#ভুলবশত_প্রেম পর্ব ৩৫
#লেখনীতে:সারা মেহেক
৩৫
আদ্রিশের এরূপ কথা শুনে আমি নিমিষের জন্য হতবিহ্বল হয়ে উনার দিকে চেয়ে রইলাম। তৎক্ষনাৎ আমার গলায় খাবার আটকে গেলো। আমি জোরে জোরে কাশি দিয়ে নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ব্যর্থ হলাম। আদ্রিশ আমার গলায় খাবার আটকে যেতে দেখে দ্রুত পানির গ্লাস এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। আমি খাবার আটকে যাওয়ায় অস্থির হয়ে যতদ্রুত সম্ভব পানি খেয়ে নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। অতঃপর মিনিট পাঁচেকের প্রচেষ্টায় নিজেকে পূর্বের তুলনায় স্বাভাবিক করে লম্বা লম্বা কয়েকটা নিঃশ্বাস ছাড়লাম।
লক্ষ্য করে দেখলাম আদ্রিশ আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছেন৷ আমিও উনার দিকে চেয়ে আছি। তবে রাগত দৃষ্টিতে। আদ্রিশ অনেকটা মিনমিনে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
” ঠিক আছো তো?”
আমি সরু চোখে উনার দিকে চেয়ে অনেকটা রাগত কণ্ঠে বললাম,
” আপনি আর ঠিক থাকতে দিলেন কোথায়? আজ তো আমাকে মে*রেই ফেলতেন আপনি। বেয়াদব লোক একটা।”
আদ্রিশ আমার এরূপ কথা শুনে চোরা চাহনিতে এদিকে ওদিক তাকিয়ে অপরাধী কণ্ঠে বললেন,
” সরি৷ এমন হয়ে যাবে বুঝতে পারিনি আমি। ”
আমি পূর্বের ন্যায় বললাম,
” বুঝতে পারেননি মানে? এমন ভয়ানক কথা শুনলে যে কারোর অবস্থাই তো এমন হয়ে যাবে!”
আদ্রিশ এবার স্বাভাবিক হয়ে আমার প্রতিক্রিয়ার তোয়াক্ক না করেই বললেন,
” অভ্যাস করে নাও বুঝলে? এখন থেকে রোজ এমন কথা শুনবে। ”
এই বলে উনি আমার দিকে কিঞ্চিৎ এগিয়ে এসে বাঁকা হেসে ফিসফিস করে বললেন,
” হতে পারে এর চেয়েও গভীর কথা শুনবে তুমি। ”
আমি আদ্রিশের এরূপ কথা শুনে হতভম্ব হয়ে বিস্মিত চাহনিতে চেয়ে আছি উনার দিকে। আমার মাথা এখন ভোঁ ভোঁ করে ঘুরার জোগাড় হয়ে এলো। নাহ, লোকটা বড়ই খারাপ প্রকৃতির! উনি আমায় নির্ঘাত লজ্জা দিয়েই মে*রে ফেলবেন। যা বুঝলাম, উনার সাথে হয় মেপে মেপে কথা বলতে হবে, নয়তো উনাকে কথার জালে ফাঁ*সিয়ে চুপ করিয়ে দিতে হবে। কিন্তু উনি যেরূপ কথা বলেন তাতে উনাকে আমার কথার জালে ফাঁ*সানোর চিন্তা স্বপ্নেই সম্ভব বলে মনে হচ্ছে।
আমি কিছুক্ষণ নিষ্পলক উনার দিকে চেয়ে রইলাম। অতঃপর ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে চেয়ারের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে বললাম,
” আমার কপালে দুঃখ আছে।”
আদ্রিশ বিস্তৃত হেসে বললেন,
” সে তো বিয়ের পরই বুঝা যাবে। আজ তাহলে উঠি চলো। ”
এই বলে উনি ওয়েটারকে ডেকে বিল মিটিয়ে দিলেন। অতঃপর আমরা দুজনে রেস্টুরেন্ট হতে বেরিয়ে গেলাম।
—–
