প্রেমনোঙর_ফেলে,১৬,১৭

0
257

#প্রেমনোঙর_ফেলে,১৬,১৭
#লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা
১৬

প্রাপ্ত পিয়ালীকে একসাথে দেখে, পিয়ালীর‌ প্রাপ্তকে ভাইয়া ডাকতে দেখে ইচ্ছের বুঝতে বাকি রইলো না ওরা দুজন ভাইবোন। টমি তখনও প্রাপ্তকে দেখে‌ চেচাচ্ছে। ইচ্ছে ঠোট টিপে হাসলো। এই টমিটা একদমই সহ্য করতে আারে না প্রাপ্তকে। যেখানে প্রাপ্ত ওর প্রান বাচিয়েছে দুদিন আগে। ইচ্ছেকে হাসতে দেখে দাতে দাত চেপে টমির দিকে তাকালো প্রাপ্ত। একটা রাগী শ্বাস ফেলে পিয়ালীকে শান্তভাবে বললো,

-ফোন কেনো দিয়েছি তোকে? সুইচড্ অফ করে রাখার জন্য?

পিয়ালী মাথা নিচু করে নিলো। ও এখন যাই বলবে, তাতে প্রাপ্তর এই‌ শান্তস্বর মুহুর্তেই তুলকালাম বাধানোর মতো মেজাজে পরিবর্তিত হয়ে যাবে। ইচ্ছে ভাইবোনের কথার মাঝে থাকবে না ভেবে “টমি কাম” বলে চুল নাড়তে নাড়তে উল্টোদিকে হাটা লাগালো। পিয়ালী একপলক চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলো ইচ্ছে চলে যাচ্ছে। তারপর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

-ভাইয়া, ইচ্ছে ম্যাম চলে যাচ্ছে তো! ওকে কিছু বল? আজকে ম্যাম না থাকলে কিন্তু…

-কিছুই হতো না তোর। আমি এসে গেছি না?

-তুই তো এতোক্ষনে এলি! আর ইচ্ছে ম্যাম…

-কি ম্যাম ম্যাম শুরু করেছিস! তোর ম্যাম বুঝি বডিগার্ড হয়ে সবসময় থাকে তোর সাথে?

পিয়ালী অবাক হলো। কিসের কথায় কি তুলছে প্রাপ্ত? ওর ভাইকে ভালোমতোই চেনে ও। যাই কিছু হোক, এভাবে অকৃতজ্ঞের মতো কথা বলার ছেলে প্রাপ্ত না, সেটা ও ভালোমতোই জানে। অবিশ্বাসের স্বরে বললো,

-এভাবে বলছিস কেনো? ম্যাম না থাকলে এতোক্ষনে সত্যিই কিন্তু আমাকে বাজে পরিস্থিতিতে থাকতে হতো ভাইয়া! কয়েকটা ছেলে…

ইচ্ছে খানিকটা দুর চলে গেলেও টমি একচুলও নড়েনি। দু সেকেন্ড পরপর প্রাপ্তকে লক্ষ্য করেই শব্দ ছুড়ছে ও। ওউ যেনো মতামত দিচ্ছে, ইচ্ছেকে ধন্যবাদ না দিয়ে চরম পাপ করছে প্রাপ্ত। সরু দৃষ্টিতে টমির দিকে তাকালো প্রাপ্ত। দাতে দাত চেপে বললো,

-ওকে সরি বলেছি। ওটা ওর প্রাপ্য ছিলো। থ্যাংকস্ দেবো না! এটা ওর প্রাপ্য না! সো উইল ইউ প্লিজ কিপ কোয়াইট?

পিয়ালীর দৃষ্টি আবারো প্রসারিত হলো। প্রাপ্ত সরি বলার মতো কাজ করতে পারে, এটাও ওর ধারনায় ছিলো না। আর সেটাও ইচ্ছেকে সরি বলেছে! ঘটনার আগামাথা কিছুই মাথায় ঢুকলো না পিয়ালীর। টমি প্রাপ্তর কথা শুনে আরো দুবার জোরে চেচিয়ে উঠলো। প্রাপ্ত এবার ধমকে বললো,

-স্টপ ইট!

ইচ্ছে সবে হুইস্টলিং শুরু করেছিলো। প্রাপ্তর ধমক শুনে পেছন ফিরলো ও। প্রাপ্তর রাগী চাওনি টমির দিকে। বুঝলো ধমকটা টমিকেই দিয়েছে প্রাপ্ত। টমি তখনো থামেনি। ওর মতে, প্রাপ্ত ইচ্ছেকে থ্যাংকস্ না দিয়ে আগে বড়সর দোষ করেছে, এরপর ওকে ধমক দিয়ে আরোবড় দোষ করে ফেলেছে। টমি নিজেও যে ধ‌মক দিতে পারে, সেটা প্রদর্শন করা জায়েজ আছে ওর। ইচ্ছে বিরক্ত হলো ভালোমতো। এই দুটোতে মানুষ-পোষ্যর সম্পর্ককে সাপে-নেউলে সম্পর্ক কেনো বানিয়ে দিচ্ছে, কে জানে? এগিয়ে গিয়ে আগে টমিকে বললো,

-টমি চুপ। আর একটুও আওয়াজ করবে না তুমি। একটুও না! গট ইট?

