নিজের পরিচয়ে বাঁচতে চাই পর্ব-৯

0
202

নিজের পরিচয়ে বাঁচতে চাই।(পর্ব–৯)
কলমে–পারমিতা মন্ডল।

অমৃতা আজ অনেক পরিনত । শক্ত হয়েছে পায়ের তলার মাটি। অন্তত নিজের রোজগারে ঘর ভাড়া দিয়ে থাকতে পারছে স্বাধীন ভাবে।না, রাতুল তাকে আর কোন বিরক্ত করেনি। এটাই তার কাছে আশ্চর্যজনক বিষয় । যে বাড়ি বয়ে এসে এতোগুলো বাজে কথা বলে গিয়েছিল, সে কেন হঠাৎ করে চুপ করে গেল ? অনেক কিছু তো বলেছিল । পুলিশ নিয়ে আসবে, নোংরা নোংরা ইঙ্গিত করেছিল । তাহলে হঠাৎ চুপ করে গেল কেন ? যাকগে, ওর কথা ভাবার আমার আর সময় নেই । ডিভোর্সটা কোন ঝামেলা না করে দিতে রাজি হয়েছে সেই অনেক । ওদের নিয়ে আমি আর ভাববো না । ডিভোর্স হয়ে গেলে রাতুল আবার বিয়ে করতে পারবে। জীবনটাকে নতুন ভাবে সাজিয়ে নেবে । এবার নিশ্চয় ওর মনের মত বৌ পাবে ।

ধুর, আমি কি রাতুলের কথা বেশী ভাবছি ? না, না আমি তো ওকে চাই না। তাইতো ছেড়ে চলে এসেছি। ডিভোর্সের ফাইল ও জমা পড়ে গেছে। কিছু দিনের মধ্যে হয়তো ডিভোর্সটা হয়েও যাবে । তাহলে মানুষ কেন বলে” বিবাহ হলো সাত জন্মের বন্ধন ? “এটা কি ভুল কথা ? আমার তো এক জন্মেই সব শেষ হয়ে গেল ? আমি কি রাতুলকে ভালোবাসি ? ছেড়ে দিতে কষ্ট হচ্ছে ? এসব কি ভুলভাল ভাবছি আমি ? আমি তো নিজেই ছেড়ে চলে এসেছি।

না, না । ফিরে গেলে আবার সেই অশান্তি হবে । একটু ,একটু করে জমে থাকা ক্ষোভ আবার বেরিয়ে আসবে । তিক্ততা বাড়বে। হয়তো আমার এই লড়াই করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোটাই বৃথা হয়ে যাবে । তাছাড়া রাতুলও তো কখনোই ভালোবেসে তার কাছে আসেনি । তাহলে সেও হয়তো আর চায় না আমাকে। তার চেয়ে এই ভালো। আলাদা থাকা। ওকে মুক্তি দিয়ে দেবো। আর তো কয়েকটা দিন। তবুও কেন কষ্ট হচ্ছে ? আসলে ভালো না বাসলেও এক ছাদের তলায় তো অনেকদিন ছিলাম। বাড়িতে একটা বিড়াল থাকলেও তো মায়া পড়ে যায়। তাই হয়তো কষ্ট হচ্ছে।সবকিছু মন থেকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া এতো সহজ নয়। তবুও আমাকে পারতে হবে। দূর্বল হলে চলবে না।

হঠাৎ ফোনটা বেজে ওঠে । সম্বিত ফিরে পায় অমৃতা। এখনো সেই মেসোমহাশয়ের বাড়িতেই আছে ।পাশের বড় ঘরটা ভাড়া নিয়েছে। বাথরুম এখন আর অন‍্যের সাথে সেয়ার করতে হয়না । নিজের মত সব কিছু গুছিয়ে নিয়েছে অমৃতা। সংসার আগের থেকে অনেক স্বচ্ছল। ইচ্ছা আছে একটি দোকান নেওয়ার । কিন্তু তার আগে ডিভোর্সটা হয়ে যাওয়া দরকার। দু’বছর তো হয়ে গেল ওরা আলাদা আছে।

“আরে কোন কথা বলছিস না কেন ? কিরে অমৃতা ? কেমন আছিস ? “ফোনের ওপারে সুজাতা একটানা বলে চলেছে।

