#ভুলবশত_প্রেম পর্ব ৪৬

0
383

#ভুলবশত_প্রেম পর্ব ৪৬
#লেখনীতে:সারা মেহেক

৪৬

রিসেপশনের পর অন্যান্য মেয়েরা যেখানে বাবার বাড়ি যায়, সেখানে রিসেশনের পর আমি শ্বশুরবাড়িতে চলে এলাম৷ এমনটাই অবশ্য হওয়ার ছিলো। কারন অন্যান্যদের মতো বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি না এসে বাবার বাড়ি থেকেছি আমি।

আদ্রিশদের বাড়িতে আসার পর আপু ও জেবা ভাবী আমাকে আদ্রিশের রুমে দিয়ে গিয়েছে। আপুর অবস্থা এখন তুলনামূলক বেশ ভালো। সেদিনের ঘটনার পর থেকে আপু এমনকি আমরা কেউই এ নিয়ে আগ বাড়িয়ে আর আলোচনা করিনি। কারণ আমরা প্রত্যেকেই চাইছি আপু ঘটনাটি সম্পূর্ণরূপে ভুলে যাক। আপু নিজেও এ চেষ্টায় আছে।

আমাকে রুমে দিয়ে আপু ও জেবা ভাবী চলে গেলেন। ফুলে সাজানো রুমের বিছানার মাঝ বরাবর বসে আছি আমি। অপেক্ষা আদ্রিশের। কিন্তু দশ পনেরো মিনিট পার হওয়ার পরও যখন আদ্রিশ এলেন না তখন ভীষণ বিরক্তি নিয়ে আমি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। আজকের আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ হওয়া সত্ত্বেও ভারী লেহেঙ্গা ও গহনাদির জন্য ভীষণ গরম লাগছে আমার। এতোক্ষণ অব্দি অপেক্ষা করার পরও আদ্রিশের নামনিশানা না পাওয়ায় আমার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেলো। বিছানা থেকে নেমেই আমি হাতের চুড়িগুলো খোলা শুরু করলাম। কিন্তু তন্মধ্যে আচমকা রুমের দরজা খুলে আদ্রিশ রুমে প্রবেশ করলেন। আমায় আয়নার সামনে হাত থেকে চুড়ি খুলতে দেখে আদ্রিশ দ্রুত রুমের দরজা লাগিয়ে আমার সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন। ঈষৎ আঁতকে উঠার প্রয়াস করে বললেন,
” এসব কি মিশমিশ! চুড়ি খুলছো কেনো?”

আমি কিয়ৎক্ষণের জন্য স্থির দৃষ্টিতে আদ্রিশের দিকে তাকালাম। অতঃপর ঠোঁট বাকিয়ে ভেঙচি কেটে বললাম,
” তো কি করবো শুনি? সারারাত পরে থাকবো না কি?”

আদ্রিশ তৎক্ষনাৎ জবাব দিলেন না। বরং আমার দিকে চেয়ে মৃদু হাসলেন। আমার গাল দুটো আলতো করে টেনে বললেন,
” ভেঙচি কাটলে একদম বাচ্চাদের মতো মনে হয় তোমাকে। ”
এই বলে উনি ড্রেসিং টেবিলের উপর হতে কিছু সংখ্যক চুড়ি নিয়ে আমার হাতে পরিয়ে দিতে দিতে বললেন,
” সাজটা যেহেতু আমার জন্য সেহেতু আমি প্রাণভরে যদি তোমায় না-ই দেখলাম তাহলে কি সাজের কোনো মূল্য রইলো?”

আমি নিশ্চুপ রয়ে আড়চোখে আদ্রিশের পানে চাইলাম। আদ্রিশ চুড়ি পরানো শেষে বললেন,
” আমি মানুষটা একান্তই তোমার। এতো লুকোচুরি করে দেখার কিছু নেই। সরাসরি দেখলেই পারো।”