টমি গুটিয়ে লেজ নেড়ে ইচ্ছের পায়ে গা ঘেষলো। প্রাপ্ত মনেমনে খুশি হয়েছে ইচ্ছের ওকে ধমকাতে দেখে। তবে প্রকাশ করলো না সেটা। “ঝামেলা তৈরী করে এখন ভালো সাজা হচ্ছে!” ইচ্ছের পায়ে টমিকে গা ঘেষতে দেখে মনেমনে ‌এ কথাটাও নাড়া দিলো ওর। ইচ্ছে প্রাপ্তর দিকে ফিরলো। তুড়ি বাজিয়ে আগে প্রাপ্তর চাওনি টমির থেকে নিজের দিকে ফেরালো। অতঃপর সিরিয়াসনেস দেখিয়ে বললো,

-আর এইযে মিস্টার গ্যাংস্টার! কাকে ধমকাচ্ছো তুমি? হ্যাঁ? কাকে ধমকাচ্ছো? আমার আগে টমিই তোমার বোনকে দেখেছিলো। আজ টমি না থাকলে ওই‌ ছেলেগুলো…

ইচ্ছেকে শেষ করতে না দিয়ে প্রাপ্ত‌ পিয়ালীর কাধ থেকে ওর ব্যাগ কেড়ে নিলো। ব্যাগের ভেতরের এক চেইন থেকে একটা ডিভাইস বের করলো দু সেন্ডের ভেতর। ইচ্ছে কপালে ভাজ ফেলে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। আচমকাই প্রাপ্ত ইচ্ছের ডানহাতের কনুইয়ের উপরে ধরে টান লাগালো ওকে। ইচ্ছে চমকে উঠতে বাধ্য হলো। হাত দিয়ে কোনো‌‌মতে দুরুত্ব গুজলো দুজনের মাঝে। পিয়ালীর চোখ এবার বেরিয়েই আসবে। কিংকর্তব্যবিমুঢ় ও। টমি নিজেও যেনো করনীয় বুঝতে পারছে না। ইচ্ছের সাথে এভাবে কাউকে‌ দেখেনি বলেই হয়তো। প্রাপ্ত চোয়াল শক্ত করে ওর হাতে ডিভাইসটা গুজে দিয়ে বললো,

-একটা থ্যাংকসের জন্য ক্রেডিট নেওয়ার এতো চেষ্টা করে লাভ হবে না মিস রকস্টার। কিভাবে বোনকে প্রোটেকশন দিতে হয়, তা প্রাপ্ত খুব ভালোমতোই জানে! আ’ম নট গোয়িং টু থ্যাংক ইউ!

ইচ্ছে একপলক হাতে থাকা ট্র্যাকারের দিকে তাকাচ্ছে, তো আরেকবার প্রাপ্তর দিকে। প্রাপ্ত তখনো রাগী চেহারা করে ওর হাত ধরে আছে। আর পিয়ালী ভয়ার্ত চেহারা করে দুজনকেই দেখছে। ও যেমন ওর ভাইয়ের রাগকে চেনে, তেমন ইচ্ছের ক্ষমতাও জানে ও। কিজানি এর পর কি ঘটেছে। ওদের দু ভাইবোনকে অবাক করে দিয়ে কয়েকমুহুর্ত পর শব্দ করে হেসে দিলো ইচ্ছে। হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো প্রাপ্ত, পিয়ালী। ইচ্ছে শব্দ করে হাসতে হাসতে প্রাপ্তর কাছ থেকে হাত ছাড়িয়ে নিলো নিজের। বেশ কিছুক্ষন হাসার পর টমিকে কোলে তুলে হাসতে হাসতে বললো,

-ইগো দেখানো কেউ তোমার কাছ থেকে শিখুক মিস্টার গ্যাংস্টার! সরিটা এক্সেপ্ট করতে একটু দেরি কিনা করে দিলাম, তুমি তোমার ইগো দেখাতে এখন থ্যাংকস্ দেওয়া নিয়েও এতোকিছু বলছো? ওয়াও! ইউ আর সামথিং এলস্ ম্যান! লেটস্ গো টমি! এখানে থাকলে আমাকে‌ জোর করে থ্যাংকস্ আদায় করার দায়ে লকাপে‌ যেতে হতে পারে। তারচেয়ে বরং চল এখান থেকে‌ যাই! আফটার অল, বেচারা থ্যাংকস্ দেবে না বলে কতোবড় যুক্তি দেখালো বল?

টমিকে কোলে নিয়ে কথাগুলো বললো ইচ্ছে। আরেকবার প্রাপ্তর দিকে তাকিয়ে ঠোট টিপে হেসে চলে গেলো ও। পিয়ালী ঠাস করে নিজেই নিজের কপালে চড় লাগালো একটা। প্রাপ্ত একধ্যানে ইচ্ছের চলে যাওয়া দেখছে। ওর মস্তিষ্কে এখন শুধু একটা কথাই ঘুরছে, ইচ্ছে এর আগে কোনোদিন কি এভাবে প্রানখুলে হেসেছে? হাসবে হয়তো! কিন্তু ওর এমন কেনো মনে হলো, এই অভুতপুর্ব হাসিটা দেখার সৌভাগ্য বুঝি একমাত্র ওরই হলো। মায়ের স্মৃতিকে মনে করে, রাতের সেই চাপা কান্নাগুলোর মতো অন্য কেউই হয়তো দেখেনি ইচ্ছের এই প্রানোচ্ছল হাসি। প্রাপ্ত ছাড়া আর কেউ না। কেউই না!


