#ভুলবশত_প্রেম পর্ব ২৩
#লেখনীতে:সারা মেহেক
২৩
কিছুক্ষণের মাঝেই রাতের খাবারের জন্য নদী রুমে এসে আমাকে নিচে নিয়ে এলো। মাঝের একটি চেয়ারে আমাকে বসিয়ে সেও আমার পাশে বসে পড়লো। আমার পাশে এবং সামনে কুহু, দাদি ও আন্টী বসে আছেন এবং আমার একদম সামনাসামনি বসে আছেন আদ্রিশ। উনাকে দেখে পুনরায় আমার মাঝে অস্বস্তিকর অনুভূতির উদয় হলো। কেনো যেনো, আজ উনার বাড়িতে এসে উনার প্রতি এ জড়তা ভাবটা তীব্রভাবে জন্ম নিয়েছে। যদিও এতোদিনেও এ জড়তা ভাবটা ছিলো। তবে তীব্র নয়।
আমি সুক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করছি আদ্রিশ আমার দিকে চেয়ে আছেন। তবে একনাগারে নয়। সালাদ চিবুতে চিবুতে এমনভাবে আমার দিকে চেয়ে আছেন যে হুট করে এই বিষয়টা কেউ ধরে উঠতে পারবে না। উনার এ লুকোচুরি চাহনি দেখে আমার মন বলছে সালাদের মতোই উনাকে চিবিয়ে চিবিয়ে খাই। কিন্তু এ ইচ্ছেটা অপূরণীয় বলে শীঘ্রই এ ইচ্ছেকে মাটিচাপা দিতে হলো। অতঃপর আমি স্বগোতক্তি করে বললাম,
” আজ আমার রাতের খাবার গেলো।”
কিছুক্ষণ পর সার্ভেন্ট এসে সবাইকে খাবার সার্ভ করে চলে গেলো। সবাই খাওয়া শুরু করলেও আমি শুরু করতে পারলাম না৷ কারণ আদ্রিশ সামনে থাকায় খাবার খেতে বেশ অস্বস্তি লাগছে। ফলস্বরূপ লোক দেখানোর জন্য এক গাল ভাত মুখে তুলে ধীরেসুস্থে চিবুতে লাগলাম। এদিকে সবাই তৃপ্তি সহকারে আরামে খেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার কণ্ঠনালী দিয়ে খাবার নামছে না। এরই মাঝে হঠাৎ আন্টী আমায় জিজ্ঞেস করলেন,
” কি ব্যাপার মিম? খাবার কি ভালো হয়নি? খাচ্ছো না কেনো?”
আন্টীর কথার প্রত্যুত্তরস্বরূপ আমি তৎক্ষনাৎ জোরপূর্বক হেসে বললাম,
” না না আন্টী। খাবার খুব ভালো হয়েছে। আমি খাচ্ছি তো। ”
এই বলে পুনরায় আরেক গাল ভাত মুখে তুলে নিয়ে চিবুতে লাগলাম আমি। পাশাপাশি আদ্রিশকে সরু চোখে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। কিন্তু এই পর্যবেক্ষণ কারণটা সঠিক জানা নেই। হয়তো আমার দিকে ফের উনি তাকাচ্ছেন কি না তা জানার জন্য দেখছি উনাকে!
হঠাৎ খাবার মাঝেই আদ্রিশ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। খাবার প্লেট হাতে নিয়ে ড্রইং রুমের সোফার দিকে যেতে যেতে বললেন,
” তোমরা এখানে খাও। আমি সোফায় বসে খাচ্ছি।”
আদ্রিশের এ কাজে আমি ভীষণ অবাক হলাম। কিন্তু অন্যান্যদের চেহারা দেখে মনে হলো, তারা বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছে। আন্টী খেতে খেতে আদ্রিশকে বললেন,
” কিছু লাগলে বলিস। নদীকে দিয়ে পাঠিয়ে দিবো।”
আদ্রিশ প্রত্যুত্তর করলেন না। বরং সোফায় বসে আমাদের বিপরীত দিকে মুখ করে খাবার খেতে লাগলেন। এদিকে আমার সামনে থেকে আদ্রিশ চলে যাওয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম আমি৷ ফলে স্বাভাবিকভাবে তৃপ্তিসহকারে খাবার খাওয়া শুরু করলাম আমি।
