নিজের পরিচয়ে বাঁচতে চাই পর্ব-৬

0
209

নিজের পরিচয়ে বাঁচতে চাই ।(পর্ব–৬)
কলমে– পারমিতা মন্ডল।

এভাবে এখানে থাকা যাবে না। পাঁচজনে ,পাঁচকথা বলবে।ভাবতে থাকে অমৃতা। অবশ্য একথা সে আগেই জানতো। মেয়েরা ঘর ছেড়ে চলে এলে সব সময় তাদেরই দোষ হয়। এটুকু সে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু রাতুল এসে যে এমন ঝামেলা করবে সেটা সত্যিই সে ভাবেনি। তারপর সুজাতার হবু শাশুড়ি মা । তিনিও কেমন যেন মেনে নিচ্ছেন না ব‍্যপারটা। হাবেভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। তার তো এখানে আসারই কথা নয়। অথচ দেখো এই খবর শুনে তিনি ঠিক দৌড়ে চলে এসেছেন। আসলে ভয় পেয়েছেন। ছেলে বৌয়ের সংসার না ভেঙে যায় ? ওনার জায়গায় আমি থাকলেও হয়তো এমন করতাম।

যাইহোক ওদের সংসারে অশান্তি বাঁধাতে তো আমি পারিনা। আমার সমস্যা আমাকেই মেটাতে হবে। আজই বাড়ি খুঁজতে বেরোতে হবে। অন্তত একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই। সে ভালো বাড়ি হোক বা খারাপ।আপাতত নিজের কানের দুলটি অমৃতা বিক্রি করে দেয়। টাকার দরকার। ঘর ভাড়ার টাকা যোগাড় করতে হবে। সবাই তো এডভান্স চাইবে। তাছাড়া বাসনপত্র, চালডাল, একটি স্টোভ কিনতে হবে। আজ তো তার কিছুই নেই। বুদ্ধি করে ব‍্যাংকের পাশবইটা নিয়ে এসেছিল। ওখানেও কিছু টাকা আছে। বাবা দিয়েছিল। এগুলো এখন কাজে লাগবে।

অমৃতা যোগাযোগ করে তার আর এক বান্ধবীর সাথে। ওরা বারাসতের ওদিকে থাকে। ওদিকে একটু কমে হয়তো বাড়ি ভাড়া পাওয়া যাবে এটা ভেবে । এই মুহূর্তে খুব ভালো বাড়িতে বেশী টাকা দিয়ে থাকার অবস্থা তার নেই। সুজাতাকে সাথে নিয়ে যায় বাড়ি দেখতে। পেয়েও যায় বাড়িটা। এক কামরার ছোট একটি ঘর । আর একটি বারান্দা । ওখানেই রান্নার ব‍্যবস্থা । বাথরুম শেয়ার করতে হবে বাড়িওয়ালার সাথে। তাতেই অমৃতা রাজি হয়ে যায়। আজ এর থেকে ভালো জায়গা পাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়।

নতুন জীবন শুরু করে অমৃতা। সম্পূর্ণ একা। এক স্বাধীন জীবন। সুজাতা ওকে অনেক সাহায্য করেছে। বেশ কিছু জিনিসপত্র কিনেও দিয়েছে। কোন বারন শোনেনি। প্রনীলদাও এসে বাড়িওলার সাথে কথা বলে গেছেন। এমনিতে সব ঠিক আছে।কিন্তু ভয় একটাই। এই ইন্টারনেটের যুগে মানুষকে খুঁজে বের করা আজ আর কঠিন ব‍্যপার নয়। তাই রাতুল যদি এখানে এসেও আবার ঝামেলা করে ? তাহলে বাড়িওয়ালা তাকে বাড়ি ছেড়ে দিতে বলবে নাতো ? অমৃতা তো লুকিয়ে থাকতে পারবে না। তাকে কাজে যেতে হবে। আর তাছাড়া লুকিয়ে থাকবেই বা কেন ? সে তো কোন অন্যায় করেনি।

কিন্তু একটা কাজ না পেলে কিভাবে সে টেনে নিয়ে যাবে নিজেকে? জমানো টাকায় কতদিন চলবে ? হঠাৎ মাথায় এলো পাশের বাড়ির দাসকাকু তো হোম সার্ভিস খান। দেখেছেন বাইরে থেকে খাবার আসে। অমৃতাও তো দু’দিন খেয়েছে। যখন সবকিছু গুছিয়ে উঠতে পারেনি । তাহলে সে যদি ঘরে বসে এটা করে তবে কেমন হয়? লেখাপড়া তো খুব বেশী শেখা হয়নি। তাকে কাজ দেবে কে ? বরং রাতুলদের বাড়িতে নানা রকম রান্না করতে করতে রান্নায় সে এক্সপার্ট হয়ে গেছে। এটা সে ভালোই পারবে। কিন্তু তার কাছ থেকে খাবার কে নেবে ?

