#একটি_রূপকথার_গল্প’৯’
#জেরিন_আক্তার_নিপা
রাতে বাড়ি ফিরে অথৈ কাউকে জানাল না সে সারাদিন আরমানের সাথে ছিল। বাবা আরমানকে তার জন্য পছন্দ করেছে। সে তো আর করেনি। আরমান ভালো লোক সেটা অন্য ব্যাপার। যদি সে বদ লোক হতো তখন! বাবা জোর করে তার বিয়ে দিতে চাচ্ছে এজন্য বাবাকে তো একটু ভুগতেই হবে। ফুপিকেও সে এত সহজে ছেড়ে দিবে না। সবাইকে একচোট নাকানিচুবানি খাইয়ে তারপর বিয়ের পীড়িতে বসবে। ফুপি নিজের বেলায় কত কাহিনী করেছে। তার ভালো মানুষ ফুপাটাকে নাকি দড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছে। অথচ তার বেলা দুই ভাই বোন মিলে তাকে না জানিয়ে বিয়ে ঠিক করে এসেছে! অথৈর সিদ্ধান্তের যেন কোন মূল্য নেই। আশরাফ হোসেন না খেয়ে মেয়ের জন্য বসে ছিলেন। অথৈ ফিরলে একসাথে খাবে। কিন্তু অথৈ তো খেয়ে এসেছে। বাবাকে বসে থাকতে দেখে অথৈ বলল,
~ তুমি খেয়ে নাও বাবা। এখন থেকে আমাকে ছাড়াই খাওয়া অভ্যেস করো। মেয়েকে বিয়ে দিতে যাচ্ছ। শ্বশুরবাড়ি থেকে আমি নিশ্চয় রোজ রোজ তোমার সাথে বসে খেতে আসতে পারব না।’
মেয়ের কথায় আশরাফ হোসেন কষ্ট পেলেন। কষ্টটা এটা ভেবে হচ্ছে অথৈ এত তাড়াতাড়ি কেন বড় হয়ে গেল? কেন ওর বিয়ে দিতে হচ্ছে! মেয়েটা চলে যাবে ভাবলেই বুক পুড়ে তার। একটা মাত্রই মেয়ে তার। এই মেয়েকে কেন সারাজীবন নিজের কাছে রাখতে পারল না। অবশ্য আরমানের সাথে অথৈর বিয়ে এজন্যই দিচ্ছেন এতে মেয়েটা তার থেকে বেশি দূরে যাবে না। আরমানেরও তো বাবা মা নেই। বিয়ের পরে ছেলেটাকে বলে বুঝিয়ে এই বাড়িতে নিয়ে এলেই হবে। মেয়ে জামাই দু’জনই চোখের সামনে থাকবে। আরমান উনাকে সম্মান করে। তার এই আবদারটা অন্যায় হলেও ফেলবে না। তাছাড়া তার যা কিছু আছে সবই তো অথৈর। এই বাড়ি গাড়ি ব্যবসা সম্পত্তি অথৈর স্বামী হিসেবে সবই তো আরমানকেই দেখতে হবে। আশরাফ হোসেন একা মানুষ, মেয়ের জামাই কি তাকে ফেলে দিবে!
অথৈ বাবাকে দেখছে। বাবার ধ্যান ভাঙাতে বলল,
~ এত কী ভাবছ?’
~ কিছু না। তুমি খাবে না?”
~ না। আমার খিদে নেই। তুমি জানো না বিয়ের কথা উঠলে মেয়েদের খাওয়া ঘুমও উঠে যায়। তুমি গিয়ে খেয়ে নাও।’
আশরাফ হোসেন একবার ভাবলেন অথৈর মতের বিরুদ্ধে গিয়ে এসব করা কি ঠিক হচ্ছে? মেয়েটা নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারে না। কিন্তু ওর নিজেরও তো কিছু খুশি আছে।
~ অথৈ মা, বিয়েটা কি তুমি করতে চাচ্ছ না?”
~ যদি বলি না তাহলে কি তুমি বিয়ে ভেঙে দিবে?”
