#একটি_রূপকথার_গল্প’৪’
#জেরিন_আক্তার_নিপা
~ কোথায় গাধাটা? ওই গরু কই? ওরে নাকি ভীমরতি ধেরেছে? ওর মাথায় তরমুজ ফাটিয়ে ওর ভীমরতি ছুটাবো আমি। কাকে জিজ্ঞেস করে এত বড় সিদ্ধান্ত নিল?”
ফুপির গলা শুনে অথৈ ঘর থেকে দৌড়ে এলো। এসেই ফুপির বুকে পড়ে কান্নার প্রস্তুতি নিতে লাগল। কিন্তু চোখ ঢলে কচলেও একফোঁটা পানি বের করতে পারছে না। চোখে পানি না থাক গলায় কৃত্রিম কান্না এনে অথৈ বলল,
~ ফুপি এসেছ তুমি!”
~ তোর বাপটা কই? গাধাটার এত বড় সাহস! কাকে জিজ্ঞেস করে তোর বিয়ে ঠিক করেছে ও? আমি কি মরে গেছিলাম? ছেলে দেখা নেই, ছেলে করে কি জানা নেই, বংশ কেমন কোনকিছু না জেনেই মেয়ে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে!”
~ বাবাকে তুমি বুঝাও ফুপি।”
~ ওই গাধাকে আর কী বুঝাব আমি? মরলেও তো ওইটা গাধাই থাকবে।”
আশরাফ হোসেন বোনের সামনে কোন কথা বলারই সুযোগ পাচ্ছে না। মারজিয়া উনাকে কিছু বলতে দিলে তো।
~ আরমান আমার ছাত্র বুবু। নিজের হাতে ওকে গড়ে তুলেছি। ছেলেটাকে আমি খুব ভালো করে চিনি।”
~ কচু চিনিস তুই। তোর কোন ছাত্রটা তোর কাছে খারাপ? তাই বলে কি সবার কাছে মেয়ে বিয়ে দিবি?”
~ আরমানকে তুমি দেখোনি বলে আপত্তি করার সুযোগ পাচ্ছ। একবার ওকে দেখলে তুমিও এটাই চাইবে।”
~ চুপ কর তুই গাধা। তোর ন্যাকা ন্যাকা কথা শুনলে গা জ্বলে আমার। করিস তো হাইস্কুলে ঠ্যাঙা মাস্টারি। ওই ছেলেকে ডাক। আমিও দেখি কত বড় সেয়ানা ওই ছেলে। তোকে হাত করে আমার ভাইঝিকে বিয়ে করার ফন্দি করছে!”
~ডাকব। কিন্তু তুমি তো আগে শান্ত হও। বিয়ে কি আমি দিয়ে দিয়েছি? তোমাকে ছাড়া…
~ আমাকে ছাড়াই তো বিয়ের কথা বলে ফেলতে পেরেছিস। দিতে বাকি আর কী রেখেছিস?”
…..
কাল মেয়ের সাথে দেখা করেছে। আজ মেয়ের ফুপু দেখা করতে চায়। পরশু কি চাচী বা খালা দেখা করার কথা বলবে? আরমানের নার্ভাস লাগছে। নার্ভাস লাগার কারণ স্যার নিজে জানিয়েছেন, “আরমান, আমার বড় বোন একটু কঠিন প্রকৃতির। ওর কোন কথায় কষ্ট পেও না তুমি। আসলে অথৈকে ও নিজের মেয়ের মত বড় করেছে তো।”
কথা ছিল আরমান উনার চেম্বারে যাবে। কিন্তু তিনি যে নিজে এসে তার বাসায় উপস্থিত হবে তা কে জানত? একলা মানুষ সে। রান্নাবান্না, ঘর গোছানোর জন্য একজন বোয়া ছিল। তিনিও কয়দিন হলো ছুটি নিয়েছেন। নিজেই রান্না করছে সে। ঘরটরও নিজেই গোছাচ্ছে। এই পরিবেশ অথৈর ফুপুর পছন্দ হবে না এটাই স্বাভাবিক। তবে অন্য দিনের তুলনায় আজকে তার বেডরুমটা ভালোই আছে। মারজিয়া ঘুরে ঘুরে অ্যাপার্টমেন্টটা দেখছে। বেশ গুছালো ছিমছাম পরিবেশ। সে আসার আগে বলে আসেনি। না জানিয়ে হঠাৎ চলে এসেছে। যাতে ছেলেটা তাকে খুশি করার জন্য আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে না রাখতে পারে।
~ তুমি এখানে একা থাকো?”
~ জি।”
~ কেন? মা বাবা তোমার সাথে থাকে না?”
~ আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন আমার বাবা মারা গেছেন। মাধ্যমিক দেওয়ার পর মা-ও চলে গেলেন। আর কোন ভাই বোন ছিল না। তাই আমাকে একাই থাকতে হয়।”
মারজিয়া ছেলেটার মুখের দিকে তাকাল। কথাটা শুনে একটু নরম হয়েছেন তিনি। এসব কথা বলার সময়ও ছেলেটার মুখে হাসি। কিন্তু এই হাসির পেছনের দুঃখটা দেখতে পারছেন তিনি। জীবনে অনেক মানুষের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে তার। নানানরকম অভিজ্ঞতাও আছে। ছেলেটাকে বাইরে থেকে হাসিখুশি দেখা গেলেও ওর মনে অনেক কষ্ট লুকানো।
~ রান্নাবান্না কে করে?”
