নিজের পরিচয়ে বাঁচতে চাই পর্ব-৫

0
250

নিজের পরিচয়ে বাঁচতে চাই ।(পর্ব–৫)
কলমে– পারমিতা মন্ডল।

না, না ওরা যতই বলুক না কেন এখানে থাকা যাবে না । ওরা অসুবিধায় পড়ে যাবে। তাছাড়া কারো ঘাড়ে বসে খাবো বলে তো ঘর ছাড়িনি। আমার নিজের পরিচয় তৈরী করতে হবে। কিন্তু কিভাবে এগোবো ? না গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছি ,না কোন কোর্স করেছি ? কে আমাকে কাজ দেবে ? আজকের যুগে কাজ পাওয়া বড়ই কঠিন। তবুও যত কষ্টই হোক না কেন ঘুরে আমি দাঁড়াবোই। যে ঘর ছেড়ে এসেছি সেখানে আর ফিরে যাবো না। সন্তান থাকলে হয়তো এতো সহজে সিন্ধান্ত নিতে পারতাম না। তা যখন নেই, তখন একটি পেট ঠিক চালিয়ে নেবো। মনে মনে ভাবে অমৃতা।

আবার কলিংবেল বেজে ওঠে । সুজাতা যায় দরজা খুলতে।দরজা খুলে তো অবাক। এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। সেলসম্যান হবে মনে হয়। সুজাতা বলে–” বলুন ,আমার এখন কিছু লাগবে না দাদা । এ মাসে সব কেনা হয়ে গেছে। পরের মাসে আসবেন। এখন একটু ব‍্যস্ত আছি।

সেতো বুঝতেই পারছি ব‍্যস্ত আছেন । অন্যের বৌকে নিজের স্বামীর দিকে লেলিয়ে দিয়েছেন ।আরে বাবা স্বামী বলি কেন ? আপনাদের তো বিয়েই হয়নি এখনো ? যাইহোক এরপর অন্য পুরুষের কাছেও পাঠাবেন হয়তো। এখন তো আপনি ব‍্যস্ত থাকবেনই। আপনারা হলেন ভদ্রবেশী শয়তান। তা এসব ব‍্যবস‍্যা কতদিন ধরে চালাচ্ছেন ? বলে আগন্তুক।

কে আপনি ? কাকে চান ? মনে হয় ভুল জায়গায় নক করেছেন। আমি তো আপনাকে চিনি না ? বিরক্ত হয়ে বলে সুজাতা।

না, না , একদম ঠিক জায়গায় নক করেছি। আপনি তো সুজাতা চৌধুরী। এটা আপনার ফ্ল্যাট । এখানে একটি ছেলের সাথে আপনি ফষ্টিনষ্টি করেন। আপনাদের এখনো বিয়ে হয়নি। আবার অন্যের ঘর ভেঙেও মেয়েদের এনে তোলেন এখানে। বেশ ভালো ব‍্যবস‍্যা ফেঁদে বসেছেন ।তাই না ?

আপনি ভদ্রভাবে কথা বলুন । আমরা তো আপনাকে চিনি না ? কিসব আবোল তাবোল কথা বলছেন ? কি নাম আপনার ? আপনি সেলসম্যান নয় ? যতসব উটকো ঝামেলা ?–বলে সুজাতা।

সব বুঝতে পারবেন বাড়িতে পুলিশ এলে । মধুচক্র খুলে বসেছেন তো ? সব জানিয়ে দেবো পুলিশকে । একটা নষ্ট মেয়ে মানুষ আর একটা নষ্ট মেয়ে মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে। স্বামীর কাছে থাকলে তো এসব বেলেল্লাপনা করা যেত না। চিৎকার করে বলে আগন্তুক।

সুজাতা, কে এসেছে ? এতো চিৎকার চেঁচামেচি হচ্ছে কেন ?বলতে বলতে বেরিয়ে আসে প্রনীল ।

ও, এই তাহলে কলির কেষ্ট । শুনেছি তো এখনো বিয়ে হয়নি। তাও ফস্টিনস্টি করেন , এর সাথে । এখন আবার একজনে হচ্ছে না । আর একজনকে ফুসলে নিয়ে এসেছেন ? বলি আপনাদের মতলবটা কি ? মেয়েপিছু কত টাকা করে পান ?

