে খেয়ে নে। একটু তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে নিস। এখন তো আর ভালো মন্দ টিফিন বানিয়ে দেওয়ার কেউ নেই। তবে ঐ আপদ যে ঘাড় থেকে নেমেছে সেই ভালো। তাড়িয়ে দেওয়ার আগে চলে গেছে। না হলে আমিই কোনদিন তাড়িয়ে দিতাম।
কেন মা ? অমৃতা কি খুব খারাপ ছিল ? ও তো তোমার সব কথা শুনে চলতো। কখনো তো তোমার সাথে তর্ক করতে শুনিনি। যখন যেমন বলেছো তখন তেমনি করেছে। তাহলে ওর উপর তোমার এতো রাগ কেন মা ?
সে কি রে খোকা ? তুই তো দেখছি বৌ পাগল হয়ে গেলি একেবারে ? আগে তো কখনো দেখিনি এমন ? চলে গেছে বলে মন খারাপ হচ্ছে ? আরে যাবে কোথায় ? এতো ভাবিসনা। দেখ দু’দিন পরে আবার এখানে এসেই হাজির হবে। শুনেছি কোন বান্ধবীর বরের সাথে ঢলাঢলি করে বেড়াচ্ছে। ওদের বাড়িতে গিয়ে উঠেছে। তা ওরা আর কতদিন রাখবে ?দেখনা ফিরে এলো বলে । আমি কিন্তু বলে দিচ্ছি খোকা ঐ মেয়ে ফিরে এলে আমি আর ঘরে তুলবো না ।সে তুই যাই বলিস না কেন ? অপয়া মেয়ে মানুষ একটা। সকালে উঠেই ঐ বাঁজা মেয়ে ছেলের মুখ দেখতে আমি আর পারবো না।
শোন খোকা , মাথা থেকে ওর কথা বাদ দিয়ে দে। এবার ডিভোর্সের কথা ভাব। তুই যেহেতু সরকারি চাকরি করিস। তাই মনে হয় দাবী ওদের অনেক বেশী থাকবে। সহজে ছাড়বে না। সে যা চায় দিয়ে ঐ আপদ বিদায় কর। আমি তোর আবার বিয়ে দেবো। আমার যে নাতি- নাতনি চাই।
মা, যদি দ্বিতীয় বিয়েতেও আমার কোন সন্তান না হয়, তাহলে কি আবার তাকেও তাড়িয়ে দেবো ? এ তুমি কি বলছো মা ? একবার কি ভেবে দেখেছো সন্তান না হওয়ার কারন আমি নই তো ? এমন তো হতেই পারে দোষ আমার। অমৃতার কোন দোষ ছিল না। শুধু শুধু আমারা ওকে দোষ দিয়েছি। আমার তো ডাক্তার দেখানো উচিৎ ছিল। আমরা তা না করে ওকে দোষ দিয়েছি। দিনের পর দিন মানষিক কষ্ট দিয়েছি মা। তাই না। আচ্ছা বলো তো যদি বোনের এমন হতো ? ওকেও যদি শশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতো ঐ একই কারনে , ? তাহলেও তুমি এমন কথা বলতে পারতে ?