নতুন নতুন রোমান্টিক গল্প পেতে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেজ ” নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ” এবং ফলো করে সাথেই থাকুন।

জমির হুজুরের খালি‌ গলায় ফজরের আযান শুনে ঘুম ভেঙে গেছে খইয়ের। দুহাতে জরিয়ে ঘুমিয়ে থাকা মায়ের দিকে তাকালো ও। ওকে আষ্টেপৃষ্টে জরিয়ে গভীর ঘুমে আছন্ন সাহেরা। যেনো ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে খই। খই মায়ের হাতদুটো থেকে আস্তেধীরে ছাড়িয়ে নিলো নিজেকে। উঠে বসে আরেকপলক তাকালো মায়ের দিকে। সাহেরা তখনও ঘুমোচ্ছে। খইয়ের ঠোটে হাসি। বেরোবে ও। এ সময় শুকমরার তীর দিয়ে টাকি মাছ ঘোরাঘুরি করে। স্বচ্ছ পানির নিচে আবছা আলোতে দেখা যায় সে মাছ। কোঁচ দিয়ে একেবারে মাথা বরাবর ঘা লাগিয়ে টাকি ধরা যায় অনায়াসে। উঠোনের লাউয়ের মাচায় দুটো কচি লাউ ঝুলছে দুদিন হলো। টাকি-লাউয়ের তরকারীর কথা ভেবেই জ্বিভে জল চলে আসলো খইয়ের। ঘরের এককোনে দেয়ালে ঠেকানো কোঁচ হাতে করে নিশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো ও।

খই হেলতে দুলতে খালিপায়ে শুকমরার দিকে এগোলো। যদিও শীতকাল না,তবুও ঘাসের ডগা ভিজে আছে পায়ের তলার। খালি পায়ের তালুতে ভেজা ঘাসের ডগা স্পর্শ করতেই শিরশিরিয়ে ওঠে পুরো শরীর। খই আস্তেআস্তে পায়ের ছাপ ফেলে ফেলে এগোচ্ছিলো। ভোর হতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে আলো ফুটবে চারপাশে।খই নির্দ্বিধায় পা চালালো। কিন্তু খানিকটা যাবার পরই থেমে গেলো ওর পা। সামনে কোনো মানুষের অবয়ব। কোনো পুরুষের অবয়ব। টিশার্ট, প্যান্ট তার পরনে। তার পাশেই পাইপের মতো কিছু একটা পূর্ব আকাশের দিকে তাক করা। আর সে মানুষটা পাশে দাড়িয়ে পকেটে দুহাত গুজে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। কপালে ভাজ পরলো খইয়ের। এ সময় এদিকে নিতুন জেলে ছাড়া আর কারো আসার কথা না। কিন্তু এটা কোনোমতেই জেলেবেশ না, সেটা স্পষ্ট বুঝলো ও। কাধে রাখা কোঁচটা সামনে তাক করে বললো,

-কেডায় ওইহানে?

পাশ ফিরে কোঁচ হাতে আবছা আলোয়া খইকে দেখে ছোট্ট একটা দম ছাড়লো রাকীন। মেয়েলি গলা শুনেই আন্দাজ করেছিলো এটা খইই হবে। গ্রামের এই শুকমরা খালটা একদম পুর্ব পশ্চিমে আড়াআড়িভাবে গেছে। রাকীন ভেবেছিলো ভোরের শুকতারা আর সুর্যোদয়, দুটোই শুকমরার তীর থেকে দেখবে। তাই চলে এসেছে এদিকে। মনেমনে শুকমরাকেই নির্বাচন করার আরো একটা কারন ছিলো। গত রাতে ঘুম হয়নি ওর। পুরোটা রাত হাশফাশ করেছে ও বিছানায় শুয়ে শুয়ে। চোখ বন্ধ করলেই বারবার খইয়ের একদম সন্নিকটে থাকা চেহারাটা ভেসে উঠেছে ওর চোখের সামনে। সেই অনুভবের পরিনামে তৈরী হওয়া একরাশ অস্থিরতার জেরেই হয়তো পা বাড়িয়েছিলো ও শুকমরার দিকে। খইয়ের দেখা পেয়ে আচমকাই ভালো লাগছে ওর ভেতরটায়। প্যান্টের পকেট থেকে হাত বের করে, কিছু না বলে খইয়ের দিকে দুপা এগোলো ও। রাকীনের চেহারা স্পষ্টতর হতেই‌ ভ্রু কুচকালো খই। কোঁচটা আবারো কাধে আটকিয়ে একহাত কোমড়ে রেখে বললো,

-ওহ্! আপনে?

-অন্যকেউ‌ হলে ভয় পেতে?

-খই কাউরে ডরায় না! এ গেরামের কেউ আমার ক্ষতি করনের চিন্তাও করবো না। সেখানে আপনারে তো আমি বাচাইছি। আপনারে দেইখা ডরামু ক্যান? আইজ নতুন আমি কোঁচ নিয়া বাইর হইছি এমন না!