দেখতে দেখতে একটি সপ্তাহ কেটে গিয়েছে। এই একটি সপ্তাহ আমার কাছে স্বাভাবিক একটি সপ্তাহ মনে হয়নি৷ কারণ এই একটি সপ্তাহে আমাকে অন্যের ঘরে পাঠানোর সকল ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছিলো। চোখের সামনে পরিবার থেকে পর হয়ে যাওয়ার আয়োজন দেখে আমি না সহ্য করতে পারছিলাম না কিছু বলতে পারছিলাম। এ এক চরম অস্বস্তির বিষয়। এদিকে কষ্টে ভেতরটা জর্জরিত হয়ে এলেও আমার করার মতো কিছুই রইলো না৷ ইশ, যদি আমি সারাজীবন শুধু আব্বু আম্মুর মেয়ে হয়েই থেকে যেতে পারতাম! কি হতো যদি আমি কারোর বউ,স্ত্রী না হয়ে শুধু বাবা -মা’র মেয়ে হয়ে থাকতাম? কিন্তু এ সমাজে আদৌ কি এভাবে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব? এ প্রশ্নের উত্তর সরাসরি ‘না’ দেওয়া যায়। কারণ আমাদের সমাজ ব্যবস্থাটাই এমন। কোনো কারণে মেয়ের বিয়ে না হলে বা সে বিয়ে না করতে চাইলে সবাই মেয়েটার দোষ ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
এক মাসের ব্যবধানে গত দুদিনে আমাদের বাসাটা পুনরায় লোকে লোকারণ্য হয়ে এলো। যদিও সবাই কাছের আত্মীয়। দূর সম্পর্কের আত্মীয় বলতে কাউকেই আমন্ত্রণ করা হয়নি৷
বড় আয়োজনে বিয়ে না করা হলেও বাসায় আয়োজনের কোনো কমতি রইলো না। আমাকে সকাল সকাল পার্লারে নিয়ে যাওয়া হলো। জুম্মার নামাজের আগেই আমাকে বাসায় নিয়ে এসে পুতুলের মতো বসিয়ে রাখা হলো। সকলের মুখে হাসি ফুটে রইলো। অথচ আমি নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলাম। আমার ভেতরে এ মুহূর্তে কেমন অনুভূত হচ্ছে তা হয়তো কেউই এ মুহূর্তে বুঝতে পারছে না। আমিও তাদের বুঝাতে পারছি না৷ বুঝাতে পারলে হয়তো চিৎকার করে, কান্না করে তাদের বুঝাতাম৷
কিছুক্ষণের মাঝেই আভা দৌড়ে এসে আমার কানে কানে বলে গেলো, আদ্রিশ ও তার পরিবারের সকল সদস্য চলে এসেছেন। আদ্রিশের নানুবাড়ি ও দাদুবাড়ির মানুষের সংখ্যা বেশ কম থাকায় উনাদের পক্ষ হতে কম মানুষ এসেছেন।
আভার মুখে আদ্রিশের আসার কথা শোনার পর আমার মাঝে প্রচণ্ড অস্থিরতা এবং ভয়ের উদয় হলো। বা পাশে অবস্থিত ধুকপুক শব্দে মত্ত হৃদপিণ্ডের স্পন্দন পূর্বের তুলনায় বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেলো। আমার চিন্তাশক্তি কিছুক্ষণের জন্য থমকে এলো। চারপাশের পরিবেশটা কেমন যেনো ঝিম ধরে এলো। দু হাত মন্দ গতিতে কাঁপতে লাগলো।
আমি দু চোখ বন্ধ করে আমার এ অবস্থা নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টা করলাম। কিছুক্ষণের মাঝেই আমার চারপাশে আম্মু, খালামনিরা, চাচিরা, আভা, আপু মোট কথা বাসায় উপস্থিত সকল মহিলারা আমার আশেপাশে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো। আব্বু আর চাচুরাও এসে দাঁড়ালো। এর কিছুক্ষনের মাঝেই কাজি সাহেব এসে উপস্থিত হলেন। ব্যস, উনাকে দেখে অঘোষিতভাবে আমার চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝড়তে লাগলো। আমি নত মস্তকে নিশ্চুপ বসে কাঁদতে লাগলাম৷ আম্মু আমার পাশে বসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
” কি ব্যাপার কাঁদছিস কেনো এখন?”