আদ্রিশের ফোঁড়ন কাটায় আমি লজ্জায় চুপসে গেলাম। ফলস্বরূপ নত মস্তকে উনার স্পর্শ হতে নিজেকে কিঞ্চিৎ দূরে সরিয়ে নিলাম। উনি আমার এ কাজে ঈষৎ হাসলেন। অতঃপর বললেন,
” আজ মন ভরে তোমায় দেখবো মিশমিশ। তোমার স্নিগ্ধ রূপের পরশে আজ পুনরায় তোমার ভালোবাসায় মত্ত হবো আমি। আজ আমাকে বাঁধা দেয়ার কেউ নেই। স্বয়ং তুমিও না।”
এই বলে আদ্রিশ আমার নিকটে এসে দাঁড়ালেন। আমাকে পিছানোর সুযোগ না দিয়ে অকস্মাৎ আমার কোমড় চেপে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলেন উনি৷ ঘটনার প্রেক্ষিতে আমি কিঞ্চিৎ চমকে উঠলাম। ফলস্বরূপ উনার সাথে ক্ষীণ সময়ের দৃষ্টি বিনিময় হলো। পুনরায় দৃষ্টি নত করার সুযোগকে প্রশমিত করে উনি অপর হাত দিয়ে আমার থুতনি ধরে বললেন,
” আমার চোখে চোখ রেখে রাখতে পারবে না?”

আমি লজ্জামিশ্রিত চাহনিতে অবিন্যস্তভাবে এদিক ওদিক চাইলাম৷ পেলব গলায় বললাম,
” উঁহু। এ দুঃসাধ্য সাধনের সাহস আমার নেই। ”

আদ্রিশ আমার থুতনি ছেড়ে আমার হাত ধরলেন। প্রতিটি আঙুলের ভাঁজে আঙুল পুরে ধীরলয়ে বললেন,
” জানো মিশমিশ? কারোর সাথে সারাজীবন কাটিয়ে দেয়ার মতো ওয়াদা করা ভীষণ কঠিন৷ আর এ ভীষণ কঠিন কাজটা সেসময় দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে যখন মন থেকে ভালোবাসার অনুভূতিটা আসে না৷
আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তোমার সাথে কাটাতে চাই মিশমিশ। আমি চাই আমার সকল অনুভূতি তোমায় ঘিরেই থাকুক। বুড়ো বয়সেও যেনো আমরা লাঠি ভর দিয়ে একে অপরের হাত ধরে হাঁটতে পারি। এটাই চাওয়া। বিনিময়ে আমি চাই, তোমার অব্যক্ত ভালোবাসায় সবসময় আমায় সিক্ত করে রাখবে। পারবে তো?”

আদ্রিশের এ আকুল আবেদনে আমি অল্পবিস্তর কেঁপে উঠলাম। মন চাইছে উনার মতোই আপন সুরে আমার জবাবটা জানিয়ে দেই উনাকে। কিন্তু এতো সাহস কুলায় না আমায়। ফলে কম্পনমান কণ্ঠে জবাব দিলাম,
” এ ব্যাপারে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। ”

আমার জবাবে আদ্রিশ মৃদু শব্দে হাসলেন। অতঃপর আমায় ধীরেধীরে ছেড়ে দিয়ে তিনি বললেন,
” যাও, চেঞ্জ করে আসো। তুমি চেঞ্জ করে আসার পর আমি যাবো৷ এতক্ষণ একটু এসিতে জিড়িয়ে নেই। ”