রাকীন খুশি হলো এটা ভেবে যে, ওকে নিয়ে খইয়ের কোনো নেগেটিভ ধারনা নেই। এটাও‌ হতে পারে, মেয়েটা বেশিই সরল। ওর সাথে কোনোদিন বাজে কিছু ঘটেনি বলেই হয়তো এতোটা আত্মবিশ্বাস ওর। ওকে আনমনে হাসতে দেখে খই কপাল কুচকে বললো,

-তা আপনে ‌এইহানে ক্যান? আবারো ম’রার শখ জাগছে নাকি? ভোরবেলায় শুকমরার তীরে যে?

-শুকমরার তীরে শুকতারা দেখতে এসেছিলাম।

বড়বড় চোখে তাকালো খই। আকাশে তাকিয়ে দেখে শুকতারা তখনইও জ্বলজ্বল করছে। চাঁদও আছে। রাকীনের চাওনি ওর নথে নিবদ্ধ। সবে পরিষ্কার হতে শুরু করেছে চারপাশ। এটুকো আলোয় সামনের শ্যামাঙ্গীর চেহারা একেবারে স্পষ্ট না হলেও ওর নাকের নোলক ঠিকই দেখা যায়। আচমকাই ওর নথ ছুইয়ে দেওয়ার অদম্য ইচ্ছা হলো রাকীনের। একধ্যানে তাকিয়ে এগোলো আরেকপা ও। এরইমাঝে খই বলে উঠলো,

-খালি চোখে শুকতারা দেখতাছিলেন?

রাকীন থামলো। কিছুটা চমকালো যেনো। যেনো কোনো ঘোর থেকে বেরোলো। স্বাভাবিক গলায় বলার চেষ্টা করলো,

-আব…না। দুরবীক্ষন আছে আমার আছে।

চকচক করে উঠলো খইয়ের চোখ। না দেখা এই‌ একটা জিনিসের প্রতিই বরাবর ঝোক বেশি ছিলো ওর। চাঁদ দেখা যন্ত্রের নাম স্কুলের আপার থেকে শুনে মুখস্থ করে রেখেছে ও একদম। শহর থেকে কেউ আসলেই মাকে বারবার করে বলতো,দুরবীক্ষন এনেছে কিনা কেউ। খই চঞ্চলভাবে এগিয়ে গেলো রাকীনের দিকে। হুট করে বেশ অনেকটাই কাছে চলে যাওয়ায় আবারো চকিত হলো রাকীন। খই উৎসাহ নিয়ে বললো,

-আমারে দেখাইবেন?

-কি?

-শুকতারা! দুরবীক্ষন!

-মানে?

-ছোটবেলা থাইকাই আমার মেলা শখ! দুরবীক্ষন দিয়া চাঁদতারা দেখুম! দেখাইবেন? আমি না আপনারে পানিতে পইরা ম’রা থাইকা বাচাইলাম! দেখাইবেন না আমারে?

রাকীনের দৃষ্টি থেমে রইলো। এই শখ চেনা ওর। এই শখ পুরনের আবদারটাও ওর চেনা। শুধু মানুষটা অচেনা। খই ওকে চুপ থাকতে দেখে আবােরো তাড়া দেখিয়ে বললো,

-আরে চুপ কইরা আছেন ক্যান? দেখাইবেন? একটুপরেই চাঁদ ডুইবা যাইবো! আইজকা না দেখলে এ‌ জীবনেও আর কাছ থাইকা চাঁদ দেখা হইতো না আমার! দেখান না আমারে দুরবীক্ষন দিয়া চাঁদ! দেখান একটু?

কিছু না বলে রাকীন কয়েকমুহুর্ত তাকিয়ে রইলো খইয়ের দিকে। খই শশব্যস্ত চোখে পরখ করছে,চাঁদ শুকতারা ডুবে না‌ যায়! রাকীন টেলিস্কোপটা ঠিকঠাকমতো সেট করে দিয়ে বললো,

-এইযে নাও। এখানে চোখ‌ রাখো।

কাধের কোঁচটা মাটিতে ফেলে তৎক্ষনাৎ টেলিস্কোপে চোখ‌ রাখলো খই। রাকীন পাশ থেকে মুগ্ধচোখে দেখতে লাগলো ওকে। মৃদ্যু বাতাসে খইয়ের বিনুনির বাইরে থাকা ছোটছোট চুলগুলো উড়ছে। চোখে এসে পরছে বলে বিরক্ত হচ্ছে খই। রাকীন আস্তেকরে চুলগুলো খইয়ের কানে গুজে দিলো। একপলক ওর দিকে তাকিয়ে নিষ্পাপ হেসে আবারো‌ টেলিস্কোপে চোখ রাখলো খই। রাকীন বুকে দুহাত গুজে পিছিয়ে দাড়ালো। তাকিয়ে রইলো খইয়ের দিকে। দুরের কোনো এক মসজিদের মাইক থেকে আযানের শব্দ শোনা যায়। একটুপরেই এই‌ চাঁদ থাকবে না আকাশে। এই শুকতারাও থাকবে না। সেভাবে ওউ তো এ ভাদুলগায়ে থাকতে আসেনি। ওকেও‌ ওর চেনা শহরে ফিরতে হবে। কিন্তু এই মুহুর্তগুলো? শুকমরাকে সাক্ষী করে‌ তৈরী হওয়া এ স্মৃতিগুলো? এগুলো কি আদৌও ফেলে যাওয়া‌ সম্ভব? কে জানে!

