একটি রূপকথার গল্প’ পর্ব-৫

0
319

#একটি_রূপকথার_গল্প’৫’
#জেরিন_আক্তার_নিপা

অথৈ হড়বড় করে বলেই যাচ্ছিল। কল কেটে গেছে এটা সে লক্ষ করেনি। ফোনের ওপাশে আরমান নিশ্চুপ হয়ে আছে দেখে রেগে বলল,

~বোবায় ধরছে নাকি? আল্লাহর দেওয়া জবান কাজে লাগাবেন না তাহলে কেটে ফেলে দিন।”

টুট টুট শব্দে ফোনের স্ক্রিনের দিকে দেখল অথৈ। ফোন হাতে নিয়ে হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইল। কত্ত বড় সাহস! তার কথার মাঝখানে কল কেটে দিয়েছে! অথৈ ফোন ছুড়ে চিৎকার করে উঠল,

~ আমি কিছুতেই এই লোককে বিয়ে করব না।”
…..
অথৈ ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে পড়ছে। তার ছোটবেলার শখ এটা বলা যায়। তার এই সিদ্ধান্তে বাবা ফুপি কেউই খুশি হয়নি। একমাত্র ফুপা ছাড়া। শুধু ফুপাই বলেছিল,

” ওর যেটা ভালো লাগে সেটা নিয়েই পড়ুক না।”

ফুপার এই কথা শুনে ফুপি ফুপাকে এমন এক ধমক দিয়েছিল,

” তুমি চুপ করো। এমনিতেই ও নাচুনি বুড়ী তুমি আবার তার উপর ঢোলের বারি দিচ্ছ। ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে পড়ে ও কী করবে? মিডিয়ার জগতে আমি ওকে কদম রাখতে দিচ্ছি না।”

জীবনে প্রথম বার বাবা ফুপির বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের শখকে প্রধান্য দিয়েছিল অথৈ। নিজের স্বপ্নটাকে পরিবারের স্বপ্নের থেকে বড় করে দেখেছিল। বাবা অবশ্য তাকে কিছুই বলেনি। ফুপিও না। তবে ফুপি শুধু বলেছিল, দেশের একজন টপ ফ্যাশন ডিজাইনার না হতে পারলে আমার সামনে কখনও দাঁড়াস না।’ চার বছরের কোর্সে এবার তৃতীয় বর্ষে আছে সে। তার লক্ষে পৌঁছাতে আর মাত্র একটা বছর। তারপর সে তার স্বপ্নকে ছুঁতে পারবে। কেউ যখন তার ডিজাইন করা কাপড় পরবে তখন তার কেমন লাগবে? ক্লাস টেস্টের প্যারায় দু’টা দিন বিয়ের কথা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। সেদিনের পর ফুপিও বাসায় আসেনি। বাবাও কিছু বলেনি তাকে৷ আজ বাড়ি ফেরার সময় ফুপির কল আসল।

~ হ্যাঁ ফুপি বলো।”

~ কই তুই?”

~ ক্লাস শেষ করে বাড়ি যাচ্ছি।”

~শোন, শোন আমার এখানে চলে আয়।”

~ তোমার চেম্বারে? ওখানে গিয়ে আমি কী করব?”

~ আরে আমার বাসায় আয়।”

~ কেন বলো তো।”

~কেন কী আবার? শেষ কবে এসেছিলি মনে আছে।”

~ অনেকদিন হয়েছে। আচ্ছা আসছি। আমি কিন্তু বিরিয়ানি খাব।”

~ বিরিয়ানির পাগল রে! হেলদি কোন খাবার তোর গলা দিয়ে নামে না।”