~ আরমান ভালো ছেলে মা। ও তোমাকে সুখে রাখবে।’
~ আমি কখন বলেছি তোমার ছাত্র খারাপ ছেলে? তোমার বিষয়সম্পত্তির লোভে যেকোনো ছেলেই আমাকে মাথায় তুলে রাখবে।’
~ আরমান তেমন না। আমার সম্পদের উপর ওর কোন লোভ নেই। ছেলেটা অল্পতেই খুশি।’
~ বুঝেছি। ছাত্রের আর এত গুণগান গাইতে হবে না। জীবনে তোমাদের একটা কথা বাদে সব কথাই আমি রেখেছি। তোমার আর ফুপির পছন্দের বাইরে গিয়ে ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে পড়ছি। এছাড়া তোমরা আমার জন্য যা ঠিক করেছ সেটাই আমি ভালো মনে করেছি। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না।’
~ কিন্তু আমি চাই না আমাদের কথা রাখতে গিয়ে তুমি নিজের খুশি বিসর্জন দাও।’
~ তোমার আর ফুপির খুশিই আমার খুশি বাবা। তোমাদের ছাড়া আমি খুশি হতে পারব না।’
আশরাফ হোসেনের চোখ ভিজে উঠেছে। মেয়েকে লুকিয়ে চোখ মুছলেন তিনি। গলায় কান্না আটকে আছে। এখন কিছু বললে অথৈ বুঝে যাবে বাবা কাঁদছে। তাই আর কিছু বললেন না। নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন। অথৈ ঘরে চলে এলো। অনেকটা সময় নিয়ে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করে বেরিয়ে এলো। ভেজা চুল মুছতে মুছতে রান্নাঘরে চলে এলো।
অথৈ বাবার ঘরে খাবার নিয়ে গিয়ে নিজের হাতে বাবাকে খাইয়ে দিয়ে এলো। খেতে খেতে আশরাফ হোসেন বাচ্চাদের মতো কেঁদে ফেললেন। অথৈও বাবার সাথে কাঁদল। মনে মনে ঠিক করে নিল, বিয়ের পরও এখানেই থাকবে সে৷ বাবাকে একা রেখে কোত্থাও যাবে না।
……
আরমান অথৈকে নিয়ে বিয়ের শপিং করতে এসেছে। তার মা, বোন, ভাবি এমন কেউ নেই যে অথৈর সাথে শপিংয়ে আসবে। তাই তাকে একাই আসতে হয়েছে। বিয়ের দিন এগিয়ে আসছে। অথৈর মনে সে একটু একটু করে জায়গা তৈরি করে নিতে পেরেছে হয়তো। বিয়ের শাড়ি, লেহেঙ্গা, গয়নাগাটি থেকে শুরু করে সবই অথৈর পছন্দের নেওয়া হবে। কিন্তু অথৈর এসব সম্পর্কে কোন আইডিয়াই নেই। প্রায় পুরো মার্কেট দেখিয়ে ফেলার পরও অথৈর কিছু পছন্দ হচ্ছে না। সে আরমানের দিকে ফিরে হতাশ গলায় বলল,
~ আমি আগেই বলেছি। এসব বিষয়ে আমার কোন ধারণাই নেই। ছোট থেকেই আমার সব শপিং ফুপি করে। আমি নিজে কোনদিন একটা ওড়নাও কিনি নি। তাছাড়া আমার পছন্দ ভীষন বাজে। আপনি বরং এক কাজ করুন, আপনার যা যা ভালো লাগে নিয়ে নিন। আমি সব পরতে পারব। আমার নিজের কোন পছন্দ যেহেতু নেই তাই আমার কোন সমস্যা হবে না।’
আরমান অথৈর দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবল। তারপর হেসে বলল,
~ ঠিক আছে। কিন্তু আমার পছন্দের উপর আপনার ভরসা আছে তো?’
আরমান কথাটা কী ভেবে বলেছে তা অথৈর বুঝতে বাকি রইল না। অথৈ তার পছন্দ। এবং এক্ষেত্রে যে তার ভুল হয়নি এটা সে নিশ্চিত। অথৈও হেসে ওর কথায় সমর্থন করল।
~ ঠিক আছে। তবে আমার লাল রঙ একদম পছন্দ না। বউয়েরা স্বভাবতই টকটকে লাল রঙ পরে। কিন্তু লাল রঙ আমার চোখের বিষ।’
অথৈ বসে ফোন ঘাঁটছে। আরমান আবার নতুন করে শাড়ি দেখা শুরু করেছে। যেটা যেটা তার ভালো লাগছে তা অন্য পাশে সরিয়ে রাখছে। অথৈ আড়চোখে মানুষটাকে দেখল। কত খুশি মনে হচ্ছে। বউয়ের জন্য শাড়ি সিলেক্ট করছে এটা মনে হচ্ছে তার জীবনে সবচেয়ে পছন্দনীয় কাজ। মুখ থেকে হাসি সরছেই না। অথৈ একবার শুধু বলল,
~ পুরো মল বাড়ি নেওয়ার উদেশ্য আছে নাকি? এত শাড়ি কে পরবে!’