মানুষের যখন সব দরজা বন্ধ হয়ে যায়, তখন ঈশ্বর হয়তো অন্য দরজা খুলে দেয়। অমৃতারও তাই হলো। সেদিন বাড়িওয়ালী মাসিমা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন । বাড়িতে ওনারা দু’জন ছিলেন। বৌমা বাবার বাড়িতে গেছে পুজোর সময়। ছেলে আর নাতিও গেছে সাথে। এদিকে উনি এতোটাই অসুস্থ যে রান্না করতে পারছেন না। মোসোমহাশয় শুধু আলুসিদ্ধ দিয়ে ভাত করেছেন। একথা শুনে অমৃতা তার রান্না থেকে কিছুটা ওদের দেন । প্রথমে আপত্তি করলেও খেয়ে খুব ভালো লাগে। তখন ওনারাই অমৃতাকে হোম সার্ভিসের আইডিয়াটা বলেন। ওনারা মোটামুটি অমৃতার পুরো ঘটনা জানতেন। সুজাতা-প্রনীল সব বলে রেখেছে ওদের। কারন রাতুল যে কোন মুহূর্তে ঝামেলা করতে পারে। মেসোমহাশয় বলেন-” খুব সুন্দর তোমার হাতের রান্না। তুমি হোম ডেলিভারী খোল। আমি তোমার খরিদ্দার যোগাড় করে দেবো। এখনে অনেকই আছে বাইরে থেকে খাবার এনে খায়। আর এতো সুন্দর সুস্বাদু খাবার পেলে তো চেটেপুটে খাবে।– বলে হেসে ওঠেন।

অমৃতা মনে ভরসা পায়। এখনো পৃথিবীতে ভালো মানুষ আছে। শুধু তার বাবাই তাকে ভুল বুঝলো। বাবা অবশ্য সেদিন ফোন করেছিল। ভুল স্বীকার করে অনেক বার তাকে ফিরে যেতে বলেছিল। কিন্তু অমৃতা রাজি হয়নি। সেদিন যদি বাবা ওকে আশ্রয় দিতো তাহলে সে হয়তো আজ এতোটা লড়াকু মনের হতে পারতো না। আজ যে কোন কিছুর বিনিময়ে তাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হবে। হারলে চলবে না। সে না তার বাবার কাছে না তার স্বামীর কাছে ফিরে যাবে ? সে নিজের পায়ে দাঁড়াবেই। একটু কষ্ট হয়তো হবে। লোকে খারাপ কথা বলবে। কিন্তু নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেলে সবার মুখ বন্ধ হয়ে যাবে, সেটা জানে অমৃতা। তাই পরিশ্রম তাকে করতেই হবে।

সেদিন যখন সুজাতার ফ্ল্যাট থেকে অমৃতা চলে আসে, তখন সুজাতার হবু শাশুড়ি মা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। খবরটা শুনে তিনি বিদ্যুৎ বেগে ছুটে এসেছিলেন সুজাতার ফ্লাটে। ভাবটা এমনই যেন তার ছেলে আবার অমৃতাকে বিয়ে করে ফেলছে। ওনার মতে “ঘি আর আগুন একসাথে রাখতে নেই। গলে যেতে পারে “। এমন বিপদ যে হয়নি তাও নয়। অনেক ক্ষেত্রে হয়েছে। তাই এই সাবধানতা। উনি ওনার দিকে ঠিক ছিলেন। কিন্তু অমৃতা তো একথা কখনো স্বপ্নেও ভাবেনি। তাই ওনার ব‍্যবহারটা খুব খারাপ লাগতো।

তুমি কি বাড়ি টাড়ি কিছু পেলে ? বলেন সুজাতার হবু শাশুড়ি মা । আসলে তোমাদের মত মেয়েদের না , কেউ বাড়ি ভাড়াও দিতে চায় না, জানো তো ? কখন কি বিপদ হয় , বলা তো যায় না ? আর তুমি দেখো কেমন থাকার জায়গা, খাওয়ার জায়গা যোগাড় না করে বর ছেড়ে চলে এলে ? আসলে কি জানো তো, ভেবে কাজ করতে হয়। এভাবে অন্যের বাড়িতে কতদিন বসে থাকবে বলো ? ওদের তো অসুবিধা হতে পারে । তবে আমার বৌমা খুব ভালো মেয়ে। অসুবিধা হলেও তোমাকে চলে যেতে বলবে না।

এটা আপনি ঠিক বলেছেন মাসিমা। সুজাতা আমাকে চলে যেতে বলবে না। কিন্তু তাই বলে তো আমি ওর বাড়িতে থাকবো না। আমি দু’একদিনের মধ্যেই ঘর পেয়ে যাবো হয়তো। আপনি চিন্তা করবেন না। আমি চলে যাবো। ওদের ঘর ভাঙতে আমি আসিনি। তাছাড়া সুজাতার সাথে তো আমার হঠাৎ দেখা হয়। আমার তো কোন প্লানইছিল না ওর এখানে আসার। এক প্রকার জোর করে সুজাতা আমাকে নিয়ে এসেছে। বলে অমৃতা।

