#ভুলবশত_প্রেম পর্ব ৩৮
#লেখনীতে:সারা মেহেক
৩৮
আদ্রিশের লেখা পড়ে মনের অজান্তে আমার ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। কাগজটি ভাঁজ করে আমি আদ্রিশের দিকে চাইলাম। রাস্তার হলদে সাদা আলোয় উনার মুখশ্রীতে তৃপ্তির হাসি দেখলাম। উনি আমায় পরের কাগজটি খুলতে বললেন। উনার কথামত আমি তৃতীয় কাগজটি খুললাম। সেখানে লেখা,
” অভিমানী স্ত্রীর চেহারাটা কেমন হয় তা দেখার ইচ্ছে বহুদিনের। জানি, এতক্ষণে তোমার অভিমানী চেহারার দর্শন করে ফেলেছি আমি এবং নিঃসন্দেহে তা অপরূপ, অতুলনীয়৷ খুব ইচ্ছে হচ্ছে, তোমার অভিমানী গালে এই আঙুলগুলো ছোঁয়াতে। অতঃপর আমার ছোঁয়ায় তোমার লজ্জা মিশ্রিত মুখখানা দেখতে। তুমি না ভীষণ লাজুক মেয়ে। অতিরিক্ত লাজুকতায় পূর্ণ মেয়ে আমার সহ্য হয় না। কিন্তু তোমার এ লাজুকতাই যেনো তোমার আরেকটি পরিচয়। তুমি যেনো এই লাজুক ভাবেও অপর এক সত্ত্বার অধিকারী হও৷
আচ্ছা শোনো মাধবীলতা, আমার একটা আবদার রাখবে ? জানি, আকাশসম অভিমানের কঠিন এক পাহাড় তৈরি করে বসে আছো তুমি। কিন্তু তোমায় এ আবদার না করে থাকতে পারলাম না। খুব ইচ্ছে হচ্ছে আমার মাধবীলতাকে শাড়ী পরিহিত অবস্থায় দেখতে। যে কি না এখন আমার সারাজীবনের সুখ দুঃখের সাথী৷
তোমার আদ্রিশের এ অবাধ্য মনটা খুব করে চাইছে তোমাকে ‘বউ বউ’ রূপে দেখতে এবং আজকে তোমার এ ‘বউ’ রূপটাকে মাত্রই আমিই উপভোগ করবো। আজ আর কারোর সাধ্য নেই তোমাকে বউ রূপে দেখার।
আমার দেওয়া শাড়ীটা পরে ছাদে চলে এসো মাধবীলতা। আর হ্যাঁ, বাসার কাউকে আমার কথা বলো না। আজ একটু চুপিচুপি প্রেম করতে চাই তোমার সাথে। এসো কিন্তু সময় করে। ”
আদ্রিশের এ চিঠি পড়ে আমি লজ্জায় সংকুচিত হয়ে এলাম। ঢের টের পাচ্ছি, আদ্রিশ আমায় একনাগাড়ে দেখে চলছেন৷ চিঠি পড়ে আমি উনার দিকে আর তাকানোর সাহস পেলাম না। বরং চিঠিটা ভাঁজ করে দ্রুত রুমে চলে এলাম৷ আমার হৃৎস্পন্দনের অস্বাভাবিক শব্দটা আমার কানে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। এসবের জন্য দায়ী একমাত্র আদ্রিশ। উনি যে আমায় এক মুহূর্তও শান্তিতে কাটাতে দেয় না। বড্ড খারাপ মানুষ উনি। কিন্তু উনি যে আবদার করলেন আমায় তার কি হবে? এ আবদার অগ্রাহ্য করার সাধ্য ও সাহস কোনটাই নেই আমার৷ উনার এমন মিষ্টি আবদার অগ্রাহ্য করার অর্থ সারাজীবন অপরাধবোধের সাথে সময় কাটানো। কিন্তু এও ঠিক যে আমি উনার উপর অভিমান করে আছি। তাহলে এ অভিমানের কি হবে? এ অভিমান নিয়ে কি উনার সামনে শাড়ী পরা সাজে? হয়তো সাজে না। কিন্তু আমি শাড়ী পরবো। উনার এ আবদার পূরণও করবো। তবে ক্ষীণ অভিমান নিয়ে৷ কারণ উনার কথায় আমার অভিমান অনেকটাই উবে গিয়েছে। আচ্ছা? উনি কি অভিমান ও রাগ ভাঙানোতে এতোটা পারদর্শী না কি আমিই অতি সহজে গলে গেলাম? নাহ, বুঝতে পারলাম না ব্যাপারটা।