আমি মনে হয় বুঝতে পেরেছি আপনি কে ? অমৃতার স্বামী তো? এভাবে কথা বলছেন কেন ? আসুন না ভিতরে। বসে কথা বলা যাবে । অনেক সময় আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। আপনি উত্তেজিত হয়ে আছেন। ভিতরে আসুন। বসে কথা বলি। বলে প্রনীল।

আসলে বিয়ের দিন ছাড়া রাতুলকে সুজাতা আর কখনো দেখেনি। তাই চিনতে পারেনি।

দেখুন, আমি এখানে বসতে আসিনি। অনেক খুঁজে আপনাদের ঠিকানা পেয়েছি। অমৃতাকে ডেকে দিন। আমি আজই ওকে নিয়ে যাবো। যে বৌ আমার সাতচড়ে এক কথা বলতো না, সে বাড়ি ছেড়ে চলে এলো ? সব আপনাদের মদতে হয়েছে। এখন সব বুঝতে পারছি। আসল যুক্তিদাতা তাহলে আপনারা ? আমি তো ভেবেছিলাম ওর বাবার কাছে আছে। তবে ভেবে দেখুন, বাবা জায়গা দিলোনা। মেয়ে যদি ভালো হতো, তাহলে কি বাবা তাড়িয়ে দিতো ? আর তাকে আপনারা আশ্রয় দিলেন ? তখনই বুঝেছি , নিশ্চয় কোন বদ মতলব আছে আপনাদের?

চিৎকার চেঁচামেচি শুনে বেরিয়ে আসে অমৃতা । রাতুলকে দেখে অবাক হয়ে যায়। এই ঠিকানা সে কোথায় পেলো ?রাতুলের কথা শুনে লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছা করে অমৃতার । সুজাতার সাথে তো তার হঠাৎ ই দেখা হয়েছিল। সে তো এসবের কিছুই জানতো না। তবুও রাতুল ওকে দোষী করে এতো অপমান জনক খারাপ খারাপ কথা বলছে ? পুলিশের ভয় দেখাচ্ছে ? এই জন্য আজকাল আর কেউ কারো পাশে দাঁড়ায় না। বেকার অন্যের ঝামেলা কে পোহাবে ?

তুমি এখানে কেন এসেছো ? তোমাকে ঠিকানা কে দিলো ? আমি তো আসার সময় বলে এসেছি , আর কোনদিন ফিরবো না । আমি প্রাপ্তবয়স্ক । নিজের ইচ্ছায় স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার আমার আছে। তোমাদের বাড়িতে এককোনে , আবর্জনা হয়ে বেঁচে থাকার ইচ্ছা আমার নেই । তাই তো চলে এসেছি। কেন খুঁজছো আমায় । আমি তো আর ফিরবো না। যখন ছিলাম তোমার কাছে , তখন তো একবার তাকিয়েও দেখোনি আমার দিকে। আমার ভালোলাগা মন্দলাগা কিছুই বোঝনি কখনো। তবে আজ কেন এসেছো ? বলে অমৃতা।

ও, আমি কিছু বুঝিনি ? তাহলে কে বুঝলো ? তোমার এই নতুন মানুষটি ? আঙ্গুল তুলে দেখায় প্রনীলের দিকে রাতুল।

ছিঃ! লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা করে অমৃতার । এতোটা নীচুতে নেমে গেছে রাতুল ? ও কি ভেবেছিল ? আমি ওর পোষা ময়না ? দানাপানি দেবে আর খাঁচায় আটকে রেখে দেবে ? আর আমি শুধু বিছানায় ওর প্রয়োজন মেটাবো ? আমার কোন ভালোলাগা মন্দ লাগা নেই ? ও যা বলবে তাই শুনতে হবে ? কখনো স্বপ্নেও ভাবেনি যে আমি বেরিয়ে আসবো । তাই এতো রাগ ?