এই বলে উনি এসির রিমোট নিয়ে এসি চালিয়ে দিলেন। পরনের কোট খুলে প্যান্ট, শার্ট পরিহিত অবস্থায় উনি গিয়ে বসলেন বিছানার উপর। হাতের উপর ভর দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় ফোন চালাতে লাগলেন। আমি আর দেরি না করে পরনের গহনাদি খোলা শুরু করলাম।
এ রুমের ড্রেসিং টেবিলের আয়না দিয়ে বিছানার অর্ধেকাংশ দেখা সম্ভব। আমি ধীরেধীরে পরনের গহনাদি খুলছি আর আয়নার মাধ্যমে আদ্রিশকে দেখছি৷ উনাকে সরাসরি দেখার সুযোগটা নেই। কারণ উনি সর্বদা আমায় লজ্জা দিতে প্রস্তুত থাকেন। সুতরাং এমন মানুষকে আড়ালে দেখাই শ্রেয়। তবে আর যাই হোক না কেনো, এ মানুষটা তো শুধুই আমার। উনার উপর সকল প্রকার হক অধিকার আরোপ করার ব্যক্তিগত অধিকার রয়েছে আমার৷ মাঝে মাঝে মন চায় আমার মনের সকল অনুভূতি উনার সামনে খোলা বইয়ের ন্যায় মেলে ধরি৷ কিন্তু এ অনুভূতির কিতাব উনার সামনে খোলা মাত্রই তা অগোছালো শব্দগুচ্ছের ন্যায় জমাট বেঁধে যাবে৷ গাঢ় হয়ে জড় হবে কণ্ঠনালীতে। ফলস্বরূপ হৃদয়ের বুলিগুলো প্রকাশ করতে ব্যর্থ হবো আমি।
আয়না দিয়ে বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি আদ্রিশকে। সাদা শার্টে দারুন মানিয়েছে উনাকে। উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, ঘন ভ্রুজুগল, খাড়া নাক সব যেনো একদম পরিমিত অনুপাতে সঠিক জায়গায় আছে। তার উপর এ মুহূর্তে ব্যাপৃত চোখজোড়ায় দেখা মিলছে রাজ্যের ব্যস্ততা। উনায় দেখে মনে হচ্ছে খুব মনোযোগ সহকারে কিছু দেখছেন, ভাবছেন। মাঝে মাঝে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে ভাবুক মুখশ্রীতে ক্ষুদ্র দার্শনিকের ছাপ এঁকে রাখছেন। এ যেনো মুহূর্তেই শশব্যস্ত হয়ে পড়া অদ্ভুত এক মানুষের আত্মা!

.

রাত গভীর হওয়ায় শীতল অনুভূতিটা আরো জেঁকে বসলো। চুলে হেয়ার স্প্রে থাকায় এই গভীর রাতেও বাধ্য হয়ে চুলে শ্যাম্পু করতে হয়েছে আমার। ফলস্বরূপ অসময়ের এ কাজে শরীর হিম করে দেওয়া শীত লাগতে শুরু করলো। ভেজা, ঠাণ্ডা চুলগুলো ছেড়ে শীতে অল্প-বিস্তর কাঁপতে লাগলাম আমি। তন্মধ্যে আদ্রিশ ওয়াশরুম হতে বেরিয়ে এলেন। আমায় এভাবে কাঁপতে দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” শীত লাগছে?”

আমি ঠোঁট জোড়া চেপে ধরে মাথা দুলিয়ে বললাম,
” হুম। ”

আদ্রিশের চেহারা এ পর্যায়ে আরো একটু উদ্বিগ্নতায় ছেয়ে গেলো। হাতে থাকা তোয়ালে দিয়ে তৎক্ষনাৎ আমার ভেজা চুলগুলো পেঁচিয়ে বললেন,
” তোমার শরীরে শীত যেহেতু এতো বেশি সেহেতু এই রাতে চুল না ভেজানোই উচিত ছিলো। ”

” না ভিজিয়ে উপায় ছিলো না। চুলে হেয়ার স্প্রে ছিলো। আর এই স্প্রে নিয়ে আজ ঘুমানো মানে চুলের বারোটা বাজানো। ”

আদ্রিশ মুখ দিয়ে ‘চ’ সূচক আওয়াজ বের করে বললেন,
” ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসো।”

” কেনো?”

” আহহা, প্রশ্ন না করে বসো তো।”

আদ্রিশের কথা মান্য করে বাধ্য মেয়ের মতো ড্রেসিং টেবিলের সামনের চেয়ারে বসে পড়লাম। আদ্রিশ জিজ্ঞেস করলেন,
” তোমার লাগেজে হেয়ার ড্রায়ার আছে না?”

” আছে তো। কিন্তু আমি ব্যবহার করবো না। ”

” কেনো? ”

” চুল নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয় আছে। আর একবার এটার অভ্যেস হয়ে গেলে আমার মাথার সব চুল নাই হয়ে যাবে। ”