“হ‍্যাঁ, খুব খুব ভালো আছি রে । তোরা কি আমাকে খারাপ থাকতে দিবি ? প্রকৃত বন্ধুর মত কাজ করেছিস তো ? তোদের জন্যই আজ আমি স্বাধীন । নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছি।”খুব খুশিতে বলে অমৃতা।

“আমাদের জন্য নয় সোনা । ওই ক্ষমতা তোমার নিজের মধ্যেই ছিল। তুমি জানতে না। আমরা শুধু প্রকাশ করতে সাহায্য করেছি। তুই ভালো আছিস , তাতেই আমরা খুশি।বলে সুজাতা।

সে যাই হোক না কেন ঐ সময় তুই আর প্রনীলদা যদি শক্ত হাতে আমার হাত না ধরতিস তাহলে আমি হয়তো অন্ধকারে ডুবে যেতাম।কোনকিছু না ভেবে তো রাগ করে বেরিয়ে এসেছিলাম। কিছুই ছিল না। এমনকি মাথার উপর ছাদটাও ছিল না। তোদের অবদানের কথা কোনদিন ভুলবো না রে!

“নে হয়েছে অনেক ! ছাড় ওসব পুরনো কথা। ওগুলো যত মনে করবি মন ততই খারাপ হবে। এখন তোর আনন্দ করার সময়। পুরনো কথা একদম ভাববি না । আর পিছনে ফিরে তাকাবিও না। যা ফেলে এসেছিস সব ভুলে গিয়ে নতুন ভাবে শুরু কর।

শোন আমি যে জন্য তোকে ফোন করেছি। আমাদের সামাজিক মতে বিয়ের দিন ঠিক হয়েছে। ডিসেম্বরের কুড়ি তারিখে। তুই কিন্তু সাতদিন আগেই আসবি। কোন কথা শুনবো না। ”

চমকে ওঠে অমৃতা । ডিসেম্বরের কুড়ি ? ঐ দিন যে ওদের ডিভোর্সের ডেট পড়েছে ? ঈশ্বরের কি লীলাখেলা ? কেউ ভাঙে কেউ গড়ে। দিনটা কিন্তু একই থাকে।সেদিনটা সুজাতার জীবন আলোয় আলোয় ভরে যাবে। খুশি উপচে পড়বে । আর অমৃতার জীবন হবে অন্ধকার। শাখা সিঁদুর মুছে সে প্রকৃত অর্থে সামাজিক ভাবে একা পথ চলা শুরু করবে। না , তাতে অমৃতার কোন দুঃখ নেই। একটি ভাঙা সম্পর্ককে বয়ে নিয়ে বেড়ানোর থেকে শেষ করে দেওয়া অনেক বেশী সুখের।

সুজাতাকে কিছুই বলেনা অমৃতা । কারন বহু প্রতিক্ষার পর ওদের জীবনে আসতে চলেছে সেই দিন। শুধু শুধু নিজের কথা বলে ওর মনটাকে খারাপ করা ঠিক নয়। মেয়েটা অনেক করেছে তার জন্য। সবার বিরুদ্ধে গিয়ে লড়াই করেছে। অমৃতাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে । তাই তার এই বিশেষ দিনে যতই অমৃতার কষ্ট হোক না কেন তাকে যেতেই হবে। সব কষ্ট বুকে চেপে রেখে সে ঠিক হাসি মুখে অমৃতার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। আনন্দ করবে খুব। সে নিজেও তো সেদিন স্বাধীনতা পাবে। এটাই তো সে চেয়েছিল। তবে কষ্ট কেন পাবে ?
হাসি মুখে বলে অমৃতা-“অবশ্যই যাবো। এটা আবার বলতে হবে নাকি ? আমি ভাবছি একমাস আগেই যাবো। বলে হি হি করে হেসে ওঠে অমৃতা।

আজ ২০ শে ডিসেম্বর । সুজাতার বিয়ে। বাড়িভাড়া নেওয়া হয়েছে । দুজনেই চাকরি করে। তাই জাঁকজমকের কোন অভাব নেই।অমৃতাকে আজ মিথ্যা কথা বলতেই হয়েছে।বৃদ্ধাশ্রমে খাবার দিয়ে হোম ডেলিভারী করে সন্ধ্যার দিকে যাবে। যদিও এখন হেল্পিং হ‍্যান্ড অনেক আছে। অমৃতা না থাকলেও তেমন অসুবিধা হয়না। ওরা চালিয়ে নিতে পারে।কিন্তু আজ যে ওর ডিভোর্সের তারিখ পড়েছে। ওকে তো যেতেই হবে। তাই এইটুকু মিথ্যা সুজাতাকে বলতেই হয়েছে।ওর এই সুখের দিন মনটা ভারাক্রান্ত করে দিতে চায়নি অমৃতা।