আমি কিছু বলতে পারলাম না। বরং আম্মুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। ওদিকে উপস্থিত সকলে চিন্তিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে চলছে, আমার কি হয়েছে? এভাবে হুট করে কেঁদে উঠলাম কেনো? এ মুহূর্তে আমি তাদের কোনো প্রশ্নেরই জবাব দিতে পারলাম না৷ আমার এহেন অবস্থা বুঝতে পেরে আপু আমার হয়ে বলে দিলো,
” নির্ঘাত ও বিয়ে না করার ধান্দায় বসে আছে। এজন্যই কান্না করছে। ”
আপুর কথা শুনে উপস্থিত সকলের মাঝে হাসির রোল পড়ে গেলেও সত্যি আমার মাঝে এখন এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতা বেড়ে চলছে৷ মন বলছে, এখনই উঠে পালিয়ে যাই।
নানু,দাদি, আম্মু বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে আমাকে শান্ত করালো। আমিও ধীরেধীরে শান্ত হয়ে এলাম৷ অতঃপর কাজি সাহেব কালেমা পড়ে আমায় কবুল বলতে বললেন৷ এবার কবুল বলতে বাঁধলো আরেক বিপত্তি। কবুল বলার সময়ে মনে হলো, আমি কথাই বলতে ভুলে গিয়েছি৷ মনের ভেতরে তৈরী হলো অদ্ভুত ভয়, আতঙ্ক৷ আচ্ছা? আদ্রিশকে কি এ মুহূর্তে বলা যায় না, আমি এ বিয়েটা করতে চাই না? উনি কি রাজি হবেন? কি এক অদ্ভুত চিন্তা!
আপু আর আম্মু আমার পাশে বসে আমাকে সাহস জুগালো। আমিও বেশ কষ্টেসৃষ্টে কবুল বলা শেষে পুনরায় কাঁদতে শুরু করলাম৷ আশ্চর্য! আজ কি আমি প্রতি মুহূর্তে কান্না করার ডিল করেছি! আমি যে কিছুতেই নিজের কান্না থামাতে পারছি না।
আমার কান্নার তোড় কিছু কমে এলে আপু আমায় টাচআপ করিয়ে দেয়৷ অতঃপর আমাকে পুনরায় সাজানো হলে আমাকে ড্রইংরুমে নিয়ে আদ্রিশের পাশে বসানো হয়। উনার পাশে বসতেই কেমন এক অদ্ভুত অনুভূতি ঘিরে ধরলো আমাকে৷ কিছুক্ষণ আগ পর্যন্তও যে মানুষটা আমার কিছুই ছিলো না, এখন সে আমার জীবনসঙ্গী। একটি শব্দ উচ্চারণেই সম্পর্ক বদলে গেলো মুহূর্তেই! অথচ এই বদলে যাওয়া সম্পর্কের সাথে একদিকে যেমন সুখের আভাস পেলাম, অপরদিকে তেমন কিছু হারানোর কষ্ট অনুভব করলাম। এ এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি।
ফ্যামিলি ফটো, কাজিন গ্রুপ ফটোসহ ছবি তোলা শেষে আমার আর আদ্রিশের কাপল ছবি তোলার সুযোগ এলো। আমাদের দুজনের ছবি তোলার পূর্বেই ঘরের সব মুরুব্বিরা ড্রইং রুম হতে বেরিয়ে গেলো। তারা চলে যাওয়ার পরপরই আদ্রিশ আমার পাশে বসে আচমকা আমার ডান হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিলেন৷ উনার এরূপ কাজে আমি ভীষণ চমকে উঠলাম। উনি বোধহয় আমাকে আরেক দফা চমকিয়ে দিতেই আমার কানের প্রায় কাছাকাছি এসে ফিসফিস করে বললেন,
” আজ থেকে এই হাত ধরার নায্য অধিকার পেলাম। ওয়াদা করলাম, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই হাতটা ছাড়বো না আমি। ”
আদ্রিশের এরূপ কথা শুনে আমি লজ্জায় কুঁকড়ে গেলাম। এদিকে আদ্রিশ আমার হাত ধরেছেন, এ নিয়ে আমার কাজিনরা, বান্ধবীরা ও আপু মজা নিতে লাগলো। ইমাদ ভাইয়া আদ্রিশকে টিপ্পনী কেটে বললেন,