~ একজন খালা ছিলেন। উনি দেশের বাড়িতে গিয়েছেন।”
মারজিয়া আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। ঘুরে ঘুরে সবকিছু দেখছেন তিনি৷ আসবাবপত্র দেখে ছেলের রুচি আন্দাজ করা যাচ্ছে। বেশ সৌখিন জিনিসপত্র। একা মানুষ। ভালো বেতনের জব করে। টাকাপয়সা কী করে? নেশা টেশা করে নাকি মেয়ে মানুষের পেছনে উড়ায়। না, এই ছেলে এরকম হতেই পারে না। এর সরলতা চোখে ভাসে।
~ চা খাবেন ম্যাম?”
মারজিয়া ভুরু কুঁচকে আরমানের দিকে তাকালেন। বেশ কঠিন গলায় বললেন,
~ কী বললে তুমি?”
আরমান হকচকিয়ে গেল। কিছুটা ভয়ে ভয়েই সে বলল,
~ চা খাবেন কি-না জিজ্ঞেস করেছি।”
~ কিন্তু তুমি ম্যাম কাকে বললে? ম্যাম কে?”
ম্যাম বলা অন্যায় নাকি? ফুপু বললে যদি রাগ করে এটা ভেবেই তো ম্যাম বলেছে।
~ আমি অথৈর ফুপু। ফুপু হলেও মায়ের থেকে কম না। অথৈ আমারই মেয়ে। তুমি আমার মেয়েকে বিয়ে করতে চাও আর আমাকে ম্যাম বলো!”
আরমান হেসে ফেলল। মনে মনে স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলল,
~ আপনাকে মা ডাকলে আপনি কি রাগ করবেন?”
~ বোকা ছেলে আবার প্রশ্ন করে! গাধাটা… আমার ভাইটা কী দেখে পছন্দ করেছে তোমায়? চা খাওয়ার কথা না বলছিলে। কে চা করবে?”
~ আমিই করব মা।”
আরমান খুব কষ্টে চোখের পানি আটকে রাখছে। আশরাফ স্যার যতটা ভালো উনার বোন তার থেকেও বেশি মমতাময়ী। পৃথিবীতে এতো ভালোও মানুষ আছে! আচ্ছা তার ভাগ্যে এমন ক’জন মানুষের ভালোবাসা পাওয়া লেখা ছিল যাদের সাথে রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও তার থেকে বেশি আপন হবে এরকমটা কি সে কখনও ভেবেছিল! আরমান আজ কতটা খুশি তা সে কাউকে বোঝাতে পারবে না। কোন ভাষায় ব্যক্ত করতে পারবে না। আজ সে মা পেয়েছে।
……
বাবা তো বাবাই, ফুপিও কি বাবার সাথে পাগল হয়েছে? ফুপির থেকে এরকমটা কোনমতেই আশা করেনি অথৈ। ভেবেছিল ফুপি লোকটাকে রাম টাইট দিয়ে আসবে। কিন্তু ফুপি তো ওখান থেকে ফিরে অন্য সুর ধরেছে। ফুপির কথা শুনে অথৈর কুয়ায় ঝাপ দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ঢাকা শহরে সে কুয়ো পাবে কোথায়? অথৈ চেঁচাচ্ছে।
~ ওই লোকটা কি জাদু জানে নাকি? মন্ত্রতন্ত্র পড়ে তোমাদের দু’জনকেই বশ করে ফেলেছে। বাবা নাহয় বোকা। কিন্তু তুমি তো একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। মানুষ চেনা তোমার কাজ। তুমি কীভাবে ওই লোকটার ধোঁকায় পড়লে ফুপু? কী পানি পড়া খাইয়েছে তোমাকে?”