#চলবে…

#প্রেমনোঙর_ফেলে
#লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

১৭.

ইচ্ছে কানে হেডফোন গুজে সিড়ি দিয়ে উঠছিলো। নওশাদ সাহেব কয়েকবার ডাক লাগালেন ওকে। শুনলো না ও। টমি পেছন থেকে ইচ্ছের পায়ের কাছে গিয়ে ওকে থামিয়ে দিলো। ইচ্ছে পেছন ফিরলো। বাবাকে দাড়ানো দেখে কান থেকে হেডফোন নামালো ও। নওশাদ সাহেব দুটো ছোটছোট চুড়ি ওর সামনে তুলে ধরলেন। ইচ্ছে নিরবে তাকিয়ে রইলো ওগুলোর দিকে। নওশাদ সাহেব বললো,

-নিজের জিনিসকে অস্বীকার কেনো করছো ইচ্ছে?

-নিজের কোথায় বাবা? যেগুলোতে খেয়ারও অধিকার আছে, ওর অনুপস্থিতিতে আমি তা কি করে নিজের নামে করে দেই?

হতাশ শ্বাস ছাড়লেন নওশাদ সাহেব। বললেন,

-এটা তো তোমার। এটা তুমি নিজের কাছে রাখো? খেয়ারটা ও…

-যতোদিন না খেয়া ফিরছে, নিজের অধিকারগুলো পাচ্ছে, ওর সমধিকারের সমতুল্য কিছুই আমি এক্সেপ্ট করতে পারবো না বাবা। ওগুলো তুমি তোমার কাছেই রেখে দাও।

ইচ্ছে চলে যাচ্ছিলো। নওশাদ সাহেব পেছন থেকে বলে উঠলেন,

-রাজীবের সাথে কথা হয়েছে আমার।

-নট এগেইন বাবা। প্লিজ!

-এভাবে আর কয়দিন ইচ্ছে? যে নেই, সে নেই! তার জন্য তোমরা কেনো নিজেদের ভবিষ্যতকে থামিয়ে দিয়েছো?

ইচ্ছে থামলো না। নওশাদ সাহেব বললেন,

-রাজীব চায় রাকীনের এই প্রজেক্টটা শেষ হওয়ার পর তোমাদের দুজনের বিয়েটা সেরে ফেলতে। আর আমিও এমনটাই চাই। তুমি মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে শুরু করো ইচ্ছে। জোর করে তোমার ওপর নিজের মত আমি চাপিয়ে দিতে চাইনা। কিন্তু তোমার জন্য রাকীনের চেয়ে বেটার কাউকে খুজে পাবো না। রাকীনের চেয়ে ভালোভাবে কেউ বুঝবে না তোমাকে। সেইম তুমিও। তোমাদের দুজনকে একসাথে দেখতে চাই। এই অক্ষম পিতার অনুরোধ রইলো, কথাগুলো তুমি আরেকবার ভেবে দেখো প্লিজ ইচ্ছে! প্লিজ!

ইচ্ছে থামলো। শক্তহাতে সিড়ি আঁকড়ে ধরলো ও। নওশাদ সাহেব চোখের কোনের জল মুছে চলে গেলেন ওখান থেকে। ইচ্ছের কান্না দলা পাকিয়ে আসছে গলায়। কাদতে পারছে না তবুও। মনেমনে শুধু বললো,
“আজ তুই থাকলে আমাকে না তোদের মাঝে থাকতে হতো, না তোদের মাঝে থাকার নামে দোষী হতে হতো খেয়া। চলে তো গেলি। কিন্তু সাথে আমার জন্য এক দমবন্ধকর পৃথিবীও রেখে গেলি তুই। না পারছি মরবো বলে শেষ নিঃশ্বাস ছাড়তে। না পারছি নতুন করে বাচবো বলে প্রশ্বাস নিতে। তুই সবকিছু ছেড়েছুড়ে হারিয়ে গিয়েও প্রিয়। আর আমি সবকিছুতে বাধা পরে আজ সবার অপ্রিয়। আর সেই অপ্রিয় মানুষটাই হয়তো তোর প্রিয় মানুষটার সাথে জড়িয়ে যেতে চলেছে। আমার আঁকা খোলস আর বোধহয় বাধ মানলো না।”

-সাহেরা মা কাছারিবাড়িতে অজ্ঞান হইয়া গেছে খই বুবু! রান্দোনের সময় আইজা আবারো নাকি রক্তবমি উডছিলো মায়ের। জলদি কাছাড়িবাড়ি চলো! মুন্সী তোমারে ডাইকা পাঠাইতে কইছে। বরুনকাকারে দাওয়াখানা থাইকা নিয়া যাওন লাগবো! জলদি চলো!