আরমান ওর দিকে না তাকিয়ে উত্তর দিয়েছে, ‘আমার বউ।’
এরপর আর অথৈ কিছু বলল না। বিয়ে করার খুশিতে লোকটার মাথা আউলিয়ে গেছে। কী করছে না করছে নিজেও বুঝতে পারছে না। কিন্তু আরমানের এসব পাগলামি দেখে দোকানের লোকটা মিটিমিটি হাসছে।
মোট ষোলটা শাড়ি আরমান অথৈর হাতে তুলে দিয়ে বলল,
~ সব কয়টা একবার করে ট্রাই করে দেখুন। ভালো না লাগলে আরও অপশন আছে।’
অথৈ চোখ কপালে তুলে বলল,
~ অসম্ভব! সবগুলো কীভাবে ট্রাই করব আমি! আমি পারব না। তাছাড়া এসব করতে করতেই রাত হয়ে যাবে।’
~ হোক। আমার কোন তাড়া নেই। রাত হয়ে গেলে আমি নিজে আপনাকে বাড়ি দিয়ে আসব।’
অথৈ বেশ বুঝতে পারছে এই লোক তার জীবন ত্যানা ত্যানা করে দিবে। বিয়ের পর এই লোক হবে ফুপার মত বউ পাগল। সে যদি বলে, এখানে সারাদিন বসে থাকুন একদম উঠবেন না। তাহলে এই লোক তা-ই করবে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ট্রায়াল রুমের দিকে এগোলো অথৈ। এক এক করে তিনটা শাড়ি পরে বাইরে এসে আরমানকে দেখিয়ে গেছে। আরমান বেচারা শাড়িতে হবু বউয়ের রূপ দেখে কাবু হয়ে গেছে। অথৈর থেকে চোখ সরাতে পারছে না ও। চতুর্থ বার অথৈ ট্রায়াল রুম থেকে বের হতে অনেক সময় নিচ্ছে। আরমান বাইরে ওর অপেক্ষায় থেকে ভেবে পেল না এত সময় লাগছে কেন? অথৈর কোন সমস্যা হলো নাকি? সে আরও পাঁচ মিনিট দেখল। তারপরও অথৈ বেরুচ্ছে না দেখে আরমান দরজায় গিয়ে টোকা দিয়ে ডাকল,
~ অথৈ, কোন সমস্যা হয়েছে? ঠিক আছেন আপনি?’
ভেতর থেকে অথৈর কোন সাড়াশব্দ আসছে না। আরমান বিচলিত হলো। কী হয়েছে অথৈর!
সে এবার জোরে জোরে ডাকতে লাগল। তার ডাক শুনে অলরেডি কিছু মানুষের ভিড় তৈরি হয়েছে এখানে। শপিংমলের লোক এসে জানতে চাইল কী হয়েছে। আরমান ওদের জানাল। লোকটা দেখছি বললে আরমান রেগে গেল।
~ কখন দেখবেন আপনারা? ভেতরে আমার বউ আটকে আছে। ও ঠিক আছে কি-না সেটা জানি না আমি। দরজা খোলার ব্যবস্থা না হলে দরজা ভেঙে ফেলুন।’
~ স্যার আপনি চিন্তিত হবেন না। আমরা দেখছি।’
~ আপনাদের আর দেখতে হবে না। যা করার আমিই করছি।’ বলেই আরমান কাঁধ দিয়ে দরজায় ঠেলতে লাগল। বার কয়েক জোরে জোরে ধাক্কা দেওয়ার পর দরজা খুলে গেল। আরমান দেখল অথৈ মেঝেতে পড়ে আছে। সে এক ছুটে অথৈর পাশে গিয়ে বসল। অথৈর গা ধরে বুঝতে পারল প্রচন্ড জ্বরে অথৈ সেন্স লেস হয়ে গেছে। আরমান আন্দাজ করল, কম হলেও জ্বর ১০২/৩ তো হবেই। আরমান কিচ্ছু না ভেবে অথৈকে কোলে তুলে নিল। মেয়েটা এই প্রচণ্ড জ্বর নিয়েও তার সাথে এসেছে। তাকে বুঝতেই দেয়নি সে যে অসুস্থ। এতটা সময় এভাবেই কাটিয়েছে। শেষে ওর সহ্য ক্ষমতার সীমা পার হয়ে গেলে জ্ঞান হারিয়েছে। আরমানের নিজের উপর ভীষণ রাগ লাগছে। সে কেন বুঝেনি অথৈ অসুস্থ। ওর হয়তো খারাপ লাগছে। তার জন্যই তো অথৈকে এতটা কষ্ট সহ্য করতে হলো। স্যারকে কী জবাব দিবে তো? বিয়ের আগেই স্যারের মেয়ের খেয়াল রাখতে পারছে না। বিয়ের পর কেমন রাখতে পারবে তা নিয়ে যদি স্যারের মনে সংশয় তৈরি হয়!
আরমান অথৈকে বাড়ি নিয়ে এলো। গাড়ি থেকে কোলে করে ভেতরে নিয়ে এলে মারজিয়ার চোখ ওদের উপর পড়ে। অথৈকে এই অবস্থায় দেখে মারজিয়া আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল,
~ অথৈ! কী হয়েছে ওর! আরমান, ওর কী হয়েছে?’
~ প্রচণ্ড জ্বরে জ্ঞান হারিয়েছে মা।’
~ জ্বর! কী বলো! কখন জ্বর এলো ওর?’
আরমান অথৈকে ওর রুমে নিয়ে গেল। মারজিয়া এতক্ষণে ডাক্তার সহ আশরাফ হোসেনকেও খবর দিয়ে ফেলেছেন। অথৈ আপা জ্ঞান হারিয়েছে শুনে বাড়ির সব কাজের লোক বিয়ের আয়োজন ফেলে জড়ো হয়ে গেল। আরমান নিজেও কতটা অস্থির হয়ে পড়েছে তা ওর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। বারবার সে অথৈর নাম ধরে ডাকছে,
~ অথৈ! অথৈ…’
চলবে_
(যারা গল্পটা পড়েন কমেন্ট করবেন)
গ্রুপ লিংক
https://facebook.com/groups/928548141001685/