পেয়ে গেলেই ভালো।আসলে পাঁচজনে পাঁচ কথা বলছে তো ? তারপর এখনো ওদের সামাজিক মতে বিয়ে হয়নি। সেটাও একটা ব‍্যপার আছে। তবে আমরা যাতায়াত করি বলে তেমন ভাবে কেউ কিছু বলতে পারে না। কিন্তু সেদিন ঐ পাশের ফ্ল্যাটের ঘোষদিদির বৌমা বলছিল; তোমাকে আর খোকাকে নাকি কোন রেস্টুরেন্টে দেখেছে।অনেক বাজে কথা বলছিল জানো তো ? মানুষের মুখ তো আর বন্ধ করা যায় না।তাই একটু সাবধান করে দিলাম। আমারা মানলেও লোকে তো আর মানবে না। তুমি বাপু এসব আবার সুজাতা বা খোকাকে বলো না। ওরা আধুনিক মানষিকতার মানুষ। এসবে পাত্তা দেয়না। শেষে আমাকে ভুল বুঝবে। বলেন সুজাতার হবু শাশুড়ি মা।

উনি তো ঠিকই বলেছেন। মানুষের মুখ তো বন্ধ করে রাখা সম্ভব নয়। ওরা ভালোটা দেখবে না। খারাপটাই দেখবে। দুটো আলাদা জেন্ডারের মানুষের সাথে প্রেম ছাড়া যে অন‍্য কোন সম্পর্ক হতে পারে তা সবাই ভাবতেই ভুলেই গেছে। সেদিন প্রনীলের সাথে একটা কাজের জন‍্য বেরিয়েছিল অমৃতা। সুজাতা যেতে পারেনি। তাই ওরা দু’জন গিয়েছিল। প্রনীলের এখন একটু কাজের চাপ কম। নতুন অফিসে জয়েন করেছে। তাই অমৃতার একটা কাজের জন্য এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে। ফেরার পথে প্রনীলের অনেক জোরাজুরিতে ওরা কফি সপে ঢুকেছিল কফি খেতে। ওখানে সুজাতাও এসেছিল পরে। কিন্তু ঘোষদিদির বৌমা ওদের দুজনকেই দেখেছিল।তখনো সুজাতা পৌঁছায়নি। তাই রটিয়ে দিয়েছে। এখন অমৃতাকে এইসব অপমান সহ‍্য করতে হবে। যতদিন না সে ঘুরে দাঁড়াতে পারছে।

সেদিন আরো একটা খারাপ পরিস্থিতির সন্মুখীন হতে হয়েছিল অমৃতাকে। প্রনীলদার চেনাশোনা একটি কোম্পানিতে রিসেপশনিস্টের কাজের জন্য অমৃতাকে নিয়ে গিয়েছিল প্রনীল। মাইনে হাজার পাঁচেক দেবে বলেছিল। পরে বাড়াবে কাজ দেখে। অমৃতা তাতেই রাজি হয়ে গিয়েছিল। এখন ওর টাকা দরকার। কিন্তু ইংরেজিতে কথা বলতে না পারার জন্য কাজটি হলো না। এখানেই প্রনীলের এক বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে যায়। তিনি সরাসরি প্রনীলকে চোখ টিপে বলেন–” গার্ল ফ্রেন্ড নাকি ? দারুণ দেখতে তো ? বৌদিকে লুকিয়ে আজকাল এসব হচ্ছে ? তা এখানে কি মনে করে ?”

ওখান থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসেছিল অমৃতা। আর দাঁড়িয়ে শুনতে পারেনি। সত্যি মানুষ আজকাল ভাই,বোন, দাদা দিদির সম্পর্কগুলো ভুলতে বসেছে। সবাইকে প্রেমিক- প্রেমিকা বানিয়ে দেয়। তার চেয়ে এই ভালো। বাড়িতে বসে ব‍্যবস‍্যা করা। একটু কষ্ট হবে ঠিকই । একহাতে সব কাজ করতে হবে। রান্না করে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে। তবুও ভালো নিজের কষ্টের রোজগার হবে। এ টাকা শুধু তার একার। তাছাড়া রাতুলের বাড়িতে থেকে সবার ফাই ফরমাস খাটতে খাটতে রান্নাটা সে ভালোই শিখেছে। নিশ্চিয় সবার ভালো লাগবে।

এই বাড়িতে এসে বেশ ভালোই লাগছে অমৃতার। একটা অন্যরকম অনুভূতি। আজ তার প্রথম হোম ডেলিভারী হলো। বাড়িওয়ালী মাসিমা মেসোমহাশয় খেলেন। জীবনে তার প্রথম রোজগার। হোক না সে সামান্য। তবুও তার কষ্টের রোজগার। এর স্বাদ আর গন্ধই আলাদা।

আজ অমৃতা স্বাধীনভাবে পথ চলা শুরু করলো নানা প্রতিকুলতা পেরিয়ে। মাসিমা মেসোমহাশয় ছাড়া প্রথম ওর্ডার পেলো পাশের ফ্ল্যাট থেকে। আরো পাঁচজনের খাবার চাই। ওরাই যোগাড় করে দিয়েছে। অনেক চেষ্টা করছে মেয়েটা নিজের পায়ে দাঁড়াতে। আপনারা সবাই থাকবেন না ওর পাশে ?

চলবে—

All rights are reserved by paramita mandal.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here