নিজের পরিচয়ে বাঁচতে চাই।(পর্ব–৮)
কলমে– পারমিতা মন্ডল।
বাবার আদরের দুলালী ছিল অমৃতা । বিয়ের আগে সেভাবে কোন কাজ করতে হয়নি। বিয়ের পরে তো বিচিত্র অভিজ্ঞতা। শাশুড়িরা ছেলে বিয়ে দিয়ে ঘরে বৌ এনে মনে করেন বাড়িতে কাজের লোক এনেছেন। সব কাজ সে করে দেবে।আমি এবার পায়ের উপর পা তুলে খাবো। একটা বাড়তি লোকের বোঝা যখন বইতে হচ্ছে তখন তো সেটা উশুল করে নিতে হবে। তাই বৌকে চলে নানা ভাবে কাজ করানোর ফন্দি ফিকির। অমৃতা তো আগে কোন কাজ তেমন ভাবে জানতো না। শাশুড়ির পাল্লায় পড়ে শিখতে বাধ্য হয়েছে। না হলে যে গঞ্জনা আরো সহ্য করতে হতো। উনি একদিকে ভালোই করেছেন। নাহলে এতো রকমের রান্না আজ অমৃতা করতে পারতো না ।
তার মতো অল্প লেখাপড়া জানা মেয়ের পক্ষে কোন চাকরি যোগাড় করা খুব কঠিন ছিল । আবার বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে টিউশনি করবে সেটাও সম্ভব ছিল না। কারণ এখন বেশির ভাগ ছেলেমেয়েরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াশোনা করে। তাই ইংরেজিতে কাঁচা অমৃতার পক্ষে সেটা সম্ভব ছিল না। তাছাড়া বহুদিন পড়াশোনার সাথে সম্পর্ক না থাকায় সব ভুলে গেছে। তাই এই হোম ডেলিভারিটাই বেছে নেয় সে। কোন কাজ ছোট নয় । যে ভাবেই হোক তাকে ঘুরে তাকে দাঁড়াতেই হবে। বিয়েটাই জীবনের শেষ কথা নয় । এটা প্রমাণ করতেই হবে। জীবনের পথ চলতে পুরুষ যদি ভালোবেসে হাত ধরে তো ভালো , না ধরলে সে মেয়ে যে অসহায় নয় সেটা বুঝিয়ে দিতে হবে। অন্তত জীবনের পথ চলতে যে পুরুষমানুষ অপরিহার্য নয় সেটা বুঝাতে হবে মেয়েদের। যেকোনো সময়, যেকোনো বয়সে, যেকোনো পরিস্থিতিতে ঘুরে দাঁড়ানো যায়। অমৃতা তার জ্বলন্ত উদাহরণ।
অমৃতা দেখো এনারা তোমার সাথে দেখা করতে এসেছেন। ঐ যে বড় রাস্তার ওপারে যে বৃদ্ধাশ্রমটি আছে ,ওখানকার ম্যানেজার মিঃ দে আর আর ওনার সহকারী মিঃ রায় এসেছেন। বলেন মেসোমহাশয়।
অমৃতা হাতজোড় করে দুজনকে নমস্কার করে । তারপর দুটো চেয়ার এনে বাইরেই বসতে দেয়।
কথা শুরু করেন ম্যানেজার বাবু । বলেন মল্লিকদার কাছে আমরা আপনার সব কথা শুনেছি। উনি খুব ভালো মানুষ। বলছিলেন যদি কোনভাবে আমরা আপনার কাজে আসতে পারি ?তাই আপনার সাথে দেখা করতে এলাম।
একটু থেমে বলেন আমাদের একটি বৃদ্ধাশ্রম আছে। ওখানে তিরিশজন মত বৃদ্ধ বৃদ্ধা থাকেন।তাদের যদি দুবেলা খাবারের ব্যবস্থা আপনি করে দেন তাহলে খুর ভালো হয়। আসলে আমাদের ওখানে যিনি রান্না করতেন তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাই বাধ্য হয়ে খাবার বাইরে থেকে আনা হচ্ছিল। কিন্তু বুঝতেই তো পারছেন সবাই বৃদ্ধ বৃদ্ধা। তেল মশলা দেওয়া খাবার ওনাদের দেওয়া ঠিক নয়। তাই ঘরোয়া রান্না খুঁজছিলাম আমরা। মল্লিকবাবু আপনার কথা বললেন। মোটামুটি তিরিশ জনের খাবার যদি আপনি দিতে পারেন তাহলে খুব ভালো হয়।
অমৃতা তো ভীষন খুশি। কিন্তু এতো জনের রান্না তার একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। তাছাড়া বাসনপত্র নেই। পৌঁছে দেবে কে ? আর এবাড়িতে তো সে ভাড়া থাকে। ওনারা ভালো মানুষ। তাই ছোটখাট কাজ করাতে আপত্তি করছেন না। কিন্তু এতোগুলো মানুষের দুবেলা রান্না ওরা কি মেনে নেবেন ?তারপর বাজার করা, কাটাকাটি করে ধুয়ে পরিস্কার করে রান্না করতে হবে। বয়স্ক লোকজন খাবেন ? একহাতে করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। অথচ অফারটা খুব ভালো। নিতে পারলে আর পিছন ফিরে তাকাতে হতো না অমৃতার।তাই ভাবনায় পড়ে যায় সে।