পুঁটির কথায় খই যেনো স্তব্ধ হয়ে গেছে। উঠোনে কাদামাটি দিয়ে সরা বানাতে বসেছিলো ও। আগেরদিন ভাতের মাড় আলাদা করতে গিয়ে মাটির সরাটা ভেঙে ফেলেছে ও। টু শব্দটা শোনায়নি ওকে সাহেরা। মায়ের আদরের সাথে সংসারের অভাবটুকো বোঝার ক্ষমতা হয়েছে খইয়ের। দশ টাকার সরা কেনার চেয়ে চালের জন্য টাকা জমানো ভালো। এমনটা ভেবে নিজেই কাদামাটি নিয়ে বসে গেছে সরা বানাবে বলে। বৈশাখের তপ্ত রোদে শুকানোর পর চুলোয় পোড়ালেই হয়ে গেলো। বেচে গেলো দশ টাকা। গালে হাতে কাদা লেগে আছে খইয়ের। পুঁটি এগিয়ে গিয়ে ধাক্কা লাগালো খইকে। আরো জোরে চেচিয়ে বললো,

-ও বুবু? কাছারিবাড়ি চলো! সাহেরা মা…

পুঁটির কথা শেষ হওয়ার আগেই উঠে ছুট লাগালো খই। দৌড় লাগালো রাস্তার নিচের জমি বরাবর। রাস্তার সংস্কার কাজ চলছিলো বলে রাস্তায় ওঠেনি। বাতাসের আগে পৌছানোর চেষ্টা যাকে বলে। চোখ দিয়ে জল গরাচ্ছে ওর অবাধে। শাড়ির আঁচলটা ছাড়া ছিলো। খই দৌড়াতে দৌড়াতেই প্যাঁচ লাগিয়ে কোমড়ে গুজলো‌ আঁচল। পুঁটিও ওর পেছনপেছন দৌড়াচ্ছে। পেছন থেকে হাঁক ছেড়ে বললো,

-তুমি কাছারিবাড়িতে যাও বুবু। আমি বরুনকাকার দাওয়াখানায় গেলাম। কাকারে ডাইকা আনি।

খইয়ের কানে যায়নি কোনো কথা। ও ছুটছে। বাড়ি থেকে দৌড়ে বিশমিনিটের রাস্তা দশমিনিটে শেষ করলো খই। দুর থেকে কাছারিবাড়ির দেয়ালতোলা পাঁচিল দেখে চোখ ভরে উঠলো ওর আরো। ঝাপসা চোখে খালি পায়ে ছুটছিলো ও। বরই গাছের নিচ দিয়ে আসার সময় তাই পায়ে কাটা ফুটতে সময় লাগেনি। বিন্দুমাত্র গতি না কমিয়ে তবুও ছুটলো খই। কাছারিবাড়ির সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলো অস্থিরচিত্ত্বে। এ বাড়িতে রান্নাঘরের পাশে‌ বেশি মানুষের রান্নার জন্য বড় হেশেল করা। তারই‌ চারপাশে একটা বড়সর জটলা। খই চিৎকার দিয়ে উঠলো,

-মা!

উপস্থিত সবাই পেছনে তাকালো। উদ্ভ্রান্তের মতো ভীড় ঠেলে মায়ের কাছে পৌছালো খই। সাহেরার জোরহীন দেহটা মাটিতে পরে আছে। কাশির বদলে ঢেকুরের সাথে ঘলঘলিয়ে রক্ত ঝড়ছে মুখ‌ দিয়ে। পাশে দুজন মহিলা সাহেরাকে ধরে দোয়াদরুদ পরছে, আরেকজন পানির বাটিতে চামচ নিয়ে বসে আছে। আরেক ঢেকুর রক্তবমি করে গায়ের মলিন কাপড়টা আরো ভিজিয়ে ফেললো সাহেরা। খইকে দেখে মুন্সী বললো,

-ওইযে আইছে সাহেরার মাইয়া। আইতে দেও ওরে সবাই। আর পুরুষমানুষেরা এইহান থাইকা যাও। জটলা কইরো না আর।

বয়জৈষ্ঠ্যের কথায় লোকজন সরে গুলো দ্রুতপদে। খই একছুটে মায়ের কাছে গেলো। মাটিতে বসে গিয়ে পাগলের মতো মাকে জরিয়ে ধরলো শক্ত করে। চিৎকার করে বললো,

-কি হইছে আমার মায়ের? মা? ও মা? কি হইছে? কোনহানে খারাপ লাগে তোমার? কোন জায়গায়? কও না মা! কও?

মেয়ের গলা শুনে এতোক্ষনে সাহেরা চোখ উল্টালো কোনোমতে। আজকেই কাছারিবাড়িতে শেষবেলা রান্না ছিলো ওর। সাদিক সাহেবের থেসিস শেষ হয়ে গেছে বলে পরদিনই ফেরার কথা তাদের। তারপর আর রান্নার লোক দরকার হতো না এ মুন্সীবাড়িতে। রান্নার জোগারে ব্যস্ত থাকতে থাকতে হঠাৎই পুরোনো রোগটা জেগে উঠলো। কাশি। কাশি থেকে রক্তবমি। শরীর তো সেই কখনই ভার ছেড়ে দেবে বলে প্রস্তুতি নিয়েছে। জোর করে দেহে প্রান ধরে রেখেছিলো যেনো সাহেরা। শেষমুহুর্তে একবার মেয়েকে দেখবে বলে। কথা বলার জন্য মুখ খুললেও, আবারো রক্ত বেরিয়ে আসলো মুখ দিয়ে। তবুও দুটো হিচকি তুলে বললো,