অথৈ বাবাকে জানিয়ে দিল সে আজ ফুপির ওখানে যাচ্ছে। ফুপি রান্নাঘরে বিরিয়ানি রাঁধছে। ভেতর থেকে কী সুন্দর ঘ্রাণ আসছে। গন্ধেই খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। অথৈ বসার ঘরে সোফায় পা তুলে বসে টিভি দেখতে দেখতে কমলা খাচ্ছে। ছোট বাচ্চাদের মত কিছু কমলার খোসা ফ্লোরে এদিক ওদিক ছিটিয়ে ফেলেছে। কিছু সামনের ছোট টেবিলে জমিয়েছে। টিভিতে টম এন্ড জেরি কার্টুন চলছে। তা দেখেই অথৈ মাঝে মাঝে হেসে গড়িয়ে পড়ছে। কে যেন এসেছে। কলিংবেল বাজছে। কিন্তু অথৈ শুনেও উঠছে না। কিচেন থেকে মারজিয়া গলা উঁচিয়ে বলল,

~ বুলবুলি দেখ তো কে এসেছে।”

~ আমি এখন টিভি দেখছি।”

~ টিভি দেখলে দরজা খোলা যায়। যা দরজা খোল গিয়ে।”

~ আমি পারব না। তুমি দেখো কে এসেছে।”

~ আমাকে আসতে হলে আগে তোর কান গরম করব তারপর দরজা খোলব।”

~দূর!” না চাইতেও উঠতে হলো অথৈকে। ফুপি যে কী! শুধু তাকে দিয়ে কাজ করাতে চায়। এরা কেন বুঝে না কাজ করতে অথৈর কতটা কষ্ট লাগে। হেলেদুলে দরজার সামনে গেল। বাম হাতে কমলার একটা কোয়া মুখে দিয়ে ডান হাতে দরজা টেনে খুলেছে মাত্র, সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে সাথে সাথে দরজা বন্ধ করে নিল। দরজা খুলেও মুখের উপর বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কিছুটা অবাক হলো আরমান। অথৈ যে দরজা খুলেছে তা সে দেখেনি। এদিকে অথৈ এক দৌড়ে বসার ঘরে চলে এলো। এই ছিল তাহলে ফুপির মনে! লোকটা আজ এখানে আসবে বলেই ফুপি তাকেও আসতে বলেছে। সে বোকার মতন বিরিয়ানির লোভে পড়ে কিছু না ভেবেই নেচে নেচে চলে এসেছে। অথৈ চিৎকার করে বলল,

~ ফুপি, তুমি অনেক খারাপ। আমি আর কোনোদিনও তোমার বাসায় আসব না। তুমি কান্নাকাটি করে বন্যা বইয়ে ফেললেও না।”

এক দৌড়ে দোতলায় চলে গেল অথৈ। রুমে গিয়ে ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিল।
আরমান ভাবছে আবার বেল টিপবে কি-না। কিন্তু তার আর প্রয়োজন হলো না। মারজিয়া এসে দরজা খুলে দিল। আরমানকে দেখে হাসি মুখে বলল,

~ এসো।”

~ আপনি কেমন আছেন?”

মারজিয়া বাঁকা চোখ তাকালে আরমান হেসে ফেলে বলল,

~ মা।”

ভেতরে এসে বসার ঘরের অবস্থা দেখে মারজিয়ার চক্ষু চড়কগাছ। অথৈটা এ কী হাল করে রেখেছে! এই মেয়েটা এত নোংরা কেন? যেখানে বসবে ওই জায়গাকে ডাস্টবিন করে ছাড়বে। আরমানের সামনে কী বলবে ভেবে পেল না মারজিয়া। তাড়াহুড়ো করে টেবিলের উপর থেকে কমলার খোসা হাতে নিয়ে আরমানের দিকে ফিরে কৈফিয়তের সুরে বলল,

~ আমার বাড়িতে ভীষণ পাঁজি একটা বেড়াল এসেছে। এসব ওরই কাজ।”

আরমানের বুঝতে বাকি রইল না ফুপি কার কথা বলছে। আর কে প্রথমে দরজা খুলেছিল। অথৈ তাহলে এখানেই আছে। কোথায় সে? অথৈকে দেখার জন্য আরমানের দু’চোখ আকুল হয়ে উঠছে। তার অশান্ত চোখ দু’টো অথৈকে দেখতে পারলেই যেন শান্ত হবে। অথৈ কি তাকে দেখে লুকিয়ে আছে? তার সামনে আসবে না? একটা বার দেখা দিবে না? আর কত অপেক্ষা করবে সে? সেদিন রেস্টুরেন্ট থেকে যাওয়ার পর দেখে অথৈকে আর দেখিনি সে। পরের দিন রাতে কল করেও অথৈ ঠিকঠাক মতো কথা বলল না। রাগের মাথায় কী সব বলল সে নিজেও জানে না।

