এক মুঠো রোদ পর্ব-২৮

0
700

#এক_মুঠো_রোদ
#Writer_নৌশিন_আহমেদ_রোদেলা
#part_28
#collected Sk Galib
পাহাড়ী উঁচু নিচু রাস্তা পাড়ি দিয়ে খাসিয়াপুঞ্জিতে পৌঁছেই চোখে পড়লো অসম্ভব সুন্দর এক গীর্জা। খাসিয়াদের ৮০% খ্রিস্টান হওয়ায় প্রায় প্রতি খাসিয়া পুঞ্জিতেই থাকে আলাদা আলাদা গির্জা অর্থাৎ প্রার্থনাগার। এমন পাহাড়ী অঞ্চলে সুন্দর কারুকার্যময় পাকা দালানে তৈরি গির্জা দেখে অবাক চোখে তাকালো রোজা-তীর্থ। রোজার মনে হতে লাগলো, এমনটা একটা গীর্জা শহরের আধুনিকায়নে ঘিরে থাকা গির্জাগুলোকেও টেক্কা দিয়ে যাবে সহজেই। গির্জার সামনেই একদল খাসিয়া বাচ্চাদের চোখে পড়লো। হাতে ছোট ছোট লাঠি নিয়ে ছুঁটে ছুঁটে খেলছে তারা। লাঠির মাথায় ছোট ছোট চাকা লাগানো। গির্জার পাশেই পাহাড়ি ঢলে সুন্দর ছোট্ট একটি চায়ের দোকান। হঠাৎই গাড়ি থামাতে বললো মৃন্ময়। ঘাড় বাঁকিয়ে রোজাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— চা খাবেন মিস.রোজা? দোকানের পরিবেশটা কিন্তু চমৎকার।
মৃন্ময়ের প্রস্তাবে খুশিতে লাফিয়ে উঠলো রোজা। ঝটপট গাড়ি থেকে নেমে বিস্ময় নিয়ে বললো,
— সবকিছু কতো গোছানো। এই পাহাড়ে এতোটা ছিমছাম পরিবেশ পাওয়া যাবে ভাবতেই পারি নি আমি।
মৃন্ময় হাসলো। হাসিমুখেই বললো,
— খাসিয়ারা খুব গোছালো জাতি। ওরা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতেই বেশি পছন্দ করে। চলুন…
তীর্থ বাচ্চাদের দিকে এগিয়ে যেতেই বাচ্চারা এক জায়গায় জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। তাদের চোখ-মুখে ভয় ভাবটা স্পষ্ট।ততক্ষণে মৃন্ময়ও এগিয়ে এসেছে বাচ্চাদের দিকে। তীর্থের কাঁধে হাত রেখে বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললো,
— ভয় পেয়ো না, এদিকে এসো। ছবি তুলবো তোমাদের সাথে।
সাথে সাথেই একজন দু’জন করে এগিয়ে এলো তারা। একসময় দেখা গেলো সবকটা বাচ্চায় ঘিরে ধরেছে তাদের৷ কে কতো কাছে দাঁড়াবে তা নিয়েই চলছে তুমুল হাঙ্গামা। তীর্থর কাছ থেকে ক্যামেরা নিয়ে ছবি তোলে দেওয়ার দায়িত্ব নিলো মৃন্ময়। তীর্থ-রোজা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আর তাদের ঘিরে রেখেছে একঝাঁক খাসিয়ান শিশু। দৃশ্যটা সত্যিই মনোমুগ্ধকর। কিন্তু মৃন্ময়ের তোলা বেশির ভাগ ছবিতেই ফুটে উঠলো রোজার হাসিমাখা মুখ। সেই টোলপড়া হাসি! ছবি তোলা শেষ করে গাড়ি থেকে চকলেট এনে বাচ্চাদের মধ্যে বিলিয়ে দিলো মৃন্ময়। রোজা অবাক হয়ে বললো,
— বাচ্চাদের সাথে দেখা হবে এটা আপনি জানতেন? এতো চকলেট আনলেন যে!
