#আমার_ভুলপর্বঃ১৪
অরিত্রিকা আহানা
ভেবেছিলাম এই জীবনে হয়ত আর কোনো দিন প্রিন্সের দেখা পাবো না। উনি সারাজীবনের জন্য আমার কাছ থেকে হারিয়ে গেছেন। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা আমার সহায় হলেন। তাই দীর্ঘ পাঁচবছর আবার আমি উনাকে দেখতে পেলাম।
ইউনিভার্সিটি প্রাক্তন ছাত্র এবং শিক্ষক হিসেবে উনার সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ উনার জন্য সংবর্ধনার ব্যবস্থা করলেন। সেই অনুষ্ঠানে আমি সহ ডিপার্টমেন্টের সকল শিক্ষক শিক্ষিকাবৃন্দ আমন্ত্রিত ছিলেন।
আমার ভেতরে ক্ষণে ক্ষণে উত্তেজনা, ভয়, শিহরণ বয়ে যাচ্ছিলো। আমি একমুহূর্তও স্থির থাকতে পারছিলাম না। উত্তেজনার কারণ প্রায় পাঁচ বছর পর উনাকে আবার দেখতে পাবো। আর ভয় ছিলো আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের প্রতিক্রিয়া কি হবে সেটা ভেবে। অনুষ্ঠানে আমি আছি জানতে পারলে উনারা যদি প্রিন্সকে আসতে বারণ করে দেন। তবে আমি উনাকে একটুখানি চোখের দেখাও দেখতে পাবো না। আমার ভয় হচ্ছিলো!
প্রিন্স চলে যাওয়ার পর এই পাঁচ বছর শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। আমি প্রথম প্রথম অনেক চেষ্টা করেছিলাম যোগাযোগ রাখার। কিন্তু উনারা প্রতিবারই আমার চেষ্টা এড়িয়ে গেছেন। উনাদের এক কথা যার জন্য তাঁদের ছেলে দেশ ছাড়া হয়েছে তাঁকে উনারা ক্ষমা করবেন না। আমি লজ্জায় সংকোচে আর বেশি জোরাজুরি করতে পারি নি। সত্যিই তো আমার ভুলের কারণেই প্রিন্স দেশ ছেড়েছেন।
তবে প্রাপ্তির সঙ্গে অনেকবার যোগাযোগ করা চেষ্টা করেছি। কিন্তু ও আমার গলা শুনলেই ফোন কেটে দিতো। মাঝেমধ্যে রাগ সামলাতে না পেরে অনেক আপত্তিজনক কথাও বলে ফেলতো। আমি চুপ করে শুনতাম। বলার মত কোনো ভাষা আমার ছিলো না।
তবে যোগাযোগ না রাখলেও দেশে থাকাকালীন বিভিন্ন মারফতে উনাদের খবর পেয়ে যেতাম। কিন্তু জাপানে আসার পর যোগাযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
আমার ভয় সংকোচ দুটোই হচ্ছিলো। সিদ্ধান্ত নিলাম উনার সামনে যাবো না। দূর থেকেই দেখবো।
চেয়ারম্যান স্যারের কাছে শুনেছি গবেষণায় সফলতা অর্জনের পর স্টেট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছেন উনি।
দুমাসের ছুটিতে দেশে এসেছেন। ছুটি শেষ হলেই আবার আমেরিকা ফিরে যাবেন। উনাকে দেখতে পাওয়ার এই সুযোগটা আমি হাতছাড়া করলাম না।সবার আগে অনুষ্ঠানে গিয়ে উপস্থিত হলাম।
★
অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হলো। আমি ভেতরে ঢুকে দেখলাম প্রিন্স স্টেজের একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। উনার পাশের চেয়ারগুলো খালি। অথচ উনার মধ্যে বসার কোনো তাড়া নেই। অনুগত ছাত্রের ন্যায় স্যারদের স্টেজে উঠার অপেক্ষা করছেন।
যতক্ষণ না পর্যন্ত স্যাররা স্টেজে উঠে নিজেদের আসন গ্রহন করলেন ততক্ষণ পর্যন্ত উনি বসলেন না। দাঁড়িয়ে ছিলেন। স্যাররা বসার পর উনি এসে বসলেন।
চেয়ারম্যান স্যার তো ভীষণ খুশি। উনাকে পেয়ে একের পর এক গবেষণা বিষয়ক আলোচনা জুড়ে দিলেন। উনি চুপচাপ ধৈর্য সহকারে শুনলেন। স্যারের যতক্ষণ কথা বলছিলেন উনার দৃষ্টি অবনত ছিলো। বসার ভঙ্গি, কথা বলা, মাথা নাড়ানো সবকিছুতে স্পষ্ট বিনয়ের ভাব।
আমি মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলাম। এত বড় অর্জন, এত বড় প্রাপ্তি পরেও বিনয় উনার সমস্ত শরীরে অপরিসীম দ্যুতি ছড়াচ্ছিলো। এই সৌন্দর্য চেহারার নয় এই সৌন্দর্য ব্যবহারের। শ্রদ্ধার। প্রকৃত শিক্ষার। আমার প্রতিটি শিরায় শিরায় শ্রদ্ধাবোধ শানিত হলো। উনার পাশে বসে থাকা মানুষগুলো যে একসময় উনার শিক্ষক ছিলেন একথা উনি একমুহূ্র্তের জন্যেও ভুলেন নি।
