নিজের পরিচয়ে বাঁচতে চাই পর্ব-১০

0
204

নিজের পরিচয়ে বাঁচতে চাই ।( পর্ব–১০)
কলমে– পারমিতা মন্ডল।

সুজাতাকে নিয়ে গেছে মন্ডপে । এখনই বিয়ে শুরু হবে। আজ থেকে ওরা সাতজন্মের বন্ধনে আবদ্ধ হবে। দেখো ঈশ্বর ওদের জীবনে যেন আমার মত ঝড় কোনদিন নেমে না আসে।তুমি এদের সুখী করো। বলে দুহাত জোড় করে ভগবানের উদ্দেশ্যে প্রনাম করে অমৃতা।

তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে হবে । কাল আবার অনেক কাজ। আশ্রমে নাকি আরো নতুন দু’জন মহিলা এসেছেন। দেখা হয়নি এখনো তাদের সাথে। যদিও ওনাদের দেখাশোনা করার কাজ অমৃতার নয়। তবুও সবাইকে সে জিজ্ঞাসা করে খাবার কেমন হয়েছে ? মতামত নেয় ওনাদের থেকে । চেষ্টা করে মোটামুটি সবার আবদার রাখতে। তাই তো ওনারা অমৃতাকে খুব ভালোবাসেন। ওর আনা খাবার খুব পছন্দ করেন সবাই।

শাখ বাজছে । ঘন ঘন উলুধ্বনি পড়ছে। এই মনে হয় বিয়ে শুরু হলো ।

“একি আপনি এখানে একা কেন দাঁড়িয়ে আছেন ? চলুন বন্ধুর বিয়ে দেখবেন না ? ” কখন যে পিছনে সৌহার্দ্য এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি অমৃতা।

চমকে ওঠে অমৃতা । “ও আপনি ? হ‍্যাঁ চলুন । বিয়ে তো দেখতেই হবে । বন্ধুর বিয়ে বলে কথা । তা আপনি মন্ডপে না গিয়ে এখানে কেন ?”

” আমিও এদিক দিয়ে মন্ডপেই যাচ্ছিলাম। আপনাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লাম। চলুন এক সাথে যাওয়া যাক। বলছি এখন কিন্তু আমি আপনার বিরোধী পক্ষ নয়। বন্ধু ভাবতে পারেন। “– বলে মিটিমিটি হাসে সৌহার্দ্য।

“না, না সে কি কথা ? ওটা তো আপনার কাজ ।আপনার পেশা । তার সাথে সম্পর্ক গুলিয়ে ফেললে কি করে হবে ? তাছাড়া আপনি সুজাতার বন্ধু। ”

হ‍্যাঁ, ঠিকই বলেছেন । ওটা আমাদের কাজ । এমন অনেক কাজ আমাদের করতে হয়। পেশার খাতিরে । দুটো সম্পর্ককে ভেঙে দেওয়ার জন্য যুক্তি খাড়া করতে হয়। সব সময় যে সঠিক থাকে তা বলবো না। কিন্তু কি করি বলুন তো ? কাজ তো কাজই হয় । মক্কেলকে জেতানোর জন‍্য আমরা টাকা পাই । তবে চেষ্টা করি সৎ পথে থেকে লড়াই করার। অন‍্যায়ের সাথে আপস না করার। তবুও মাঝে মাঝে হেরে যাই নিজের কাছে। ভাঙন রোধ করতে পারি না ।আজ যেমন আপনার সাথে হলো ? ভেঙে গেল সম্পর্কটা।

এখানে আপনাদের তো কোন দোষ নেই। কি করা যাবে বলুন ? আমরা দুজন যে এক সাথে আর থাকতে পারলাম না।
আপনার হ‍্যাজবেন্ড মানে রাতুলবাবু কিন্তু শেষের দিকে চেয়েছিলেন সব কিছু মিটিয়ে নিতে। সম্পর্কটাকে আবার জোড়া লাগাতে । আমাকে বলেও ছিলেন। সেভাবেই আমি চেষ্টা করছিলাম । কিন্তু আপনি —