কি সুন্দর সাজিয়েছে বাড়িটাকে ! অপূর্ব লাগছে। সানাই বাজছে মৃদুসুরে। সানাইয়ের সুরে মন যেন কেমন করে ওঠে। সানাই যেন কেঁদে কেঁদে বিদায় জানায়, বলে–” এবাড়িতে তোমার পাট চুকলো। যাও পাখি বাসা বাঁধো অন্য কোন ডালে ” — এমনই মনে হয় অমৃতার বরাবর। আজ যেন একটু বেশী মনে হচ্ছে। কোনকিছু কি মনে পড়ে যাচ্ছে ? এই তো সেদিন এই বাড়িতেই বধুবেশে সেও বসেছিল। চারদিকে এমনই লোকজন আত্মীয় স্বজন ঘিরেছিল তাদের। কত হৈচৈ, হাসি ঠাট্টা হয়েছিল সেদিনও। রাতুল এসেছিল বরবেশে । পিসি বরণ করতে গিয়ে কি কান্ডটাই না করেছিল ? নতুন পাঞ্জাবীতে মিষ্টি ফেলে দিয়েছিল। তাই নিয়ে কত হাসাহাসি। আসলে পিসি তো চোখে কম দেখতো। তাই এই বিপত্তি। মনে মনেই হেসে ওঠে অমৃতা।

“আরে অমৃতা , তুমি কখন এলে ? এসো এসো । তোমার বন্ধু তোমার জন্য অপেক্ষা করছে কখন থেকে। “এগিয়ে আসে প্রনীল।

এখানে অনেকেই আজ আসবে যারা অমৃতাকেও চেনে। বন্ধু তো সব এক ছিল। তারপর একই পাড়ার মেয়ে। অনেকের সাথে দেখা হয়ে যেতে পারে। তাই একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যেতে হবে। আজ মনটাও তেমন ভালো নেই। এতো বছরের সম্পর্ক একটি সইতে কি শেষ হয়ে যায় ? আজ থেকে রাতুল আর আমি আইনী মতে আর স্বামী স্ত্রী নয় । কিন্তু কত ভালো স্মৃতি, খারাপ স্মৃতি ওর সাথে জড়িয়ে আছে সেগুলো কি এতো সহজে ভুলে যাওয়া যায় ? পারছি না তো ভুলতে।

“এতো দেরী করে এলি তুই ? সবার আগে তোর আসার কথা ছিল। “গাল ফোলায় সুজাতা।

“আরে তুই জানিস আমার কাজ। সব সামলে আসতে একটু দেরী হয়ে গেল। এই আছি। এখন অনেকক্ষন থাকবো। রাগ করিস না।”–বলে অমৃতা।

“ঠিক আছে, ঠিক আছে । মাফ করে দিলাম ।” বলে খিলখিল করে হেসে ওঠে সুজাতা।

কি মিষ্টি ওকে লাগছে। বলে দাঁড়া আমার বন্ধুদের সাথে তোর আলাপ করিয়ে দেই। “এই রিকিতা ,তোরা এদিকে আয় একবার। ” বলে কাউক ডাক দেয় সুজাতা।

ওরা সব ঝাঁক ধরে দৌড়ে আসে। পরিচয় করিয়ে দেয় ছোট বেলার বন্ধু অমৃতার সাথে। এর মধ্যেই চলে আসে পাড়ার লোকজন। বিনিতা পিসিও আছে তার মধ্যে। দূর থেকে দেখেও চিনতে পারে অমৃতা। আগে বাপের বাড়িতে এলেই পিসি আসতো। পাশের বাড়িতে থাকে। খুটিয়ে খুটিয়ে সব জানতে চাইতো আমি কেমন আছি ? বর যত্ন করে কিনা ? শাশুড়ি কতটা জ্বালা কষ্ট দেয় ? সংসারে কার কতৃত্ব চলে ?আমার না শাশুড়ির ? এসবে খুব উৎসাহ ছিল পিসির। এখন কি আর ছাড়বে ? এতো সুন্দর টপিক যদি জানতে পারে তবে কি আর হাতছাড়া করবে ? তারচেয়ে চুপিচুপি সরে যাই। যেই পা বাড়িয়েছি অমনি পিছন থেকে ডাক দিলো পিসি —-

