নিজের পরিচয়ে বাঁচতে চাই।( পর্ব–৪)
কলমে– পারমিতা মন্ডল।
এ আমি কি করলাম ? মেয়েটাকে বাড়িতে জায়গা দিলাম না ? একবার শুনতে পর্যন্ত চাইলাম না ওর কি হয়েছে ? কেন চলে এলো শ্বশুর বাড়ি থেকে ? রাতুল তো খুব ভালো ছেলে। সব সময় তো আমাদের সাথে ভালো ব্যবহার করেছে। কিন্তু কি এমন হলো যে অমৃতা সব ছেড়ে চলে এলো ? ওর সংসারের অশান্তির কথা তো আগে কখনোই আমাকে বলেনি? তাহলে কি ওটা রাতুলের মুখোস ছিল ?আমি কি মারাত্মক ভুল করলাম ?মনে মনে ভাবছেন অমৃতার বাবা সমীরণবাবু।
আসলে বড় মেয়ে মারা যাওয়ার পর মাথাটা আর ঠিকঠাক কাজ করছে না। সন্তান হারানোর যন্ত্রণা যে কি , তা যিনি না হারিয়েছেন তিনি বুঝবেন না। চোখের সামনে মেয়েটাকে কষ্ট পেতে দেখেছি। তিলে তিলে আমার সামনে মেয়েটা শেষ হয়ে গেল। বাঁচাতে পারলাম না। তাই ভেবেছিলাম যদি অমৃতার কথা শুনে ওকেও ঘর ভাঙতে উৎসাহ দেই ,তাহলে হয়তো সন্তান সুখ আর পাবো না। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। ওর সংসার তো আগেই ভেঙে গেছে। মেয়েটা নিশ্চয়ই চেষ্টা করেছিল টিকিয়ে রাখতে। না পেরে চলে এসেছিল আমার কাছে। আমি ওকে ফিরিয়ে দিলাম ? এখন যদি অমৃতাও কিছু করে ফেলে ? তখন কি সমাজ আমাকে দেখবে ? আমি সমাজকে ভয় পেলাম ? আবার আমি সন্তান শোক পাবো নাতো ? কোথায় গেল মেয়েটা ? মনে মনে প্রচণ্ড ভেঙে পড়েন অমৃতার বাবা। ঝোঁকের মাথায় এ কি ভুল করে ফেললাম আমি ? এ বাড়ি তো ওরই বাড়ি। ফোন করতে হবে দেখি।
তুই ঘর অন্ধকার করে বসে আছিস কেন ? কি হয়েছে রে সোমু? বলেন অমৃতার পিসি অতসী দেবী।
দিদি ,আমি খুব ভুল করে ফেলেছি । মেয়েটার কাছে একবার শোনা উচিত ছিল ওর কি হয়েছে ? আসলে আমি ভেবেছিলাম ,স্বামী-স্ত্রীর মান অভিমান। ও ফিরে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আশ্রয় দিলে আর যদি শশুর বাড়িতে না যায় ? সত্যিই যদি রাতুলকে ছেড়ে চলে আসে ? আমি বুঝতে পারিনি, মেয়েটা আমার কত কষ্ট বুকে চেপে রেখেছিল। আমি কষ্ট পাবো বলে আমাকে বলেনি। আজ নিরুপায় হয়ে বেরিয়ে এসেছিল। আমিও ওকে ভুল বুঝলাম দিদি? আজ যদি ওর মা থাকতো তাহলে এমনটা হতো না।
তুই রাতুলকে একটা ফোন কর না সোমু ? দেখতো ওখানে আবার ফিরে গেছে কিনা ? বলেন অতসীদেবী।
আমি ফোন করেছিলাম দিদি । ওখানে যায়নি। উল্টে রাতুল অনেক গুলো বাজে কথা শোনালো আমাকে। আমি তো এসবের কিছুই জানতাম না।অনেকদিন ধরেই চলছিল ওদের অশান্তি। আজ আর থাকতে না পেরে বেরিয়ে এসেছিল মেয়েটা। কিন্তু কোথায় গেল আমার সে ? কোথায় খুঁজবো ওকে ?