তোর কি হলো রে খোকা ? আগে তো কখনো এমন বৌ পাগলা দেখিনি ? তা তোর বৌকে কি আমি তাড়িয়ে দিয়েছি নাকি ? ও তো ইচ্ছা করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। তা। তোর যদি এতোই খারাপ লাগে তাহলে যা না পা ধরে নিয়ে আয় । এতো কাঁদুনি গাইছিস কেন ? তবে আমার এখানে উঠতে দেবোনা বলে দিলাম। নষ্টামী করে বেড়াচ্ছে। আবার তার জন্য তোর দরদ উথলে উঠছে।
মা, তুমি এসব কি যা তা বলছো ? সুজাতা ওর বান্ধবী। আর প্রনীল সুজাতার স্বামী। সে অমৃতাকে চাকরির জন্য সাহায্য করছে। সুজাতার বাড়ির লোক সব জানে।
আমি সব শুনেছি, কোথায় কি করছে ? তবে তোমাকে একটা কথা বলি শোন। তোমার মন দূর্বল হয়ে গেছে বুঝতে পারছি। কিন্তু ঐ বৌ নিয়ে তুমি আর আমার বাড়িতে থাকতে পারবে না। এটা আমি বলে দিলাম। বলেই গটগট করে বেরিয়ে যায় রাতুলের মা।
আজ আমি চাইলেও অমৃতা আর ফিরে আসবে না মা। যখন কাছে ছিল তখন অনেক অবহেলা করেছি। একবার ওর কথা ভাবিনি। যখন ভাবতে বসলাম , তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। পাখি উড়ে গেছে। সে মুক্তির স্বাদ পেয়েছে। আর খাঁচায় ঢুকবে না। মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকে রাতুল।
অমৃতা এখন সারাদিন একটুও সময় পায়না। একা হাতে তাকে সব করতে হয়। বাজার করা, রান্না করা, আবার সেগুলো বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসা। তবে এখনো খুব বেশী দূরে যেতে হয় না। আশেপাশের ফ্ল্যাটের সবাই নেয়। দুপুরের খাবার দিয়েই আবার রাতের জন্য কাজ শুরু করতে হয়। খরিদ্দার ও এখন বেড়েছে। কিন্তু একটা লোক নেওয়ার মত পরিস্থিতি এখনো আসেনি। তাই কষ্ট তো করতেই হচ্ছে। বাড়িভাড়া দিতে হয় প্রত্যেক মাসের দশ তারিখের মধ্যে। কষ্ট হলেও এজীবনে আনন্দ আছে অনেক। সারাদিন পরিশ্রম করার পর তো শুনতে হয়না ” পটের বিবি সেজে বসে থাকো। কোন কাজ নেই বাড়িতে । ” ওর কাজের তো কোন দাম দেয়নি রাতুলের পরিবার। শুধু দুবেলা দুমুঠো ভাত পেয়েছে সারাদিন পরিশ্রম করে। আবার কটু কথাও শুনেছে। অথচ সেই একই কাজ করে সে রোজগার করছে। নিজের ইচ্ছামত জিনিস কিনতে পারছে। কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে না কাউকে।
আচ্ছা রাতুল কেমন আছে ? একবারও কি ভাবছে তার কথা ? সেদিন যদি ভালো ভাবে ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলতো , তাহলেও একবার ভেবে দেখা যেত। কিন্তু যে অসভ্যতামিটা করে গেল , তারপর ওর কথা আর মনে আনাই উচিৎ নয়। সংসার করা ছাড়াও আরো অনেক কাজ আছে। আমি আজ থেকে সেগুলোই করবো। সংসার করবো বলেই তো লেখাপড়া ছেড়ে বিয়ে করেছিলাম। কিন্তু আমার কপালে সংসার নেই। আসলে বিয়েটা হলো অনেকটা জুয়া খেলার মতো। যার লেগে গেল সে আমীর আর যার লাগলো না সে ভিখারী। যেমন আজ আমি পথের ভিখারী। কিন্তু আমি ঘুরে দাঁড়াবোই। আর কখনোই ফিরে যাবো না রাতুলের কাছে। মনে মনে ভাবে অমৃতা। চোখ দিয়ে কি একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো ? সে কি ভালোবেসেছিল রাতুলকে ?
“অমৃতা বাড়িতে আছো নাকি ? “বাইরে থেকে ডাক দেন বাড়িওয়ালা মেসোমহাশয় । সম্বিত ফিরে পায় অমৃতা। তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছে বাইরে বেরিয়ে আসে। দেখে দরজার কাছে মেসোমহাশয়ের সাথে দাঁড়িয়ে আছেন দুজন অপরিচিত ভদ্রলোক। পরিচয় করিয়ে দেন উনি অমৃতার সাথে। তাদের কথা শুনে অমৃতা খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়। এটাও সম্ভব ? সত্যিই ঈশ্বর তুমি আছো । বলে হাত জোড় করে ঠাকুরের উদ্দেশ্যে প্রনাম করে অমৃতা।
অমৃতা কি খুশির খবর পেলো জানতে চোখ রাখুন আগামী পর্বে।
চলবে—
( আমি আমার সকল পাঠক-পাঠিকার কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইছি দেরী হওয়ার জন্য।🙏🙏🙏 আমাকে অনেকেই মেছেজ করেছেন। আসলে স্কুলে যেতে হচ্ছে প্রায়ই। তাই সময় একটু কম পড়ছে। তবে আপনারা যেভাবে পাশে আছেন আমি আপ্লুত ।আশা করি একটু আমাকে সময় দেবেন। আমি চেষ্টা করবো পরের গুলো খুব তাড়াতাড়ি দিতে।)