থাক ওসব কথা । চলুন মন্ডপে যাই। সবাই অপেক্ষা করছে।

বিয়ে শুরু হয়েছে। চলছে কত হাসি ঠাট্টা। কিন্তু অমৃতার কেন বারবার একজনের মুখ ভেসে উঠছে। এতোদিন তো এমন হয়নি ? আজ প্রায় এক বছর পর রাতুলকে দেখলো অমৃতা। সেই আগের মত চেহারা আর নেই। শরীর ভেঙে গেছে। কেমন যেন ঝুঁকে গেছে সামনের দিকে । কি হয়েছে ওর ? কোন কি কঠিন অসুখ করেছে ? না, না আর ভাববো না ওর কথা। যে সম্পর্ক ভেঙে গেছে অকারণে তাকে টেনে এনে কষ্ট পাওয়ার কোন মানে হয়না।

সৌহার্দ্য ছিল ওদের পক্ষের উকিল। অনেক চেষ্টা করেছিল যাতে সম্পর্কটা আবার জোড়া লাগে। হয়তো রাতুল বলেছিল। কিন্তু অমৃতা চায়নি কোন ভাবেই আর ওদের সাথে জড়াতে। সে মুক্তির আনন্দ পেয়েছে। দরকার হলে সারাজীবন একা থাকবে । তবুও আর কোনদিন ঐ খাঁচায় ফিরে যাবে না।

কিন্তু অমৃতা ভাবেনি এখানে এসে সৌহার্দ্যর সাথে দেখা হয়ে যাবে ? ওদের ডিভোর্সটা আজই হয়েছ। সুজাতা যদি জানতে পারে তবে ওর মন খারাপ হতে পারে। আজ তো ওর, বিয়ে কত আনন্দের দিন। তাই সে সৌহার্দ্যকে বারন করেছিল সুজাতাকে যেন কিছু না বলে। পরে সে নিজেই সুযোগ মত বলবে।

বিয়ে মিটতেই বাড়িতে ফিরে আসে অমৃতা। “ইস্ ! কত রাত হয়ে গেল ফিরতে । এখন আবার কালকের কথা ভাবতে হবে । কি বাজার হবে , কি রান্না হবে সব অমৃতা ঠিক করে দেয়। তারপর ওরাই সব করে। এখন আর নিজের হাতে তেমন কিছু করতে হয়না। শুধু দেখা শোনা করলেই চলে। সামনের মাসে একটা বড় রেস্টুরেন্ট খোলার ইচ্ছা আছে। লোনের জন্য দরখাস্ত করেছে। পেয়ে গেলেই খুলে ফেলতে পারবে। এভাবেই এক পা এক পা করে নিজের স্বপ্ন পুরনের দিকে এগোচ্ছে অমৃতা। কে বলেছে মেয়েরা অবলা ? শুধু মনের জোর রাখতে হবে। তবেই পুরুষের চেয়ে অনেক এগিয়ে যাবে মেয়েরা।

পাখি ডাকছে । ভোর হয়ে গেছে । কাল যে কখন ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়াল নেই। তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে অমৃতা। আজ একবার তাকে আশ্রমে যেতে হবে। নতুন দু’জন এসেছে। তাদের সাথে দেখা করতে হবে। যদিও এটা বাধ্যতা মূলক নয়। তবে অমৃতা করে।

দুপুর একটা নাগাদ অমৃতা আশ্রমে যায়। সবাই তখন খেতে বসে। হাসিমুখে সবাইকে জিজ্ঞাসা করে, খাবার কেমন লাগছে ?রান্না কেমন হচ্ছে ? তাদের পছন্দ হয়েছে কিনা ? অন‍্যরকম কিছু চাই কিনা ? এটা এই বৃদ্ধাশ্রমের সবচেয়ে বড় পাওনা। অন্য জায়গায় এমনটা হয় না। যা দেয়, তাই খেতে হয়। কিন্তু অমৃতা যতটা পারে চেষ্টা করে এদের মন রেখে খাবার বানাতে। তাইতো সবাই এমনকি ম‍্যানেজার ও অমৃতাকে খুব পছন্দ করে। আর এজন্য লোকসংখ্যাও অনেক বেড়ে গেছে আশ্রমের।