অমৃতার ফোনে একটা ফোন করে দেখ না সোমু ? কোথায় আছে সে ?–বলেন অতসী দেবী।
আমি ওকেও ফোন করেছিলাম । ফোন ধরেনি। এখন সুইচ অফ বলছে। আর কেনই বা ধরবে আমার ফোন ? আমি তো ওকে তাড়িয়ে দিয়েছি।
অমৃতা , কার ফোন ছিল রে ?কেটে দিলি তুই ? রাতুলদার ? একবার ধরে দেখ না কি বলতে চায় ?–বলে সুজাতা ।
না ,না,ওটা বাবার ফোন ছিল । রাতুলও কাল ফোন করেছিল । আমি ধরিনি। ঐ মানুষগুলোর মূল্য আজ আর আমার কাছে নেই। বেকার ফোন ধরলে কতগুলো বাজে কথা বলবে। আর সেসব শুনে আমার মনোবল ভেঙে যাবে। যে সম্পর্ক আমি ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছি, আর কখনোই তার বাঁধনে জড়াবো না। কঠিন হয়ে বলে অমৃতা।
কিন্তু কাকুর ফোনটা তো ধরতে পারতিস। কি বলতে চান, একবার শুনে দেখতে পারতিস। হয়তো ওনার ভুল বুঝতে পেরেছেন।– বলে সুজাতা।
যে বাবা বলে– মেয়ে মরে গেলে শান্তি পাবে , সেই বাবাও আজ থেকে আমার কাছে মৃত। আমি ঠিক ঘুরে দাঁড়াবো একদিন। আর শুধু এমাসটাই তোর বাড়িতে থাকবো। সামনের মাসে ঠিক চলেই যাবো। –দৃঢ় গলায় বলে অমৃতা।
আচ্ছা বাবা ঠিক আছে। আমি তোকে আটকাবো না। তুই যখন ইচ্ছা চলে যাস । আমি শুধু বলছি একবার কাকুর সাথে কথা বলে দেখ। ওনার কোন বিপদও তো হতে পারে।
এমন সময় কলিং বেল বেজে ওঠে । মনে হয় প্রনীল এলো ।ওকে তো অমৃতা সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। কি জানি কিভাবে নেবে ? আসলে ফোনে কিছু বলতে চায়নি সুজাতা।
দরজা খুলেই দেখে প্রনীল দাঁড়িয়ে আছে সামনে বিশাল বড় একটা ব্যাগ নিয়ে। ব্যাগ রেখে সুজাতাকে একেবারে ঝাপটে ধরতে যায়। এক লাফে পিছনে ছুটে যায় সুজাতা। অমৃতা আছে তো ঘরে। ওদিকে প্রনীল ও হকচকিয়ে যায় সুজাতার ব্যবহারে। কি হলো ব্যপারটা ?
আরে দাঁড়াও, দাঁড়াও । বাইরে থেকে এসেছো । আগে হাত মুখ ধোও । ফ্রেস হও, তারপর কাছে আসবে। এখন করোনা চলছে না ? এভাবে কেউ কাছে আসে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে না ? মিটিমিটি হাসে আর বলে অমৃতা।
সেকি ম্যাডাম ? এতো দূর থেকে পিয়াসী হয়ে ছুটে এলাম তোমার কাছে। আর তুমি তৃষ্ণার জল না দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখবে ? করোনার দোহাই দিয়ে ? ঐ সব সামাজিক দূরত্ব আমার জন্য নয়। — বলেই আবার জড়িয়ে ধরতে যায় সুজাতাকে।
আরে করছো টা কি ? দাঁড়াও না একটু ? বাড়িতে লোক আছে। বলে ছিটকে যায় দূরে অমৃতা।
নিজের বৌকে আদর করছি । দাঁড়ানোর কি আছে ? এমন ভাব করছো, আমি যেন পরপুরুষ । এর আগে তো কখনো এমন দেখিনি। আরে তুমি আমার রেজিস্ট্রি করা বৌ। কোন পরকীয়া নয়। বলে হা হা করে হাসতে থাকে।
আচ্ছা ঠিক আছে, আরে শোন না । ফিসফিস করে বলে সুজাতা। অমৃতা এসেছে ।সেই অমৃতা–, কলেজে আমার সাথে পড়তো । তুমি ওকে দেখেছো দু’একবার।
আগে ভিতর এসো। তারপর সব বলছি।
প্রনীল এতোক্ষনে বুঝতে পেরেছে,কিছু একটা হয়েছে। অমৃতা মানে সুজতার সেই বান্ধবী। হ্যাঁ, মনে পড়েছে। কলেজে পড়তে পড়তে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। সুজাতার কাছে শুনেছিল। কলেজেও ওকে কয়েকবার দেখেছি। খুব শান্তশিষ্ট মেয়ে ছিল। ওর আবার কি হলো ? ঘুরতে এসেছে বলে তো মনে হলো না ? কোন সমস্যা কি ? ভাবতে ভাবতে ঘরে ঢোকে প্রনীল।
ফ্রেশ হয়ে সোফায় এসে বসে প্রনীল। কফি নিয়ে আসে সুজাতা। পরিচয় করিয়ে দেয় প্রনীলের সাথে অমৃতার। খুব আড়ষ্ঠ হয়ে থাকে অমৃতা। মনে মনে অপরাধ বোধে ভোগে। ওদের হয়তো অসুবিধা হচ্ছে। কিভাবে নেবে প্রনীলদা ? তারপর মুখের উপর যদি কোন অপমান জনক কিছু বলে ফেলে ? না, না ,এখানে আসা আমার উচিত হয়নি। মনে মনে ভাবে অমৃতা। এখানে থাকলে ওর আরো বেশী অস্মান হবে । আজ অমৃতা যেন অনেক পরিনত। যে মেয়ে রাতুল ছাড়া এক পা বাইরে বেরোনোর কথা ভাবতে পারতো না, সে আজ সম্পূর্ণ একা। পরিস্থিতি তাকে এখানে এনে দাঁড় করিয়েছে।
সব শুনে প্রনীল গম্ভীর হয়ে যায়। মুখে কিছুই বলে না। তাহলে কি প্রনীল অসন্তুষ্ট হলো ? সে অমৃতাকে থাকতে দিয়েছে বলে ? হোক অসন্তুষ্ট । এ ফ্লাট আমার। আমি একজন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি। তাতে ওর যদি পছন্দ না হয় ,না হবে। তবুও আমি অমৃতাকে এখানেই রাখবো। আমি অন্তত এটা বুঝতে পারবো যে , যাকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চলেছি ,তার আসল মানষিকতা কি ? আগে বুঝে সরে এলে অমৃতার মত হবে না। আমি মনকে শক্ত করে নিয়েছি। মনে মনে ভাবে সুজাতা।
কিছুক্ষন পর গম্ভীর হয়ে প্রনীল বলে –আমাকে তো একবার জানাতে পারতে। কেন বললে না ? তুমি এমন একটা অসুবিধার মধ্যে পড়েছো ?