~ তুমি বসো বাবা।”
….
আসার পর থেকে একাই বসে আছে আরমান। অথৈর দেখা সে এখনও পায়নি। বসে বসে পা নাচাচ্ছে। নখ খুঁটছে। ঘরের আসবাবপত্র দেখছে। বসার ঘরে অনেকগুলো পেইন্টিং আছে। একটা জল রঙে আঁকা গ্রামের ছবি। ছবিতে প্রকৃতি বৃষ্টি নামার আয়োজন করছে। বাতাসে ধানের ক্ষেত দুলছে তা যেন আরমান চোখের সামনে দেখতে পারছে। আরেকটা পেইন্টিং অনেকগুলো কদম ফুল একসাথে। বাকি যেগুলো আছে তা কোন বাচ্চার হাতে করা। আরমান মুগ্ধ হয়ে দেখছিল। মারজিয়া কখন এসে তার সামনে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি। মারজিয়াও আরমানের দৃষ্টি অনুসরণ করে দেয়ালে ঝুলানো ছবি গুলোর দিকে তাকাল। হেসে বলল,

~ এখানে যা যা দেখছ সব অথৈর হাতে আঁকা।”

আরমান অবাক হলো। অথৈ এত সুন্দর ছবি আঁকতে পারে! এই মেয়ের তো দেখা যাচ্ছে গুণের শেষ নেই। মারজিয়া বলতে থাকল।

~ ছোট বেলা থেকেই ওর আঁকাআঁকির দিকে ভীষণ ঝুঁক ছিল। কিন্তু ওর মা আবার এসব পছন্দ করত না। তবুও অথৈ জেদ করেই আঁকত। আমি অনেকবার ওকে আর্ট ক্লাসে দিতে চেয়েছি কিন্তু অথৈ রাজি হয়নি। তারপর ওর মা মারা যাবার পর অথৈ আঁকাআঁকি ছেড়েই দিয়েছিল। ওর বাবা আমি বললেও তেমন আঁকত না। এখন তো ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে পড়ছে। তাই টুকটাক আঁকতেই হয়। ওর করা ডিজাইন দেখলে তুমি মুগ্ধ হবে। এখনই ওর কাজ প্রফেশনালদের মতন।”
….
অথৈ ঘরে আসার পর থেকে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। মারজিয়া এসে কয়েকবার ডেকে গেছে ওকে। এবারও ডাকতে এসে অথৈর সাড়াশব্দ না পেয়ে রাগ হলো। ছেলেটা কখন থেকে একা বসে আছে। দুইদিন পর ওর সাথে বিয়ে হবে। না, আরমানের প্রতি অথৈর এই আচরণ কোনভাবেই মানা যাচ্ছে না। মারজিয়া দরজা ভেঙে ফেলতে চাচ্ছে। বিকট শব্দে হুড়মুড়িয়ে ঘুম থেকে উঠল অথৈ। কখন ঘুমিয়েছিল সে খেয়ালই নেই। তাড়াহুড়ো করে দরজা খুলে দিয়ে হাই তুললো অথৈ।

~ তুই এতক্ষণ ঘুমোচ্ছিলি!”

~ কেন কী হয়েছে? বাড়িতে ডাকাত পড়েছে?”

~ ছেলেটাকে একা বসিয়ে রেখে এসে তুই ঘরে ঘুমোচ্ছিস!”