” ভাই, তোর সইছে না? তাই না? নিজেকে কন্ট্রোল করো আদ্রিশ মিয়া। রুমে রোমান্স করার বহুত সুযোগ পাবে। এটলিস্ট এখন কয়েকটা ছবি তুলেনে।”
ইমাদ ভাইয়ার এরূপ কথায় সকলে হো হো করে হেসে উঠলো। এদিকে আমি না পারছি লজ্জায় এখানে বসে থাকতে আর না পারছি এখান থেকে উঠে চলে যেতে। এদিকে আদ্রিশ আমার হাত পূর্বের ন্যায় ধরেই আছেন৷ এতোগুলো কাজিন, ফ্রেন্ডের কথা শুনে যে হাত ছেড়ে দিবে তা নয়৷ বরং শক্ত করে আমার হাতটা ধরে আছেন। যেনো ছেড়ে দিলেই আমি উড়ে যাবো। আমি আড়ালে আড়ালে উনার হাত হতে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু উনার সাথে পেরে উঠতে পারলাম না। শেষমেশ হাল ছেড়ে উনি যেভাবে আমার হাত ধরে রাখলেন সেভাবেই বসে রইলাম।
—–
ঘড়িতে সময় এখন বারোটা।
রাতের খাবার শেষে আমাকে রুমে দিয়ে গেলো আপু। আদ্রিশের রুমে প্রবেশের পূর্বেই আমি বিয়ের শাড়ি, গহনা সব খুলে ফ্রেশ হয়ে নিলাম৷ এখন আপাতত থ্রিপিস পড়ে পড়ার টেবিলে বসে আছি। আগামীকাল এক্সামের ছোটখাটো একটা মেলা বসেছে বলে বিয়ের রাতেও শান্তি পেলাম না। যদি স্যারদের এই কথা বলতে পারতাম যে, ‘স্যার, শুক্রবারে আমার বিয়ে বলে শনিবারের পরীক্ষাটা অন্ততপক্ষে পিছিয়ে দিন৷’ তাহলে ব্যাপারটূ মন্দ হতো না৷ কিন্তু তা কি আর বলা সম্ভব!
বহু কষ্টে পড়াশোনায় মনোযোগ বসাতে না বসাতেই রুমে এসে হাজির হলেন আদ্রিশ। দরজা আটকে আমায় পড়ার টেবিলে দেখে উনি যেনো আকাশ থেকে পড়লেন৷ মুখশ্রীতে অত্যাশ্চর্য ভাব ফুটিয়ে তুলে বিস্মিত কণ্ঠে বললেন,
” এ কি মিশমিশ! তুমি আজকে পড়ার টেবিলে কেনো?”
আদ্রিশের এরূপ আশ্চর্যজনিত ভাব দেখে প্রথম দফায় বেশ মায়া লাগলেও পরমুহূর্তেই উনার সাথে একটু দুষ্টুমি করার কুবুদ্ধি মাথায় চেপে বসলো। উনার দিকে চেয়ে বেশ স্বাভাবিকভাবেই বললাম,
” হবু ডাক্তারকে বিয়ে করেছেন। তো এটা মাথায় রেখেই বিয়ে করেছেন নিশ্চয়ই যে, পড়া ছাড়া আমার গতি নেই?”
আদ্রিশ হতবাক হয়ে বললেন,
” তাই বলে কি আজ রাতে পড়তে বসবে!”
” কেনো? আজ রাতে আবার স্পেশাল কি আছে? ডাক্তার আর মেডিকেল স্টুডেন্টদের জন্য আজ রাত,কাল রাত বলে কথা নেই। আমাদের পড়া মানে পড়া। আমার কালকে পরীক্ষা আছে। এবার আমাকে পড়তে দিন। ”
এই বলে আমি বইয়ের দিকে তাকালাম। অমনি আদ্রিশ এসে অকস্মাৎ আমার বইটা বন্ধ করে দিলেন। উনার এ কাজে আমি কিছুটা রাগান্বিত হয়ে বললাম,
” সমস্যা কি আপনার? আমাকে পড়তে দিবেন না না কি?”
আদ্রিশ দু হাত আড়াআড়ি ভাবে বুকে গুঁজে বললেন,
” জ্বি না ম্যাডাম৷ আজ আপনাকে পড়তে দেওয়া যাবে না। ”
এই বলে উনি বইটা হাতে নিয়ে আমার টেবিলের কাছ থেকে সরে এসে দাঁড়ালেন। এদিকে আমার পড়া বাকি আর অন্যদিকে উনি এমন করছেন দেখে আমি ক্রোধিত হয়ে উঠে দাঁড়ালাম। উনার কাছে গিয়ে বই চাইতেই উনি বিস্তৃত হেসে বললেন,
” আজ বই পাবে না মিশমিশ। কোনো বউকে কি দেখেছো বিয়ের রাতে স্বামীর সাথে রোম্যান্স বাদ দিয়ে পড়ালেখা করছে?”