অনেক খারাপ কথা বলেছো এতোক্ষন ধরে। আর একটাও খারাপ কথা বললে তোমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে এখান থেকে বের করে দেবো সিকিউরিটি ডেকে। এটা মস্তানী করার জায়গা নয়। আমি তোমার সাথে যাবো না। তুমি যা পারো করে নাও। দৃঢ় কন্ঠে বলে অমৃতা।

রাতুল হঠাৎ প্রনীলকে এক ধাক্কা দিয়ে অমৃতার হাত ধরতে যায়। টেনে ওকে ঘরের বাইরে নিয়ে আসতে চায়। সুজাতা এসে সামনে দাঁড়ায়। এখানে বেয়াদবি করার চেষ্টা করবেন না রাতুলদা। বধুনির্যাতন বোঝেন । সেই কেসে ফেঁসে যাবেন। ভালোয় ভালোয় কেটে পড়ুন এখান থেকে। বলে সুজাতা।

পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে দেখে সিকিউরিটিকে ডাকা হয়। ওরা এসে রাতুলকে বের করে দেয়।

রাতুল শাসাতে শাসাতে যায়। বলতে থাকে সে আবার আসবে। এই অপমানের প্রতিশোধ সে অবশ্যই নেবে। তার বৌকে নাকি এরা জোর করে আটকে রেখেছে।

এমন পরিস্থিতি হবে ভাবতে পারেনি অমৃতা। লজ্জায় একেবারে মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছা করে তার। হাতজোড় করে ক্ষমা চাইতে যায় সুজাতা ও প্রনীলের কাছে। অমৃতা বলে ” আমি আর এখানে এক মুহূর্ত থাকবো না সুজাতা। ও আবার আসবে। আমি চাইনা আমার জন্য তোরা বিপদে পড়িস ? এ কয়দিন থেকেছি তার জন্য তোদের কাছে আমি চির কৃতজ্ঞ থাকবো। আমি কালই তোদের এখান থেকে চলে যাবো। বলে অমৃতা।

খারাপ ব‍্যবহার তো তুমি করোনি । তাহলে লজ্জা পাচ্ছো কেন ? আর ক্ষমাই বা চাইছো কেন ? অন‍্যের দায়ভার তুমি কেন মাথায় নেবে ? বলে প্রনীল। তুমি যেতে চাইলে আমরা বাধা দেবো না । তবে আগে একটা থাকার জায়গা ঠিক হোক, তারপর যাবে। আমার বোনকে তো আমি রাস্তায় বের করে দিতে পারিনা ।এতো ভাবার কিছু হয়নি। যাও ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করো। আমরা আছি তো তোমার পাশে।

প্রনীল এই জন্য তো তোমাকে আমি এতো ভালোবাসি। আমি এতোক্ষন ভাবছিলাম ব‍্যপারটা তুমি কিভাবে নেবে ?– বলে সুজাতা।

কেন আমাকে কি রাবন মনে হয় নাকি ? হৃদয়হীন আমি ? সব পুরুষ কিন্তু খারাপ নয়। তাদের ও মন আছে, স্নেহ ভালোবাসা আছে। তবে খারাপের সংখ্যা এতো বেশী যে ভালোর দিকে চোখই পড়ে না। বলে প্রনীল।

এদিকে প্রনীল এসেছে অথচ বাড়িতে যায়নি । তাই ওর মা ফোন করেছেন। আসলে এর আগে কখনোই সুজাতার ফ্ল্যাটে প্রনীল রাত কাটায়নি। তাই ওর মা ফোন করে জানতে চাইছেন রাতুল বাড়িতে ফিরবে কিনা ?

