#ভুলবশত_প্রেম পর্ব ১১
#লেখনীতে:সারা মেহেক
১১
আমি পরাস্ত চাহনিতে ক্ষণিকের জন্য আদ্রিশের দিকে চাইলাম। আদ্রিশ মুচকি হেসে আমাকে বললেন,
” এজন্য যা বলবে ভেবেচিন্তে বলবে।”
আমি কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করলাম না৷ নির্বাক রয়ে উনার পরনের পাঞ্জাবির ঘাড়ের দিকের অংশ চেপে ধরলাম। উনি অকস্মাৎ বলে উঠলেন,
” এই আস্তে ধরো আমাকে। তোমার নখগুলো খুবই ভয়ংকর।”
উনার এমন অকস্মাৎ কথা শুনে আমি কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গেলাম৷ সাথে সাথে উনার পাঞ্জাবি ছেড়ে দিলাম আমি৷ অবুঝ বালিকার ন্যায় প্রশ্ন করলাম,
” এমন বললেন কেনো? কি করেছি আমি?”
আদ্রিশ সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে বললেন,
” মনে নেই? নিচে পড়ে যাওয়ার সময় আমার পাঞ্জাবি খামচে ধরেছিলে? তখন তোমার নখ দিয়ে আমার পিঠে আঁচড় লেগেছিলো। এখন আঁচড়টা কতটুকু ডিপ তা জানি না। কিন্তু এখনও অব্দি আমার পিঠ জ্বলছে।”
আমি নিজের ভুল বুঝতে পেরে অপরাধীর ন্যায় দৃষ্টি নত করে সরি বললাম। উনি প্রত্যুত্তরে কিছু বললেন না।
আদ্রিশ আমায় নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে প্রায় নিচের দিকে নেমে এসেছেন৷ ধীরেধীরে মানুষজনের কলরব শুনে আমার টনক নড়লো। তৎক্ষনাৎ আমি আদ্রিশের ঘাড় চেপে ধরে ভয়ার্ত কণ্ঠে বললাম,
” দাঁড়ান দাঁড়ান৷ আমাকে এখানে নামিয়ে দিন। ”
আদ্রিশ শেষ তৃতীয় এসে থমকে দাঁড়ালেন। ভ্রু কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করলেন,
” এতো তাড়াতাড়ি তোমার পা ঠিক হয়ে গেলো! ”
আমি দ্রুততার সহিত বললাম,
” না। আমার পা এখনও আগের মতো আছে। কিন্তু আমাকে আপনি নামান কোল থেকে।”
” কিন্তু কেনো? তোমায় তো এখন ক্লিনিকে যেতে হবে। ”
আদ্রিশের কথায় আমার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে এলো। আমি বিস্মিত কণ্ঠে বললাম,
” পাগল না কি আপনি! এভাবে আমাকে ক্লিনিকে নিয়ে যাবেন!”
আদ্রিশ স্বাভাবিক উত্তর দিলেন,
” এভাবে নিবো কেনো? প্রথমত এভাবে গাড়ির কাছে যাবো। তারপর গাড়িতে করে ক্লিনিকে যাব। তারপর আবার সেখান থেকে কোলে করে হসপিটাল বেডে নামাবো। ”
আদ্রিশের সোজাসাপটা কথায় আমি প্রচণ্ড বিরক্ত হলাম। রাগত স্বরে বললাম,
” আমি এই ‘ এভাবে’র কথা বলিনি। আমি বলেছি আমাকে এভাবে কোলে করে সবার সামনে দিয়ে যাবেন না কি!”
আদ্রিশ অবুঝ বালকের ন্যায় বললেন,
” হ্যা, এভাবেই। ”
” আপনি নিশ্চয়ই পাগল হয়ে গিয়েছেন৷ কিন্তু আমি পাগল হয়নি। এভাবে আমি কিছুতেই সবার সামনে যাব না। মরে গেলেও যাব না৷ এর চেয়ে বরং আমাকে এখানেই নামিয়ে রাখুন। আমি কল করে আমার চাচুকে ডেকে নিবো। আর আমার এ অবস্থার ব্যাপারে কাউকে জানাতে চাচ্ছি না আমি৷ কারণ এ ব্যাপারে জানলে আপুর বিয়ের ফাংশনটাই মাটি হয়ে যাবে৷ সবাই আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে৷ যা আমি চাই না। সুতরাং, আমাকে নামান আপনি।”
আদ্রিশ ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন। আমার কথায় কোনো পাত্তাই দিলেন না তিনি। বরং আমায় নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলেন। উনার এ কৃর্তিতে আমার হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। আমি পুনরায় রাগত স্বরে উনাকে বললাম,
” দেখুন! এগুলো ভালো হচ্ছে না কিন্তু। একে তো আমার পারমিশন ছাড়াই আপনি আমাকে এভাবে উঠিয়ে নিয়েছেন। তার উপর আপনাকে নামাতে বলছি। কিন্তু আপনি তা আমলেই নিচ্ছেন না! এভাবে সবার সামনে যাওয়াতে আপনার মানসম্মানের কিছু হবে না৷ যা হবে সব আমার উপর দিয়েই যাবে। লোকে আমাকে থু থু করবে। প্লিজ আপনি আমাকে কোল থেকে নামান৷ ভালো হচ্ছে না কিন্তু! আমি কিন্তু এবার…….”