-ত্ তরে অনেক কিছু থাইকা‌ বঞ্চিত করছি, দিবার পারি নাই খই। পেটে না ধইরাও তরে মাইয়া হিসেবে পাইয়া, এই সাহেরার বাইচা থাকা স্বার্থক! তাই‌ স্বার্থপর হইয়া‌ গেছিলাম রে! স্ সাদিক ভাইয়ের কথা মাইনা চলিস। আ্ আর পারলে…পারলে আমারে মাফ কইরা দিস মা। মাফ কইরা দিস।

বড়বড় দম নিয়ে কথাগুলো বলে মেয়ের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে শ্বাস ছাড়লো সাহেরা। পুরো মুন্সীবাড়ি থমকে গেলো খানিকটা সময়ের জন্য। দু দন্ড মায়ের স্থির চাওনির দিকে শ্বাস থামিয়ে তাকিয়ে রইলো খই। পরপরই উন্মাদের মতো করে চেচিয়ে বললো,

-মা? কথা কও না ক্যান মা? বরুনকাকা আহে নাই? কেউ মহিষের গাড়ি লইয়া আহো! মারে নিয়া আমি দাওয়াখানায় যামু! মা? ও মা? কিছু হইবো না তোমার! ও মা? মা? এইযে আমারে দেহো না তুমি? এইযে তোমার খই! মা? দেখতাছো না?

পাশে পানির বাটি নিয়ে বসে থাকা মহিলা আঁচলে মুখ গুজে হুহু করে কাদছিলো। সাহেরার চোখজোড়ে হাত দিয়ে বন্ধ করে দিলো সে। খই শ্বাস আটকে বড়বড় চোখে তাকালো তার দিকে। কিছু বলতেও পারছে না মহিলা। কোথা থেকে বদু ফকির একতারা হাতে খইয়ের পাশে এসে হাটুতে বসলো। খইয়ের মাথায় হাত রেখে বললো,

-তর মা আর নাই খই।

কথাটা কর্নগোচর হলো কিন্তু যেনো বুঝলো না খই। বদুফকির আবারো বললো,

-মারে শেষবারের মতো মা কইয়া ডাইকে দে খই। সাহেরা আর এই‌ দুনিয়ায় নাই। আল্লার কাছে চইলা গেছে তোর মা।

নতুন নতুন রোমান্টিক গল্প পেতে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেজ ” নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ” এবং ফলো করে সাথেই থাকুন।

বুঝে উঠতেই মাকে জরিয়ে এবার গগনবিদারক চিৎকার আর আহাজারিতে ফেটে পরলো খই। উপস্থিত ছেলে বুড়ো সবাইই কাদছে। গ্রামের হাসিখুশি দস্যি মেয়েটা যখন এভাবে কাদে, কেউই চোখের জল ধরে রাখতে পারে নি। মুন্সীর চার মেয়ে, থেসিসের জন্য শহর থেকে আসা ছাত্রছাত্রীরা, গ্রামের পাড়াপরশি, রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় পাতা কুড়ানো বাচ্চা, রাখালের দল সবাই যারযার জায়গায় দাড়িয়ে কাদছে। খইকে জরিয়ে সামলানোর চেষ্টা করলো কেউকেউ। মিনিটপাঁচেক কান্নার পর জ্ঞান হারালো খই। মুন্সী বললো,

-সাহেরারে ধোয়াইনার ব্যবস্তা করো। খইয়ের হুশ ফেরোনের আগেই ওর দাফনের ব্যবস্তা করোন লাগবো।

পুঁটি ততোক্ষনে গ্রামের একমাত্র নাড়িটেপা ডাক্তার, দাওয়াখানার মালিক বরুন চ্যাটার্জীকে নিয়ে হাজির। সাহেরাকে মৃত দেখে সেও চোখের কোনের জল মুছলো। কতোবার বলেছে, রোগ সারাতে শহরে যেতে। যায়নি সাহেরা। শহরে কিসের ভয় ওর, কে জানতো! মুন্সীর কথা শুনে চ্যাটার্জীমশাই বললেন,

-এ কি কথা দাদা? এতো তাড়াতাড়ি দাফন? মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে আছে। মায়ের দাফন দেখবে না ও?

-দাফন দেখনের কি আছে? জানাজা তো মুসুল্লিরা পড়াইবো। আর তুমি এইসবে জড়াইয়ো না চ্যাটাজ্জী! আমাগো ধর্মে মুদ্দারে বেশিক্ষন রাখনের কথা বলা নাই। এতে মুদ্দার জান আজাব পায়।

ধর্মের কথা বলায় আর কিছুই বললো না ডাক্তার। কিন্তু বেশ বুঝলো, মুন্সী যতো দ্রুত সম্ভব ঝামেলা সরাতে চাইছে নিজের বাড়ি থেকে। মাথা নিচু করে নিলো সে। পুঁটি কি ভেবে কাদতে কাদতে ছুট লাগালো। ছুটতে ছুটতে পৌছালো রাস্তা সংস্কারের জন্য করা তাবুর কাছে। তাবুর সামনে দাড়িয়ে রাকীন বোর্ডের উপর মাপঝোক করে নকশা আঁকাচ্ছিলো। পুটি গিয়ে হাপাতে হাপাতে বললো,

-ও নকশাদার, জানোতো! খই বুবুর মা সাহেরা মা আইজকা মইরা গেছে!