মৃন্ময় হেসে বললো,
— ঠিক জানতাম না। তবে গেইস করেছিলাম। চলুন চা খাওয়া যাক। এখনও অনেকটা পথ বাকি।
রোজাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তীর্থকে নিয়ে দোকানের দিকে এগিয়ে গেলো মৃন্ময়। চা’য়ের দোকানে দুটো বাঁশের ব্রেঞ্চ। রোজা তার একটিতেই চা ঝুলিয়ে বসে এদিক ওদিক তাকালো। প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করেই আধুনিকতার পরশে সিক্ত হয়েছে তারা। রাস্তার দু’পাশে ছিমছাম গোছানো ছোট বড় কাঁচা পাকা ঘর। কোথাও কোথাও সোলার প্যানেলে বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যবস্থা। রোজা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে গির্জার দিকে তাকালো। আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে বললো,
— ওটা কিসের মূর্তি নায়ক সাহেব?
রোজার হাতকে লক্ষ্য করে গির্জার দিকে তাকিয়ে চা’য়ের কাপে চুমুক দিলো মৃন্ময়। শান্ত গলায় বললো,
— ওটা যিশুর মূর্তি। এখানের বেশিরভাগ জনগোষ্ঠীই ক্যাথলিক খ্রিষ্টান। যিশুকে খুবই ভক্তি করে সবাই।
— ওহ।
চা খাওয়া শেষ করে গাড়ি ছুটতেই আবারও চোখে পড়লো একদল বাচ্চা। তাদের হাতেও লাঠি। রোজা -তীর্থ জানালায় ঝুঁকে পড়ে হাত নাড়াতেই উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তাদের মুখ। নিষ্পাপ হাসিতে মত্ত হয়ে তারাও হাত নাড়াতে লাগলো তুমুল গতিতে। তাদের থেকে চোখ সরাতেই চোখে পড়লো একদল যুবক ও বৃদ্ধ। রাস্তার পাশে ড্রাম উল্টিয়ে তারওপর কেরাম খেলছে তারা। রোজা সেদিকে দৃষ্টি রেখেই বললো,
— আচ্ছা? এই খাসিয়ান বাচ্চাদের কি খেলার মতো আর কোনো খেলনা নেই? সবাই লাঠি দিয়েই খেলে কেন? দেখুন সবার হাতেই লাঠি।
মৃন্ময় হেসে উঠলো। তীর্থও খানিক ভেবে নিয়ে ফোঁড়ন কেটে বললো,
— আমিও খেয়াল করলাম। আহারে! আগে জানলে আমাদের মানবদরদি রোজা ম্যাডাম কিছু খেলনা কিনে আনতো। তাই না রোজা ম্যাডাম?
রোজা রাগী চোখে তাকিয়ে বললো,
— তীর্থ! মাইর খাবার চাইস না।
তীর্থ সেদিকে পাত্তা না দিয়ে জানালা দিয়ে উঁকিঝুঁকি দিয়ে চিন্তিত গলায় বলে উঠলো,
— ইশশশ রে… বাচ্চা থেকে বুইড়া খাসিয়ানও দেখা হয়ে গেলো। কিন্তু একটা মাইয়াও চোখে পড়লো না। চারদিক কেমন মরুভূমি লাগতাছে রে দোস্ত। এরা কি জানে না আজ আমি আসবো।
রোজা বিরক্তি নিয়ে বললো,
— তুই আসবি জেনেই ঘর থেকে বের হয়নি কেউ। মেয়েদের ওপর তুই আস্ত এক আজাব। সর এইখান থেকে…
তীর্থ মুখ ভেঙিয়ে সরে বসলো। ডানপাশের জানালা দিয়ে আবারও ছবি তোলায় মগ্ন হয়ে পড়লো। রোজা উৎসাহ নিয়ে বললো,
— সত্যিই কি এদের আর কোনো খেলনা নেই?
মৃন্ময় একটা ছোট্ট শ্বাস নিয়ে বললো,
— ওটা ওদের খেলনা নয় প্রতিরক্ষার প্রস্তুতি মিস. রোজা।
রোজা অবাক হয়ে বললো,
— মানে? কিসের প্রতিরক্ষা?