তাই ইতস্ততঃ করে অমৃতা বলে -আসলে আমি তো একা কাজ করি। ঘরোয়া ভাবে। আমার তো এতো লোকের রান্না করার মতো সরঞ্জাম নেই। জায়গাও নেই। তাছাড়া এটা তো ভাড়াবাড়ি। মাসিমা-মেসোমহাশয় খুব ভালোবাসেন তাই টুকটাক কাজ করার পারমিশন দিয়েছেন। কিন্তু এতোজনের রান্না আমি কিভাবে করবো ? বলে মল্লিকবাবুর দিকে তাকায় অসহায় ভাবে।
শোন অমৃতা । তুমি আমার মেয়ের মত। এটুকু সহযোগিতা আমি তোমাকে করতেই পারি। নাহলে তো ওনাদের ডেকে আনতাম না। ওসব নিয়ে ভেবোনা। আগে শোন ওনারা কি বলেন ? বলেন মেসোমহাশয়।
ম্যানেজার বাবু আবার বলেন– তোমার কথা চিন্তা করে আমরা আশ্রমের ক্যানটিনটা তোমার জন্য ছেড়ে দিতে পারি। ওখানে তুমি রান্না করতে পারবে। দু’একজন হেল্পার নিয়ে নাও। আর আমরা তোমাকে কিছু টাকা এডভান্স দেবো। তাই দিয়ে বাসনপত্র যা লাগে কিনে নাও। এটা তো তোমার পার্মানেন্ট কাজ হবে। ওগুলো কিনে নিলে কোন লোকসান হবে না। আসলে সব করছি মল্লিকবাবুর জন্য। ওনাকে বহুদিন ধরে চিনি তো। বন্ধুর মতো হয়ে গেছে। তাই ওনার কথা ফেলতে পারলাম না। আর আমরা একটু সাহায্য করলে যদি তোমার একটু উপকার হয় , তাহলে আমাদের ও ভালো লাগবে।
অমৃতা যেন হাতে স্বর্গ পেলো। এই কাজটা ঠিকভাবে করতে পারলে আর তাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হবে না। মনে মনে ঈশ্বরকে অনেক ধন্যবাদ দিলো। সেই সাথে ঈশ্বররূপী মেসোমহাশয়কে। ঠাকুর তুমি আছো। সৎ পথে থাকলে ঠিক সঠিক পথের দিশা পাওয়া যায়।
কাজটা নিয়ে নেয় অমৃতা । কিছু টাকা এডভান্স দেয় ওরা। তাই দিয়ে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস বাসনপত্র কিনে নেয় । দুজন হেল্পার রাখে। সব আশ্রমের ওরাই যোগাড় করে দেয়। এখন আর নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই অমৃতার। কোনকিছু ভাবার ও সময় নেই। সারাদিন কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সকালে উঠে বাজারে যেতে হয়। আজ কি রান্না হবে সেই মেনু অনুযায়ী বাজার করে এনে দুপুর একটার মধ্যে খাবার দিয়ে দিতে হয়। সবাই তো বয়স্ক মানুষ। দেরী করা চলে না। আরো দুটি মেয়ে আছে। বেশ চটপটে। ভালোই কাজ করে। দেখতে দেখতে একমাস কেটে গেল। এখন বেশ অনেকটা সরবর হয়েছে কাজে অমৃতা। ওদের ও অমৃতার হাতের খাবার খুব ভালো লাগে।
তবে মনের মধ্যে চাপা কষ্টটা তো থেকেই যায়। সব কাজের ফাঁকে মাঝে মাঝে বড় একা লাগে। বিশেষ করে যখন কোন পরিচিত মানুষের সাথে দেখা হয়ে যায়। তারা না বুঝে অনেক উল্টাপাল্টা কথা বলে দেয় । তাদের চোখে সে স্বামী পরিত্যক্তা নারী ছাড়া আর কিছুই না। ভীষণ অবজ্ঞার চোখে দেখে।
এই তো সেদিন দুলু মাসির সাথে দেখা হয়েছিল বাজার করতে গিয়ে। মায়ের দূর সম্পর্কের বোন। আগে খুব আসতো আমাদের বাড়িতে। মানে বাবার বাড়িতে। সেদিন দুই ব্যাগ বাজার করে যখন রিক্সায় উঠতে যাবো তখন মাসি পিছন থেকে ডাক দেয়। “আরে অমৃতা না ? এতো বাজার করেছিস কার জন্য ? শুনলাম তো তুই বরকে ছেড়ে চলে এসেছিস ?”
প্রথম দেখাতেই এই প্রশ্ন । আমি কেমন আছি জানতে চাইলো না । কি উত্তর এদের দেওয়া যায় ?