~ উনাকে কি আমি ডেকেছি? আমার মেহমান উনি? তোমার মেহমানের সাথে তুমি বসে গল্প করো। আমার তো কোন কাজ নেই।”

~ ওর সাথে তোর বিয়ে হবে বজ্জাত মেয়ে। দু’দিন পর ও তোর স্বামী হবে।”

অথৈ আবার হাই তুলল। বলল,

~ তোমরা চাচ্ছ বলে হচ্ছে। আমি তো ওই লোককে বর বানাতে চাই না।”

~ এক্ষুনি চোখে মুখে পানি দিয়ে আরমানের কাছে যা। ওর সাথে গল্প কর। ওর চাকরির ব্যাপারে, বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে কথা বল। ত্যাড়িং বেড়িং করলে আমি তোর ঠ্যাং ভেবে দেব অথৈ। ছেলেটা অসহায়ের মত একা বসে আছে।”

~ তোমার কাছে দুনিয়ার সবাই অসহায়। অথচ আসল অসহায় তো আমি।”

~ যা এখন।”
…..
খাবার টেবিলে বসে অথৈ আরমানের সাথে কথা বলবে তো দূর একবার ওর দিকে দেখলও না। এদিকে আরমান বারবার আড়চোখে ওকেই দেখছে। অথৈ কি তার সাথে কথা বলবে না? অথৈর যে আচরণে ওকে ভালো লেগেছিল, ওর তোতাপাখির মত বলে যাওয়া। আজ তো কোন কথাই বলছে না। আরমান খুব করে চাইছে অথৈ কিছু বলুক। কিন্তু অথৈ বোবা হয়ে খেয়েই যাচ্ছে। মারজিয়া আরমানকে জোর করে সবকিছুই একটু একটু করে খাওয়াচ্ছে। আরমান মারজিয়াকে মা বলে ডাকলে অথৈ বিষম খেয়ে কাশতে লাগল। বড় বড় চোখে আরমানের দিকে তাকাল। মারজিয়া ব্যস্ত হয়ে বলল,

~ কীভাবে খাচ্ছিস? এত বড় হয়ে গেছিস এখনও খাওয়া শিখলি না! পানি খা, পানিটা খা বুলবুলি।”

আরমান পানির গ্লাস অথৈর হাতে তুলে দিল। অথৈ কোনরকমে পানি খেয়ে সরাসরি আরমানকে প্রশ্ন করল,

~ কে আপনার মা!”

যাক অথৈ তাহলে মৌনব্রত ভেঙেছে। আরমান উত্তর না দিয়ে মৃদু হাসল।

~ ফুপিকে আপনি মা ডাকছেন! কেন? আমার ফুপি আপনার মা হবে কেন? আশ্চর্য! আপনি আমার ফুপিকে মা ডাকবেন না বুঝেছেন।”

মারজিয়া অথৈকে ধমক লাগাল।

~ এসব কেমন কথা অথৈ! আমি তোর ফুপু হয়েছি বলে আর কারো মা হতে পারব না।”

~ না। তুমি শুধু আমার ফুপি।”

অথৈর রাগ লাগছে। লোকটা সবাইকে হাত করে রেখেছে। অথৈর ফুপা অফিসের কাজে চট্টগ্রাম গেছে। তাই আরমানের সাথে উনার দেখা হলো না। আরমান অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে যাওয়ার জন্য উঠল। মারজিয়ার থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে সে৷ মারজিয়া অথৈকে শাসিয়ে আরমানকে এগিয়ে দিতে পাঠাল। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে এলেও অথৈ কিছু বলছে না। গাড়ির কাছে এসে আরমানই বলল,

~ কিছু বলবেন না অথৈ?”

~ আমার কিছু বলার নেই।”

~ আমাকে এতটা অপছন্দ করার কারণটা জানতে পারি কি?”

~ আপনি বিয়েতে রাজি কেন হলেন?”

~ আপনি আমাকে বিয়ে করতে চান না?”

~ না।”

~ আপনি যে শর্ত গুলো দিয়েছিলেন সেগুলো মেনে নিলেও না?”

অথৈ চোখ কুঁচকালো। আরমান বলল,

~ আমি আপনার সব শর্ত মেনে আপনাকে বিয়ে করতে রাজি।”

চলবে..

গ্রুপ লিংক
https://facebook.com/groups/928548141001685/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here