” বিপদে একদিন ব্যবহার করলে কিছু হয় না। ”
এই বলে আদ্রিশ আমার লাগেজ থেকে হেয়ার ড্রায়ার নিয়ে এসে আমার চুল শুকিয়ে দিতে লাগলেন।
চুল প্রায় শুকিয়ে এলে আমার শীত শীত ভাবটা কমে গেলো। আমি পূর্বের ন্যায় স্বাভাবিক হয়ে গেলাম। আদ্রিশ বললেন,
” এই কাজটা আগেভাগে করলে এই শীতটা আর লাগতো না।”
এই বলে উনি আয়নার মাধ্যমেই আমার দিকে চাইলেন। খোলা চুলে আলতো হাত বুলিয়ে স্নিগ্ধ গলায় বললেন,
” খোলা চুলে তোমার সৌন্দর্য আরো বেড়ে যায় মিশমিশ। খোলা চুলে তুমি যেনো অন্য এক রমনী হয়ে উঠো। ”
বলেই উনি মুহূর্তমধ্যেই ভ্রু কুঁচকে ভাবুক গলায় বললেন,
” তবে এ সুন্দরী রমনীর সৌন্দর্যতায় একটি কমতি রয়ে গেলো। ওয়েট, এখানেই বসো। আমি আসছি।”
এই বলে উনি আমায় রেখে ব্যালকনির দিকে পা বাড়ালেন। সেই সুযোগে আমি হেয়ার ড্রায়ারটা আপাতত লাগেজের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখলাম।

আদ্রিশ ব্যালকনিতে গিয়ে মাধবীলতার এক গুচ্ছ এনে আমার সামনে দাঁড়ালেন। অতঃপর আলতো করে আমার বাম কানের পিছনে চুল সরিয়ে দিয়ে সেখানে মাধবীলতা গুঁজে দিয়ে স্মিতহাস্যে বললেন,
” এই না হলে পরিপূর্ণ রমনী। আদ্রিশের মাধবীলতা। ”

উনার প্রশংসামূলক বাক্যে আমি ঈষৎ লাজুকমিশ্রিত হাসি হাসলাম। উনি বললেন,
” তুমি কি জানো, মাধবীলতা ফুলে তোমার সুপ্ত সৌন্দর্যটা মন উজার করে প্রকাশ পায়?”

প্রত্যুত্তরে আমার বলার মতো কিছু রইলো না বিধায় চুপচাপ নত মস্তকে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। আদ্রিশও কিয়ৎক্ষণ নিশ্চুপ রইলেন। অতঃপর
অকস্মাৎ আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে মন্থর কণ্ঠে বললেন,
” একটা গোপন কথা কি জানো মিশমিশ?”

অকস্মাৎ উনার এহেন আগমন, উনার এ কণ্ঠস্বর আমায় স্থবির করে তুললো। আমি কোনো রকমে বললাম,
” কি গোপন কথা?”

আদ্রিশ আমার কানের আরো নিকটে ঠোঁট এনে ফিসফিসিয়ে বললেন,
” তোমায় ভালোবাসি। অপরিমেয় ভালোবাসি। ”

এ প্রথম উনার মুখ নিঃসৃত ‘ভালোবাসি’ শব্দটি শোনা মাত্র আমার শরীরে শিহরণ বয়ে গেলো। অতিশয় অনুভূতিতে নিঃশ্বাস আটকে আসার উপক্রম হলো। হাত পা যেনো অবশ হয়ে এলো। এমতাবস্থায়ও আমি কি মনে করে কম্পিত কণ্ঠে ধীরলয়ে বললাম,
” তা আমার অগোচরে নেই আদ্রিশ।”

আদ্রিশ আমার কথায় ক্ষীণ শব্দে হেসে উঠলেন। আমার কোমড় চেপে পূর্বোক্ত অবস্থায় থেকে ক্ষণিকের বিরতি নিলেন। পুনরায় আচ্ছন্ন কণ্ঠে বললেন,
” ভালোবাসি জানো। তবে এ ভালোবাসার সীমা তোমার অজানা মিশমিশ। একজনকে কতোটা ভালোবাসলে নিজের মধ্যকার সবকিছু হারিয়ে সে নিঃস্ব হয়ে বসে তা তোমার জানা নেই মিসেস মিম আরসালান আহমেদ আদ্রিশ। এর পরিসীমা সম্পর্কে তুমি কখনও অবগত হতে পারবে না। কারণ তুমি কখনও আমার মতো ভালোবাসতে পারবে না। কখনও না। মাই লাভ হ্যাজ নো লিমিট মিশমিশ।”
®সারা মেহেক

#চলবে
( আজকের পর্ব কেমন হয়েছে জানাতে ভুলবেন না😶। আর হ্যাঁ, আগামী পর্বে এট্টুসখানি একটা ধামাকা থাকবে। একদম এট্টুসখানি। 🤏)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here