রাতের খাবার শেষ হওয়ার আধঘণ্টার মাঝেই আদ্রিশ আমাকে ও কুহুকে ইমাদ ভাইয়াদের বাসায় রেখে এলেন। পথিমধ্যে আমার এবং আদ্রিশের মাঝে কোনোরূপ কথাবার্তা হয়নি। হয়তো কুহু আছে বলে। তবে আমি নিশ্চিত, আজ কুহু না থাকলে আদ্রিশ নিশ্চয়ই আগ বাড়িয়ে কথা বলতেন। এ যেনো উনার এক চিরাচরিত স্বভাব, যা এ কয়দিনেই আমি বুঝতে পেরেছি। আর এও লক্ষ্য করেছি যে, উনি সবার সামনে আমার সাথে খুব একটা কথা বলেন না। কিন্তু আমাদের মাঝে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি উপস্থিত না থাকলে উনার মুখ দিয়ে কথার ফুলঝুরি বেরুতে থাকে। আসলেই উনি অদ্ভুত নামের কিম্ভূতকিমাকার একটা মানুষ।
——–
গত পরশু আদ্রিশদের বাসা থেকে ডিনার করে এসে যে ঘুম দিয়েছিলাম, সে ঘুম আমার ভাঙে পরেরদিন সকাল সাড়ে নয়টায়। ফলে সকালের ক্লাসটাও মিস যায়। অবশ্য পরে জানতে পারি কলেজে একটা পরীক্ষার জন্য ক্লাস সাসপেন্ড রাখা হয়েছে। ব্যস আমার খুশি আর দেখে কে! ক্লাস বন্ধ থাকার ফায়দা লুটে গতকাল প্রায় সারাটাদিন ঘুমু ঘুমু ভাবেই কাটিয়েছি আমি। তবে ইমাদ ভাইয়া না থাকায় গতকাল আমি আপুর রুমে শিফট হয়েছি এবং আপুর রুমেই আমি সারা বিকেল সন্ধ্যা শুইয়ে কাটিয়েছি। অতঃপর গতকালের আরামময় আরামের খেসারত আজ কলেজে রেগুলার আইটেম ও পেন্ডিং আইটেম দিয়ে চুকাতে হয়েছে। ক্লাস, আইটেম, ওয়ার্ড, সব মিলে আমার অবস্থা আজ বেগতিক। ক্লান্তিতে দু চোখ ভেঙে এরূপ ঘুম আসছে যে মনে হচ্ছে এখনই রাস্তায় ঘুমে ঢলে পড়বো আমি। অথচ আমি গতকাল ঘুমিয়েই কাটিয়েছি!
কলেজ হতে ক্লান্ত-অবসন্ন শরীর নিয়ে বাড়ির গেটে ঢুকতেই দারোয়ান চাচা এসে আমার হাতে চিঠিস্বরূপ কিছু ধরিয়ে দিলেন। চুপিসারে বললেন,
” আপা, এটা শুধু আপনাকেই দিতে বলেছে। ”
দারোয়ান চাচার কথা শুনে আমি ভ্রু কুঁচকে খামের দিকে তাকালাম। এপাশ ওপাশ উল্টে প্রেরকের নাম না দেখে জিজ্ঞেস করলাম,
” কে পাঠিয়েছে এটা?”
দারোয়ান চাচা দাঁত কেলিয়ে হেসে বললেন,
” সে বলা নিষেধ। ”
এই বলে উনি সিকিউরিটি রুম থেকে মাধবীলতা ফুলের এক গুচ্ছ এনে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
” সে বলেছে, এই ফুল আপনাকে দিলেই আপনি তাকে চিনে যাবেন। ”
দারোয়ান চাচার কথা শোনামাত্রই আমি চট করে উপলব্ধি করলাম, চিঠিটি আর কেউ নয় বরং আদ্রিশ পাঠিয়েছেন। এতে আমি ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেলাম৷ দারোয়ান চাচা যে আদ্রিশের এ কাণ্ডে ভারী মজা পাচ্ছেন তা উনার দাঁত কেলানো হাসি দেখেই টের পেলাম। আমি আর কোনো কথা না বাড়িয়ে চিঠি নিয়ে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে গেস্টরুমে চলে এলাম। কারণ আদ্রিশ হতে প্রাপ্ত এই চিঠি নামক ভয়ংকর কাগজখানা কোনোমতেই আপুর চোখের সামনে আনা যাবে না। এজন্যই নিরাপদ রুম হিসেবে গেস্টরুমে চিঠিটি নিয়ে এলাম।
রুমে এসে দ্রুত কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে চিঠিটা নিয়ে ধপ করে বিছানায় বসে পড়লাম। প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়তেই এই চিঠি নামক বস্তুটি দেখে আমার বুকের ভেতরে হৃদপিণ্ডটা দ্রিম দ্রিম করে বাজতে শুরু করলো। এক হাতে চিঠির খাম, অপর হাতে মাধবীলতার গুচ্ছ। নির্ভাবনায় আমি চিঠির খামের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাম। অতঃপর জিহ্বা দ্বারা শুকনো ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করলাম। ধীরেসুস্থে মাধবীলতার গুচ্ছ পাশে রেখে চিঠির খাম খুলে চিঠিটা বের করলাম। অতঃপর কাগজের ভাঁজ খুলতেই আমার দৃষ্টি গিয়ে আটকালো সম্বোধনে। ‘মাধবীলতা’! নতুন এ সম্বোধনে আমি যারপরনাই বিস্মিত হলাম। তবে এ বিস্ময়ের মাত্রা কিছু কাটিয়ে চিঠি পড়তে শুরু করলাম,