ঐ কোনায় নতুন এসেছে সবিতা দিদা। ছেলে বৌ বিদেশে চলে গেছে। তাই ওনাকে এখানে রেখে গেছে। তার পাশেই আছেন প্রতিমাদি। উনিও কাল এসেছেন । স্বামী মারা গেছেন সদ‍্য । আবার একমাত্র ছেলের দূরে কোথায় যেন ট্রান্সফার হয়ে গেছে।সেখানে ছেলের সাথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া ছেলে বৌয়েরও ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। তাই এখানে রেখে গেছে।

নামটা শুনে চমকে ওঠে অমৃতা । না, না এসব কি ভাবছি ? এক নামের তো অনেকেই থাকতে পারে । ধুর , কিসব ভুলভাল ভাবছি আমি ? বলেই উঠে পড়ে । এবার যেতে হবে। অনেক কাজ পড়ে আছে। আসি গো দিদারা। আবার কাল আসবো ?
হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন ডাক দেয় -“বৌমা ” বলে ।
আবার ও চমকে ওঠে অমৃতা । এসব কি হচ্ছে তার সাথে ? কি শুনছে সে ? কে ডাকছে বৌমা বলে ?

না, ভুল তো শুনছে না ? ঐ তো কোনের নতুন আসা ঐ দিদা তাকে বৌমা বলে ডাকছে । তাহলে কি —?

কাছে এগিয়ে যায় অমৃতা । প্রতিমা দেবী খপ করে অমৃতার হাত চেপে ধরে । “আমাকে ক্ষমা কর বৌমা। আমি তোমার সাথে অনেক অন‍্যায় করেছি। এখন তার ফল ভোগ করছি। তুমি আমার ঘরের লক্ষ্মী। ফিরে চলো মা । আমি তোমাকে কত খুঁজেছি জানো ? কেউ খোঁজ দিতে পারেনি। খোকা হয়তো জানতো । কিন্তু আমাকে বলেনি। এখানে এসে তোমার সাথে দেখা হয়ে যাবে ভাবতে পারিনি আমি। আমাকে ক্ষমা কর মা ।”বলে জড়িয়ে ধরে অমৃতাকে।

এই আমার সেই প্রভাবশালী শাশুড়িমা । যার কিনা আমার কোন কিছুই পছন্দ হতো না। পদে পদে আমাকে অপদস্থ আর অপমান করতো। আজ তার এ কি করুন পরিনতি ? অবশেষে বৃদ্ধাশ্রমে আসতে হলো ?

সবাই তাকিয়ে আছে অমৃতার দিকে। এরা জানতো অমৃতার কেউ নেই। একা থাকে। তাহলে ? খুব খারাপ লাগছে অমৃতার। তবুও মন শক্ত করে বলে–

“আপনি ভুল করছেন মাসিমা । আমি আপনার বৌমা নয়। আমি অমৃতা । আমার একটা আলাদা পরিচয় আছে। আমি হোম ডেলিভারী করি। এই আশ্রমে সবার খাবার সাপ্লাই দেই। আমি আপনার বৌমা নয়।”

জানি তুমি আমাকে ক্ষমা করবে না । অনেক অন‍্যায় করেছি তোমার সাথে। তাই তো আমার ওতো বড় বাড়ি, টাকা পয়সা সব থাকতেও এই বৃদ্ধাশ্রমে স্থান হলো। খোকা খুব অসুস্থ। তারপর ট্রান্সফার হয়ে গেছে। সেখানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আর মেয়ে তো বিদেশে থাকে। তুমি থাকলে তাও বাড়িতে থাকতে পারতাম। ফিরে চলো না বৌমা। আমি আর কখনোই তোমার সাথে খারাপ ব‍্যবহার করবো না।”- বলে হাত চেপে ধরে প্রতিমাদেবী।

কোনরকমে হাত ছাড়িয়ে চলে আসে অমৃতা । হায় ঈশ্বর ! এ তোমার কেমন খেলা ? কেন ভাঙলে আর কেনই বা আবার গড়তে চাইছো ? আমি তো মন থেকে সম্পূর্ণভাবে ওদের মুছে ফেলেছি। তাই ক্ষমাও করে দিয়েছি। তবুও কেন এতোদিন পর আবার ওনার সাথে দেখা হলো ? আজ তো সত্যিই আমি ওদের কেউ না । ডিভোর্স যে হয়ে গেছে । ওনাকে দেখে বড় কষ্ট হচ্ছে মনে কি করবো এখন আমি ?

চলবে—–
All rights are reserved by paramita mandal.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here