আমি ভীষণ বিরক্ত হয়ে বললাম,
” হ্যাঁ। অনেক আছে এমন। আমি বরং কালকে আপনাকে লিস্ট করে তাদের নাম বলে দিবো। আজ অন্তত আমার বইটা দিন। আমার অনেক পড়া বাকি। কালকে পেন্ডিং খেলে সেই পরীক্ষা আবারো দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।”
এই বলে আমি উনার হাত হতে বইটা নেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু উনি আমাকে বই তো দিলেনই না৷ বরং হাতে বই নিয়ে হাতটা উঁচু করে রাখলেন৷ যেনো আমি বইয়ের নাগাল না পাই। কিন্তু আমিও নাছোরবান্দা। আমি হাত উঁচু করে বইটা নেওয়ার চেষ্টা করলাম। ওদিকে আদ্রিশও নিজের হাতটা আরো উঁচু করার চেষ্টা করলেন। এ মুহূর্তে আদ্রিশের মুখশ্রীতে ফু্টে উঠেছে বিজয়ের হাসি এবং আমার মুখশ্রীতে ফুটে উঠেছে অসহায়ত্বের ছাপ।
কিছুক্ষণের প্রচেষ্টার পরও যখন আদ্রিশের কাছ থেকে বই পেলাম না তখন হাত নামিয়ে অসহায় কণ্ঠে বললাম,
” প্লিজ আদ্রিশ। বইটা দিন। খুব দরকার তো!”
আদ্রিশ আমার কণ্ঠ শুনে হয়তো কিছুটা মোলায়েম হলেন ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস বললেন,
” আমার কিছু প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। এরপর বই পাবে। ”
অগত্যা পরিস্থিতির শিকার হয়ে আদ্রিশের শর্তে রাজি হয়ে বললাম,
” আচ্ছা, ঠিক আছে। করুন কি প্রশ্ন করবেন৷ ”
এই বলে আমি ভীষণ বিরক্ত নিয়ে উনার দিকে চেয়ে রইলাম। উনিও কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে চেয়ে রইলেন৷ অতঃপর আচমকা আমার কোমড় ধরে নিজের কাছে টেনে আনলেন৷ উনার এহেন কাজে আমি যেনো আকাশ থেকে পড়লাম৷ বিস্মিত এবং নিষ্পলক চাহনিতে কিছুক্ষণ উনার দিকে চেয়ে রইলাম। আমি কখনো আশাও করিনি আদ্রিশ এমন কিছু করে বসবেন। এদিকে আদ্রিশ আমার দিকে ঘোর লাগা দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন৷ উনার এরূপ চাহনিতে আমি মিইয়ে এলাম। উনার বাহুডোর হতে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বরাবরের মতোই ব্যর্থ হলাম। বরঞ্চ আমার এরূপ প্রচেষ্টা দেখে আদ্রিশ আমাকে নিজের সাথে আরো মিশিয়ে নিলেন। ফলস্বরূপ আমি তৎক্ষণাৎ খিঁচে চোখজোড়া বন্ধ করে নিলাম। এ পর্যায়ে উনার তপ্ত নিঃশ্বাস আমার চোখেমুখে আছড়ে পড়লো।
আদ্রিশ মন্থর কণ্ঠে আমায় বললেন,
” কবুল বলার আগে অতো কান্না করছিলে কেনো?”
আমি কোনোরূপ জবাব দিতে পারলাম না। কারণ এ প্রথম আদ্রিশের এতো নিকটে এসে আমার ভেতরে অস্বস্তিরা দানা বাঁধতে শুরু করলো। শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি ধীর হয়ে এলো, হৃৎস্পন্দন অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেলো।
আদ্রিশ পুনরায় আমায় জিজ্ঞেস করলেন,
” কি ব্যাপার বলো? অতো কাঁদছিলে কেনো? আমায় বিয়ে করার ইচ্ছে ছিলো না না কি?”
আমি জবাব দিলাম না৷ আদ্রিশ এ পর্যায়ে আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন,
” সোজা প্রশ্নের জবাব দিতে পারো না? কোনো…….”