এই সাধারণের মাঝে অসাধারণ হয়ে ওঠা, নির্ভেজাল, অমায়িক প্রকৃতির মানুষটি আবারো আমার হৃদয়ে ভালোবাসার জোয়ার বইয়ে দিলো। আশেপাশের সবকিছু আমার কাছে তুচ্ছ, নগণ্য মনে হচ্ছিলো। আমি শুধু উনাকেই দেখছিলাম। এত আগ্রহ ভরে রিসার্চের কোনো থিসিস দেখেছি বলেও আমার মনে পড়ে না।
বক্তৃতা দেওয়ার সময় উনি সবাইকে উদ্দেশ্য করে মৃদু হাসি উপহার দিলেন। সঙ্গে গোটা অডিটোরিয়াম করতালিমুখর হয়ে উঠলো। আমার নিজেরও ভালো লাগছিলো।
কিন্তু হঠাৎ করেই বুকে ব্যথা অনুভব করলাম। চোখ জ্বালা করে উঠলো।
আমি উনাকে পেয়ে হারিয়েছি। এই কথা যতবার মনে পড়ে ততবার আমি মরে যাই। আজ উনার স্বপ্নসীমানায় প্রবেশের অধিকার আমার নেই। অথচ একদিন আমিই উনার সব ছিলাম। আমার ব্যাকুল, ব্যথিত হৃদয় হাহাকার করে উঠলো। ঠোঁট কামড়ে কান্না চাপলাম।
অনুষ্ঠানের একেবারে শেষমুহুর্তে চেয়ারম্যান স্যার আমাকে স্টেজে ডাকলেন। আমার হাতে একটা সম্মাননা স্মারক ধরিয়ে দিয়ে বললেন,’এটা তুমি দেবে প্রিন্সকে।’
আমি স্মারক হাতে নিয়ে অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে রইলাম। কষ্টে বুক ফেটে যায়, তবুও ঠোঁট নড়ে না। জীবনের এই ক্রান্তিকালে এসে সত্যিই বড্ড ক্লান্ত হয়ে গেছি! নিজের মানুষটাকে নিজের বলে পরিচয় দিতে পারি না!
এত কষ্ট! আর যে পারি না!
টলতে টলতে উনার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার সমস্ত শরীর কাঁপিয়ে মৃদু কম্পন দিয়ে উঠলো। স্মারক লিপিটা উনার হাতে নেওয়ার আগমুহূর্তেই ঢলে পড়লাম।
উনি ক্ষিপ্রহস্তে ধরে ফেললেন। কি নিষ্পাপ দৃষ্টি!
আমার হৃদয় জুড়ে প্রশান্তির শীতল বাতাস বয়ে গেলো। ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে ফেললাম! অনুভব করলাম ঐ মানুষটা শক্ত করে আমাকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছেন। উদ্বিগ্ন কন্ঠে চেয়ারম্যান স্যারকে মেডিকেল সেন্টারে ফোন করার অনুরোধ জানালেন। নিজের অজান্তেই আমার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো।
আমার জ্ঞান ফিরলো সন্ধ্যার নামার কিছুক্ষণ পূর্বে। মেডিকেল সেন্টারে কর্মরত চিকিৎসক আমার প্রেশার চেক করলেন। জটিল কোনো সমস্যা নয়। জাস্ট প্রেশার ফল করেছিলো।
আমি বিব্রত মুখে সবার দিকে চাইলাম। আমার জন্যই সবাইকে এতক্ষণ বসে থাকতে হয়েছে। নইলে অনুষ্ঠান শেষ করে আগেই বাড়ি ফিরে যেতে পারতো সবাই। চেয়ারম্যান স্যার আমার বিব্রত অবস্থা দেখে মাথায় হাত রেখে স্নেহের সহিত বললেন,’অসুস্থতার কি কোনো সময় জ্ঞান আছে নাকি। এটা যেকোনো মুহূর্তে যে কারো ঘাড়ে চেপে বসতে পারে। তুমি শুধু শুধু অস্বস্তি বোধ করছো।’
তবুও আমার লজ্জা লাগছিলো।
প্রিন্সকে দেখে আরো বেশি লজ্জা পাচ্ছিলাম। চেয়ারম্যান স্যার আমাকে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব প্রিন্সের ওপরেই ন্যস্ত করলেন। প্রিন্স প্রতিবাদ করলেন না। আমাকে উদ্দেশ্য করে শান্ত স্থির গলায় বললেন,’এসো।’
আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। সারারাস্তা ঘোরের মাঝে ছিলাম। মনে হচ্ছিলো বুঝি স্বপ্ন দেখছি। উনার সঙ্গে একসাথে বাড়ি ফিরতে পারবো এটা আমার কল্পনার বাইরে ছিলো।
উনি ভেতরে ঢুকে আব্বা মায়ের সঙ্গেও দেখা করলেন। যাওয়ার সময় আমার প্রেসক্রিপশন মায়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে আমার খেয়াল রাখতে বললেন।
আব্বা এতদিন অপেক্ষায় ছিলেন। সুযোগ পেলেই প্রিন্সের সঙ্গে আমার মিটমাটের বিষয়টা আলাপ করবেন। সেই সাথে এতদিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখার কারণ নিয়ে প্রিন্সকে দুচার কথা শুনিয়েও দেবেন।
কিন্তু প্রিন্সের এমন শান্ত, শিষ্ট ব্যবহার দেখে আব্বা নিজে থেকে কোনো কথাই তুলতে পারলেন না। সংকোচে পড়ে গেলেন। মানুষ রাগের চেয়ে বেশি ব্যক্তিত্বকে ভয় পায়। তাই একান্ত অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আব্বাকে চুপচাপ উনার চলে যাওয়া দেখতে হলো।