মৃন্ময় হেসে বললো,
— পাহাড়ি পরিবেশটা আমাদের পরিবেশের মতো স্বাভাবিক নয়।পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতার জন্যই খেলার ছলে ছোট সময়েই হাতে লাঠি ধরিয়ে দেওয়া হয় তাদের। কারণ চা বাগানের পাহাড়ি রাস্তায় সাপের আনাগনাটা চোখে পড়ার মতো। বিভিন্ন জায়গায় বিপদ ওঁত পেতে থাকে। তাই বাচ্চাদের ছোট থেকেই তাদের প্রতিরক্ষা সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া হয়। বলতে গেলে, প্রতিকূল পরিবেশে এভাবেই প্রতিকূলতার সাথে খাপ খাইয়ে বেড়ে উঠছে এ এলাকার শিশুরা।
রোজা কিছু বলবে ঠিক তখনই চোখে পড়লো
বাগান ঘেরা একটি পাকা বাড়ি । বাড়ির সামনের বারান্দাটাই সবচেয়ে বেশি নজর কাড়ল রোজার । পরিপাটি করে সাজান সুন্দর বসার ব্যবস্থা। দেখতে অনেকটাই চা বাগানের বাংলোবাড়ি গুলির মতো। রোজা খেয়াল করে দেখলো বাড়ির ছাদের উপর দুটি ডিশ এন্টেনা। ব্যাপারটায় খুবই অবাক হলো রোজা। এমন একটা পাহাড়ে ডিশ এন্টেনা? এতটা পাহাড়ি বন্ধুর পথ পেরিয়ে এমন সুন্দর বাড়ি দেখতে পাবে কল্পনায় করতে পারে নি রোজা। রোজার বিস্ময় কাটিয়ে আলী বলে উঠলো ,
—- স্যার? এটাই এটাই ঝিনু মন্ত্রীর বাড়ি।
তীর্থ কপাল কুঁচকে বললো,
— শহর রেখে কোনো মন্ত্রী এই পাহাড়ি অঞ্চলে থাকে কোন কামে?
আলী উৎসাহ নিয়ে বললো,
— তীর্থ ভাই?এই মন্ত্রী হেই মন্ত্রী না। খাসিয়াগো পুঞ্জি-প্রধানকে এরা মন্ত্রি বলে। মন্ত্রি মানে পুঞ্জির হ্যাডম্যান। এই এলাকায় ঝিনু মন্ত্রি নামেই পরিচিত এই ভদ্রলোক। আসল নাম হইলো গিয়া জিনুল আমিন।
ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ঠোঁট উল্টালো তীর্থ। আপাতত এটাই তাদের গন্তব্য বলে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো সে। এখানেও একগুচ্ছ বাচ্চারা লাঠি হাতে ছুটোছুটি করছে। আগন্তুকদের দেখেই থেমে গেলো তাদের ছুটোছুটি। অবাক চোখে নিষ্পাপ চাহনী নিয়ে তাকালো রোজাদের দিকে। বাচ্চারা হঠাৎ নীরব হয়ে যাওয়ায় দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোক। কপাল কুঁচকে জিগ্যেস করলো,
— কে আপনারা? এখানে কি চান?
মৃন্ময় পেছনে ছিলো। সানগ্লাসটা খুলে নিয়ে দু’পা সামনে এগিয়ে এসে স্মিত হেসে বললো,
— আমরা ঢাকা থেকে এসেছি। জিনুল আমিন সাহেব আছেন? তার সাথেই দেখা করতে চাই আমরা।
লোকটা খানিকটা ভরকে গেলো। কিছুক্ষণ নিরব থেকে মুখে হাসি নিয়ে বললেন,
— জি আমিই জিনুল আমিন। কিন্তু আপনারা আমার সাথে কি কথা বলতে এসেছেন?
মৃন্ময় হাসিমুখে বললো,
— তেমন কিছুই নয়। আপনাদের পুঞ্জি ঘুরতে এলাম সেই সুবাদেই পুঞ্জি প্রধানের সাথে দেখা করার ইচ্ছে জাগলো মনে।
মৃন্ময়ের কথায় বেশ আস্বস্ত হলেন ভদ্রলোক। সৌজন্যের সঙ্গে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেলেন ওদের। “পুঞ্জিপ্রধান” — শব্দটা উচ্চারণ করতেই মনের মাঝে গম্ভীর কোনো ব্যক্তির ছবি ভেসে উঠে। মনে হয় লোকটি কতোই না কঠোর! কিন্তু জিনুল আমিনের মাঝে এমন কিছুই চোখে পড়লো না রোজার। রোজার মনে হলো লোকটি অত্যন্ত বিনয়ী এবং সরল মনের মানুষ। “অতিথি আপ্যায়ন” যে বাঙালীদের ঐতিয্য তা যেনো আবারও মনে করিয়ে দিলেন উনি। গরুর খাঁটি দুধের তৈরী অসাধারণ স্বাদের চা আর মচমচে বিস্কুটে অতিথি আপ্যায়ন করলেও মনটা ভরে উঠলো সবার। কি সারল্য হাসি,কি বন্ধুপূর্ণ ব্যবহার! আজকাল এই আধুনিক সমাজে টেবিল ভরে খাবার সাজিয়ে দিলেও কোথাও যেন কিছু একটা ফাঁকা থেকে যায়। সেই ফাঁকা অংশটা হলো আন্তরিকতা। শহরের মানুষের মনে আন্তরিকতার নিঃশেষ ঘটলেও পাহাড়ি এই দুর্গম অঞ্চলে বসেও এই ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠী মানুষগুলো “আন্তরিকতা ” নামক জিনিসটাকে আঁকড়ে ধরে আছেন খুব শক্ত করে। চা খাওয়া শেষ করে কথায় কথায় বললো মৃন্ময়,