~ মাথা ঠান্ডা কর তো সোনা। কেউ আমাকে পানি পড়া খাওয়ায়নি। হ্যাঁ একটা কথা তুই ঠিক বলেছিস। ছেলেটা জাদু জানে। কিন্তু এই জাদু মন্ত্রতন্ত্রের জাদু না। ভালোবাসার জাদু আছে ওর কাছে। এই বাড়ির জামাই হলে আরমানই হবে।”
আশরাফ হোসেন বোনের কথা শুনে হাসছেন।
~ দেখেছ তো বুবু! আমি তোমায় বলেছিলাম। তুমি তো সকালে আমাকে শুধু শুধু বকলে।”
~ সরি রে বাবু। আমি বুঝতে পারিনি। শুধু শুধু তোকে কত কিছু বলেছি। আ’ম রেইলি ভেরি সরি।”
~ ইট’স ওকে বুবু। তুমি আমাকে কারণ ছাড়াই বকতে পারো।”
অথৈ দুই ভাই বোনের গদগদ ভালোবাসা দেখে অন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আজ সকালেও ইঁদুর বিড়ালে ঝগড়া করে গেছে। এখন ভালোবাসা দেখো! অথৈ রাগ করে হাতের কাছে থাকা ফুলের টবটা তুলে আছাড় মেরে কয়েক টুকরোয় ভেঙে ফেলল। সেদিকে বাবা বা ফুপু কেউ নজরই দিল না। ফুপু গদগদ গলায় বলছে,
~ ছেলেটাকে একদিন বাড়িতে আসতে বলতে হবে। বোয়া দেশে গেছে। কী রাঁধে কী খায় কে জানে! তুই যত তাড়াতাড়ি পারিস বিয়ের ডেট ঠিক করে ফেল। ওর তো গুরুজন কেউ নেই। বিয়ের কথা ওর সাথেই বলতে হবে।”
অথৈ আর এক মুহূর্তও ওখানে দাঁড়াল না। ঘরে গিয়ে ধড়াস শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিল। ফুপিও পাগল হয়ে গেছে। এখন শুধু তার পাগল হওয়া বাকি। তাহলেই ষোল কলা পূর্ণ। পুরো গোষ্ঠী পাগল হয়ে ওই লোকের ঘাড়ে ঝুলে পড়বে। দুঃখে কষ্টে নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে তার। শেষে কি-না ফুপিও! ফুপি তার সাথে এমনটা করতে পারল। এখন তো এই বিয়ে কেউ আটকাতে পারবে না। কারো সাধ্য নেই এই বিয়ে আটকানোর। অথৈ নাকিকান্না করতে করতে বলল,
~ আল্লাহ তুমি আমাকে এ কোন ঝামেলায় ফেললে বলো তো। ওই লোকটাকে আমি বিয়ে করতে চাই না। তুমি কি ওকেই আমার কপালে লিখে রেখেছ?”
অথৈ বালিশ টালিশ ছুঁড়ে ফেলে ফোন খুঁজে হাতে নিল। লম্বা করে দম নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করল। এখন বাবা বা ফুপিকে কিছু বলে লাভ নেই। যা বলার লোকটাকেই বলতে হবে। গতরাতের মত আজও রিং হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু লোকটা কল তুলছে না। অথৈ বিরক্তি নিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে লাগল,
~ ফোন ধর ব্যাটা তুই। ফোন ধর। কোন দেশের রাজারে তুই! ফোন কল ধরার জন্য চামচা রেখে দিতে হবে তোরে? তুই খালি একবার কল তুলে দেখ। ফোনের ভেতর দিয়ে গিয়ে তোর চুল ছিড়ব আমি। আমাকে বিয়ে করবি? তোর বিয়ে করার শখ যদি আমি জন্মের মত ঘুচিয়ে না দিয়েছি , তাহলে আমার নামও অথৈ আশরাফ না। আমার নাম হবে কথা রাখতে না পারা বাদুড়নী আশরাফ।
…..
আরমান ফোন রুমে ফেলে রেখে বাইরে গিয়েছিল। যার কারণে অথৈর কল সে ধরতে পারেনি। রুমে এসে ফোন হাতে নিয়ে এতগুলো মিসড কল দেখে ভাবনায় পড়ে গেল। এটা কে হতে পারে? কার নাম্বার এটা? কাল রাতেও এই নাম্বার থেকে অনেকগুলো কল এসেছে। সে কল ব্যাক করলো।
ফোন রিং হতেই অথৈ বেডের উপর ঝাপিয়ে পড়ে ফোন হাতে নিল। ব্যাটা নবাবজাদা কল ব্যাক করেছে। রিসিভ করেই অথৈ বলতে লাগল,
~ অসভ্য। অভদ্র। ইতর। বদ লোক। আপনার সাহস কী করে হয় আমার ফুপিকে…
কানের পর্দা হয়তো ফেটেই গেছে আরমনাের। অথৈ এরকম ভাবে চেঁচিয়ে কথা বলছে। ফোন ধরা হাতটা কান থেকে দূরে সরিয়ে নিল। অন্য হাতে কান ডলতে ডলতে বলল,
~ফোনের ভেতর এত চোটপাট! সামনে থাকলে কী করত কে জানে!”
~ এই ব্যাটা উত্তর দিচ্ছেন না কেন? এখন বোবা লেগে আছেন কেন? আমার ফুপিকে কী খাইয়েছেন আপনি? আপনি কি ভেবেছেন এসব করে আপনি পার পেয়ে যাবেন! কত বড় বদ লোক হলে…
আরমান কট করে কল কেটে দিল। অথৈ এখন রেগে আছে। ওর রাগ কমার অপেক্ষায় রইল সে। রাগের মাথায় মানুষ যা খুশি বলে ফেলতে পারে। পরে রাগ কমলে সেই কথার জন্য অনুতপ্ত হলেও তা আর ফেরত নেওয়া যায় না। আরমান চায় না অথৈও এখম এমন কিছু করে পরে অনুতপ্ত হোক।
চলবে_