আমার কথার পরিসমাপ্তি না ঘটতেই আদ্রিশ আমাকে সোফায় বসিয়ে দিলেন। সাথে সাথে আমি বিস্মিত নয়নে চারপাশ দেখতে লাগলাম। এটা নিচের হল নয়৷ বরং একটা রুম৷ হয়তো রেস্টরুম!
আমি চারপাশ একবার পর্যবেক্ষণ শেষে আদ্রিশকে এই জিজ্ঞেস করতে উদ্যত হলাম যে, উনি কোথায় এনেছেন আমাকে। কিন্তু আমার মুখ দিয়ে টু শব্দটুকু বের হবার পূর্বেই উনি বললেন,
“চুপচাপ এখানে বসে থাকো। মুখ দিয়ে টু শব্দটুকুও বের হলে তোমার এ অবস্থার কথা বাইরের সবাইকে বলতে এক সেকেন্ডও সময় নিবো না আমি। ”
আদ্রিশের কথায় আমি ব্যাথায় কোঁকানোর পরও যতদূর সম্ভব কথাবার্তা বিহীন বসে রইলাম। এ মুহূর্তে চুপচাপ বসে থাকাকে সবচেয়ে বড় সাজা বলে মনে হলো আমার কাছে। কিন্তু এমতাবস্থায় বাধ্য হয়ে চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া আর উপায় রইলো না আমার পক্ষে।
আদ্রিশ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
” এটা রেস্টরুম। সিঁড়ির পাশ দিয়েই এসেছি। আই থিংক কেউ দেখেনি আমাদের। তুমি এখানেই বসে থাকো। দেখি,আমি কোথাও থেকে বরফ জোগাড় করতে পারি কি না। আপাতত এই স্প্রেইন এ বরফের সেক দেওয়ার দরকার। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বরফ পাবো কোথায়?”
আদ্রিশ এবার চিন্তায় মগ্ন হলেন এবং আমি চুপচাপ ব্যাথাযুক্ত পা নিয়ে বসে আছি। আদ্রিশ কিছুক্ষণ ভাবনার সাগরে ডুবে রইলেন। অতঃপর পকেট হতে ফোন বের করতে করতে রুমের বাইরে বেরিয়ে গেলেন। উনি বেরিয়ে যেতেই আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম এবং সাথে সাথে আমার ব্যাথা যেনো জাগ্রত হয়ে উঠলো। ব্যাথায় ‘আহ’ শব্দ করে আমি আলতো করে পা স্পর্শ করলাম।
প্রায় দশ মিনিট পর আদ্রিশ একটা বক্স নিয়ে ফিরে এলেন। উনার সাথে এলেন তামিম এবং সাদিক। তিনজনের চেহারায় উদ্বিগ্নতার ছাপ। আদ্রিশ দ্রুত এসে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলেন। আমার পায়ের হিল খুলে নিজ পাঞ্জাবির পকেট হতে রুমাল বের করে তাতে বরফ নিয়ে আমার গোড়ালিতে চেপে ধরলেন উনি৷ উনার অকস্মাৎ স্পর্শে আমি ব্যাথায় ককিয়ে উঠলাম। আমার প্রতিক্রিয়া দেখে আদ্রিশ সাথে সাথে বরফ সরিয়ে নিলেন। উনার এ কাণ্ডে সাদিক অনেকটা ধমকের সুরেই বললেন,
” আরে বরফ সরালি কেনো! ওর পায়ে বরফ দে! ”
আদ্রিশ বাচ্চাদের মতো বলে উঠলেন,
” কিন্তু ও তো ব্যাথা পাচ্ছে।”
সাদিক এবার এগিয়ে এসে উনার হাত হতে বরফ নিয়ে বললেন,
” তুই সর তাহলে। আমিই ওকে বরফ লাগিয়ে দিচ্ছি। ”
সাদিকের কথা শেষ হতে দেরি হলো। কিন্তু উনার হাত হতে আদ্রিশের বরফ নিতে দেরি হলো না৷ আদ্রিশ বরফ হাতে নিয়ে আমার পায়ে আলতো করে চেপে ধরতে ধরতে বললেন,
” আমিই লাগিয়ে দিচ্ছি। সমস্যা নেই। তুই বরং বাইরে যা। এখনই তো সবাই বেরিয়ে যাবে। ”
আদ্রিশের কথায় সজোরে বলে উঠলাম,
” কি! আপুরা এখনই বের হয়ে যাবে!”