এ নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমি চুপিচুপি আব্বু আম্মুর রুমে গেলাম এই দেখতে যে তারা দুজনে ঘুমিয়ে পড়েছে কি না। আমি পা টিপে টিপে আব্বু আম্মুর রুমের সামনে এলাম। বন্ধ দরজাটা খুব সাবধানে খুলে ভেতরে উঁকি দিলাম। হ্যাঁ, দুজনেই ঘুমিয়ে পড়েছে। এবার আভার রুমে উঁকি মারার পালা। আমি পুনরায় চোরা পায়ে ওর রুমের সামনে গিয়ে উঁকি মারলাম। হ্যাঁ, আভাও ঘুমিয়ে পড়েছে। তাহলে দু’দিকেই রাস্তা পরিষ্কার। এবার রুমে গিয়ে জলদি শাড়ীটা পরে নিতে হবে।
—-
মেরুন রঙের শাড়ী, মেরুন রঙের রেশমী চুড়ি, কানের দুল পরে খুব সাবধানে বাসার প্রধান দরজা খুলে বের হলাম আমি। এক হাতে শাড়ীর কুঁচি ধরে খুব সাবধানে হাঁটতে হচ্ছে আমাকে। সাবধানতা অবলম্বন করতে হচ্ছে দুটো কারণে। এক শাড়ী খুলে যাওয়ার ভয়, দুই হাতেনাতে ধরে পরার ভয়ে। দুটো ভয়ই আমাকে নাজেহাল করে তুলছে।
খুব সাবধানে কুঁচি ধরে এক সিঁড়ি করে উপরে উঠছি আমি৷ মাঝেমধ্যে মনে হচ্ছে, এই বুঝি শাড়ী খুলে সব জড়িয়ে ধপাস করে পরে যাবো আমি। কিন্তু সাবধানী হওয়ায় তা আর হলো না। সফলভাবেই ছাদেই পা রাখলাম আমি।
আজ আকাশে মস্ত বড় এক চাঁদ উঠেছে। কলঙ্কিনী দাগে পূর্ণ চাঁদের আলোয় নিকষ কালো প্রকৃতি রূপালী রঙে রাঙায়িত হয়েছে। কি অদ্ভুত অবর্ণনীয় তার এ সৌন্দর্যতা! আবার চারপাশে ক্ষীণ শব্দের ঝিঁঝিঁ পোকারা গান গাইতে ব্যস্ত। মৃদুমন্দ হাওয়ার তালে গাছের পাতারা নৃত্য করতে ব্যস্ত। আর আমি! আদ্রিশের অপেক্ষা করতে ব্যস্ত। ছাদে পৌঁছানোর কয়েক সেকেন্ড হলেও আদ্রিশকে দেখতে পেলাম না। উনি কি আসেননি এখনও? নিচে গিয়ে কি একবার উঁকিঝুঁকি দিয়ে আসবো?
এই ভেবে পিছনে ফিরতেই আচমকা কারোর সাথে ধাক্কা লাগলো আমার৷ ধাক্কার তাল সামলাতে না পেরে কয়েক কদম পিছিয়ে এসে পরে যেতে নিলাম আমি৷ কিন্তু এর পূর্বেই আমার কোমড় ধরে আমাকে সামলে নিলেন আদ্রিশ। চাঁদের আলোয় উনার চেহারা স্পষ্টত বিদ্যমান আমার কাছে। আমি নিজেকে পুরোপুরি সামলে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই আদ্রিশ আমায় ছেড়ে দিলেন এবং বিনাবাক্যে আমার দিকে একধ্যানে চেয়ে রইলেন উনি। উনার এ চাহনিতে স্বাভাবিকতার ছিঁটেফোঁটাও নেই। বরং উনার এ চাহনিতে মিশ্রিত আছে মা*দকতা, ঘোর যা আমায় লজ্জায় আকণ্ঠ ডুবিয়ে মা’রতে যথেষ্ট।
আমি উনার এ চাহনির সামনে টিকে থাকতে না পেরে ডান হাত দিয়ে উনার চোখ দুটো চেপে ধরে বললাম,
” আজ দেখি আপনার এ নজর দিয়েই আমাকে মে’রে ফেলবেন আপনি! ”
আদ্রিশ মৃদু শব্দে হেসে উঠলেন। আলতো হাতে আমার হাতটা সরিয়ে নিদারুণ নে’শাক্ত কণ্ঠে বললেন,
” আজ না হয় আমার চাহনিতে একটু করে মৃ’ত হও। আমি না হয় ঢের ভালোবাসা দিয়ে তোমায় জীবিত করে তুলবো।”