যাইহোক ,মাথা ঠান্ডা রেখে বললাম ঠিকই শুনেছো মাসি। আমি বরকে ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছি। কেন বলো আমাকে ডাকলে ? আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে।
হ্যাঁ, সেতো হচ্ছে বুঝতে পারছি। লোকের হাতের কাজ তো ? তা বলছি বরকে ছেড়ে দিয়ে এই যে লোকের রান্না করে বেড়াচ্ছিস , এটা ভালো লাগছে ?কত বড়লোকের মেয়ে বৌ তুই ? তুই তো আমাদের মান সন্মান ডুবিয়ে দিলি একেবারে ? লোকের কাছে পরিচয় দিতেও খারাপ লাগে।
তা তো বুঝলাম। আমার পরিচয় দিতে যদি তোমার এতো লজ্জা লাগে তাহলে আমাকে ডাকলে কেন ? না ডাকলে তো আর কথা বলতে হতো না। মুখ দেখতে হতো না। তোমার লজ্জাও লাগতো না মাসি।
তুই তো খুব ব্যাকা ব্যাকা কথা শিখেছিস ? ভাবলাম দুটো ভালো মন্দ পরামর্শ দেবো তাই ডাকলাম । শুনলাম তোর বাবাও নাকি তোকে জায়গা দেয়নি ? তাই কি করছিস, কোথায় আছিস জানতেই ডাকলাম। এমনভাবে বলবি জানলে ডাকতাম না।
আসলে তা নয় গো মাসি। তুমি তো আমার জন্য ডাকোনি ? আমি কতটা খারাপ আছি সেটা জানার জন্যই ডেকেছো । কেউ আশ্রয় দিলো না । তাহলে রাস্তায় বসে ভিক্ষা করছি কিনা , সেটা জানার যে তোমার বড় কৌতূহল দেখতে পাচ্ছি মাসি। যাই হোক আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে। এখন আসি গো।
তা এখনো কি ঐ বন্ধুর বরের ফ্ল্যাটে আছিস নাকি ? বলে মুখ টিপে হাসে মাসি।
মাসির ইঙ্গিত দেখে মাথার মধ্যে ধপ করে আগুন জ্বলে যায়। একটি মেয়ে যদি কোন কারনে সংসার করতে না পারে ;যদি ভেঙে যায় তার সংসার তাহলেই কি সে চরিত্রহীন হয়ে যায় ?তাও আর একটি মেয়ের কাছে ? যে তার আপনজন বলে দাবী করছে ? না , আর কিছুক্ষণ এর সাথে কথা বললে মাথা ঠিক রাখা যাবে না। এখনই বিদায় করতে হবে একে।
বলছি মাসি তোমার তো এতো বড়বাড়ি। তা দাওনা আমাকে কিছুদিন থাকতে। দেখি তোমার উদারতা।
এবাবা ! তুই ওখানে কিভাবে থাকবি ? পাঁচজনে পাঁচকথা বলবে না ? তাছাড়া তোর মেসোকে আমি কিকরে বলবো এসব কথা ? ছিঃছিঃ । এসব কি বলা যায় যে তুই জামাইকে ছেড়ে চলে এসেছিস ?
জানতাম তো তুমি এই উত্তরটাই দেবে । দূর থেকে সমালোচনা করা যায়। কিন্তু কাছে এসে সহযোগিতা করার লোকের বড় অভাব জানো তো মাসি। আমি খুব ভালো আছি। কারো ফ্ল্যাটে নেই। ঘরভাড়া নিয়ে স্বাধীন ভাবে থাকি। খবরদারি করার কেউ নেই। আর প্লিজ তোমরা আমাকে নিয়ে আর ভেবোনা। বরং সুকন্যাকে নিয়ে ভাবো। শুনেছি ওকেও নাকি শশুরবাড়িতে জ্বালাকষ্ট দেয়। বর ধরে মারে। তোমরা তো ওর বাবা- মা । পারোনা মেয়েকে কাছে এনে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে দিতে ? যে মেয়েকে তোমরা এতো স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে মানুষ করেছো, কখনো গায়ে হাত দাওনি সে অন্যের বাড়িতে বসে মার খাচ্ছে ? কেন এমন হবে ? আমার বাবার মতো ভুল করো না মাসি। এখনো সময় আছে। সুকন্যার পাশে দাঁড়াও। বলেই রিক্সায় উঠে যায় অমৃতা।
কি বলে গেল মেয়েটা ? সত্যিই তো এভাবে কখনোই ভেবে দেখিনি। শুধু ভেবেছি লোকে কি বলবে ? তাইতো মেয়েকে মেনে নিতে আর মানিয়ে নিতে বলেছি। কিন্তু ওরা যদি অত্যাচার করতে করতে মেয়েটাকে মেরে ফেলে ? না, না । অমৃতা ঠিক কাজ করেছে। আমি এবার সুকন্যার পাশে দাঁড়াবো। দরকার হলে ওকে বের করে নিয়ে আসবো শ্বশুর বাড়ি থেকে। সে লোকে যাই বলুক না কেন ? মনে মনে ভাবে অমৃতার মাসি। আস্তে আস্তে অমৃতার রিক্সাটি দূরে মিলিয়ে যায়।
চলবে—-
All rights are reserved by paramita.