— অনেক বছর আগে এই পুঞ্জিতে একবার এসেছিলাম আমি। তখন তাহেরা পতাম নামে এক লোকের সাথে পরিচয় হয়েছিলো। খুবই আন্তরিক লোক ছিলেন উনি। এতো বছরে পুঞ্জির অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়ে গেছে। উনি কোথায় এখন? এসেছিই যখন উনার সাথে একবার দেখা করতে পারলে বেশ হতো।
জিনুল সাহেব কিছুক্ষণ ভেবে বললেন,
— তাহেরা পতাম? হ্যাঁ ও তো এই পুঞ্জিতেই ছিলো। খাসিয়া সংগঠনের সংক্রিয় সদস্যও ছিলো। কিন্তু এখন আর নেই।
তীর্থ বিস্ময় নিয়ে বলে উঠলো,
— নেই মানে? গেলো কই? মারা গেছে?
জিনুল সাহেব মাথা দুলিয়ে বললেন,
— না। মারা যায় নি। এখান থেকে মাগুরছড়া পুঞ্জিতে চলে গেছে প্রায় পাঁচবছর হলো।
তীর্থ এবার কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে রোজার দিকে তাকালো। এতো কষ্ট করে আসাটা তারমানে সবটাই ভেস্তে? রোজা উদ্বিগ্ন গলায় বললো,
— কিন্তু কেন?
— নিরালাপুঞ্জির থেকে মাগুরছড়াপুঞ্জির যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো। এটাই হয়তো মূল কারণ।
রোজা-তীর্থ দু’জনেই ভগ্ন হৃদয় নিয়ে মৃন্ময়ের দিকে তাকালো। মৃন্ময় মুখে হাসি টেনে নিয়ে জিনুল সাহেবের সাথে কথা বলে চলেছেন। রোজার ইচ্ছে করছে মৃন্ময়ের মাথাটাকে দু-টুকরো করে পা ছড়িয়ে কাঁদতে। উফফ! অসহ্য!
৫২.
আরুর বাবা এখন অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠলেও বেশ কিছুদিন হসপিটালেই থাকতে হবে তাকে। কিন্তু আরিফ আরমান সাহেবকে রিলিজ করে নেওয়ারই চেষ্টা চালাচ্ছে। প্রাইভেট হসপিটালে দিনে যতটাকা খরচ হয় তা একটা মিডিলক্লাস ফ্যামিলির জন্য অর্ধেক বছরের উপার্জন। অপারেশনের জন্য এতো টাকা খরচ হওয়ার পরও কেবিন খরচ,ঔষধ হেনতেন নিয়েও বড় অঙ্কের টাকার প্রয়োজন পড়ছে আরিফের। ব্যাংকে আরুর বিয়ের জন্য জমানো টাকা আর ঢাকার একতলা বাড়িটা বন্ধক রেখে যা কিছু টাকা হয়েছে তাতেই বাবার চিকিৎসা চালাচ্ছে সে। কিন্তু সেই টাকাও তো প্রায় শেষের দিকে। ডক্টরদের অনেক বলে কালকের দিনে রিলিজ করানোর জন্য রাজি করাতে পেরেছে সে। দুই দিনের ধকলে ক্লান্ত শরীরটা যেন আর টানতে পারছে না সে। তবুও টানতে হচ্ছে! বড় ছেলে বলে কথা। ভারি ক্লান্ত শরীর নিয়ে দরজা ঠেলে বাবার কেবিনে ঢুকলো সে। আরু টোলে বসে বাবার হাত ধরে ঘুমিয়ে আছে। লিনা খানিক দূরে সোফায় গা এলিয়ে বসে আছে। চোখ-মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে বসে থাকতেও কতোটা কষ্ট হচ্ছে তার। আরিফ ভেতরে ঢুকেই ঘুমন্ত আরুর দিকে তাকালো। নিঃশব্দে আরুর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুমন্ত বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে হালকা ঠোঁট ছোঁয়ালো। দু’টো দিন যাবৎ বোনটাকে কাছ থেকে দেখতেই পারে নি সে। যা করুক,যেমনই করুক কলিজার টুকরো ওর। ছোট্ট বেলা থেকে বুকের কাছে লাগিয়েই বড় করেছে তাকে। বোনের নিষ্পাপ ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো আরিফ। আবারও কপালে চুমু দিয়ে সরে দাঁড়িয়ে লিনাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— কাল বাবাকে রিলিজ দিয়ে দিবে লিনা। আমরা কাল দুপুরেই “সোনাপুকুর” যাচ্ছি।
লিনা অবাক চোখে তাকালো। দুর্বল গলায় বললো,
— সোনাপুকুর! ঢাকায় বাসা রেখে অসুস্থ বাবাকে নিয়ে গ্রামে কেন যাবে আরিফ? ওখানে ইলেট্রিসিটির সমস্যা, রান্নার সমস্যা। কিভাবে সব হবে আরিফ?