আচমকা দরজায় টোকা পড়ায় আমি এবং আদ্রিশ উভয়ই চমকে উঠলাম। আদ্রিশ তড়িঘড়ি করে আমায় ছেড়ে দিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। ততক্ষণে আমি নিজেকে সামলে নিলাম।
আদ্রিশ গিয়ে দরজা খুলে দাঁড়ালেন। বাইরে ইমাদ ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছেন। আদ্রিশকে দেখে ইমাদ ভাইয়া দরজার ওপাশে থেকে ঘাড় এগিয়ে দিলেন৷ ভ্রু নাচিয়ে দাঁত কেলিয়ে হেসে বললেন,
” কি আদ্রিশ মিয়া? রোম্যান্স মুড অন হয়ে গিয়েছে অলরেডি?”
ইমাদ ভাইয়ার এরূপ কথায় আমি লজ্জায় কুঁকড়ে গেলাম। এদিকে আদ্রিশ ইমাদ ভাইয়াকে ধমকে বললেন,
” লাথি খাবি ইমাদ। এখানে কি? অসময়ে এখানে এসেছিস কেনো?”
” আপনার রোম্যান্সের বারোটা বাজাতে এসেছি আমি। আপাতত আপনার রোম্যান্সের মুডটা অন থেকে অফ করুন৷ কারণ আপনাকে জরুরি ভিত্তিতে আংকেল ডেকেছে। ”
আদ্রিশ সন্দেহের সুরে জিজ্ঞেস করলেন,
” কেনো? কি এতো জরুরি কাজ?”
ইমাদ ভাইয়া তৃপ্তির হাসি হেসে বললেন,
” আপনাকে এখনই রেডি হয়ে আংকেলের সাথে অফিসে যেতে হবে। ”
আদ্রিশ যেনো আকাশ থেকে পড়ে বললেন,
” মানে কি! এখন কেনো? আজকের দিনে কিসের এতো কাজ!”
” আংকেল বললো, কালকে ফরেইনার এক ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির কিছু লোক আসবে। তাদের সাথে মিটিং আছে কালকেই এবং এ কারনে আজই সব গোছগাছ করতে হবে। ”
” কি ভাই! আজ আমার বিয়ে হলো৷ আজ আমি এসব কাজ করতে পারবো না। আব্বুকে বল অন্য কাউকে সাথে নিতে। আমি যেতে পারবো না। ”
এই বলে উনি ইমাদ ভাইয়ার মুখের উপরই দরজা আটকিয়ে দিতে চাইলেন৷ কিন্তু ইমাদ ভাইয়া আদ্রিশকে বাঁধ দিয়ে বললেন,
” কাজগুলো কনফিডেন্সিয়াল। তোকেই করতে হবে৷ আংকেলের কড়া আদেশ। এখনই রেডি হয়ে বের হতে হবে। কারণ কালকে ১০টার মধ্যেই তারা চলে আসবে৷ ”
আদ্রিশ এবার ভীষণ বিরক্ত এবং ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন,
” এ কাজটা আগে বললে হতো না? আজই কেনো?”
” আমি ভাই এসবের কিছু জানি না। তুই জলদি রেডি হয়েনে। বাইরে আংকেল বসে আছে।”
ইমাদ ভাইয়ার এরূপ কথা শুনে আদ্রিশ ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন,
” শা*লা তুই আর আমার বাপ মিলে আমার বাসর রাতের বারোটা বাজিয়ে ছাড়লি। এসব প্রিপ্ল্যান্ড ছিলো তাই না? আমার বাসর রাতের ব্যাণ্ড বাজিয়ে কতদিন আরামে থাকবি তুই? তোকে আমি কখনোও মাফ করবো না৷ বন্ধু নামে কলঙ্ক তুই৷ আর আমার বাপের কথা বললামই না।”
আদ্রিশের এরূপ ক্ষিপ্র কণ্ঠ শুনে আমি কিছুতেই নিজের হাসি আটকিয়ে রাখতে পারলাম না৷ মুখ টিপে হাসতে৷ হাসতে আমার পেটে খিল ধরে গেলো।
®সারা মেহেক
#চলবে
(আজকে এ গল্পের সবচেয়ে বড় পর্ব দিয়েছি। রিভিউ আর কমেন্ট না পেলে এক সপ্তাহ গল্প দেওয়া বন্ধ। ৩৬নং পর্ব থেকে গল্পের ট্র্যাক চেঞ্জ হবে।