আদ্রিশ হ্যা সূচক জবাব দিলেন। মুহূর্তেই আমার দু চোখ উপচে জল গড়িয়ে পরতে লাগলো। আমি কাঁদোকাঁদো গলায় বললাম,
” এই ব্যাথা এখনই পাওয়ার দরকার ছিলো! আপু চলে যাবে আর আমি দেখতে পাবো না! এটা হওয়া উচিত না। আমি আপুর কাছে যাবো।”
এই বলেই আমি উঠতে উদ্যত হলাম। সাথে সাথে আদ্রিশ আমার হাত চেপে ধরে বললেন,
” পাগল না কি! এই ব্যাথা নিয়ে তুমি অতদূর কি করে যাবে? এই রুম থেকেই বের হবার সাধ্য নেই তোমার। আবার বাইরে যাবার প্ল্যানিং করছে!”
আমি আদ্রিশের কথা মানতে নারাজ। আমার চোখ বেয়ে এখনও জল গড়িয়ে পড়ছে। তামিম আমাকে দেখে বললেন,
” মানো আর না মানো। বাইরে যাওয়ার উপায় নেই তোমার কাছে। একটা হুইলচেয়ার থাকলে গতি করা যেতো। কিন্তু এখানে তো আর হুইলচেয়ার পাওয়া সম্ভব না৷ বরং আমি বাইরে গিয়ে তোমার এ অবস্থার কথা বলি। তাহলে তোমার আপুই এখানে চলে আসবে।”
আদ্রিশ সায় দিলেন,
” হ্যাঁ। তাই কর বরং। এছাড়া তো আর উপায় দেখছি না৷ ”
আদ্রিশের সম্মতি পেয়ে তামিম এবং সাদিক বেরিয়ে গেলেন এবং দু মিনিটের মাঝেই আপু, আব্বু,আম্মু,আভাসহ আরো অনেকে এসে রেস্টরুম ভরিয়ে ফেললো। আমাকে দেখামাত্রই আপু আর আম্মু আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পরলো। আপুর চেহারা কাঁদোকাঁদো। হয়তো আপু কান্না শুরু করে দিয়েছিলো!
আপু আমাকে দেখে কাঁদতে কাঁদতে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” এ অবস্থা হলো কি করে!”
আমি নত মস্তকে জবাব দিলাম,
” হিলের কারণে হয়েছে।”
আম্মু এবার ধমকের সুরে বলে উঠলো,
” হিল সামলাতে না পারলে পরিস কেনো? কতবড় একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছিস দেখলি! এখন পায়ের ভেতরকার অবস্থা কি আল্লাহ ভালো জানেন।”
আম্মুর কথা শেষ হতে না হতেই আপু আমাকে জড়িয়ে কান্না করতে লাগলো। এদিকে আমি ও আভাও আপুর সাথে সমান তালে কেঁদে চলছি। আমাদের দেখাদেখি আম্মুও কান্না শুরু করে দিলো। ব্যস, পরিবেশটা তখন বিদায় পূর্ববর্তী মহলে পরিণত হয়ে গেলো।
এভাবে কান্নাকাটির পর আব্বু আর ইমাদ ভাইয়া মিলে আপুকে উঠিয়ে নিয়ে গেলো। আপু আমাকে ছেড়ে কিছুতেই যাবে না৷ এজন্য একপ্রকার জোর করেই তাকে উঠিয়ে নেওয়া হলো। আপু যাওয়ার পর আভা আর আম্মু আমার পাশে থাকতে চাইলেও আমি তাদের আপুর পিছে পাঠিয়ে দিলাম। একে একে সবাই আপুকে বিদায় দেওয়ার জন্য চলে গেলে আমি ফুঁপাতে ফুঁপাতে কাঁদতে লাগলাম। ঠিক এই মুহূর্ত থেকেই আমি আপুকে ভীষণভাবে মিস করতে লাগলাম। চোখের সামনে ভেসে এলো আপুর সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত। যা এখন একটা স্মৃতি।
®সারা মেহেক(গ্রুপ সারা’র গল্পকুঞ্জ
#চলবে
(এগারোটার পরই দিলাম😓৷ আর আপনাদের রেসপন্স কমেন্ট এতো কম কেনো! আমি যে লিখতে উৎসাহ পাই না আপনাদের রেসপন্স ছাড়া💔)