আরিফ অসহায় চোখে স্ত্রীর দিকে তাকালো। ধীর পায়ে স্ত্রীর সামনে গিয়ে হাঁটু ভাজ করে বসে লিনার হাতদুটো নিজের হাতে টেনে নিয়ে মৃদু গলায় বলে উঠলো,
— ঢাকার বাড়িটা বন্ধক দিয়ে দিয়েছি লিনা। টাকা শোধ না করা পর্যন্ত ওরা সেখানে ভাড়াটিয়া রাখবে এই শর্তেই দিয়েছি। ওখানো তোমার খুব কষ্ট হবে লিনা। (একটু থেমে) তুমি বাবার বাড়ি চলে যাও লিনা। আমি দিয়ে আসি?
লিনার চোখ থেকে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো। স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে শক্তকন্ঠে বললো,
— আমি শুধু তোমার সুখের সময়ে পাশে থাকবো বলে বিয়ে করি নি আরিফ। তুমি যখন যে অবস্থায় থাকবে আমিও ওভাবেই থাকবো। শুধু চোখ মেলে তোমাকে দেখতে পেলেই হলো। প্লিজ…এটুকু থেকে বঞ্চিত করো না আমায়।
লিনার কথায় দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো আরিফ। চোখটা জ্বলছে খুব। আদৌ কি লিনার মতো একজন জীবনসঙ্গী পাওয়ার যোগ্য সে? আরিফ নিচের দিকে চোখ রেখেই বলে,
— জেদ করো না লিনা। ওমন পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারবে না তুমি। তাছাড়া আমাদের বাবু…
— খুব পারবো। ওসব নিয়ে ভেবো না তো তুমি। তোমাকে, বাবাকে আমার আরুটাকে রেখে কোথাও যাচ্ছি না আমি আরিফ। তুমি সোনাপুকুর যাওয়ার ব্যবস্থা করো। তুমি সবদিকটা সামলে নিতে পারলে তোমার স্ত্রী হয়ে এটুকু আমি পারবো আরিফ।
আরিফ-লিনার সব কথায় কানে গেলো আরুর। দু’দিন যাবৎ ঘুম নামক জিনিসটা চোখে যেন ধরায় দিচ্ছে না তার। তবুও চোখ বুজে পড়েছিলো শুধুমাত্র ভাইয়ের আদর পাওয়ার জন্য। আরু জানে, আরিফ আরুর সামনে কঠোর হওয়ার চেষ্টা করলোও আরুর ঘুমিয়ে থাকার সুযোগে বোনের পাশে বসে সে। প্রথম যেদিন চড় লাগিয়েছিলো সেদিনও এসেছিলো আরিফ। ঘুমন্ত আরুর মাথায় হাত বুলিয়েছে প্রায় ঘন্টাখানিক। হাতের ছাপ পড়ে যাওয়া গালটা চুমুতে ভরিয়ে দিয়েছিলো যেন, আরু সেই ছোট্টটিই আছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখের পানি মুছে নিজেকে শক্ত করলো আরু। এবার রাফিনকে কোন সুযোগ দিবে না সে। একফোঁটা সুযোগও না। রাফিনের একটা প্রতিশোধের জ্বালা অনেক পুড়িয়েছে তাদের আর পুড়াতে দিবে না আরু। রুখে দাঁড়াবে এরপর যা হয় হোক।
নিজের রুমে ব্যাগ প্যাক করছে রাফিন। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ব্যাগের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে আসিফ। যেন ব্যাগ থেকেই মারাত্মক কোনোকিছু আবিষ্কার করে ফেলবে সে। রাফিন ব্যাগের চেইন লাগাতে লাগাতে বললো,
—- শালা এই মৃন্ময় নিজে গেছে গেছেই। মেয়েটাকে সাথে নেওয়ার কি দরকার ছিলো?আর এই মেয়ে খুঁজে খুঁজে প্রবলেমের মাঝেই কেনো গিয়ে পড়ে বুঝি না। এদের সম্পর্ক কি রে? কি চলে এদের মাঝে?