আকস্মাৎ খইয়ের নাম আর ওর মায়ের মৃত্যুসংবাদ শুনে মাথা ফাঁকা হয়ে গেলো রাকীনের। চুপচাপ তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন পুঁটির দিকে। খইয়ের সাথে দেখা হয়নি ওর আজ। ভাবছিলো হাতের কাজটা সেরে একবার শুকমরার ব্রিজ দেখার নাম করে যাবে ওইদিক। কিন্তু তার আগেই এমন সংবাদ। আর এইটুকো মেয়ে মিথ্যে মৃত্যুসংবাদই বা কেনো দেবে? একটু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে রাকীন বললো,

-খইয়ের মা মারা গেছে?

-হ! সাহেরা মা কাছারিবাড়িতে রান্দোনের সময় রক্তবমি করতে করতে মইরা গেছে! বুবু তো অজ্ঞান হইয়া পইরা আছে কাছারিবাড়িতে।

কপাল চেপে ধরে ঠোট কামড়ে ধরলো রাকীন। যতোটুকো জেনেছে, মা ছাড়া কেউই নেই খইয়ের। হুট করে সেই মায়ের মৃত্যু! রাকীন বেশ আন্দাজ করতে পারলো খইয়ের উপর দিয়ে কি যাচ্ছে। নকশার কাগজপত্রের উপর একটা পেপারওয়েট রেখে পাশের একজনকে বললো,

-এদিকটা দেখো। আমি আসছি।

মানুষটা কোনদিকটা দেখবে বোঝার জন্য প্রশগন করতে যাচ্ছিলো রাকীনকে। সে সময় দেয়নি রাকীন। শার্টের হাতা টান মেরে একপ্রকার দৌড় লাগালো কাছারিবাড়ির দিকে। সংস্কারের জন্য এসেছিলো বলে পঞ্চায়েত ওই বাড়িতেই মিটিংয়ে বসেছিলো ওকে নিয়ে। গ্রামের একমাত্র বিল্ডিংঘরটা খুজে পাওয়া খুব কঠিন কোনো বিষয় ছিলো না ওর জন্য। সাহেরাকে ততোক্ষনে কাফনে মুড়িয়ে খাটিয়ায় শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। খই ইতিমধ্যে দু দুবার জ্ঞান হারিয়েছে। এখনো জ্ঞান ফেরেনি ওর। হাত, গাল, গলা, কাপড়ে লেগে থাকা কাদা শুকিয়ে উঠেছে। বিনুনিবাধা চুল উশকোখুশকো। হেশেলের রোয়াকে বসে দুজন মহিলা ওর জ্ঞান ফেরানো চেষ্টারত। টুপটাপ জল গরালো রাকীনের চোখ থেকে। তৎক্ষনাৎ মুছে ফেললো ও সেই জল। ওর ভেতরটা যেনো খামচে ধরেছে কেউ। এতো দুরন্ত মেয়েটার একি রুপ? উঠোনের এক জায়গায় দাড়িয়ে কথা বলছিলো গ্রামপঞ্চায়েতের কয়েকজন। রাকীন চিনলো তাদের। নিজেকে সামলে সাহস করে এগোলো সেদিকে। সালাম দিয়ে বললো,

-আপনারা অনুমতি দিলে আমি কিছু বলতে চাই।

তারা শুনবে বলে আগ্রহী ছিলো। কিন্তু বলার সুযোগ পেলো না রাকীন। খানিকটা দুরেই সাদিক সাহেব স্থির হয়ে বসে ছিলেন এতোক্ষন। উনি উঠে দাড়ালেন এবার। সবাই তার‌ দিকে কৌতুহলী হয়ে এগোলো। রাকীন থামলো। সাদিক সাহেবের মতামতের জন্যই সবাই বসে আছে একপ্রকার। কারন মৃত্যুর আগে সাহেরা শুধু তার সাথেই কথা বলেছে। খইয়ের দায়িত্বও তাকেই‌‌ দিয়ে‌ গেছে। সাদিক সাহেব এতোক্ষন শান্তস্বরে বললেন,

-সাহেরাকে এখান থেকেই কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হবে। আর জ্ঞান ফিরলে খই আমাদের সাথে ঢাকায় ফিরবে। ফর্মালিটিস্ যাবতীয় যা কিছু করার বা দেখার আছে, গ্রামের পঞ্চায়েত-মাতব্বর-মুন্সী-ইউপি মেম্বার-চেয়ারম্যান সবটা আমি দেখে নেবো। খই আমার সাথে ঢাকা যাবে, এটাই সাহেরা চেয়েছিলো। এমনটাই করবো আমি। আর এটাই শেষ কথা। আশা করবো আপনারা সবাই সাহেরার শেষ ইচ্ছাকে, আমার মতামতকে সম্মান দেখাবেন। আপনাদেরকে সাক্ষী রেখে, আজ থেকে খইয়ের সম্পুর্ন দায়িত্ব আমি নিলাম। খই আমার সাথে যাবে।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here