আমি তো কোন অসুবিধার মধ্যে পড়িনি প্রনীল ? বিপদে তো মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়ায়। আমি শুধু তাই করেছি। অমৃতা কিন্তু এখানে আসতে চায়নি। আমি জোর করে নিয়ে এসেছি। আর ও শুধু একমাস এখানে থাকবে। সব শুনেও তুমি একথা বলতে পারলে ? আমার তো মনে হচ্ছে নতুন করে ভাবতে হবে আমাকে, তোমার সম্পর্কে।
আমার জন্য নিজেদের মধ্যে ঝামেলা করিস না । বলে অমৃতা। আমি আজ এখান থেকে চলে যাবো। তোকে তো বলেছিলাম এখানে থাকবো না। তুই জোর করে নিয়ে এলি। বলে অমৃতা।
তুই কোথাও যাবি না। তোকে আমি নিয়ে এসেছি। আর এটা আমার ফ্ল্যাট। এখানে আমার কথাই শেষ কথা। কারো অসুবিধা হলে সে চলে যাবে।–বলে সুজাতা।
আমি তো জানি এটা তোমার ফ্ল্যাট। এতোবার বলার কি আছে? আমার থেকে এক পয়সাও নাওনি। কিন্তু আমাকে তো তাড়িয়ে দেওয়ার কথা ছিল না ? এতদিন অপেক্ষা করার পর এখন তাড়িয়ে দেবে ? বলে মিটিমিটি হাসে। আরে আমার পুরো কথাটা তো শোন। এটাই হলো তোমার বড় দোষ। বলে প্রনীল।
আমি বলছি – আমাকে জানালে আমি অমৃতার একটা কাজের ব্যবস্থা করতে পারতাম। আমার তো অনেক জানাশোনা আছে। তাছাড়া তোমার বন্ধু তো আমার বন্ধু না হলেও বোন তো হতে পারে ? আমাকে কি এতোটাই খারাপ মনে হলো ম্যাডাম ? বাবা ,একেবারে তাড়িয়ে দেওয়ার হুমকি ? বলে হো হো করে হেসে ওঠে প্রনীল।
বাবা, আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভাবলাম এ কাকে ভালোবেসেছি। একে তো আমি চিনি না। বলে সুজাতা।
আমি তোমার সেই” জড়ু কা গোলাম “আছি ম্যাডাম। কোন চিন্তা নেই। আর আমার বোনের সব দায়িত্ব আমার। আমি ওকে দাঁড় করিয়ে দেবো নিজের পায়ে। পুরুষ মানেই খারাপ নয়। যারা মেয়েদের সন্মান করতে পারে না , তারা পুরুষের পর্যায় পড়ে না। তুমি চিন্তা করো না। আমি তোমার সাথে আছি।
এতোক্ষনে অমৃতা কথা বলে। সব ঠিক আছে দাদা। কিন্তু আমি কারো দয়ায় বাঁচতে চাইনা। রাতুলকে ছেড়ে চলে এসেছি, ওর দয়া চাই না বলে। আবার এখানে যদি তোমাদের ঘাড়ে বসে থাকি , তাহলে আমার ওকে ছেড়ে আসার কোন মানেই হয়না। মান সন্মান বিসর্জন দিয়ে ওখানেই থাকতে পারতাম।
তোমার এখানে থাকতে হবে না। তুমি স্বাধীন ভাবে থাকবে। নিজের রোজগারে বাঁচবে। আমরা শুধু সহযোগিতা করবো। তোমার এই মানষিকতাকে আমি স্য্যালুট জানাই। নারী বাঁচুক তার আপন অধিকারে। বলে প্রনীল।
কথাবার্তা চলার মাঝেই হঠাৎ কলিং বেল বেজে ওঠে। কে এলো এ সময় ? খুব একটা কেউ তো আসে না এখানে ? দরজা খুলে অবাক হয়ে যায় সুজাতা ।
চলবে—–
All rights are reserved by paramita.