আসিফ সচকিত চোখে তাকায়। ঢোক গিলে নিয়ে বলে,
— কাগোর মাঝে ভাই? রাদিবের মাইয়া আর ওই নায়কের মাঝে?
রাফিন ঘুরে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে রাগী গলায় বললো,
— রাদিবের মাইয়া বললি কেন? নাম ধরে বলতে পারিস না? এই রাদিব হারামজাদার নামটা আমার সামনে নিবি না। শালা হারামি একটা। এই এর ছেলেকে এখনে মারতে পারলি না? এই ছোট্ট একটা ছেলেকে মারতে এতো সময় লাগে?
আসিফের মুখটা কালো হয়ে আসে। যার নামটাই শুনতে পারে না তার মেয়েকে নিয়ে এতো চিন্তার কি আছে বুঝে না আসিফ। বিরবির করে বলে,
— না মানে হারুন রে কাজটা করতে দিছিলাম। ফাজিলটাই ট্রাক দিয়ে এক্সিডেন্ট করতে গিয়ে না মেরে শুধু রিক্সা উল্টে চলে আসছে। পাব্লিক দাওয়া করেছিলো নাকি। পোলা মরে নাই শুধু পা ভাঙছে। চিন্তা করবেন না ভাই। কাম হয়ে যাবো।
রাফিন ভ্রু কুঁচকে কিছু ভাবে। তারপর বিরক্তি নিয়ে বলে,
— থাক। এটা আপাতত স্কিপ করে নতুন কাজটাই মন দে। মৃন্ময় সিলেট কেন গেছে এবং এই ডিরেক্টরের সমস্যাটা কি খুঁজে বের কর। দরকার পড়লে মৃন্ময়কে মেরে দিস। এক গুলিতে ক্ষতম। খুব দরকার না পড়লে রোজাকে মারার দরকার নেই। আর হ্যা, ডোন্ট টাচ হার। মারার আগে যদি ওকে টাচ করতে যাস তো খবর আছে। হাত কেটে গলায় ঝুলিয়ে দিবো।
রাফিন রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে লাগেজটা হাতে তুলে নেয়। সাদা শার্টের উপর কালো কোট জড়াতে জড়াতে বলে,
— দু’দিনের জন্য সিঙ্গাপুর যাচ্ছি। পরশোই চলে আসবো। এসে যেন সব রেডি পাই আমি।
আসিফ অবাক চোখে তাকালো। বিস্ময় নিয়ে বললো,
— কি রেডি পাওয়ার কথা বলছেন ভাই?
রাফিন স্বাভাবিক গলায় বললো,
— কাজি। বিয়ে করবো। বিয়ে করতে নাকি কাজি লাগে? আর কি কি লাগে রে? এনিওয়ে, যা কিছুই লাগুক না কেন। সবকিছুই রেডি চাই আমি। গট ইট?
আসিফ হা করে তাকিয়ে আছে। রাফিন খুব স্বাভাবিকভাবেই বেরিয়ে যায় যেন হুট করে বিয়ে করতে চাওয়াটা নিতান্তই একটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু আসিফ আগের জায়গায় অনড়। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। আসিফ ঢোক গিলে নিয়ে দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। মাথাটা ঝিমঝিম করছে তার। ভাই কি তবে ওই রাদিবের মাইয়া থুক্কু রোজা ম্যাডামকে বিয়ে করবে নাকি? “রোজা” নামটা মনে হতেই আবারও ঢোক গিলে আসিফ। চোখ বন্ধ করে একটা নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
# চলবে…
[ রি-চেইক করা হয়নি। তাই ভুলভ্রান্তি হতে পারে প্রচুর। দয়া করে ভুলগুলোকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ]

#part_29
https://m.facebook.com/groups/459470204903112/permalink/943503726499755/

#part_27
https://m.facebook.com/groups/459470204903112/permalink/943503119833149/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here