এই বলে আদ্রিশ আমার কোমড় ধরে আমাকে নিজের নিকটে নিয়ে এলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি কিছুটা হকচকিয়ে গেলাম। আদ্রিশ সেদিকে তোয়াক্কা করলেন না৷ বরং আমার চোখ হতে চশমা খুলে নিজের প্যান্টের পকেটে রাখলেন। অতঃপর আমার গালে আলতো করে আঙুল ছুঁয়ে দিয়ে পূর্বের ন্যায় বললেন,
” ভেবেছিলাম তোমায় দেখে আমি স্তব্ধ হয়ে যাবো। কিন্তু তুমি তো আমায় পাগল বানিয়ে ছাড়লে তোমার এ রূপে। আচ্ছা? এ রূপ এতোদিন কোথায় লুকিয়ে ছিলো? আজ তোমায় না ডেকে আনলে তো এ রূপে আমি ঘায়েল হতাম না। এবার আমার এ ঘায়েল অবস্থার উন্নতি ঘটাতে কি করবে তুমি? তোমার স্বামী কিন্তু ঘায়েল হয়েই কুপোকাত হয়ে যাবে মিশমিশ। তোমার নতুন এ অদেখা রূপে আমায় ঘায়েল না করলেও পারতে তুমি। ”
আদ্রিশের কথায় আমি টিকতে পারলাম না। লজ্জায়, অনুভূতিতে উপায়ন্তর না পেয়ে টুপ করে উনার বুকে মাথা লুকালাম আমি। দু হাত দিয়ে জাপটে জড়িয়ে ধরলাম উনাকে। উনিও মৃদু শব্দে হেসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। খানিক বাদে টিপ্পনী কেটে বললেন,
” আজ আমার বউয়ের লাজ লজ্জা সব দেখি উধাও হয়ে গিয়েছে। কি ব্যাপার বলো তো? কি মনে করে সেই লজ্জা ভুলে আমায় নিজ থেকে জড়িয়ে ধরলে?”
আদ্রিশের এরূপ কথায় আমি লজ্জা পেলাম ঠিকই। কিন্তু উনার বুক থেকে মাথা তোলার সাহস পেলাম না। কারণ এরপর উনার সেই চাহনিতে ডুবে ম’রার চেয়ে এভাবে থাকা ঢের ভালো। আমি মৃদু হেসে বললাম,
” আপনার ঐ নজর থেকে বাঁচতেই এতো কিছু করা। আপনি জানেন না আপনার ঐ দুটো চোখ কতোটা খা’রাপ!”
আদ্রিশ এবার সশব্দে হাসলেন। আমাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আমাকে উল্টো ঘুরিয়ে দিলেন। অতঃপর আমার কাঁধে থুতনি রেখে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
” আমার চোখদুটো খারাপ না কি তোমার এ রূপ, তোমার এ সৌন্দর্য খা’রাপ? যা আমাকে মোটেও ঠিক থাকতে দেয় না। আচ্ছা? আমায় দেখে কি তোমার প্রেম প্রেম পায় না?”
আমি মুচকি হেসে বললাম,
” তা জানি না। আর জানলেও আপনাকে বলবো না। আপনার মতো আমি এতো বে’হায়া নই যে মুখে যা আসবে সব বলে দিবো। ”
” এমন বে’হায়াই হতে হয় মিশমিশ। এই আমি বেহায়া না হলে তোমার প্রতি ভালোবাসা দেখতে কি করে? আর আমি তোমার এ লাজুকতায় মাখা চেহারাখানা দেখতাম কি করে?”
আমি কোনোরূপ জবাব দিলাম না। আদ্রিশ পুনরায় বললেন,
” মেরুন রঙটা যে তোমার গায়ে এভাবে মানিয়ে যাবে ভাবতে পারিনি আমি। গায়ে মেরুন রঙ, আকাশে চাঁদের আলো সব দিয়ে অপ্সরী লাগছে তোমায়। ”
আমি সশব্দে হেসে আদ্রিশের হাতে চাপড় মেরে বললাম,
” এতো তেল কিভাবে দিতে পারেন আপনি? তেলেট বুঝি দাম নেই। ”
আদ্রিশ আমার কথায় আঘাত পেয়েছে এমন ভান করে বললেন,
” আহ! প্রেমিকের অনুভূতি প্রকাশকে তেল মা’রা বলে দিলে তুমি!”