–“আরে অমৃতা না ? কিরে , কেমন আছিস ? চিনতে পারছিস না ? আমি বিনিতা পিসি রে ! মুখখানা যে একেবারে শুকিয়ে গেছে ? তা তোর বর আসেনি ? কোথায় দেখছি না যে ?”

এক নিঃশ্বাসে এতোগুলো কথা বলে গেল পিসি। জানি পিসি এটা ইচ্ছা করে বলছে। সব জানে । তবুও সবার মাঝে অপদস্থ করার ইচ্ছা। কিন্তু এতোদিনে ঘা খেতে খেতে অমৃতা শক্ত হয়ে গেছে। এসব কথা এখন আর গায়ে লাগে না।
ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে অমৃতা ” না গো পিসি আসেনি। তুমি তো সব জানো। আমরা একসাথে থাকি না। আমাদের ঝামেলা চলছে। ডিভোর্স হয়ে গেছে । তাও কেন বলছো বলোতো ? আমার মুখ থেকে শুনবে বলে ?”

অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে পিসি। এমন উত্তর পাবে ভাবতে পারেনি। মনে মনে বলে সত্যিই তো মেয়েটা ভারী পাঁজি হয়েছে ? সবার সামনে কেমন আমাকে অপমান করে দিল ? বেশ হয়েছে, বর ছেড়ে দিয়েছে !

“কি ভাবছো পিসি ? বেশ হয়েছে বর ছেড়ে দিয়েছে তাই না ? বলে মিটিমিটি হাসতে থাকে অমৃতা। তবে শোন বর আমাকে ছাড়েনি । আমি ওকে ছেড়ে দিয়েছি। বুঝলে ?

“এই মেয়ে কি মনের কথাও পড়তে পারে নাকি ? ওরে বাবারে ? এখানে আর থাকা যাবে না । “পিসি অমৃতাকে এড়িয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যায়।

হঠাৎ সুজাতার বন্ধু সৌহার্দ্যর চোখ যায় অমৃতার দিকে। বলেন– আপনাকে খুব চেনা লাগছে । কোথায় যেন দেখেছি ! ঠিক মনে করতে পারছি না ম‍্যাডাম। কোথায় দেখেছি বলুন তো ?
দেখুন আমি তো এই শহরেই থাকি। রাস্তা ঘাটে চলাফেরা করি। কোথাও না কোথাও দেখে থাকবেন হয়তো।

তাই হবে । কিন্তু না ,আমি বিশেষ কোন জায়গায়, খুব কাছ থেকে আপনাকে দেখেছি। এবার মনে পড়েছে। আপনি সুজাতার বন্ধু ?

হ‍্যাঁ, আমি সুজাতার বন্ধু। এবং খুব কাছের বন্ধু। তাই তো আজও আসতে হলো । আমিও আপনাকে চিনতে পেরেছি। কিন্তু সুজাতাকে এখন কিছু বলবেন না। ও ব‍্যপারটা জানে না। আমি পরে ওকে বলবো। আজ ওর জীবনের একটি বিশেষ দিন।
ঠিক আছে বলবো না । বলে সৌহার্দ্য।

“বর এসেছে বর এসেছে”– বলে সবাই হৈ হৈ করে ওঠে। সবাই দৌড়ে ছুটে যায় বর দেখতে । ঘন ঘন উলুধ্বনি ও শঙ্খ বেজে ওঠে। সানাইটাও যেন বেশ জোরেই বেজে ওঠে ।অমৃতা দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। কিছু কি তার মনে পড়ছে ?সেকি কষ্ট পাচ্ছে ,? এমন সময় পাশে এসে দাঁড়ায় সৌহার্দ্য।চোখের জল মুছে ঘুরে দাঁড়িতে গিয়ে চোখাচোখি হয় দুজনের।

কে এই সৌহার্দ্য ? জানতে চোখ রাখুন আগামী পর্বে।

  • চলবে —
    All rights are reserved by paramita mandal

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here