” প্রিয় মাধবীলতা,
এ সম্বোধনে কিছুটা অবাক হলেও এটা জানো যে, এ সম্বোধনটা আমি করেছি এবং এই ‘আমি’টা কে সেটাও জানো। তবে হ্যাঁ, এ সম্বোধনে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তোমার জন্য এ সম্বোধনটা কিন্তু গত পরশুই উদ্ভাবন করেছি আমি। সে যাই হোক, আশা করি, আপনি আমার এ পত্র এবং পত্রের সম্বোধনটা মন দিয়ে কবুল করেছেন। অবশ্য কবুল না করেও উপায় নেই তোমার কাছে। তোমায় কিন্তু এ সম্বোধনে আমি সবসময় ডাকবো না। নির্দিষ্ট কিছু সময়ে, কিছু সুযোগ বুঝে ডাকবো।এবার আসি মূল কথায়।
এই চিঠি লেখালেখি কিন্তু আমার দ্বারা খুব একটা হয় না। ছোট বেলায় সেই বাংলা দ্বিতীয় পত্রের চিঠি লিখতে গিয়ে ভীষণ রাগ লাগতো। মন চাইতো, এই ‘চিঠি লেখা’ উদ্ভাবন করা লোকটির মাথা ফাটাই। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, সেই লোকটি শতবার ধন্যবাদ বলে আসি। কারণ, এ বয়সে একটি মেয়েকে চিঠি লেখার মতো মজার বিষয় আর দ্বিতীয়টি নেই। এ চিঠি লেখার আইডিয়া কিন্তু হুট করে মাথায় আসেনি। মনে আছে, সেদিন কামাল আংকেলের কথা? ব্যস, সেই সূত্র ধরেই আমার চিঠি লেখা।
জানো মাধবীলতা? তোমায় এ নাম দেয়ার কি কারণ? আমার মনে হয় তুমি জানো না। জানবেই বা কি করে? আচ্ছা আমিই বলি। গত পরশু যখন আমার অনুপস্থিতিতে আমার ব্যালকনিতে এসে মাধবীলতা দেখছিলে তখন আমি নিচেই দাঁড়িয়েছিলাম। সে সময় মাত্রই বাড়িতে পা রেখেছি। অমনি আমার ব্যালকনির দিকে দৃষ্টি চলে গেলো। সেখানে দেখলাম, মাধবীলতা ফুলের প্রেমে পড়ে যাওয়া এক যুবতীকে। যার চোখে সে মুহূর্তে বিরাজ করছিলো, অপার মুগ্ধতা, অপার বিস্ময়তা। সে কি এক চাহনি! যেনো রাজ্যের সৌন্দর্য এবং বিস্ময় সে মুহূর্তেই ঐ মাধবীলতার মাঝেই বিরাজ করছিলো। এরপর বারংবার সেই যুবতীর দৃষ্টি মাধবীলতার কাছে ছুটতে যাওয়া দেখলাম। অতঃপর তার হাতে যখন মাধবীলতার গুচ্ছ এলো তখন তার খুশি চোখে পড়ার মতো ছিলো। এরপর সেই যুবতী কি করলো জানো? সেই যুবতী চুলের বাঁধন খুলে মাধবীলতার গুচ্ছ কানের পিছনে গুঁজে নিলো। তার চেহারায় দেখা মিললো অস্পৃশ্য এক খুশি। সাথে তার মুখশ্রী ভরে উঠলো এক অপরূপ স্নিগ্ধতায়। মন চাইছিলো সে মুহূর্তকে থমকে দেই। মন চাইছিলো সেই যুবতীর অদ্ভুত লালিমায় মাখা চেহারাখানা ক্যামেরায় বন্ধি করে রাখি এবং আমি করলামও তাই। আড়ালে সেই যুবতীর স্নিগ্ধ রূপের একটা স্থির দৃশ্য তুলে রাখলাম। তবে অনুমতিহীন এ কাজের জন্য আমি সেই যুবতীর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। শুনছো, মাধবীলতা নামক যুবতীটা? আমায় ক্ষমা করে দিও কিন্তু। ক্ষমা করেছো তো? অপেক্ষায় রইলাম কিন্তু। ”
®সারা মেহেক(অণুগল্প পেজে পোস্ট করা হয়েছে) গ্রুপ: সারা’র গল্পকুঞ্জ
পেজ: সারা মেহেক
#চলবে
( একদিনে দুটো গল্প দিলাম। এবার বিশাল বিশাল কমেন্ট করুন😪)