” উঁহু, প্রেমিক নয়। স্বামী। আপনার প্রেমিক নামক অস্তিত্ব এখন বিলীন হওয়ার পথে। ”
” ইশ! ভুল কথা বললে। আমি বরং স্বামী রূপেই প্রেমিক হওয়ার নতুন যাত্রা শুরু করলাম কাল হতে। এখন এই প্রেমিকের ঢের ঢের রূপ দেখবে তুমি। ”
এই বলে আমার কাঁধে অধর ছোঁয়ালেন উনি। উনার এ স্পর্শে আপাদমস্তক কেঁপে উঠলাম আমি। নিজেকে উনার থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার সকল শক্তিও হারালাম আমি।
—–
নতুন নতুন জিনিসের ইয়া লম্বা লিস্ট নিয়ে আমি ও আপু মার্কেট করতে বের হলাম। প্রথমে আদ্রিশ ও ইমাদ ভাইয়া আমাদের সাথে যেতে চাইলেন। কিন্তু আমরাই তাদের আসতে নিষেধ করলাম। বললাম, মেয়েদের শপিং এ ছেলেদের থাকা উচিত নয় এবং আমরা নিবোও না। আমাদের এ যুক্তিতর্কে ইমাদ ভাইয়া হার মানলেন না। নিজে না আসলেও আমাদের পিছু পিছু দুজনে বডিগার্ড পাঠিয়ে দিলেন।
মার্কেটে এসে আমাদের থেকে একশ হাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকার নির্দেশ দিলাম৷ বডিগার্ডদের। প্রথমে তারা রাজি না হলেও আমার হুমকিধামকিতে রাজি হলো তারা।
বেশ…..মার্কেট শেষ হওয়ার পূর্বেই আপু ওয়াশরুমে যেতে উদ্যত হলো। আপু একা থাকায় আমিও আপুর পিছু পিছু এলাম। লেডিস ওয়াশরুমে আমাদের ঢুকতে দেখে বডিগার্ড দুজনে বেশ দূরত্বে দাঁড়িয়ে রইলো।
আমি আর আপু ওয়াশরুমে ঢুকলাম। আপাতত ওয়াশরুমে কাউকে না দেখে আমরা ওয়াশরুম থেকে বেরিয় টুকটাক গল্প শুরু করে দিলাম।
আচমকা ওয়াশরুমের প্রধান দরজা খুলে নির্দ্বিধায় চার পাঁচজন লোক ঢুকে পরলো। তাদেরকে লেডিস ওয়াশরুমে প্রবেশ করতে দেখে আমি ও আপু বিস্মিত হলাম। কণ্ঠে বিস্ময় প্রকাশ করে আমি বললাম,
” আশ্চর্য! আপনারা কারা? লেডিস ওয়াশরুমে কেনো ঢুকেছেন? আপনাদের…..”
কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই তন্মধ্যে একটি লোক আমার পিছনে এসে আমার মুখে একটু রুমাল চেপে ধরলো। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হতবিহ্বল হয়ে পরলাম এবং প্রথম নিঃশ্বাস নিতে না নিতেই সামনের সবকিছু ভোঁ ভোঁ করে ঘুরতে শুরু করলো। মুহূর্তে সবকিছু ঝাপসা হয়ে এলো। বুঝতে পারছি আমার ক্লোরো’ফর্ম শুকানো হয়েছে। কিন্তু এখন কিছু করার নেই। আমার চোখজোড়া ধীরেধীরে বুজে এলো। সাথে সাথে লোকটি আমাকে তাড়াহুড়ো করে ফ্লোরে ছেড়ে দিলো। স্পষ্ট অনুভব করলাম আমার হাত পা নির্জীব হয়ে আসছে। মস্তিষ্ক নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। আধো আধো চোখে দেখতে পেলাম আপুও নিস্তেজ হয়ে আছে এবং সেই লোকগুলো আপুকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
®সারা মেহেক
#চলবে
(সবার বিশাল বিশাল কমেন্ট চাই। গত পর্বে রিপ্লাই না করতে পারায় দুঃখিত। তবে আজ রিপ্লাই করবো আমি। সবার কমেন্টের রিপ্লাই করবো)