প্রনীল বলে –মা একটা ঝামেলায় জড়িয়ে গেছি । আজ মনে হয় ফিরতে পারবো না । তুমি রাগ করোনা। আমি আগামীকাল যাবো। এখানে সুজাতার এক বান্ধবী এসেছে। ওকে নিয়ে একটু সমস্যা হচ্ছে। বলে সব কথা মাকে খুলে বলে প্রনীল। না হলে মা ভুল বুঝতে পারে।

সুজাতাও বলে শাশুড়িমাকে – অমৃতা কিছুদিন এখানে থাকবে মা। ওর একটা কাজের ব‍্যবস্থা, আর থাকার জায়গা যতদিন না হচ্ছে ততদিন ও এখানেই থাকবে। এটাই আমাদের ইচ্ছা। আর প্রনীল যদি এই কয়দিন এখানে থাকে, মানে আমার কাছে, তাহলে অমৃতার একটা কাজের ব‍্যবস্থা তাড়াতাড়ি হয়ে যেতে পারে। ওর তো অনেক চেনাশোনা আছে।

তা বাবা ,এভাবে বিনা রোজগেরে মেয়ে তেজ দেখিয়ে স্বামী ছেড়ে চলে আসার বা কি দরকার ছিল ? একটু কি মানিয়ে নেওয়া যেত না ? এভাবে অন্যের ঘাড়ে এসে ওঠা কেন বাপু ? তাছাড়া তোমার তো কাজকর্ম আছে। তোমাকে অফিস যেতে হবে ? ঐ মেয়ে কি তখন আমার খোকার সাথে একা একা থাকবে নাকি ? এ তোমার কেমন বিচার বলো ? না, আমি খারাপ কিছু বলছি না । কিন্তু ঘর ভাঙ্গা মেয়ে তো ? একটু সাবধানে থেকো । শেষে না তোমাদের মধ্যে অশান্তি বেধে যায় ?

ফোন নিয়ে সুজাতা ছাদে চলে আসে। অমৃতা শুনে ফেললে খারাপ ভাববে। তবে শাশুড়ি মা যেটা বলছেন সেটা কিন্তু ভুল কথা নয়। আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিটা এমনই। ডিভোর্সী, অল্প বয়সে বিধবা, ঘর ভাঙা মেয়েদের এই চোখেই দেখা হয়। মনে করা হয় ওদের চরিত্র খারাপ। নিজেরা ঘর করতে পারেনি, তাই অন‍্যের ঘর ভাঙতে এসেছে। বিবাহিত মেয়েরা তাদের স্বামীদের এই সব মেয়েদের থেকে দূরে রাখতে চায় সব সময়। হঠাৎ করে এই সব মেয়েদের যেন পরিচয় বদলে যায়। অনেকেই মনে করেন এরা পর পুরুষ ধরার জন্য ওত পেতে বসে থাকে। এবং খুব লজ্জার কথা যে এইসব ভাবনা মেয়েদের মাথাতেই আসে বেশী। যেমন ভাবছেন সুজাতার হবু শাশুড়ি মা। এ সমাজ সত্যিই আর বদলাবে না ।

আপনি কোন চিন্তা করবেন না। আমরা ঠিক আছি। অমৃতা এখানে থাকবে না। দু’একদিনের মধ্যেই চলে যাবে।

ফোনটা ছেড়ে দিয়ে মনের মধ্যে কেমন যেন খুতখুত করতে থাকে সুজাতার হবু শাশুড়িমা বিজয়াদেবীর । একে তো ছেলের এই অসম বিয়ে মেনে নিয়েছি। তা নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলেছে । তারপর সবাই যদি এই কেচ্ছা শোনে তাহলে ছিঃছিঃ করবে । না ,না এই বিপদ থেকে ছেলেকে উদ্ধার করতেই হবে। আমাকে এখনই যেতে হবে ওদের কাছে।

চলবে—-
All rights are reserved by paramita mandal.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here